#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৫৭)
চারপাশে শোরগোল। দলবেঁধে ছেলে মেয়েদের হাঁটাহাঁটি। কথা ছিলো ছেলেদের আলাদা জায়গায় হলুদ দেওয়া হবে মেয়েদের ও আলাদা ভাবে দেওয়া হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মেয়ে পক্ষরা ফটোসেশনের জন্য এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে আর ছেলেরা উঁকি ঝুকি দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার পিছু লাগছে। ছেলেদের প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে একভাবে মেয়েদের আরেকভাবে। ফোটোসেশন দুটোতেই করতে হবে। মেয়েদের টায় ছেলেরা ঢুকতে পারছেনা। কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু ছেলেদেরটায় মেয়েরা ঠিকই হানা দিয়েছে। বিভিন্ন পোজে ছবি তুলছে। ছেলেরা মেয়েদের দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। চিল্লিয়ে বলছে, ” দোস্ত বিয়ে করলে ময়দা সুন্দরীকেই বিয়ে করা উচিত। ”
” কেন?”
” সকালের নাস্তার টাকাটা বেঁচে যাবে। ”
সবাই হো হো করে হেঁসে উঠে। উর্মিলা তো কটমট করে তাকায়। ছেলেরা আবার চিল্লিয়ে বলে,
” কি চাহনি রে! মারগায়া হায়!”
উর্মিলা স্টেজ থেকে নেমে আসে। মালার হাত ধরে বলে,
” চল। থাকা যাবে না এখানে। মুখ চিনে রাখ শুধু। স্যারকে বলে পরে ডলা দিবো এদেরকে। ”
বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে আঁচল টেনে ধরে। উর্মিলা ঘাড় ফিরিয়ে একটা ছেলের হাতে নিজ শাড়ির আঁচল দেখে ভীষণ রেগে যায়। আঙুল তুলে হুংকার ছাড়ে,”এই!”
অথচ ছেলেটার কোনো রিয়েকশন নেই। মুখে চুইংগাম চিবুতে চিবুতে উর্মিলার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উর্মিলা তুড়ি বাজায়, “হে মিষ্টার, কি প্রবলেম?”
” ভাবীর কে হোন?”
” কেন কি দরকার? প্রেম প্রস্তাব দিবেন? এখনও হিরোর মতো যে আঁচল ধরে আছেন।”
রাকিব আঁচল ছেড়ে দেয়। গা ঝাড়া ভাবে বলে,
” আমার প্রেম টেমে ইন্টারেস্ট নেই। আমি ডাইরেক্ট বিয়েতে বিশ্বাসী।আমি আবার ভাবলাম ভাবীর বোন মনে হয় আপনি অথচ আমার জানা মতে ভাবীর কোন বোন টোন নেই। ”
” আপনার কেন মনে হলো আমি বোন হবো?”
” নয়তো? থ্যাংক য়্যু মিস। আপনা বেয়াই বেইনী ব্যাপারটা আবার কেমন যেনো ঘেঁটে যায়। আপনিও দূরের আমিও দূরের কাছে আসতে নো বাধা। ”
” ডিসগাষ্টিং। ”
উর্মিলা চলে যায়। আকাশ পেছন থেকে জোর গলায় বলে, ” হেই ময়দা সুন্দরী,আমি আকাশ। নামটাতো বলে গেলে না ।”
উর্মিলা দ্রুত বেগে হাঁটে। মালা থেকে গিয়ে আঙুলে ইশারা করে বললো, ” উর্মিলা।”
যেখানে যাচ্ছে সেখানেই উর্মিলা আকাশকে দেখতে পাচ্ছে। কি চায় ছেলেটা? এভাবে পিছু ঘুরার মানে কি?প্রেমে ইন্টারেস্টেড না। হু! চ্যাংরা পোলা! স্যারকে জানাতে হবে। যত মুসকিল সব স্যার সলভ করে দেবে। কিন্তু স্যার নেই। একদল শালা শালির অতিপ্রিয় জিজু তানভীর খান পুরো এরিয়াতে নেই। অনেক খোজেও পাওয়া গেলো না। অগত্যা উর্মিলা নাকিবকে ডেকে আনলো। নাকিব মহা ব্যস্ত।
” এই বল তাড়াতাড়ি কি হয়েছে? অনেক কাজ পড়ে আছে।”
” কি কাজ করছিস তুই? আমিতো দেখছি এদিক থেকে সেদিকে শুধু ঘুরঘুর করছিস। ”
” তো এটা কি কাজ নয়? সবাই নজরে নজরে রাখছি। বিয়ে বাড়ি বলে কথা! কোন অঘটন যেনো না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে না?”
” আর এদিকে যে একটা আস্ত চেংরা পোলা আমার পিছু লাগছে সেটা খেয়াল করছিস একবার?”
” সত্যি দোস্ত? কনগ্ৰাচুলেশন। আমি তো ভেবেছিলাম বুড়ি হয়ে যাবি তা-ও কোনো আশিক জুটবে না। এতো তাড়াতাড়ি যে পেয়ে যাবি আমি সত্যি অভিভূত দোস্ত। খুশিতে চোখে কান্না চলে আসছে। দেখ আমি কানছি। আমার চোখে পানি টলমল করছে।”
” হারামি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ। আর দুলাভাই স্যার কোথায় বলে যা। আমি সব বিচার দিবো।”
” জানিনা। খুঁজে নে যা।”
” একটা কল করনা। আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই।”
” আমার ফোনেও নেই। মুডি খা।”
মালা ঝটপট বলে, ” দাঁড়া আমি উপর থেকে গিয়ে দেখে আসি। এখানে কোথাও থাকলে ঠিক চোখে পড়বে।”
সিড়ি বেয়ে উঁচু টাওয়ার টায় উঠে যায়। উর্মিলা চেঁচায়,
” মালা! পেলি দুলাভাইকে? ”
” তোরটাকে পায়নি রে আমাদেরটাকে পেয়েছি। ঠিক তোর পেছন বরাবর ঝাউ গাছের নিচে ।”
উর্মিলা নাকিব দু’জনেই পেছন ঘুরে তাকায়। উর্মিলা রাগে ফুঁসতে থাকে। নাকিব হো হো করে হেসে উঠে। উর্মিলাকে জ্বলাতে বলে,
” সাদা চামড়াটা নাকি রে? দোস্ত তোর সাথে মানাইছে। আকাশ ভাই বেশ হ্যান্ডসাম আছে। ”
“নাকিবের বাচ্চা! চুপ। ”
” আমি চুপ হলে কি আর কাহিনী আগাবো? লাভের মুখ দেখে সরে যাওয়া লোক আমি না। দোস্ত তোরা দুই সাদা মিলে বছর বছর একটা করে ফরেনার বাচ্চা পয়দা করবি আমি বিদেশে ঐগুলারে ডেলিভারী দিমু। লাভে লাভ! আইডিয়াটা দারুন না? ”
উর্মিলা নাকিববের পিঠে ধুম ধাম লাগিয়ে দেয়। নাকিবের চিৎকার করার আগে মালা চিৎকার করে উঠে, ” দুলা ভাই পাইয়া গেছি। হুররে”
উর্মিলা নাকিবের কলার টেনে টাওয়ারের উপর উঠে আসে। তানভীরকে দেখতে পাওয়া মাত্রই নাকিব বলে,
” কতগুলা মাইর দিসছ। আকাল ভাইয়ের সাথে তোর কি সবগুলা বিচার দিবো। ”
উর্মিলা নাকিবকে ফেলে দৌড় দেয়। সে আগে বিচার দিবে। নাকিব আগে পৌছালেই উল্টাপাল্টা বলে দিতে পারে। মাইরের শোধ তুলবে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কিল বসিয়েছে যে। অথচ উর্মিলা আকাশ নাকি বাতাস! তাকে চেনেই না।
শাড়ি পড়ে কি দৌড়ানো যায়? নাকিব, উর্মিলা, মালাকে ঐভাবে দৌড় প্রতিযোগিতা দেয়া দেখে আকাশ ও ছুটে। আকাশের দলের ছেলেরাও ছুটে।তামিম ও পা বাড়ায়। একে একে স্টেজের প্রায় অর্ধেক ছেলেমেয়ে এগিয়ে যায়।
বিল্ডিং থেকে কিছুটা পথ। উত্তরে বয়ে চলেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। বহু প্রাচীন বট গাছের নিচে মাঝারি দুটো নৌকা বাঁধা। পারাপারের জন্য নৌকাদুটো ব্যবহার করা হয়। একটা নৌকাতে নীল সচ্ছ আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে তানভীর। মাথার নিচে দুটো হাত ভাঁজ করে রাখা। হাঁটু ভাঁজ করে এক পায়ের উপর পা তুলে একটু পর পর বিট তুলছে। নদীর উপর নৌকাতে অনেক দিন এভাবে শুয়ে থাকা হয়না। বয়ে চলা হাওয়া সাদা পাঞ্জাবির কোনা উড়িয়ে দিচ্ছে। অদ্ভুত ভালোলাগা ঘিরে ধরেছে চারিপাশ থেকে। মানুষের ভিড় কোলাহলের থেকে একরম নীরব স্থান ঢের শ্রেয়। তানভীরের মোটেই পছন্দ নয় এসব কোলাহল। অথচ অপছন্দের কাজের সাথেই সে সম্পৃক্ত। হাজার হাজার স্টুডেন্টস, লক্ষ লক্ষ জনগণ, শত শত টেনশন সবকিছু মিলিয়ে দৈনন্দিন সিডিউল তার। শত ব্যস্ততার মাঝে তার একমাত্র সুখ কল্পনায় বিচরিত লাবিবা নামের মেয়েটা। মেয়েটাকে এখন পার্মানেন্টলি তার কাছে আনার প্রসেস চালিয়ে যাচ্ছে। আজ বাদে কাল থেকেই তাঁকে যখন তখন চোখের সামনে দেখতে পারবে। তাকে ছুঁতে পারবে। তার বুকে মাথা রাখতে পারবে। শান্তিতে ঘুমোতে পারবে। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য হাজারটা কাজ ঘাড়ের উপর চাপাবে না। একান্ত ব্যক্তিগত সুখটাকে নিয়ে ব্যক্তিগত সময় অতিবাহিত হবে। চোখে মুখে সেই সুখের ছাপ। মস্তিষ্ক জুড়ে সেই সুন্দরী সুখটার বিচরণ। পড়ন্ত বিকালে এভাবেও যে কেউ গাছের নিচে নদীর উপর সুখের সময় অতিবাহিত করতে পারে কারো হয়তো জানা ছিল না। তামিম ডাকলো,
” তানভীর?”
তানভীর ঘাড় ঘুরিয়ে হকচকিয়ে উঠলো। শুধু তামিম নয়। শূন্য দৃষ্টিতে আবার সেই দল। যাকে উপেক্ষা করে সে এখানে সুখী সময় অতিবাহিত করছে। তানভীর উঠলো না। তাকিয়ে থেকেই মুচকি হাসলো। তামিম তানভীর সম্পর্কে অবগত। সে নৌকায় পা বাড়ালো। ছোট্ট বাক্যে বুঝালো, ” তিনটা দিন মাত্র! ওকে?”
তানভীর মাথা নাড়ালো। হাসির রেশ ধরে বললো,
” জি ভাইয়া।”
তানভীরের খারাপ লাগলো না মোটেই। জায়গাটা এতো মনোরম আর শান্ত যে তাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারদর্শ। অভিযোগ নিয়ে এসেছিলো অনেকেই। কিন্তু নিস্তব্দ জায়গা আর শীতল বাতাসে তারাও উদাস হয়ে গেলো। উঠে এলো নৌকায়। তামিম তানভীরের পাশে বসে বললো, ” এতো সুন্দর একটা জায়গা আছে কাছেই জানালিনা কেন? হৃদয় ছুঁয়ে দিলো একদম। ”
” এরকম একটা জায়গায় এসে তোমার রোজকে নিয়ে কিছু ভেবো ভাইয়া। পৃথিবীর সব থেকে সুখী ব্যক্তিদের একজন মনে হবে নিজেকে। ”
” দুলাভাই আমাদের লাব্বুকে ভাবছেন তাহলে। লাব্বুতো হলুদে সাজছে আপনাকে দেখাতে।”
” কিন্তু আমাদের দুলাভাই যে নদীর ঘাটে। ”
” ডেকে নিলেই হয়।”
” বারণ আছে। ”
তানভীর উঠে বসে। দলের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
” সুর ধর তোরা উদাস দুপুর বেলা। ”
সবাই ‘ হৈ’ বলে উঠে। নৌকার পাটাতন, মেয়েদের নুপুর, ঠোটের শীষ হয়ে উঠে বাদ্যযন্ত্র।
তানভীর প্রথমে শুরু করে,
” আর উদাস দুপুর বেলা সখি
আসবে কি একলা নদীর ঘাটে রে,
দেখতে তোমায় মন চাইছে
ও কি দেখতে তোমায় মন চাইছে।
আর একবার যদি আসো সখি
জল ভরিবার ছলে ..
মনের কথা বলবো তোমায়
বসে কদম তলে,
মনের কথা বলবো তোমায়
বসে কদম তলে। ”
সবাই একসাথে সুর তুলে __
” একবার যদি আসো সখি
জল ভরিবার ছলে ..
মনের কথা বলবো তোমায়
বসে কদম তলে,
মনের কথা বলবো তোমায়
বসে কদম তলে।”
কানের কাছে সুর ভেসে আসলে লাবিবা শাড়ি ঠিক করতে করতে গিয়ে উত্তরের বন্ধ জানালা খুলে দেয়। বহু গলা মিশ্রিত সুর কানে স্পষ্ট হয়। উকি দিয়ে দেখে দূর থেকে সুর ভেসে আসছে ছেলে মেয়ের একসাথে। হলুদ, নীল আবছা রংয়ের ভিড় একটুখানি দেখা যাচ্ছে তিনতলার উপর থেকে।লাবিবার মন চঞ্চল হয়ে উঠে। তানভীরের ছাড়া গলা তো তার বেশিই পরিচিত। রোজী পেছন থেকে ডাকে,
” লাবিবা আসো তোমাকে ফুল লাগিয়ে দেই। ”
মারিয়া বলে, ” মামুনী কাম। ”
রোজী হাতে লম্বা গাদা ফুলের মালা হাতে দাঁড়িয়ে। তার সাজ একদম কমপ্লিট। এবার লবিবাকে কমপ্লিট হলেই বেরিয়ে পড়বে স্টেজে যাবার জন্যে। লাবিবা ঘুরে তাকায়। চিৎকার করে উঠেই দৌড়ে গিয়ে রোজীর হাত ধরে টান লাগায়। ” আপু এসো। ”
” আরে লাব্বু কোথায় দৌড়াচ্ছো?”
” দৌড়াও আপু দৌড়াও। চিট করা হয়েছে আমাদের না নিয়েই গানের আসর বসিয়ে ফেলেছে। দৌড়াও।”
” তুমি সকল দুঃখ ভুলে যেও
চোখের পানে চেয়ে,
তুমি সকল দুঃখ ভুলে যেও
চোখের পানে চেয়ে,
আর শক্ত কইরা ধরিয়ো হাত
ছাইড়া যাইবার ভয়ে,
দেখতে তোমায় মন চাইছে
ও কি দেখতে তোমায় মন চাইছে।
আর উদাস দুপুর বেলা সখি
আসবে কি একেলা নদীর ঘাটে রে,
দেখতে তোমায় মন চাইছে
ও কি দেখতে তোমায় মন চাইছে।
আর না জানি মুই লিখতে চিঠি
না জানি মুই পড়তে
বাঁশির সুরে ডাকি তোমায়
আসো না গো ছুটে,
বাঁশির সুরে ডাকি তোমায়
আসো না গো ছুটে।
আর উথাল পাথাল নদীর ঢেউয়ে
বুকে জোয়ার ভাটা চলে,
উথাল পাথাল নদীর ঢেউয়ে
বুকে জোয়ার ভাটা চলে,
চেয়ে তোমার পানে,
দেখতে তোমায় মন চাইছে
ওকি দেখতে তোমায় মন চাইছে।
আর উদাস দুপুর বেলা সখি
আসবে কি একলা নদীর ঘাটে রে,
দেখতে তোমায় মন চাইছে
ওকি দেখতে তোমায় মন চাইছে।। ”
সবাই একসাথে করতালি দেয়। নদীর পাড়ে ঘাসের উপর সারি বসেছে গানের উদ্দেশ্যে। নাকিব বলে,
” এরপর কে শুরু করবে?”
” এভাবে হবেনা। একের পর এক গান ধরতে হবে।”
” পাঁচমেশালি?”
” আরে ঐদিকে দেখো। আমাদের কনেরা দৌড়ে আসছে। ”
সবাই ফিরে তাকাতেই দেখে অদূরে লাবিবা রোজীর হাত ধরে দৌড়ে আসছে। মেয়েপক্ষ হৈ হৈ করে উঠে,
” আরে তোমরা চলে আসলে কেন? এখনই মুরুব্বিরা বকাঝকা করতে শুরু করবে। ”
রোজী এতোটা দৌড়েছে কবে জানেনা। রিতীমতো হাপাচ্ছে। নৌকাতে বসেই তামিম ছেলেদের বললো,
” এই তোদের ভাবীদের রাস্তা করে দে। ”
লাবিবা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাঁটুতে হাতে ভর করে ঘাসের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে কয়েকদম শ্বাস ছাড়লো। পরক্ষনেই মাথা তুলে তানভীরের দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোনায় ভেসে উঠলো চমৎকার এক প্রাপ্তির হাসি। এই মেয়ে সব অর্জন করে ছাড়বে। বিন্দু মাত্র ছাড় দিতে প্রস্তুত না। তানভীরকে এলোমেলো করে দিতে একটা মিনিটও সময় নিতে জানেনা। চোখের ভাষা বুঝতে বড় ব্যাকুল হয়ে থাকে যে! মুখ খোলার কি প্রয়োজন? তানভীর উঠে দাঁড়ালো। এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় পা দিয়ে এগিয়ে এলো। হাত বাড়ালো। লাবিবা এগিয়ে এলো। এই নৌকার মেয়েগুলো ঐ নৌকায় তামিমের পাশে গিয়ে বসলো লাবিবার সুবিধার্থে। দু হাত মুঠোবন্ধ করেই লাবিবার পা পড়লো নৌকাতে। ফিসকাট পেডিকোট দিয়ে শাড়ী পড়ে দৌড়ানো যেমন কষ্টের বসাও তেমন কষ্টের। তানভীরের রাগ লাগলো।” দৌড়ে আসার কি প্রয়োজন ছিলো? মুখ থুবড়ে পড়লে?”
লাবিবার অসহায় দৃষ্টি মেললো, ” তবুও তো গান শেষ হয়ে গেলো?”
“কিচ্ছু শেষ হলোনা। শূণ্যতা পূর্ণ হয়ে উঠলো। ”
লাবিবার মনে হয় আজকাল তানভীর নিরামিষ থেকে আমিষ খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। নয়তো আগে থেকেই সে আমিষভোগী। যদি তাই হয় তাহলে লাবিবার দুঃখের শেষ থাকবেনা। আফসোসের ও শেষ থাকবে না। বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেলো শুধু শুধু। আশিক তো আগে থেকেই দেওয়ানা। ছুপা রোস্তম।
লাবিবার জায়গা হলো জানুর উপর। ভীষন লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু কেউ আমলে নিলো না ব্যাপারটা। এটাই যেনো হবার ছিলো। আগেকার দিনে একটা প্রচলন ছিল, বিয়ের আগে ছেলে মেয়েকে আগলে রাখো। এখনকার দিনে, বিয়ে যেহেতু হবেই,যত;পারো বোঝাপড়া করো। সেখানে এটাতো দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে। সবাই খুশি মনেই মজা লুটলো। রোজী প্রথমে লজ্জা পেলেও এখন আর পায়না। সে দেখেছে সবাই কত স্বাভাবিক। সে কেনো অস্বাভাবিক আচরণ করতে যাবে নিজের দোষে? তামিম জিজ্ঞেস করলো,
” গলা শুকিয়ে গেছে?”
” ঠিক আছি। সমস্যা নেই। ”
এবার নাকিব গান ধরলো,
” বকুল ফুল, বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত কানও বান্ধাইলি
বকুল ফুল, বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত কানও বান্ধাইলি
শালুক ফুলের লাজ নাই
রাইতে শালুক ফোটে লো
রাইতে শালুক ফোটে
শালুক ফুলের লাজ নাই
রাইতে শালুক ফোটে লো
রাইতে শালুক ফোটে
যার সনে যার ভালোবাসা
যার সনে যার ভালোবাসা
সেইতো মজা লুটে লো
বকুল ফুল, বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত কানও বান্ধাইলি
বকুল ফুল, বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত কানও বান্ধাইলি। ”
একে একে সবাই গান ধরলো,
সোনাবন্ধু, তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা
মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না
সোনাবন্ধু, তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা
মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না
সোনাবন্ধু, তুই আমারে
সোনাবন্ধু, তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা
সোনাবন্ধু, তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা
মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না
মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না
সোনাবন্ধু, তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা
মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না।
সবাই বেশ ইনজয় করছে। সব থেকে বেশি ইনজয় করছে লাবিবা। গলা ছেড়ে গান গাইছে। তালে তাল মিলিয়ে হাত নাচাচ্ছে। কাঁধ নাড়িয়ে তানভীর ও সায় দিচ্ছে। তানভীর খেয়াল করেছে তার বউটা যখন হা পা মুখ নাড়িয়ে নাচের ভঙ্গি করে ভীষন কিউট লাগে। কি এক্সপ্রেশন! শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে। কাচা হলুদ শাড়ি ব্লাউজে খোপা করা চুলে তো একদম হলদে পরীর মতো লাগছে। এই পরীটা যখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাচে তখন এর থেকে সুখের আর কি লাগে? তানভীর আনমনেই হাসে। ভাবনা লুকাতে এদিক ওদিক তাকাতেই তামিম রোজীকে চোখে পড়ে। তারাও হাত তালি দিয়ে মজা লুটছে। রোজীর কোলের উপর লম্বা তাজা গাদার মালা। রোজীর খোপায় হাতে গাদা ফুল। অথচ লাবিবার হাত, খোপা খালি। তানভীর হাত বাড়িয়ে মালাটা হাতে তুলে নেয়। রোজী সামান্য দৃষ্টি বিনিময়ে মুচকি হাসে। তানভীর ও হাসে। হুট করেই বগলের নিচে দিয়ে হাত তুলে পায়ের সামনের দিকে বসিয়ে দেয় উঠিয়ে। লাবিবা চমকে পেছনে তাকাতে যাবে সে মুখ ঘুরিয়ে দেয়। চুলের গাছি খোপা খুলে দেয়। ফুলের মালা গোড়া থেকে আলতো হাতে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একদম আগা অব্দি এনে কোমড়ের উপরে ক্লিপ লাগিয়ে দেয়। দু হাতে দু হাত মুঠো করে নাক ঢুবিয়ে ঘ্রান নেয় হলদে গাদার। লাবিবা চোখ নিচের দিকে নামিয়ে রাখে। এখন ভীষন লজ্জা করছে তার।
ক্যামেরা ম্যানরা সহ বাড়ির বড়রা কখন এসে দাঁড়িয়েছে জানা নেই কারোর। সবাই নিজেদের মতো ইনজয় করতে ব্যস্ত।সময় বসে থাকে না। বেলা গড়িয়ে যাবে ভাব। মুরুব্বিরা আফসোস করে বললো,
” শুধু শুধু এদের আলাদা করে কি লাভ? ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর লোকের অযথা দুই জায়গায় প্যান্ডেল করতে গিয়ে খাটুনি হলো। ”
” সেই তো। কাছেই এতো সুন্দর জায়গা ছিল। এখানে করলেই হতো। ”
নাকিব উঠে দাঁড়ালো,
” আমরা চাইলে এখানেই বেলা ঢুবার আগে হলুদ সারতে পারি। ”
” কিভাবে?”
” চল স্ট্রেজ খুলে মালাগুলো নিয়ে আসি নৌকা সাজিয়ে ফেলি। ”
শুধু নৌকা সাজানো হলোনা। মাটির কাসায় শত শত সলতে প্রদীপ আর গাদার পাপড়ি ছড়িয়ে গেলো নদীর বুকে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে। রোজী অবাক হয়ে এতো সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো। হুট করেই তামিমের দিকে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
” ডাক্তার সাহেব আমি জীবনেও ভাবিনি আমার জীবনে এরকম একটা দিন আসবে। আমার ভীষণ সুখ লাগছে ডাক্তারসাহেব। আমিতো লোভী হয়ে যাচ্ছি। ”
” কিসের উপর?”
” নিজের উপর। নিজের অধিকারের উপর। ”
” তোমার পাশে যে আমি বসে আছি। তোমার মনে হচ্ছে না এই লোকটা তোমার থেকে প্রায় দ্বিগুন বয়সী?”
” দেহের বয়স বাড়ে মনের নয়। শক্তি সামর্থ্য আল্লাহর দান। অনেক বুড়ো মানুষ কে দেখবেন যুবকের থেকে দ্বিগুন ভাড় বেয়ে নিয়ে যাচ্ছে অথচ যুবক সেটা পারছেনা। বরং আমার মনে হয় আমিই বুড়িয়ে গেছি। আমার শক্তি কম, প্রসস্ত কম, সামর্থ্য কম। ”
” চিন্তাটা আমি মাথায় নিলাম। ”
রোজী নিঃশব্দে হাসলো। তামিম হলুদের বাটি থেকে এক আঙুলে হলুদ নিয়ে রোজীর গালে লাগিয়ে দিলো। সবাই একযোগে হৈ করে উঠলো। রোজী লজ্জা পেলো কিন্তু তার থেকে শতগুন বেশী হাসলো।
তানভীর ইতস্তত করছে। কারণ লাবিবার হলুদে এলার্জি আছে। লাগানো উচিত কি উচিত না সেটাই ভাবছে। সাবিনা মেয়েকে লাগাতে গিয়ে সেও ভাবছে। সবাই বলছে, ” শুরু করুন না… আমরা লাগবো তো। ”
তানভীর জানতে চাইলো, ” আম্মু কেমন এলার্জি বের হয়? ”
” গুটি গুটি। প্রেসক্রিপশন আছে ঔষধ খেলে,লাগালে কিছু হয়না। তবে সাথে সাথে নিলে ভালো। ”
” আমি ব্যবস্থা করবো ওকে?”
সাবিনা সায় দিলো। প্রথমে হালকা গালে ছুয়ালো। সবাই এক এক করে ঐখানেই একটু ছুঁইয়ে দিলো। লাবিবা চেচালো,
” একদিন লাগালে কিচ্ছু হবে না। আরে আমি ছবি নিবো তো? সুন্দর সুন্দর ছবি না থাকলে নাতি নাতনি কে কি দেখাবো?”
ভাবী হেসে ধমক দিলো,
” চুপ কর। মুখে কিছুই আটকায় না তোর। ”
” হ্যা! যদি আটকাতো… দ্যা গ্ৰেট তানভীর খানের দিলে লাব্বুর সিলমোহর লাগতো না। কোয়ালিটি আছে বস। বুঝতে হবে। ”
চারিদিকে হাসির রোল পড়ে গেলো। তানভীর বললো,
” ঘুরে বসো। ”
” হ্যা?”
” ঘুরে বসো। পা দুটো এদিকে দাও।”
লাবিবাকে ঘুরিয়ে বসিয়ে পা দুটো তানভীর কোলের উপর তুলে নিলো। ক্যামেরা ম্যানকে বললো,
” মামা ফটাফট ক্যান্ডিড চলবে। আমার বউয়ের শখ পূরণ করি। ”
তানভীর লাবিবার পায়ের উপর শাড়িটা একটু তুলে দিলো। হাত ভর্তি হলুদ লাগিয়ে দু পায়ে উপর থেকে নিচের দিকে পুরোটাই হলুদ মাখালো। মেয়েগুলোও থামলো না। পেছন থেকে কয়েকটা হাত গিয়ে লাবিবার গাল ছুঁইয়ে দিলো। ছবি তুলে চললো ফটাফট। হলুদ মাখানো পা দেখে তানভীরের প্রচুর লোভ লাগলো। সামলাতে না পেরে ঝুকে গিয়ে চুমু দিয়ে বসলো দুপায়ের পাতায়। সুরসুরি লাগতেই লাবিবা হলুদ মাখানো হাত খামচে ধরলো তানভীরের সাদা পাঞ্জাবি। খিল খিল হাসিতে মুখোরিত হলো চারিপাশ। ক্যামেরাবন্দি হলো প্রত্যেকটা মুহুর্ত। ইসস! এতো সুখ কেন?
অনেক অপেক্ষা করালাম। আশাকরি মনে সুখানুভূতি হবে।যারা এখনো পেইজটাকে ফলো দিননি শিগগিরই ফলো দিয়ে দিন। গল্প সম্পর্কে সকল আলোচনা Labiba’s Tale🧚♀ গ্ৰুপে।
চলবে ___