ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো (৪৮)

0
537

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(৪৮)
তানভীর লাবিবাকে নিয়ে বসেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। জলজ্যান্ত একটা মানুষকে কেচ ধরে আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার, ফ্রাঙ্ক জেন, ডরিয়ান ইয়েটস হলে হয়তো সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যেত। তামিম এসে মেকি রাগ দেখায়,
” তোদের পাগলামি শেষ হয়েছে? উঠ। ”

তামিমের দু হাত দুজনে ধরে উঠে দাঁড়ায়। টেবিলে গিয়ে বসে। লাবিবার অর্ডার সহ তামিমের অর্ডারকৃত খাবার চলে এসেছে। রোজী অবাক হয়ে তানভীর লাবিবাকে দেখছে। তামিম অবাক হয়ে দেখছে রোজীকে। এই মেয়েটার কি একটু অন্যরকম কিছু দেখলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হবে? তামিম রোজীকে ডাকে।
” রোজ! লুক এ্যাট মি। রোজ?”

” হুহ? এইতো। ”

” ইটস নরমাল। এই দুটোর সাথে থাকলে তোমাকে সারাজীবন অবাক হয়েই থাকতে হবে। নরমাল আর হতে পারবেনা। ”

রোজী মুচকি হাসলো। মাথা নিচু করে বললো,
” আপনি আমাকে বলেন আমাকে ট্রিটমেন্ট করবেন। আমাকে ছাড়ুন। ওদের ট্রিটমেন্ট করুন।”

” টেল মি ওয়ান থিংক রোজ। তোমাকে আমি যেন খুঁজে পাইনা। তুমি প্রায় প্রায় দোলো। তোমার চেহারা অন্যরকম লাগে। তুমি কি অতিরিক্ত টায়ার্ড ফিল করো?”

” না তেমন কিছু না। ”

রোজী লাবিবাদের টেবিলের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তানভীর মিটি মিটি হাসছে। আর লাবিবা কথা বলেই যাচ্ছে। কি সুন্দর মানিয়েছে দু’জনকে।

লাবিবা হাত মোজা পরেই স্যান্ডুইচ ধরলো। তানভীর বাঁধা দিলো। ” উহু। মোজা খুলে তারপর খাবার তুলো। ”

লাবিবা সময় নিয়ে মোজা খুললো। তানভীর তাকিয়ে আছে হাতের দিকে। যেই স্যান্ডুইচ তুলতে হাত বাড়িয়েছে তখনি তানভীর হাত ধরে ফেললো। নিজের দিকে টেনে নিলো। এপিঠ ওপিঠ করে পরখ করলো। হাতটা কেমন ফুলে আছে। লাল হয়ে আছে। মোজা পরে থাকলে এমন হবার কথা নয়।
” হাত ফুলা কেন?”

” এমনি। ”

” এমনি?”

লাবিবা বলতে চাইছে না। চোখ লুকাচ্ছে। তানভীর আরেকটা হাত ও টেনে নিলো। সেই হাতটাও এমন। থমথমে গলায় প্রশ্ন করলো, ” মারামারি করেছো?”

” ঐঐ আর কি। ”

” তুমি তো এখন আর মারামারি করো না। কি হয়েছে? কে কি বলেছিলো তোমাকে? বলো কি প্রবলেম হয়েছে?”

” আমি আগে মারামারি করতাম আপনি জানলেন কি করে?”

” এনস্যার দাও আগে। ”

” আগে আপনি বলুন। আপনি কি আগে থেকেই চিনতেন আমাকে?”

তানভীর লাবিবার মুখের দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। হাত ছেড়ে দিয়ে নিজে থেকেই লাবিবার মুখে স্যান্ডুইচ তুলে ধরে। লাবিবা ভ্রু কুচকায়।
” কবিরের থেকে শুনেছি। হা করো। ”

লাবিবাকে খাইয়ে দেয় নিজেও খায়।‌ কিছু সময় পর বলে, ” মারামারি করবেনা লাব্বু। এখন আর তুমি ছোট নেই। ”

” আপনি ভাইয়ার থেকে আমার সম্পর্কে সবকিছুই শুনেছেন?”

” বাকি আছে। শুনে নিবো। খাও। ”

তামিম খেয়াল করলো রোজী অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। তানভীর লাবিবাকে খাওয়াচ্ছে নিজেও খাচ্ছে। এটা কি রোজীর কাছে অবাক হওয়ার মতো কোনো বিষয় মনে হচ্ছে? আশ্চর্য ব্যাপার। এরকম সময় তামিম ও স্পেন্ড করেছে। খুব স্পেশাল ছিলো সময় গুলো। সেসব স্মৃতি আজ দীর্ঘশ্বাস হয়ে পড়ে। তামিম এক চামচ সুপ তুলে নিলো রোজীর দিকে। ডাকলো,
” রোজ?” রোজী চোখ ফিরিয়ে তামিমের দিকে তাকালো। তার মুখের সামনে চামচ ধরে আছে তামিম। বললো, ” হা করো।”

রোজী আরো একটু অবাক হলো। লজ্জাও পেলো। আহাম্মকের মতো ঐদিকে তাকিয়ে ছিলো বলে তামিম কি ভাবলো তার ও তামিমের হাতে খেতে ইচ্ছে করছে? রোজী মাথা নাড়ালো, “‘আমি নিয়ে খাচ্ছি। ”
তামিম চামচ সরালো না। অগত্যা রোজী তামিমের হাতে খেলো। রোজীর দু চোখ ভরে জল টলমল করলো। তামিম মনে মনে হাসলো। নিজের ভাগ্যের উপর। জীবন যে দিকে মোড় নেয় সেদিকেই যেতে হবে। আরো ভাবলো এই মেয়েটার অনেক যত্ন পাওয়ার আছে। রোজীর অস্বস্থি বুঝে বললো,
” আমার সাথে রিলেশনে যাও রোজী। বিয়ের আগেই ফ্রি হয়ে নাও। তোমার সংকোচ বোধ নয়তো পরে আমার অনেক প্রবলেম ক্রিয়েট করবে। ”

তামিমের সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। লোকটি পরিচয় দিয়েছে এস আই বলে। তামিম আন্দাজ করলো লোকটি কে। কি বলতে পারে। আন্দাজটাই ঠিক হলো। লোকটি আর কেউ নয়। রোজীর এক্স হাজবেন্ড। লম্বা চওড়া ভালোই দেখতে। চেহারায় কেমন শয়তান শয়তান ভাব চলে আসছে। তামিমের মনে হলো রোজীর মতো ইনোসেন্ট মেয়ে এর সাথে কখনোই ম্যাচ হতে পারে না। একটা কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করে এতো গুলো বছরে পুরো প্রতিবন্ধী বানিয়ে ছেড়েছে। মেয়েটার বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে জ্ঞান নেই বললেই চলে। একা একা চলাচল করতেও ভয় পায়। ভালো খাবার পর্যন্ত ও পায়নি। ফ্যাকাশে সিংষ্ট শরীর দেখেই বোঝা যায়। ভালোবাসা তো দূর ভালোব্যবহার পর্যন্ত ও মনে হয়না পেয়েছে। রোজীর হাত দেখেই বোঝা যায় অনেকদিন থেকেই রিপেয়ার হয়ে আসছে। লোকটি সালাম দিলো।‌জানালো সে রোজীর এক্স হাজবেন্ড। তামিম মুচকি হাসলো বললো, ” আমি রোজীর বাগদত্তা। ”

” কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি।”

” সিউর। আপনি তো আর এমনি এমনি আসেন নি। আসার সময় নিশ্চয় জেনে এসেছেন আমি কে? আমার পরিচয়।”

” জি তা তো অবশ্যই। আমি জানতে চাইছিলাম রোজীর সাথে আপনার আগে থেকেই পরিচয় মানে আগে থেকেই রিলেশন ছিলো নাকি আপনাকে বিয়ে করার জন্যই আমাকে ডিভোর্সটা দিলো? ”

” হুয়াট?কি বলতে চাইছেন? ”

তামিম আর বসে থাকতে পারলোনা। উঠে দাঁড়ালো। রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছে তার। লোকটি রিকুয়েষ্ট করলো,
” প্লিজ কুল ডাউন স্যার। রাগ করবেন না। আমরা বসে কথা বলি। ”

” রুচি চলে গেছে আমার। ছিহ এতো নোংরা মন আপনার? আপনার সংসারে থাকা কালীন আপনার ওয়াইফের সাথে আমি রিলেশনে ছিলাম এরকম কুপ্রবৃত্তি মন মাইন্ড নিয়ে আমার সাথে কোন সাহসে কথা বলতে এসেছেন?”

” তাহলে মি. আমাকে জোর করে ডিভোর্স দিয়ে আপনাকে বিয়ে করছে কেন ডিভোর্সের কিছু দিন না যেতেই?”

” আপনাকে ডিভোর্স করেছে আপনার ক্যারেক্টারের জন্য। আপনার সেকেন্ড ওয়াইফের কথা জানার পরেও এতো গুলো দিন যে আপনার সংসারে রোজ ছিলো এটাই তো আপনার ভাগ্য। ”

” বিয়ে করেছি তাতে কি হয়েছে? মানুষের কি দুই বউ থাকে না? আমার এবিলিটি আছে আমি দুই বউ ম্যানেজ করবো তাই বলে ট্রাপে ফেলে ডিভোর্স দিয়ে অন্য নাগর নিয়ে ঘুরবে? ”

” কোন থানায় পোষ্টিং আছেন?”

” তা জেনে আপনি কি করবেন?”

” কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার্ড হয়ে যাবেন।”

” পাওয়ার দেখান? সরকারী চাকরী খাওয়া মুখের কথা?”

” সরকারী চাকরী সরকারের লোকই খাবে। এইযে এতোক্ষন ধরে আমার উপর চেচালেন আমি কে তা জানার পরেও। বাড়িতে বউ রেখে আরেকটা বিয়ে করেছেন। বড় বউকে দিনের পর দিন নির্যাতন করে গেছেন। রাস্তা ঘাটে মেয়েদের হ্যারেস করে যাচ্ছেন। আইনের লোক হয়েও কন্টিনিউআসলি বেআইনি কাজ করছেন। এর একটা প্রমান ই যথেষ্ট আপনাকে আউট করার জন্য।”

এবার বেশ ভয় ই করছে। ফাঁকা আওয়াজ দেওয়া খানদের কর্ম নয়। শান্ত হয়ে থাকতে এসেও শান্ত হতে পারেনি। অনুরোধ করলো,
” স্যার প্লিজ আপনি এটা করতে পারেন না। আমাকে ক্লিয়ারলি কনফেস করতে দিন।”

” আপনি এমপির বাড়ির বউকে নিয়ে ছেলেখেলা করতে এসেছেন। মরার পাখনা গজিয়েছে। বাড়িতে যান। যে বউকে ভাড়া বাসায় রেখেছেন তাকে বাসায় নিয়ে এসে বাবার সাথে কাজ করুন। খেটে খান। ঘোষ খেয়ে পেট ফুটবল বানিয়ে ফেলেছেন। উচ্চ রক্তচাপে মারা যখন তখন। খেটে খান ওজন কমান। ”

” আপনি রোজীকে বিয়ে করবেন না। রোজী আমার। ওর উপর শুধু আমার নজর থাকবে। ”

” আমার ছোট ভাইয়ের উপর যে এট্যাক করতে এসেছিলেন এখনো এটা ভাইয়ের কানে যায়নি। দুটোই মারামারিতে পটু। আমি আবার ওদের মতো না। তাই ছেড়ে দিচ্ছি। একবার আমার ভাইয়ের কানে কথাটা গেলে রক্ত মাংস আলাদা করে ছাড়বে। আপনার কাজিন ফাহাদ নাকি এখনো ঠিকমতো চলাচল করতে পারে না? দোয়া করি আপনি সুস্থ স্বাভাবিক থাকুন।”

” রোজী শুধু আমার। আপনি ওকে বিয়ে করবেন না।খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।”

” শালা হারমজাদা গলার স্বর এখনও মাড়াস। শরীরের এতো লোভ তোর! নিজের বউরে দিয়ে হয়না? আমার হবু বউ নিয়ে টানাটানি করস। রোজের আশেপাশে যেনো তোকে না দেখি। বের হ শালা এখান থেকে। আর শোন রোজ একটা ইনোসেন্ট মেয়ে। ওর সম্পর্কে খারাপ কথা মুখেও আনবিনা। ”

ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। তামিম রাগে ফুসফুস করতে থাকে। তানভীরকে বিষয়টা জানায় না।কলেজে প্রোগ্ৰাম নিয়ে ব্যস্ত আছে সে। নিজের টেনশন আর ভাইয়ের উপর দিতে চায়না।

“স্যার টাকা লাগবে। ”

” কার্ডে দিয়ে দিয়েছি। ”

” সে তো আছেই কিন্তু তুলতে ইচ্ছে করছে না। ”

” লাবি পাখি সামনে থেকে সরো এখন আমার তাড়া আছে। পরে টাকা দিচ্ছি। ”

” ঐ কাপড়টা মানুষ নিয়ে যাবো তো। ”

” তুমি একা একা মার্কেটে গিয়েছিলে?”

” না উর্মি ছিলো। দিন না এতো পছন্দ হয়েছে অন্য কেউ নিয়ে গেলে আমার হলুদ টাই মাটি হয়ে যাবে। ”

তানভীরের পা থেমে যায়। জরুরী কাজে বের হচ্ছিলো।
” হলুদ মাটি হবে মানে? ভাইয়ার বিয়ে জাস্ট পড়িয়ে নিয়ে আসা হবে। কোনো ফাংশন হবেনা।”

” আরে ভাইয়ার বিয়ে না। আমার বিয়ে। একবার তো লুকিয়ে চুরিয়ে বিয়ে করেছি। এবার তো ধুমধাম ছাড়া হবেনা।”

এর মাথায় কখন কি চলে সে নিজেও হয়তো জানেনা। তানভীর প্যান্টের পকেটে দুই হাত গুজলো। কাঁধ সোজা করে একটা ভাব নিয়ে জানতে চাইলো,
” ও আচ্ছা। ম্যাম কবে যেন আপনার ধুমধাম করে বিয়েটা হবে?”

লাবিবা লাজুক হাসলো। তানভীরের হাত দুটো পকেট থেকে বের করে ছেড়ে দিলো।
” ওভাবে দাঁড়াবেন না এখন। ক্রাশ খেয়ে ফেলি। চোখ ভরে দেখার সময় নাই। ”

” যা বলছি তার উত্তর দাও। ”

” অনার্স শেষ করার পর। একবছরও তো সময় নেই।”

” সিরিয়াসলি? একবছর আগে থেকেই তোমার এই বিয়ের শপিং করতে হবে? মানুষ দুই ঘণ্টাতে শপিং কমপ্লিট করে আর তোমার এক বছর লাগবে?”

” অন্য মানুষের সাথে কি আমাকে মেলালে চলবে? ওরা তো লাব্বু না। লাব্বুর বরাবরই একটু বেশিই সময় লাগে।”

” একবছর। তাইনা?”

” তাড়াতাড়ি টাকা দিন আমি যাবো তো। ”

” তোমার শুধু শুধু শপিং সেন্টারে ঘুর ঘুর করা আর কমবে না। ”

লাবিবা দশহাজার টাকা নেয়। ওয়ালেট ফিরিয়ে দিয়ে বলে,
” আরো লাগলে পরে নিবো। এখন এটুকুই নিচ্ছি।”

” গাড়ি নিয়ে যাও।”

” এতো ভয় পান কেন?”

” তুমি বুঝবেনা।”

লাবিবা ভেংচি কেটে চলে গেলো। তানভীরের কথা শুনলো না। টেনশন তানভীরের ঘাড়ের উপর অনবরত নাচে। একদিকে শ্বশুড়ের বাসার কাজ ধরেছে আরেকদিকে কলেজে প্রোগ্ৰাম, ভাইয়ের বিয়ে তারউপর এই অবাধ্য বউ! একটা না একটা ঘটনা ঘটিয়েই চলে।

লাবিবা মার্কেটে গিয়ে গজ কাপড় নিলো কয়েকগজ। সাথে তানভীরের পাঞ্জাবীর কাপড় ও নিলো। টেইলার্সে গিয়ে বানাতে দিয়ে বাড়ি ফিরল। তানভীর আর ওর একটাও কাপল ড্রেস নেই। এই একটা হলো। সকালে গিয়ে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছে। এতো সুন্দর রেইনবো কালার! দেখেই পছন্দ হয়ে গেছে। মনস্থির করে ফেলেছে এটাই তাঁদের হলুদে পড়বে। সাথে তানভীর কেও পড়াবে।

তামিমের দিনগুলো ভালো মন্দে যাচ্ছে। ফ্লোরার সাথে সময়গুলো এতো বছরের গ্যাপে ফিকে হয়ে গেছে। এজন্যই মানুষ বোধহয় বলে চোখের আড়াল হলে তো মনের আড়াল। তামিম রোজীর সাথে প্রতিদিন ফোনে কথা বলে সময় করে। রোজীর আর সংকোচ বোধ হয়না। খুব নরমালই কথা বলা শুরু করেছে। আস্তে আস্তেই ঠিক হয়ে যাবে। আজ রাতেও রোজীর সাথে কথা বলা শেষ করে শুতে যাচ্ছিল। সে সময়ে হুয়াটসাপ এ একটা মেসেজ আসে। মেসেজ অপেন করে দেখতেই ঠাস করে হাত থেকে পরে গেলো ফোনটা। তামিম দু পা পিছিয়ে যায়। চুল গুলো মুঠো করে ধরে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে।

চলবে ___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here