#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-০৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
বাস যখন টেকনাফ এসে থামলো তখন তটিনী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ। সকালের মৃদু হাওয়ায় দুলা দিয়ে যাচ্ছে মানুষের মন। রুদ্র প্রথমে মৃদুস্বরে ডাকলো, ‘ঐশি? ঐশি উঠ।’
কিন্তু কোনো আওয়াজ দিল না তটিনী। বরং নাক ডাকতে লাগলো। রুদ্র হতভম্ব হয়ে চারিদিকে তাকালো। ভাগ্যিস সবাই তখনো ঘুমে। এই প্রথম তটিনীকে নাক ডাকতে দেখছে রুদ্র। তার মনে পুরনো ক্ষুভ জেগে উঠলো। স্মার্টফোন বের করে রেকর্ডার অন করলো। তাতে রেকর্ড হলো তটিণী-র নাক ডাকার গান।
ফোন পকেটে রেখে এবার রুদ্র কানের কাছে মুখ নিলো। ডাকলো, ‘ঐশি?’
তটিনী হুম জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘হুম?’
‘উঠ, পৌঁছে গেছি তো।’
তটিনী জবাব দিলো না। বাধ্য হয়ে রুদ্র হাত দিয়ে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলো। তটিনী ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে বলল, ‘যদি পড়ে যেতাম মাথা ঘুরে? আপনি তার দায়ভার নিতেন রুদ্র ভাই?’
রুদ্র সাইট দিয়ে বের হয়ে গেলো। বলল, ‘এতো কথা শুনার টাইম নাই। বের হো জলদি। বলে রুদ্র বাকিদের ডাকতে শুরু করলো। একে একে সবাই জেগে গেলো। ব্যাগপত্র কাঁধে নিয়ে নামতে লাগলো সবাই বাস থেকে।
টেকনাফের দমদমিয়া এলাকায় এসে থেমেছে বাসটি। সকালের নাস্তা সেখাসেই সেরে নিলো তারা। এখান থেকে কয়েকটি ঘাটের দিকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জাহাজগুলোর অবস্থান। রুদ্ররা কেয়ারি ক্রুজ অ্যান্ড ডাইনিংয়ের দ্বিতীয় তলার টিকিট নিলো। ভাড়া পড়লো আসা-যাওয়া জনপ্রতি দেড় হাজার টাকা।
তটিনী দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘আমার তো ভাড়া নিয়ে চিন্তা নেই। যা দেওয়ার রুদ্র ভাই দিবে। কারণ আমি তো তার দায়িত্বেই বাসা থেকে বের হয়েছি।’
তটিণী-র কথা শুনে রুদ্র ফটাফট বলল, ‘বাড়ি থেকে বের হবার পর না আমরা কেউ কারো কিছু লাগি না? তুই না বলেছিস আমি তোর কাজিন হই না? তবে এখন কিসের দায়িত্ব? আমি কোনো ভাড়াটারা দিবো না। তোর ভাড়া তুই-ই দে।
তটিনী কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, ‘ওমা আমি কি সিরিয়াসলি বলেছি নাকি? আমি তো তখন মজা করে বলেছি।’
রুদ্র দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘তাই?’
তটিনী মুখ কাচুমাচু করে বলল, ‘দিয়ে দিন না রুদ্র ভাই। আমার কাছে মাত্র পাঁচ হাজার আছে। ওগুলো তো সেন্টমার্টিনে শপিং করতেই চলে যাবে।’
রুদ্র কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। শেষ পর্যন্ত সেন্টমার্টিনে শপিং! সিরিয়াসলি।
টিকিট কাটার পর নিতে হলো গেট পাস। পানির ওপর কাঠের তৈরি করিডোরের মতো প্রায় ২০০ মিটার লম্বা ব্রিজ। সেটা পেরোনো সহজ ছিল না তটিনীর জন্য। সে রুদ্রের হাত ধরে হেলেদুলে ধীরে ধীরে জাহাজে উঠলো।
রুদ্র ও তটিণী-র পেছন পেছন উঠলো বাকি পাঁচজনও।
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজ যেন স্বাগত জানালো। চারদিকে অপরূপ পরিবেশ। সবুজের সমারোহ। দূরে আরও জাহাজ চোখে পড়লো সবার। একে একে লোকজনে ভরে উঠছে রুদ্রদের জাহাজ। দ্বিতল জলযানটি ছাড়লো সকাল নয়টার কিছুক্ষণ পর। মন নেচে উঠলো তটিণী-র। সে রুদ্রের হাত চেপে ধরে বলল, ‘সবকিছু এতো সুন্দর কেনো রুদ্র ভাই?’
রুদ্র হেসে বলল, ‘আরও অনেক কিছু দেখার বাকি এখনো। এনজয় করে যা ধীরে ধীরে সব দেখতে পাবি।’
‘আপনি কি আগে কখনো সেন্টমার্টিনে গিয়েছিলেন রুদ্র ভাই?’
রুদ্র সবুজ সমারোহের দিকে তাকিয়ে চোখ জোড়াতে জোড়াতে বলল, ‘ক্লাস ফাইভে থাকতে গেছিলাম একবার। তখন তুই পুচকি ছিলি।’
টেকনাফে নদীর পাশে পাহাড়। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনের দূরত্ব প্রায় ৪২ কিলোমিটার। ২৫ কিলোমিটার নাফ নদী আর বাকি ১৭ কিলোমিটার খোলা সাগর। পথটুকু পাড়ি দিতে লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। মূলত এটি কোনও নদী নয়, বঙ্গোপসাগরের বর্ধিত অংশ। তবুও এর স্থায়ী পরিচয় নাফ নদী। এর পানি সাগরের মতোই লবণাক্ত। নদী মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে দু’ভাগ করেছে। পশ্চিম পাড়ে বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলা এবং পূর্ব পাড়ে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের আকিয়াব।
নদীটা যখন পেরিয়ে যাচ্ছিল তখন চঞ্চল তটিনী আবেগে চোখের জল ছেড়ে আবারও বলেছিল, ‘সবকিছু এতো সুন্দর কেন রুদ্র ভাই?’
রুদ্র ভেবেছিলো শুধু জল দেখা হবে, টেকনাফে অনেক পাহাড়ও চোখে পড়লো। নদীর কোল ঘেঁষে আছে গাছের সারি, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য আর নীল আকাশ। সব মিলিয়ে অপূর্ব। রুদ্র সেই অপূর্ব দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করতে করতে বলেছিল, ‘তোকে একদিন পুরো দেশ ঘুরাবো ঐশি। আরও কতো কিছু রয়েছে আমাদের বাংলাদেশে। এতো সবুজে ভরা দেশ আর কোথাও নেই।’
জাহাজের পিছু পিছু খাবারের লোভে উড়ে আসছে গাঙচিল। একসময় জাহাজ পেরিয়ে গেলো শাহ পরীর দ্বীপের শেষ অংশ বদর মোকাম চর। সাগরের নীলাভ জল মন ভিজিয়ে দিলো। এত অপরূপ বাংলা! কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে নাফ নদী ও ওপারে মিয়ানমার সীমান্তের সৌন্দর্য দেখছে। সাগরের হাওয়ায় ভেসে যেতে লাগলো সবার মন।
নাফ নদীর পাড় ঘেঁষে মিয়ানমারের সঙ্গে কাঁটাতারের সীমান্ত। সাগরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জাহাজ। সাগর ও নদীর পানির ভিন্ন দুই রঙ, কী বিচিত্র লীলা! মাঝে মধ্যে সবাই জাহাজের ভেতরে ঢুকে খানিক বিশ্রাম নিয়েছে। সাগরের নীল জলে সাদা ফেনার খেলা। সাগর ও নাফ নদীর মোহনায় জেলে নৌকা দেখা যাচ্ছিল। সোনার বাংলার অপরুপ সৌন্দর্যে নেচে উঠছিল প্রতিটি প্রাণ।
দীর্ঘ ক্লান্তিহীন ভ্রমণ শেষে সবাই নামলো প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের ঘাটে। জাহাজ থেকে নামার পর আগে থেকে ভাড়া করা রিসোর্টে যাওয়ার জন্য টমটম নেওয়া হলো। ভাড়া পড়লো একশো টাকা। রিসোর্টের পাশেই সৈকত। দেখে মন জুড়িয়ে গেলো তটিণী-র। হাতের ব্যাগ ফেলে দৌড়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। রুদ্র ক্যামেরা নিয়ে পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে বললো, ‘আস্তে আস্তে যা পড়ে যাবি তো।
রুদ্রের ক্যামেরায় বন্দি হলো সৈকতের মোহনীয় মায়ায় আটকে পড়া তটিণী-র অপরুপ সোনার মতো ছবি। অবশেষে দারুচিনি দ্বীপের দেশে রুদ্রের সাথে পৌঁছেই গেলো তটিনী ইফফাত ঐশি!
প্রায় ২৫০ বছর আগে আরব ব্যবসায়ীরা প্রথম এই দ্বীপে আসেন। তারা এর নাম দেন ‘জিঞ্জিরা’। পরবর্তী সময়ে পর্তুগিজ জলদস্যুরা দ্বীপটির নাম রাখে ‘সিনামন আইল্যান্ড’, বাংলায় দারুচিনি দ্বীপ। ব্রিটিশ শাসনামলে চট্টগ্রামের ডিসি মার্টিনের নামে এর নামকরণ হয় ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপ’। এখানকার অধিবাসীদের আগমন ঘটে বহু বছর আগে। টেকনাফ থেকে কিছুসংখ্যক জেলে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে এসে দ্বীপটির সন্ধান পায়। এরপর তারা স্থায়ী বসতি গড়ে। শুরুতে সাতটি পরিবার ছিল বলে জানা যায়। পরে এসব পরিবারের সূত্রেই আসতে থাকে আরও লোক। বর্তমানে দ্বীপটিতে প্রায় সাত হাজার লোকের বসবাস।
পুরো দ্বীপে নয়টি গ্রাম, একটাই ইউনিয়ন। পর্যটকদের নিরাপত্তা এখানকার মানুষের অগ্রাধিকার বিষয়। তাই যে কেউ অবাধে যেকোনও সময় ঘুরতে পারেন সাগরপাড়ে। জীবিকা বলতে মাছ ধরা, ধানচাষ, তরমুজ চাষ ও নারিকেল। নারিকেল গাছ বেষ্টিত এ দ্বীপে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা বেড়াতে আসে। পর্যটকদের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল হোটেল।
দ্বীপটিতে তটিণী-রা ছিল মোট দু’দিন। দ্বীপটি দেখলে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। প্রবাল পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটার অনুভূতি অন্যরকম। দূরে জেলে নৌকার দেখা মেলে। দ্বীপের কয়েকটি জায়গা থেকে সাইকেল ভাড়া নেওয়া যায়। সাইকেল নিয়ে সৈকতে ঘোরা যাবে। তটিনী বায়না করেছিল সে সাইকেলে ঘুরবে। অগত্যা রুদ্র সাইকেলেও ঘুরিয়ে ছিলো।
বিকালে দ্বীপ ঘুরতে বের হওয়াটা ছিল উপভোগ্য। হাঁটতেই ভালো লাগে বেশি। ঘুরতে ঘুরতে হুমায়ুন আহমেদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি সমুদ্র বিলাসের সামনে গেছিলো তারা। প্রয়াত নন্দিত এই কথাসাহিত্যিক এটি গড়ে তুলেছিলেন। সেই সমুদ্র বিলাসের সামনে ক্লিক করা হলো একটি গ্রুপ ফটো। রুদ্রসহ ছয়জনের সাথে জায়গা করে নিয়েছিল চঞ্চল তটিনী নামের মেয়েটি!
ঘুরতে ঘুরতেই বেলা গড়িয়ে গোধূলি। অনেকে বেলাশেষে সাগরপাড়ে নিজেকে দেখবেন বলে ভিড় করে। সূর্যাস্তের ক্ষণ ঘনিয়ে আসছিলো। সবাই দারুণ উচ্ছ্বাসে সূর্যাস্ত দেখেছিল। বলে রাখা ভালো, রাতে সৈকতে বসে সাগরের গর্জন শোনার মধ্যে আছে অন্যরকম আনন্দ। তটিণী-রা সেই আনন্দ উপভোগ করেই তিনদিনের ট্যুর শেষে বাড়ি ফিরেছিল।
(চলবে)
(প্রয়োজনীয় বিষয় গুলো গুগল থেকে নেওয়া।)