প্রিয়_রুদ্র_ভাই #পর্ব-০৮ #তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

0
168

#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-০৮
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

তটিণী-র কাজিনমহলে ভরে গিয়েছে বাড়ি। রাত তখন দশটা। চিৎকার চেচামেচিতে রুদ্রের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি তটিণী-র গলাই বেশি শোনা যাচ্ছে। রুদ্র মাথা চেপে ধরে উঠে বসলো। ভার্সিটি থেকে এসে এখনো ফ্রেশ হওয়া হয়নি তার। শরীর ম্যাচ ম্যাচ করছে। রুদ্র একটানে টিশার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেললো। হেলেদুলে ওয়াশরুমে ঢুকলো শাওয়ার নিতে।

তটিণী-র কাজিনমহল তেমন বড়ো না৷ তটিণী-র মা ঈশানীর এক বোন রয়েছে। যিনি ঈশানীর ছোট। তারই দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে রয়েছে যারা তটিণী-র সাথে বর্তমানে হৈ-হুল্লোড় করছে। বাকি রইলো রুদ্রের গোষ্ঠী। রুদ্র ও তটিণী-র বাবার দিক থেকে আবার গোষ্ঠী ভীষণ বড়ো। রুদ্র ও তটিণী-র দাদা ছিলেন বিরাট বড়োলোক। বারিধারায় তার বিশাল পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে। যেটাতে কেউ থাকে না। পুরান আমলের হওয়ায় সেটাতে কারো তেমন যাতায়াত নেই। রুদ্রের বাবা চাচা ভেবে রেখেছেন ওটা পুনরায় মেরামত করে এতিমখানা বানাবেন।

তাহসিন ইরফানের চাচাতো ভাই-বোন রয়েছেন দুজন। তাদের ছেলে-মেয়ে আবার পাঁচজন। একজনের দুই ছেলে এক মেয়ে। আরেকজনের এক ছেলে এক মেয়ে। চাচাতো ভাইয়ের নাম আশফাক আহমেদ। তার ছেলেদের নাম ‘আষাঢ় আহমেদ ও আশফি আহমেদ। মেয়ের নাম আলপনা আহমেদ।

আষাঢ় অনার্স শেষ করে মাস্টারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আশফি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আলপনা ইন্টার শেষ করে অনার্সে এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তাহসিন ইরফানের চাচাতো বোনের নাম আশারিয়া আহমেদ। স্বামীর নাম ওবায়দুল দেওয়ান। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। নাম ‘শশি দেওয়ান ও শিশির দেওয়ান।’ শিশির রাজ ও তুরফানের সমবয়সী। শশি আশফির মতোই অনার্স এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এই হলো রুদ্র ও তটিণী-র গোষ্ঠীর ডিটেইলস। রুদ্রদের ডোয়িং রুমের সোফাতে বসে আছেন সবাই। কতো’দিন পর ভাই বোন একসাথে। রোবা নাহার ও ঈশানী একের পর এক নাস্তা পানি তৈরি করছেন। আশারিয়া আহমেদের যত্নের কোনো ত্রুটি রাখছে না কেউ। যতোই হোক তিন ভাইয়ের মধ্যে এক বোন সে। আশারিয়া আহমেদ গাজিপুরে থাকেন। আশফাক আহমেদ থাকেন শাহবাগে। তটিণী-রা থাকে মিরপুরে।

*
শাওয়ার নিয়ে নিচে নামলো রুদ্র। তটিনী তখনও এদিক সেদিক ছুটছে। সাথে ছুটছে তার খালাতো দুই ভাই বোন। রুদ্র মৃদুস্বরে ধমক দিয়ে বলল, ‘এতো দৌড়াদৌড়ি করছিস কেন তোরা? এই তুই না একটু আগে মাথায় সেলাই নিয়ে বাসায় ফিরলি? এতো বড়ো কান্ড করেও এখন দৌড়াদৌড়ি করছিস।’

তটিনী এক কোণায় চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। বাচ্চা দুটো ভয় পেয়ে তাদের মা বাবার কাছে চলে গেছে। তটিনী মিনমিন করে বলল, ‘এতো ধমকাচ্ছেন কেন? একটু তো দৌড়েছিই।’

রুদ্র কথা না বাড়িয়ে সোফার দিকে চল গেলো। সবাইকে সালাম দিয়ে বসে পড়লো। কাজিনদের সাথে হাই হ্যালো করে রান্না ঘরে ঢুকলো। রোবা নাহার তখন মাংস রান্না করছেন। রুদ্র নিজের হাতে খুন্তি নিয়ে তরকারি নাড়তে লাগলো। রোবা নাহার ছেলের কান্ডে হেসে বললেন, ‘আমাকে দে আমি পারবো।’

রুদ্র দিলো না বলল, ‘তুমি বরং সবজি কাটো। আমি দেখছি এটা। শিলা আন্টি কবে গ্রাম থেকে ফিরবেন? তোমার ও চাঁচি আম্মার উপর অনেক ধকল চলে যাচ্ছে তো।’

রোবা নাহার শসা কাটতে কাটতে বললেন, ‘অনেক দিন পর বেড়াতে গিয়েছে বেচারি। থাক আসুক তৃপ্তি ভরে থেকে। আমি আর তোর চাঁচি সামলে নিতে পারবো সমস্যা হবে না।’

রুদ্র মাংস রান্না করে মাছ ভাজতে শুরু করলো। তখনই তটিনী ঢুকলো রান্না ঘরে। নাক টেনে মাছ ভাজার গন্ধ নিয়ে বলল, ‘আহ্, বড়ো মা আমাকে মাছ ভাজা দাও খাবো।’

রুদ্র গম্ভীর গলায় বলল, ‘বিড়াল নাকি তুই?’ মাছের গন্ধ পেয়ে চলে এসেছিস।’

তটিনী মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘কাজ করছেন সেটাই করুন। মালকিনের সাথে তর্ক করতে আসবেন না।’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘মালকিন? আর তুই?’ ফু দিলেই তো উড়ে যাবি।’

তটিনী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘তোমার ছেলেকে বলো আমাকে মাছ ভাজা দিতে। নাহলে কিন্তু আমি চিৎকার করবো বড়ো মা।’

রোবা নাহার হেসে বললেন, ‘দিয়ে দে রুদু, বেচারি অনেক রক্ত খুইয়ে এসেছে।’

রুদ্র প্লেটে মাছ ভাজা দিয়ে বলল, ‘নে, আর চাইবি না। বিড়াল কোথাকার!

তটিনী মাছের প্লেট নিয়ে চলে গেলো। রোবা নাহার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শুধু শুধু ওর সাথে লাগিস।’

রুদ্র কিছু না বলে হাসলো। মাছ ভাজা শেষ করে মাছের তরকারি বসিয়ে দিলো। ভাত আগেই রান্না করা হয়ে গেছে। রোবা নাহার সবজি কাটার পর রুদ্র সেগুলো টেবিলে নিয়ে রাখতে লাগলো এক এক করে। বলা বাহুল্য রুদ্র প্রায়ই তার মা চাচিকে রান্নায় সাহায্য করে।

ঈশানী থালাবাসন পরিষ্কার করে টেবিলে এনে রেখেছেন। আজ রুদ্রদের বাড়িতে এক টেবিলে জায়গা হবেনা। একেকজন একেক জায়গায় বসে পড়েছে খেতে। কেউ সোফায়, কেউ টেবিলে কেউ বা মেঝেতে। রুদ্র মেঝেতে বসে খাচ্ছে। তার একপাশে বসেছে আশফি ও আষাঢ়। সামনাসামনি বসেছে তটিনী, আলপনা ও শশি। শিশির টেবিলে বসে চশমা ঠেলতে ঠেলতে খাচ্ছে। তটিণী-র খালাতো কাজিন দুটো নিজের মায়ের হাতে খাচ্ছে৷ মুরব্বিরা সব টেবিলে।

খাওয়া দাওয়ার পাফ চুকিয়ে সবাই এসির পাওয়ার বাড়িয়ে বসে আছেন। আশারিয়া আহমেদ হেসে বললেন, ‘অনেক দিন পর তোমাদের হাতের রান্না খেলাম। মন্দ লাগলো না ভাবি।

ঈশানী কোকা কোলা গ্লাসে ঢেলে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনাদের পেয়ে আমাদেরও অনেক ভালো লাগছে। কতোদিন পর সবাই একসাথে।’

আশফাক আহমেদ দিলখোলা মানুষ। তিনি চট করে বললেন, ‘এই ফাঁকে সবাই মিলে একসাথে একটা ট্যুর দিলে কেমন হয়?’

লাফিয়ে উঠলো তটিনী। চাচার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘অবশ্যই অবশ্যই। আমি যাবো।’

ঈশানী মেয়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। তাহসিন ইরফান আধপাকা দাঁড়িতে হাত ভুলিয়ে বললেন, ‘যেহেতু অনেকদিন পর একসাথে, সেহেতু একটু ঘুরাঘুরি করাই যায়। কি বলো রোবা?’

রোবা নাহার রুদ্রের দিকে তাকালেন। রুদ্রের সহজ উত্তর, ‘সবাই গেলে যাবো সমস্যা কি?’

অবশেষে সবাই মতামত দিলো। তটিনীকে পায় কে?’ সে নেচে নেচে বাড়ি মাথায় তুলছে। রাজ ও তুরফান ট্যুরে যাবে বলে দারাজে শার্ট-প্যান্ট অর্ডার করতে বসে গেছে। রোবা নাহার ও ঈশানী সাথে আশারিয়া ও ঈশানীর বোন অনলাইনে জামা কাপড় দেখা শুরু করেছেন। বাড়িতে যেন হঠাৎ করে ঈদ লেগে গেছে।

শুধু আমাদের তটিনীই নেচে বেড়াচ্ছে একা একা। কিন্তু চোখ ফাঁকি দিতে পারছে না রুদ্রের। সোফায় বসে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে রুদ্র। মাঝে মধ্যে চোখ রাঙাচ্ছে। তারমধ্যে ডাক দিলেন ঈশানী।

তটিনীকে অনলাইনে জামাকাপড় দেখাতে বসিয়ে দিলেন। চঞ্চল তটিনী নাক ফুলিয়ে বলল, ‘তুমিই দেখো মা, তুমি যা কিনে দিবে তা-ই পড়বো।’

শশি চশমা ঠেলে বলল, ‘নিজের কোনো পছন্দ নেই?’

তটিনী সেটা কানে নিলো না। সে আবারও দুটো বাচ্চার সাথে ছুটতে ব্যস্ত। শশি নিজের ভাই শিশিরকে ফিসফিস করে বলল, ‘তটিণী-র বয়স কতো যেনো ভাই?’

শিশির বলল, ‘ষোলো তো হবেই।’

শশি ভ্রু চুলকিয়ে বললো, ‘এই বয়সেও এতো চঞ্চল! ওর কি কোনো প্রব্লেম আছে?’

শিশির অবাক হয়ে বলল, ‘কি প্রব্লেম থাকবে?’

শশি কথা কাটাতে বলল, ‘না কিছু না। এমনি বললাম। অতিরিক্ত চঞ্চল তো।

শিশির অভিজ্ঞদের মতো করে বলল, ‘এমন করার বয়সই এখন। আজকের যুগে প্রায় সবাই নিজেকে ভিতরে ভিতরে গুটিয়ে নেয়। সেখানে ও হাসোজ্জল একটি মেয়ে। প্রত্যেকেরই উচিত ওর মতো হওয়া। নিজেকে গুটিয়ে না নিয়ে হাসিখুশি থাকা। নাহলে দিনশেষে ‘বেরঙিন শৈশব’ বলে স্ট্যাটাস ছাড়া কিছু দিতে পারবে না।’

শিশিরের কথার প্রতিত্তোরে শশি চুপ হয়ে গেলো। হয়তো তার ভাই সত্যিই বলেছে। কারণ তার ভাই অনেক বই পড়ে। আর যারা বই পড়ে তাদের অনেক জ্ঞান থাকে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here