ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো (৩৪)

0
324

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৩৪)
তানভীর রুমে এসে দেখে লাবিবা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রুমের এক কোনায় বসে আছে। দু হাতে হাঁটু জড়িয়ে মুখটা পুরোপুরি উপুড় হয়ে গুঁজে দিয়েছে। মেঝেটা ভেজা। কিছুক্ষণ আগেই মনে হয় পরিষ্কার করা হয়েছে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে লাবিবা একটা ঘাড় বাঁকা করে দেখলো তানভীরকে। আবার ঘাড়টা সোজা করে নিলো। তানভীর কয়েক সেকেন্ড পরখ করে ওয়াশরুমে যায়। একদম শাওয়ার নিয়ে তবেই বের হয়। সারাদিনের ক্লান্তি শাওয়ার নিয়ে দূর হয়। টাওয়ালে চুল মুছতে মুছতে খালি পায়ে এসে লাবিবার সামনে দাঁড়ায়। লাবিবা মাথা তুলে সদ্য শাওয়ার নেওয়া তানভীরকে দেখেই আবার চোখ নামিয়ে নেয়। উদোম গায়ে প্রসস্ত কাঁধের সহিত গম্ভীর্যভাবে দাঁড়িয়েছে। গা থেকে বডি ওয়াশের মিষ্টি স্মেল নাকে আসছে।ফ্লোরে তানভীরের ফর্সা পা জোড়া। লোপকূপের উপর বিন্দু বিন্দু জল জমেছে। লাবিবা দৃষ্টি গুটিয়ে নিয়ে হাঁটুর ভাঁজে আবার মুখ ঠেকায়। তানভীরের নিশ্চুপ উপস্থিতিতে তার মনে উথাল পাতাল শুরু হয়েছে। বুকটা দুরুদুরু করছে। কি করবে? এখনও রেগে আছে? আবার মারবে? এবার মারলে লাবিবা আর সহ্য করবেনা। যখন তার তিন বছর বয়স তখন নাকি বাবা একবার মেরে ছিলো। সেটাও লাবিবার শোনা কথা।তারপর মা ছাড়া কেউ তার গায়ে হাত তুলে নি। বড় হবার পর মাও যা বকা দেয় কখনও আর মারে না। আর আজ তানভীর কতগুলো থাপ্পড় দিলো। ব্যথায় গাল টন টন করছে। কানের নিচে জ্বালাও করছে। এতো ব্যথা লাবিবার কখনও লাগেনি। অভিমানে লাবিবার ঠোঁট ভেঙে এলো। ভেতর ভেতর ফুপালো। কিছু সময় বাদে নিজের সামনে তানভীরকে বসা অবস্থায় অনুভব করলো। শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলার আওয়াজ পেলো।
” লাবিবা। ভেজা ফ্লোর ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসো। উঠে আসো।”

লাবিবা চুপ থাকলো। অভিমানে আরো আরো চেপে গেলো। তানভীর দুপাশে মাথা নাড়িয়ে হাত ধরল।
” উঠো। ”
লাবিবা হাত ছাড়িয়ে নিলো। অন্যদিকে মুখ ঘুরালো।
” এখানেই ভালো আছি।”

তানভীর বুঝলো এভাবে উঠবে না। জোর পূর্বক দুই হাত চেপে ধরলো। উপর দিকে টেনে তুললো। লাবিবা কাঁচুমাচু করে তানভীরের হাতের মুঠো থেকে শক্তি লাগিয়ে ছাড়িয়ে নিলো। মুখ তুলে গজগজ করে বললো,
” বললাম না এখানে ভালো আছি? ”

তানভীর আবার এগুলো,
” কথা শোনো। ঠান্ডা লেগে যাবে। ”

” লাগবেনা। ছাড়ুন আমাকে। আরে ভাই ছাড়ুন না আমাকে। আমার আপনাকে সহ্য ই হচ্ছে না। ”

” আমাকেই সহ্য করতে হবে।”

” লাগবেনা আমার।”

” বুঝেছি সোজা কথায় উঠার মানুষ তুমি নও। আমার আঙুল বাকাতেই হবে। ”

লাবিবার হাত মুড়ে ধরে টেনে পাঁজাকোলে নিয়ে নেয়। লাবিবা চেঁচায়, “ছাড়ুন আমাকে। ”

” ছাড়ার জন্য ধরিনি। বাঁধার জন্য ধরেছি। বাধঁবো তোমাকে। তার আগে চুপটি করে বসো। ”

” বসবোনা আমি। ”

তানভীর লাবিবার কথায় কান দেয় না। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ফাস্ট এইড বক্স খুলে। লাবিবা এর মধ্যেই নেমে যেতে চায়। তানভীর এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। আবার বিছানায় বসায়। লাবিবাকে এক হাতে জড়িয়ে আরেক হাতে গাল স্পর্শ করে। লাবিবা মাথা পিছিয়ে নেয়। তানভীর বিরক্ত হয়। আবার টেনে নেয় নিজের দিকে।
” দেখি দেখতে দাও। ”

” লাগবেনা দেখা। ”

” দেখতে দাও আমাকে। স্পট পড়ে যাবে। ”

” আপনার কি তাতে? জুতো মেরে গরু দান করতে আসছেন? ”

তানভীর লাবিবার থুতনি চেপে ধরে মুখ উঁচু করে। দু পাশে গাল দুটো আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। লাল হয়ে আছে পুরো মুখ। যেনো গরম ভাব বের হচ্ছে। নাকে মৃদু ঘামও জমেছে। অথচ শরীর ঠান্ডা। তানভীর লাবিবাকে টেনে কোলে বসায়। মাথায় হাত লাগাতেই লাবিবা আরো একবার চিৎকার করে উঠে। দুহাতে তানভীরের হাত সরানোর চেষ্টা করে। তানভীর ওকে আশ্বস্ত করে,
“আমি সুন্দর ভাবে করবো। ”
সাবধানে পিন খুলে খুলে হিজাব ছাড়িয়ে নেয়। চুলের কাঁটাটা খুলে নিতেই ঝড়ঝড় করে পিঠময় চুলগুলো ছড়িয়ে পড়ে। রক্তিম ফেসে কেশবতীকে দেখে তানভীরের ভেতরে কি হচ্ছে তা লাবিবা জানে না।‌ যদি জানতো তাহলে এখন অন্তত চুপ করে থাকতো। বার বার ছটফট করে তানভীরকে আর ক্ষত বিক্ষত করতো না। মাথায় তো হাতটাও দেওয়া যাচ্ছে না। রাগের মাথায় এতোটা জোরে ধরেছে বুঝতে পেরে তানভীরের খুব খারাপ লাগছে। তানভীর সহজে রাগে না। তবে রাগলে হুস থাকে না। এসব রাগ খুব খারাপ হয়। এইযে তার বউটাকে মারলো, ব্যথা দিলো! হাতে হাতে লালন পালন হওয়া আদরের মেয়েকে কোনদিন কেউ মেরেছে কিনা এটাতেও ডাউব্ট আছে। আর সে এতোটা হাইপার ছিল যে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টাও করলোনা। তানভীর আলতো ভাবে গালে ঠোঁট ছোয়ালো। লাবিবা সাথে সাথে মাথা সরিয়ে নিয়ে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে লাগলো। তানভীর বুঝলো বেশ অভিমান হয়েছে তার বউটার। নরম সুরে ডাকলো,
” লাব্বু। সোনা বউ। একটু স্থির থাকো আমি গালে মলম লাগিয়ে দিচ্ছি। প্রমিজ একটুও ব্যথা দিবো না। ”

এতো আদুরে ডাকে লাবিবার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। মুখে আওড়ালো,
” লাগবেনা। ব্যথাও দিবে আবার মলম ও লাগাতে আসবে। ”

” আমার বউ আমি যা ইচ্ছা করবো। চুপ থাকো। দেখি মুখটা ওদিকে ঘুরাও। ”

” উঁহু জ্বলে। ”

” একটু পরেই ঠান্ডা লাগবে। ”

” আমি বাসায় যাবো। ছাড়ুন।”

” কেনো এটা বাসা না?”

” আপনার বাসায় থাকবো না। আপনি আমাকে মেরেছেন।আমাকে কখনোই ভালোবাসেন নি। আজ আপনার সাথে জড়িয়ে গেছি দেখে আমার দিকে নজর রাখেন। রাজনীতির মানুষ আপনি। নিজের দিকে যেন কেউ কাঁদা ছুঁড়তে না পারে সেজন্য আমার সাথে আজ এমন করলেন। ”

” তুমি শুধরাবে না তাইনা? ভালোবাসি তো। সত্যি বলছি অনেক ভালোবাসি বউ।”

” লাগবে না আমার আর আপনার ভালোবাসা। গরু খাক ঐ ভালোবাসা। আমার লাগবেনা। ”

” কি চাও তুমি?”

” বাসায় চলে যাব আমি। আপনার কাছে থাকব না। আপনাকে অনেক চেয়েছি আমি। বিনিময়ে অবহেলা আর কষ্ট ছাড়া কিছুই পায়নি। আজ যখন চাইছিনা তখন কোথা থেকে আসে আপনার ভালোবাসা? ছেড়ে দেন আমাকে। কারো সাথে কথা বললেই তার সাথে রিলেশনে যাওয়া হয়না। যে মানুষটা আমি আপনার জন্য পাগল সেই আপনি কিভাবে ভাবতে পারেন এসব কথা? আপনার মানসিকতা এতো খারাপ কেন? একটা মানুষ কে চিনবেন তার সম্পর্কে জানবেন তাকে বুঝবেন তারপর তাকে সন্দেহ করবেন। প্রথম থেকেই আপনি আমার বিপরীতে থাকেন। আমি আপনাকে চেয়েছি। আপনার বিপরীত আচরণ কে নয়। আমি মেনে নিতে পারবো না কখনো।”

” আমি তোমাকে নিয়ে প্রচুর জেলাস লাব্বু। সত্যিই জেলাস। ফাহাদ না এলে হয়তো জানতে পারতাম না। তোমার কাছে যদি মনে হয় আমি বেশি রিয়েক্ট করে ফেলেছি তাহলে আমি সরি। তোমার কি চাই বলো? সব তোমাকে দিয়ে দিব। আমার অর্থ সম্পদ,ব্যাংক ব্যালেন্স ফ্ল্যাট বাড়ি গাড়ি‌‌ সব তোমাকে দিলাম তবুও আমি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষকে তোমার পাশে দেখতে চাইনা।‌ তুমি আমার বউ লাবিবা। তোমার ভালো চাওয়াই আমার প্রধান কাজ। তোমার চরিত্রে দাগ পড়ুক এটা আমি কখনোই চাইনা। ”

” এতো কথা বলছেন কেন মেরে টেরে? আগে তো কোনদিন বলেননি। আমার লাগবেনা আপনার ভালো চাওয়া।”

” তাহলে লাগবে টা কি? কি পেলে তুমি তোমার জেদ দেখানো বন্ধ করবে? এই রুমটাতো তোমার লাগবে তাই না?”

লাবিবা কান্না থামিয়ে চোখ তুলে তাকায়। ভাঙ্গা গলায় উত্তর দেয়,
” লাগবেনা। ”

” আমাকেও লাগবে না?”

লাবিবা নাক টেনে জবাব দেয়,
“আপনাকে দিয়ে আমার কি কাজ?”

তানভীর নিঃশব্দে হাসে। লাবিবার গলায় মুখ গুঁজে আওড়ায়,
” সেটা তুমিই জানো আমার জান। যাও দিয়ে দিলাম তোমাকে সব। আমার সমস্ত কিছুর অধিকার তোমাকে দিয়ে দিলাম। এই আমিটাকেও তোমাকে দিয়ে দিলাম। নাও আমাকে। আমার ভালোবাসা গ্ৰহণ করো বউ।
আমি তোমার তরে সপেছি এ প্রাণ
তোমার আঙিনায় ভিড়িয়েছি শুণ্য হস্তে
আমায় এবার স্থান দাও তোমার বরাদ্দকৃত
যত্নে রাখা তনু হৃদয় অন্তে।।
তোমার সকল অভিমান পড়ে যাক। অভিযোগ গুলো চেপে যাক। ভালোবাসাগুলো প্রস্ফুটিত হোক। জীবন জুড়ে ছড়িয়ে যাক। আই লাভ য়্যু জান। আই লাভ য়্যু সো মাচ। আই কান্ট লিভ উইথআউট য়্যু। প্লিজ নেভার ডোন্ট য়্যু ডেয়ার। ”

তানভীরের আহাজারি তে লাবিবার চোখ থেকে শুধু জল গড়িয়ে পড়ে। তানভীর কে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। যে কথাটা শোনার জন্য এতোগুলো দিন সে অপেক্ষা করেছে তানভীরের মনে নিজের জন্য জায়গা করতে চেয়েছে সে অবশেষে পেরেছে। অন্য কোন সময় হলে হয়তো লাবিবা অনেক কিছুই করে ফেলতো আনন্দে কিন্তু প্রায় মধ্য রাতে এতো কাছে রয়েছে নিজের মানুষটা যার প্রতিটা বাক্যে তাকে ভালোবাসার দাবী জানাচ্ছে এই সিচুয়েশনে লাবিবা শুধুই কাঁদছে। এ কান্না কাঙ্খিত জিনিসটা পাওয়ার কান্না। যার সাথে জীবনের ভালো থাকাটা জড়িয়ে আছে। লাবিবা অনুভব করে গলায় তরল কিছুর অস্বিত্ব। তাহলে কি তানভীর কাঁদছে? লাবিবা কান্নার ফলে বসে যাওয়া গলায় ডাকে,
” খান সাহেব! ”

সাথে সাথেই গলায় ভেজা ওষ্টের ছোঁয়া পায়। ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে সেই চুমুর বর্ষন। লাবিবা শিহরণে কেঁপে কেঁপে উঠে। তানভীরের উদাম পিঠে হাত ঠেকায়। কাতর স্বরে আবার ডাকে, ” খান সাহেব!”
তানভীর গলা থেকে মুখ তুলে তাকায়।‌ লাবিবার গলায় আলতো ভাবে হাত রেখে সরাসরি চোখে চোখ রাখে।
” তোমার ঠোঁটের এই কাঁটা‌ জায়গায় কি এখনো ব্যাথা জান?”
লাবিবা মাথা নাড়ায়। ব্যথা করছে না। সত্যি সত্যি এখন কোনো ব্যাথা লাবিবা অনুভব করছেনা। লাবিবার কথায় আস্বস্থ হয় তানভীর। মুচকি হেসে “আই লাভ য়্যু জান ” বলে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দেয়। রাত যতো গভীরে যায় তানভীরের প্রসস্ত বুকের নিচে লাবিবা ততোই ছটফট করে। তানভীর আদরে আদরে ভরিয়ে তুলে লাবিবাকে। বার বার বলতে থাকে ” ভালোবাসি বউ। ভীষণ ভালোবাসি” সারাটা রাত এক মুহুর্তের জন্য ও ছাড় দেয়না। নাজুক শরীরে তুফান উঠিয়ে সেই তুফান থামিয়েও ক্ষান্ত হয়না।

সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ লাবিবার নিভু নিভু চোখ। শরীর অসাড় হয়ে আছে। অর্ধচেতন মানুষটা তানভীরের বুকে গুটিসুটি হয়ে আছে। গায়ে বুক অব্দি সুন্দর করে পড়ানো সাদা টাওয়েল। ভেজা চুলগুলো বিছানায় ছড়িয়ে আছে। তানভীর নিজে ওকে শাওয়ার করিয়ে এনে বুকে নিয়ে শুয়েছে। সেও একটু ঘুমোবে। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। চোখ মেলে লাবিবার দিকে তাকিয়ে থাকে। কপালে চুমু এঁকে বলে,
” ভালোবাসি শোনার জন্য তুমি যদি এতোটা ডেস্পারেট হতে পারো আমিও বলতে বলতে পাগল হতে পারি বউ। ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা হয়না। ভালোবাসা অনুভব করতে হয়, ভালোবাসার মানুষকে বুঝতে হয়, কখনও কখনও তার উপস্থিতিও যে তার প্রমাণ জেনে নিতে হয়। তুমি ভীষণ চালাক লাবি পাখি। সবই জেনেছো তবুও আমার মুখ থেকে কথাটা বলিয়ে ছাড়লে। সার্টিফিকেট চাই তোমার! আমার মুখের কথাই যথেষ্ট। ”

চলবে___

সরি ফর লেট। রিচেক দেবার সময় পেলাম না। মনে হলো অনেক দিন পর লিখছি উনাদের রোমান্টিকতা। শব্দগুলো গুছাতেই সময় লেগে গেলো। আমার সকল গল্প নিয়ে আলোচনায় ছোট্ট Labiba’s Tale🧚‍♀ এই গ্ৰুপে জয়েন করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here