প্রিয়_রুদ্র_ভাই #পর্ব-০৬ #তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

0
177

#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-০৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

রুদ্রের ভার্সিটি বাসা থেকে প্রায় দেড় ঘন্টা দূরত্বে। সেজন্য সে বাইক ব্যবহার করে। দারুচিনি দ্বীপ থেকে আসার পর বন্ধুদের সাথে আর আড্ডা দেওয়া হয়নি। আজকেই দ্বিতীয় ইয়ারের ক্লাস শুরু তাদের। তীব্র আগ্রহ নিয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে রুদ্র যখন বাইকে বসে মাথায় হেলমেট পড়ছিল, তখনই কাধে স্কুল ব্যাগ নিয়ে দুবেনী নাচিয়ে হেলেদুলে এসে দাড়ালো তটিনী। রুদ্র হেলমেট পড়ে নিয়ে বলল, ‘স্কুলে যাচ্ছিস?’

তটিনী নাক ফুলিয়ে বলল, ‘স্কুল ড্রেস পড়ে কি মানুষ টয়লেটে যায় নাকি?’

রুদ্র নিজের মুখ সামলে নিলো। কোনো বাক্যব্যয় না করে বাইক স্টার্ট দিতেই তটিনী চট করে পেছনে বসে পড়লো। রুদ্র চোখমুখ কুঁচকে বলল, ‘পেছনে বসেছিস কেন?’

‘তো কি সামনে বসবো? আমার আপত্তি নেই, হিন্দি সিনেমায় নায়িকারা সামনে বসে। আমি দেখেছি।’

তটিণী-র নির্লিপ্ত উত্তরে রুদ্রের গলা শুকিয়ে গেলো। হালকা কেশে বলল, ‘তুই বাড়ির গাড়ি দিয়ে স্কুলে যা।’

তটিনী মন খারাপ করে বলল, ‘আজ আমার বান্ধবী ললিতা স্কুলে যাবে না রুদ্র ভাই। সেজন্য আমার একা যেতে ভালো লাগছে না। তুমি প্লিজ পৌঁছে দাও।’

‘তো গাড়িতে যা না, ড্রাইভার চাচা পৌঁছে দিবে।’

তটিনী মুখ ছোট করে বলল, ‘গাড়িতে যেতে ভালো লাগে না সবসময়। ললিতার সাথে হেঁটে হেঁটে যেতে ভালো লাগে।’

রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কি হইছে ললিতার?’

তটিনী মুখ কাঁদো কাঁদো করে বলল, ‘ওর অনেক জ্বর রুদ্র ভাই।’

রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘ধরে বস, তোকে পৌঁছে দিয়ে আমাকে ভার্সিটিতে যেতে হবে।’

রুদ্র নিজের হেলমেট খুলে তটিনীকে পড়িয়ে দিলো। তারপর বাইক পুনরায় স্টার্ট দিলো। তটিনী পেছন থেকে শক্ত করে দুহাত দিয়ে ধরে বলল, ‘এতো আস্তে চালাচ্ছেন কেন? আরও জোরে চালান।’

রুদ্র স্প্রিড বাড়ালো। হাওয়ায় বেগে ছুটতে লাগলো বাইক। তটিনী একহাত দিয়ে রুদ্রের চুল মুঠো করে ধরলো। রুদ্র তৎক্ষনাৎ বাইক থামিয়ে নিলো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘তোকে আমাকে ধরে বসতে বলেছি। চুল ধরে বসতে বলিনি ফাজিল!’

তটিনী চোখমুখ কাচুমাচু করে বলল, ‘না ধরলে পড়ে যেতাম তো। ভয় করছিল।’

‘তাহলে বললি কেন স্প্রিড বাড়াতে? বেয়াদব মহিলা একটা।’

তটিনী ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘আমি মহিলা নই রুদ্র ভাই। আমি তো মেয়ে!

রুদ্র কথা না বাড়িয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। তটিণী-র স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে স্প্রিড বাড়িয়ে হাওয়ার বেগে ছুটে গেলো। তটিনী সেদিকে তাকিয়ে মুখ বাকিয়ে বলল, ‘এহ্ ভাব!’

*
গোধূলি বিকেল। তটিনী বাসায় ফিরে একটার দিকে। মাঝে মধ্যে তো সাড়ে বারোটার মধ্যে চলে আসে। সেই মেয়ে আজ বিকেল হয়ে গেলো তবুও এখনো বাসায় আসেনি। ব্যাপারটা চিন্তার না? অবশ্যই চিন্তার। ইতিমধ্যে হুলস্থুল পড়ে গেছে তটিণী-র বাড়ির মধ্যে। রোবা নাহার কেঁদেকেটে একাকার। ঈশানী কান্না আটকে রেখে তাহের ও তাহসিনকে লাগাতার কল করছেন। কিন্তু কেউ-ই ফোন রিসিভ করছেন না। আজ রুদ্রও বাসাতে ফেরেনি। রাজ ও তুরফান আজ মাঠে খেলতে যায়নি। এক কোণে মন খারাপ করে দাড়িয়ে আছে। দুজন মিলে তটিণী-র বান্ধবী ললিতার বাড়িতে খুঁজ নিয়েছে। কিন্তু ললিতা আজ স্কুলে যায়নি জ্বরের কারণে। স্কুলের টিচারদের থেকে কিছু জানা যায়নি। তারা যথাসময়ে স্কুল ছুটি দিয়ে দিছে। তারপর কে কোথায় গেছে সেটা তারা জানে না।

ঈশানী হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তার চঞ্চল মেয়েটি ছাড়া বাড়িটা খা খা করছে। আহাজারি করে বললেন, ‘কোথায় গেলি মা, তটিনী ফিরে আয় সোনা৷ মা তোকে আর বকবো না।’

রোবা নাহার চোখের জল মুছে তাহসিন ইরফানকে কল দিলেন। এইবার কল রিসিভ হলো। ধরেছে তাহসিন ইরফানের এসিস্ট্যান্ট। বলল, তারা দুজন মিটিংয়ে রয়েছেন।’

রোবা নাহার রেগে চিৎকার করে বললেন, ‘তোমার স্যারকে গিয়ে বলো তার মিটিং থেকেও জরুরি কিছু এদিকে শেষ হয়ে যাচ্ছে।’

এসিস্ট্যান্ট ছেলেটি ভড়কে গিয়ে বলল, ‘আমি এক্ষুনি স্যারকে ইনফর্ম করছি ম্যাম।’

তার ঠিক তিন মিনিটের মাথায় তাহসিন ইরফান ফোন ব্যাক করলেন। তড়িৎ গতিতে বললেন, ‘কি হয়েছে রোবা?

রোবা নাহার রাগে ফেটে পড়লেন। ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘তোমরা দুভাই থাকো তোমাদের মিটিং নিয়ে। এদিকে আমার মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছি না। তোমাদের তো কিছু না। তোমরা তো জন্ম দিয়েই রেহাই পেয়ে গেছো। আমার মেয়ের কিছু হলে আমি তোমাদের দুভাইকে দেখে নিবো ইরফান।’

কল লাউঞ্জে ছিল। তাহের ইফফাত তড়িঘড়ি করে ফোন কেঁড়ে নিয়ে বললেন, ‘মানে কি হয়েছে ভাবি? আমার মেয়ে কোথায়?’

রোবা নাহার কল কেটে দিলেন। আধা ঘণ্টা পর বাড়িতে এসে পৌঁছালেন দু’ভাই। নিজের স্ত্রীদের সামলাতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা তাদের। মেয়ের চিন্তায় পাগল পাগল অবস্থা সবার। দু ভাই মিলে কোনো জায়গা বাদ রাখেন নি। যতো আত্নীয় স্বজন আছে সবাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছেন তটিনী গিয়েছে কি না।

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামতেই বাড়িতে কান্নার রুল পড়লো। চিৎকার করে কাঁদার আহাজারি শুনা যাচ্ছে শুধু। তুরফান ও রাজ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। বহুদিন পর ভার্সিটিতে গিয়ে নোট কালেক্ট করতে করতে ও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে রুদ্র বাড়িতে পা রাখলো সন্ধ্যার দিকে। কান্নার শব্দ কানে যেতেই বুক ছ্যাঁত করে উঠলো তার।

বাইক ফেলে দৌড়ে এসে ঢুকলো বাড়িতে। মেঝেতে বসে ঈশানীর মাথায় পানি ঢালছেন রোবা নাহার। রুদ্র শুকনো ঢুক গিলে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে মা?’

রোবা নাহার হেঁচকির কারণে কথা বলতে পারছেন না। রুদ্র চারিদিকে তাকালো। তটিনী ছাড়া সবাই উপস্থিত। নিজের বাবা চাচাকে সোফায় মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে তার মাথা ঘুরে গেলো। মনে মনে প্রার্থনা করলো সে যা ভাবছে তা যেনো সত্যি না-হয়। তুরফান ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো। রাজ ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘বুড়িকে খুঁজে পাচ্ছি না ভাইয়া। ও আজ বাসায় আসেনি। আমরা সব জায়গায় খুঁজেছি।

রুদ্র বুকে হাত চেপে ধরলো। জোরে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘স্কুলে খুঁজ নিস নি তোরা? বাসায় আসেনি মানে কি? তোরা দুটো বাসায় থাকতে ও কিভাবে বাসায় আসে না? তোরা ওকে দেখে রাখতে পারিস নি?

রুদ্র মেঝেতে বসে পড়লো। রোবা নাহার রুদু বলে চিৎকার করে উঠলেন। তার হার্ট দূর্বল ছেলেটির শেষে হার্ট অ্যাটাক না হয়ে যায়।

রুদ্র মুখ নিচু করে বলল, ‘আমাকে জানানো হয়নি কেন মা?

রোবা নাহার শাড়ির আচল দিয়েুখ চেপে ধরে বললেন, ‘তোর হার্ট দূর্বল রুদু। দেখেছিস এখনই কেমন করছিস? কিভাবে তোকে আমি জানাতাম বল?’

রুদ্র চোখের জল ছেড়ে দিলো। ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে বলল, ‘আমি ওকে নিজে সকালে স্কুলে দিয়ে গেছি। তোমরা ওর একটু খেয়াল রাখতে পারলে না! এখন আমি ওকে কোথায় খুঁজবো মা?

রুদ্র পাগলের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। তাহের ইফফাত ও তাহসিন ইরফান আবারও বের হলেন খুঁজতে। রুদ্রদের হাসিখুশি বাড়িটি কয়েক ঘন্টাতে বিধ্বস্ত রুপ ধারণ করলো যেনো।

বাইকের গতি বাড়িয়ে ছুটে চলেছে রুদ্র। একের পর এক জায়গায় গিয়ে ঐশি বলে চিৎকার করে ডাকছে। খুঁজতে খুঁজতে একসময় রাস্তার পাশে বুকে হাত চেপে বসলো সে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে আগুন জল। রুদ্র মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো। অনুনয় করে বলল, ‘ওকে ফিরিয়ে দাও গড। যেখানেই থাকে যেনো সুস্থ থাকে। ওকে দেখো। ওর যেনো কোনো ক্ষতি না-হয়। প্লিজ!

রুদ্রকে এমুহূর্তে কি বলা যায়? এতো যন্ত্রণা সবকিছু কি শুধু একজন কাজিনদের জন্য? নাকি গভীরে রয়েছে অমূল্য কোনো অনুভূতি?’

(চলবে)

(কষ্ট পাবেন না, আগামী পর্বে তটিনী আসবে।😐)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here