#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-০২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
খুন্তি হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হলেন ঈশানী। মাকে দেখতে পেয়েই তটিনী রোবা নাহারকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। ঈশানী ধেয়ে এসে খুন্তি ছুঁড়ে মা*রলে রুদ্র সেটা হাত দিয়ে ধরে নিলো। ঈশানী রাগে গজগজ করতে করতে তটিণী-র চুলের মুঠি ধরতে চাইলেন। এবার গর্জে উঠলেন রোবা নাহার। তটিনীকে আগলে নিয়ে বললেন, ‘তোমার এতো বড়ো সাহস! তুমি আমার মেয়েকে মা*রতে চাও!’
ঈশানী দমে গেলেন। কিন্তু মুখ বন্ধ করলেন না। ফুসফুস করে বললেন, ‘ওকে জিজ্ঞেস করুন আপা, আধা ঘণ্টাও তো হয়নি রুদ্র কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছে! ও এতো তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসলো কেন?’
রোবা নাহার প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে তটিনীর দিকে তাকালেন। এবার রুদ্র নিজেও ভাবনায় পড়ে গেলো।তটিণী-র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে কেন ঐশি?’
তটিনী নিজের দু’বেনী নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘আমি তো ক্লাসে গেছিলাম রুদ্র ভাই। কিন্তু..
‘কিন্তু?’
তটিনী মন খারাপ করে বলল, ‘কিন্তু স্যারের না হঠাৎ পেট খারাপ করে, সেজন্য আমাদের তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেয়।’
রুদ্র ঈশানীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাদ দাও চাঁচি আম্মা।’
ঈশানী খুন্তি নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন। রোবা নাহার ছেলের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন,’তুমি শুধু শুধু আমার মেয়ের নামে বিচার দিলে। দেখলে তো কতো ভালো ও?’
রুদ্র কথা না বলে হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলো। তটিনী মুখ বাঁকিয়ে তার বড়ো মাকে বলল, ‘দেখেছো তোমার ছেলের কাজ? সবসময় মুখটাকে বাঁকা করে রাখে। জন্মের পর মধু খাওয়াতে পারোনি?’
রোবা নাহার মুখ টিপে হেসে বললেন, বাপের মতো হয়েছে তো। দেখিস না তোর বড়ো বাবা ঝগড়া লাগলে কিরকম করে?’
তটিনীর যেনো এক আকাশসম আফসোস হলো। সে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল, ‘তোমার মতো কেন হলো না বড়ো মা?
রোবা নাহার মন খারাপ করে বললেন, ‘রাজটা তো আমার মতোই হয়েছে, মাঝ দিয়ে রুদ্র বাপের সব পেয়ে বসেছে। কি করবো বল? সবই আল্লাহর ইচ্ছে।’
তন্মধ্যে রান্নাঘর থেকে হাঁক ছাড়লেন ঈশানী, ‘তুই ফ্রেশ হতে যাচ্ছিস না কেন? আমি কি আবার আসবো?’
তটিনী দ্বিগুণ মন খারাপ চেহারায় ফুটিয়ে বলল,’দেখেছো বড়ো মা? মা আমাকে সবসময়ই ধমকে কথা বলে শুধু। একটু আদর করে বললে কি হতো বলো? কই তুমি তো কখনো আমাকে ধমকাও না।
রোবা নাহার তটিণী-র মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘থাক মন খারাপ করে না। তোর এক মা ধমকালে আরেক মা আদর করবে। এখন গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।’
তটিনী অবুঝ বাচ্চাদের মতো রিয়াকশন দিয়ে সবে সোফা থেকে উঠে দাড়িয়েছে। তখনই হুঙ্কার দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলো রুদ্র। তটিণী চমকে পেছনে সরে গেলো। রোবা নাহার অবাক হয়ে বললেন,’কি হয়েছে রুদু?’
রুদ্র দাত কিড়মিড় করে বলল, ‘তোমার আদরের মেয়ে ক্লাস না করে পালিয়ে এসেছে।’
রোবা নাহার হতভম্ব হয়ে তাকালেন তটিণী-র দিকে। তটিনী মাথা নাড়িয়ে মানা করলো। সে পালিয়ে আসেনি।
রুদ্র এগিয়ে এসে বেনী ধরে টান মা*রলো। তটিনী ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকিয়ে বলল,’দেখেছো বড়ো মা?
রোবা নাহার তেড়ে এলেন, ‘তোমার এতো বড়ো সাহস রুদু!
রুদ্র নিজের মোবাইলের স্কিন তুলে ধরলো। বলল,’দেখো তোমার আদরের দুলালির কান্ড! স্যারের কিসের পেট ব্যথা? বরং ওর নিজেরই পেট মুচড় দিচ্ছিল কবে ক্লাস থেকে বের হয়ে এসেছে। অভিনয় করেছে ও, স্যারকে বলেছে ওর নাকি পেট ব্যথা!’
রোবা নাহার কিছু বলবেন তখনই রান্নাঘর থেকে আবারও বের হলেন ঈশানী। মাকে দেখে তটিনী এক দৌড় দিলো। সিঁড়ি দিয়ে পৌছাল নিজের ঘরে। তারপর দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে লাগলো। আজ তার কপালে দুঃখ আছে। আর সে-ই দুঃখ তার রুদ্র ভাই লিখেছেন। তটিনী জানে আপাতত রুদ্র ভাই ছাড়া তাকে কেউ মায়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না।
*
ধরনীর বুকে কালো কালো ভাব। সময়টা বৈশাখমাস। আবহাওয়া জানান দিচ্ছে কালবৈশাখী ঝড়ের। নিজ রুমের বিছানায় শুয়ে একমনে উপন্যাসের বই পড়ে চলেছে তটিনী। দুপুরে রোবা নাহার এসে খাবার দিয়ে গেছিলেন। সেটা খেয়েই সে উপন্যাসের বই পড়া শুরু করেছে। আপাতত তার হাতে রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের শুভ্র সমগ্রের একটি বই। ‘দ্বার’চিনি দ্বীপ। শুভ্র ও তার বন্ধুরা দ্বার’চিনি দ্বীপে গিয়েছে অবশেষে অনেক কিছু পেরিয়ে। তটিণী-র মস্তিষ্কে চট করে একটি প্রশ্ন আসলো। রুদ্র ভাই ও কি তার বন্ধুদের নিয়ে ‘দ্বার’চিনি দ্বীপে যাবে?’ মুঠোফোন হাতে নিয়ে রুদ্রকে একের পর এক বার্তা পাঠাতে শুরু করলো তটিনী। যেভাবেই হোক তাকে জানতে হবে। বইটা পড়ে তার নিজেরও এখন ‘দ্বার’চিনি দ্বীপে যেতে ইচ্ছে করছে।
নিজের রুমের পড়ার টেবিলে বসে আছে রুদ্র। হাতে মুঠোফোন। ফেসবুক ঘুরতে ঘুরতে মেসেজের আসার শব্দ বেজে উঠলো। মেসেঞ্জারে প্রবেশ করতেই তটিণী-র আইডি থেকে আসা মেসেজ চোখে পড়লো তার। মেসেজ সিন করলো রুদ্র। তটিনী লিখেছে, ‘আপনি কি দ্বার’চিনি দ্বীপে যাবেন রুদ্র ভাই?’ বলুন না প্লিজ।
রুদ্র টাইপ করলো, ‘একই বাড়িতে থেকে মেসেজ দেওয়াটা কোন ধরনের ম্যানার? যা বলবি সামনাসামনি এসে বল। তাহলে তোর প্রশ্নের উত্তর পাবি।
রুদ্রের পাঠানো মেসেজ সিন হলো সেকেন্ডের সাথে। তটিনী লিখলো, ‘ঠিক আছে আসছি।’
তার ঠিক এক মিনিট পর রুদ্রের রুমের দরজায় টুকা পড়লো। কেউ ফিসফিস করে ডাকলো, ‘রুদ্র ভাই?’
রুদ্র গলা তুলে বলল, ‘দরজা খুলা আছে।’
তটিনী শোনা মাত্রই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়লো। ভালো করে দরজা লক করে রুদ্রের সামনে এসে দাড়ালো। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘দরজা লক করেছিস কেন?’ মতলব কি তোর ঐশি?’
তটিনী ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘হঠাৎ যদি মা চলে আসে? জানো না মা আজ রেগে আছে আমার উপর?
রুদ্র চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। অন্য সময় হলে হয়তো তটিনী বলতো, ‘জানেন না নাকি? আপনার কারণে মা আমার পিছনে পড়েছে। না মে*রে শান্ত হবে না। সব দোষ আপনার রুদ্র ভাই। আপনি যদি মা’কে কিছু না বলতেন তো মা আমার উপর ক্ষেপে যেতো না। এখন আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন দরজা লক করেছি! দরজা শুধু আপনার একা নেই আমারও আছে। হুহ!’
নিজের ভাবনা থেকে বের হলো রুদ্র। চোখমুখ স্বাভাবিক করে বলল, ‘কি জানতে চাস?’
তটিনী চোখেমুখে বিরক্তি লুকিয়ে বলল, ‘আপনি কি দ্বার’চিনি দ্বীপে যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ।’
তটিনী ‘ইয়াহু’ বলে চিৎকার করলো। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এতো খুশি হচ্ছিস কেন?’
‘আপনি আমাকে আপনার সাথে নিবেন প্লিজ প্লিজ প্লিজ।’
‘তোকে কেন নিতে যাবো? হু আর ইউ?’
তটিনী অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল, ‘এমন করবেন না রুদ্র ভাই। আমি সত্যিই যেতে চাই। প্লিজ?’
রুদ্র চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ক্লাস ফাঁকি দেওয়া মেয়েকে আমি আমার সাথে ঘুরতে নিতে পারবো না৷ যে মেয়ে বড়দের সম্মান করতে জানে না তাকে তো কখনোই না।’
তটিনী কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল, ‘তাহলে আপনি সত্যিই নিবেন না?’
‘না।’
‘আমি আর কখনো ক্লাস ফাঁকি দিবো না রুদ্র ভাই। দ্বার’চিনি দ্বীপ ঘুরে এসে মন লাগিয়ে ক্লাস করবো। স্কুলেও নিয়মিত যাবো। বান্ধবীদের চুলে ধরে টানবো না। আইসক্রিম ফুচকাও খাবো না। হোমওয়ার্ক করবো নিয়মিত৷ আপনার শার্টে কখনো সর্দি মুছবো না।’
বলতে বলতে নাক টেনে রুদ্রের শার্টে সর্দি মুছলো তটিনী। রুদ্র একটানে নিজের শার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলে কটমট করে তাকালো। তটিনী কিটকিট করে দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘আপনি যদি আমাকে নিয়ে না যান তো এখন আমি চিৎকার করবো।’ বলব আপনি আমাকে রুমে জোর করে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।’
রুদ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বলল, ‘এসব কোথা থেকে শিখেছিস?’
তটিনী চোখ মে*রে বলল, ‘বড়ো মা জি বাংলা দেখে না?, সেসব আমিও দেখেছি।’
রুদ্র কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, ‘বের হয়ে যা এখনি।’
‘আগে বলুন নিয়ে যাবেন।’
রুদ্র আগুন চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তুই যদি এখন না বের হোস তো আমিও চিৎকার করে বলবো, ‘তুই আমার ইজ্জত লুটতে আমার রুমে এসে দরজা বন্ধ করেছিস।’
তটিনী মুখে হাত দিয়ে বলল, ‘এটা বলবেন না রুদ্র ভাই, আমি চলে যাচ্ছি।’বলেই তটিনী দৌড়ে বের হয়ে গেলো।রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘বোকা মেয়ে এটা জানে না যে আদিম যুগ থেকে মেয়েদের ইজ্জত হরনের কাহিনি হয়ে আসছে। কিন্তু আজও পুরুষের ইজ্জত হরনের কাহিনি হয়নি। কেউ বিশ্বাসও করবে না। রুদ্র শব্দ করে হেসে বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খেলো। বেশ জব্দ করতে পেরেছে সে। এবার একটু শুধরে গেলে হয় এই মেয়ে!’
(চলবে)