রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা #লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া ২৬

2
354

রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

২৬
[ কপি করা নিষেদ্ধ ]
রিদের কালো মার্সিডিজ গাড়িটা খান বাড়ির গেইট ধরে ঢুকতে বাগানে চত্বর থেকে আরাফ খান তাকাল সেদিকে। বাড়ির মালিদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কাজ দেখছিলেন তিনি। অসময়ে রিদের গাড়িটা বাড়ির গেইট ধরে ঢুকতে দেখে তিনি সেদিকে আগায় হাতের লাঠিটা ভর করে। আজকাল রিদের মতিগতি ভালো ঠেকছে না উনার কাছে। যেই ছেলেকে ধরে বেঁধে চট্টগ্রামে আনা যেত না সেই ছেলে আজকাল ঘনঘন পারা পরছে চট্টগ্রামের মাটিতে। ব্যাপারটা সন্দেহজনক। ভিষণ রকমের সন্দেহজনক। তিনি আরও দুইদিন আগে শুনেছিল এই ছেলে চট্টগ্রামে এসেছে। উনারদের সাথে দেখা না করে মুরাদপুর ফ্ল্যাটে পরেছিল দুইদিন। কিন্তু কেন পরেছিল জানা নেই? সেই কারণটা আপাতত তিনি জানেন না। শুনেছে এর মধ্যে বাবা নিহালের সঙ্গে দেখা করেছে রিদ কিন্তু উনাদের কাছে আসেনি। দেখাও করেনি। এমনটাও তো না যে রিদ চট্টগ্রামে তার বাবা কাজে এসেছে। তিনি বেশ বুঝতে পারেন রিদ তার মতলবে আজকাল হুটহাট চট্টগ্রামে চলে আসে। তাছাড়া রিদ যদি তার বাবার কাজে চট্টগ্রামে আসায় হতো তাহলে মুরাদপুর না থেকে বাড়িতে আসতো। উনাদের সাথেই থাকতো। কিন্তু রিদের মুরাদপুর থাকার পিছনে নিশ্চয়ই সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার আছে উনার মনে হয়। নয়তো এই ঘাড় ঠ্যাডা রিদ খান এমনই এমনই কোথাও পরে থাকা মানুষ না। যেখানে এই ছেলে বাবা-মা বিচ্ছেদ পর নিজের বাড়িতে না থেকে নিজের আলাদা বাড়িতে উঠেছে সেই ছেলে আর যায় হোক অন্তত মতলব ছাড়া মুরাদপুরে পরে থাকবে না। বিচক্ষণ আরাফ খান হাতে লাঠিটা ভর করে সামনে এগোল। রিদকে দেখাল গাড়ি থেকে নেমে কেমন গুমোট গম্ভীর মুখে হনহন করে চলে যেতে বাড়ির ভিতরে পথে। কিন্তু মাঝে পথে পথ আটকে দাঁড়াল আরাফ খান। যাওয়ার পথে বাঁধা পাওয়ায় বিরক্তি কপাল গুটাল রিদ। আরাফ খানের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি কন্ঠে বলল।

‘ কি সমস্যা? কি চাই?
‘ চাই তো অনেক কিছু। কিন্তু তুই তো দিতে অক্ষম। তুইতো আর আমার বউ না। নাতি হোস। দিবি কেমনে?

আরাফ খানের রসিকতা কথায় রিদের বিরক্তি বাড়ে। এমনই মন মেজাজ ভালো নাই। বউয়ের সাথে রাগারাগি করে এসেছে সে। রিদ বিরক্তি নিয়ে পাশ কাটাতে চাইল আরাফ খানের কিন্তু আবারও একই ভাবে পথ আটকে দাঁড়াল তিনি। জহরী দৃষ্টিতে রিদের পা থেকে মাথা অবধি পরখ করল একবার। রিদের বামহাতের কব্জিতে বেশ বড়সড় একটা ব্যান্ডেজ চোখে পরলো উনার। সাথে কপালেও দেখলো একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ করা। এই অল্প সময়ে তিনি ভাবলেন রিদ হয়তো মারামারি করে নিজের মাথা আর হাত ফাটিয়ে এসেছেন। তাই তিনি তীক্ষ্ণ গলায় রিদকে প্রশ্ন করে বলল…

‘ তোর এই অবস্থা কেন হুম? কি করে এসেছিস তুই?

রিদের সোজাসাপ্টা উত্তর…
‘ বিয়ে করে এসেছি।

আরাফ খান বলতে দেরি কিন্তু রিদের তৎক্ষনাৎ উত্তর আসতে দেরি হলো না। চট করে নিলিপ্ত গলায় বলে ফেলল কথাটি। রিদ স্পষ্টভাষী। সে কখনো কোনো কথা মিথ্যা বা লুকোচুরি করে না। আর না কাউকে পরোয়া করে। স্থান, কাল, মানুষ বেঁধ করেও সে সর্বদা স্পষ্টভাষায় কথা বলতে পছন্দ করে। বলেও। আরাফ খান জানেন রিদ স্পষ্টভাষী। সর্বদা সত্য কথা বলে। তারপরও তিনি রিদের এই ‘বিয়ের করে এসেছি’ এই কথাটা বিশ্বাস করলেন না। বিশ্বাস না করার পিছনে অবশ্য কারণ আছে। বিগত কয়েক বছর ধরে রিদকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছেন উনারা। কিন্তু সে রাজি নয়। এমনকি রিদ বিয়ে করবে না বলে এই নিয়ে বাসায়ও তুমুল হুলুস্থুল পাকিয়ে ছিল। কতো কাহিনি করলো রিদ বিয়ে করবে না বলে। সেজন্য তো বাধ্য হয়ে রিদ থেকে তিন বছরের ছোট সাতাইশ বছরের ফাহাদকে বিয়ে করাল। নয়তো রিদকেই আগে বিয়ে করাতেন উনারা। এখন এতো কাহিনি পর যদি হঠাৎ করে রিদ এসে বলে সে বিয়ে করে এসেছে তাহলে উনারা বিশ্বাস করবে না এটাই স্বাভাবিক। হলোও তাই। আরাফ খান রিদের বিয়ের কথাটা এক রত্তিও বিশ্বাস করেন নি, উল্টো তিনি ভাবলেন রিদ উনার সাথে হেয়ালি করছে। সেজন্য তিনিও রিদের সাথে হেয়ালিপনা করেই বলে…

‘ বিয়ে করে এসেছিস ভালো কথা। কিন্তু তোর এই অবস্থা কেন? বিয়ে করতে কি আর যুদ্ধ করা লাগে নাকি? আঘাত পেয়েছিস কিভাবে?

আবারও রিদের দায়সারা উত্তর আসল…
‘ বউ মেরেছে।
‘ বউ মেরেছে? আরেহ সাব্বাশ! বউয়ের হাতের মার খেয়ে এসেছিস অবশেষে। আমার তো গর্ববোধ হচ্ছে তোর বউয়ের উপর রিদ। বাপরে কি সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার রিদ খানকেও কেউ পিঠায়? তোর বউকে তো আমার একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার রিদ। বাঘিনীর বাচ্চা সে। তোকে মারার মতো দুঃসাহসিক কাজটা সে করে ফেলল।

আরাফ খানের কৌতুক কথায় দাঁতে দাঁত চাপল রিদ। রাগ বাড়ছে সেজন্য চোয়াল শক্ত হচ্ছে জেদে।

‘ সামনে থেকে সরো দাদাভাই। ভালো লাগছে না।

রিদ আবারও পাশ কাটাতে চাইলে ফের বাঁধা দিল আরাফ খান। তিনি যেন আজ শপথ করেছে রিদকে সর্বোচ্চ বিরক্ত করবে। তিনি রিদের পথ আটকে দাঁড়াতে দাঁড়াতে একই ভাবে খোঁচা মেরে বলল…

‘ আমাকে তোর ভালো লাগবে না এটাই স্বাভাবিক। আমি কি আর তোর বউ লাগি যে আমাকে তোর ভালো লাগবে? ভালো লাগার মানুষের কাছে তো মাইর খেয়েই এসেছিস। আর কি চাই বল? এমন বউ সোহাগা স্বামী কতোজন হতে পারে। তুই তো সাংঘাতিক কপাল নিয়ে জম্ম নিয়েছিস রিদ। সোজা স্বামী পেঠা বউ পেয়েছিস। তোর ভাগ্যটা ভালো বুঝলি। আমাদের বউতো খালি আদর করে। মারে না।

আরাফ খানের খোঁচা মারা হেয়ালি কথায় রিদ দাঁতে দাঁত পিষে জোরপূর্বক আরাফ খানকে পাশ কাটিয়ে হনহন চলে গেল বাড়ির ভিতরে। রিদকে চলে যেতে দেখে বৃদ্ধ বয়সের ঝুলন্ত চামড়ায় সুন্দর হাসলেন তিনি। রিদের চলে যাওয়ার দিকে হাসতে হাসতে ঘুরে সামনে তাকাতে তক্ষুনি চোখে পরলো আসিফকে। রিদের গাড়ি পাকিং করে এদিকটায় আসছে। কিন্তু আসিফের ভাবভঙ্গিমা এমন যেন সে চুরি করে ধরা পরে যাওয়ার নেয় অবস্থা। আরাফ খান তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে আসিফের চোরের মতোন মতিগতিটা চট করে ধরে ফেললো। আসিফ যে উনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এমন চোরের মতোন পালায়ন করতে চাইছিল সেটা বুঝতে পেরেই তিনি আসিফের ভয়টা আরও বাড়িয়ে দিয়ে তক্ষুনি হাক ছেড়ে ডাকল আসিফকে।

‘ এই রিদ ভাইয়ের বলদ এদিকে আয়।

আসিফ থমথমে মুখে আরাফ খানের দিকে এগিয়ে আসল। পালাতে গিয়েও আরাফ খানে চোখে ধরা পরে যাওয়ার আসিফ বোকা হাসল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে আরাফ খানের সামনে দাঁড়াতে তিনি সন্দেহ ভাজক দৃষ্টিতে আসিফকে পরখ করে বলল…

‘ কি ব্যাপার? কাহিনি কি বলতো? আজকাল ঘনঘন কি করিস তোরা চট্টগ্রামে? কি চলে তোদের?

আসিফ বোকা হেঁসে উত্তর করে বলল…

‘ কিছু চলে না দাদাভাই। এমনই এমনই কাজে এসেছিলাম আমরা।

‘ কি কাজে আসলি শুনি? তোর রিদ ভাই যে বলে গেল সে বিয়ে করেছে ঘটনা কি সত্য?

আসিফ একই ভাবে বোকার মতো বলল..
‘ রিদ ভাই বলেছে এমনটা? যদি বলে থাকে তাহলে হবে হয়তো সত্য। আমি কিছু জানি না।

‘ সারাদিন তো থাকিস রিদের সাথে বলদের মতোন। আবার বলছিস জানিস না কিছু। সত্যি করে বলতো তোদের মধ্যে কি চলে হুম? আমার তো তোদের দুজনকে কেমন সন্দেহ সন্দেহ লাগে। কোনো সম্পর্কে-টম্পর্কে জড়িয়ে পরিসনি তো তোরা আবার?

ছিটকে দূরে সরে যাওয়ার মতোন পিছু হাটলো আসিফ। নাক মুখ কুঁচকে আহাজারি করার মতোন করে বলল…

‘ আস্তাগফিরুল্লাহ! নাউজুবিল্লাহ! কি বলেন এসব দাদাভাই? রিদ ভাই আমার বস হয়। আমার কাজই রিদ ভাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকা। নয়তো আমি মেয়েতে ইন্টারেস্ট!

‘ তোদের ইন্টারেস্ট বুঝবো কেমনে হ্যাঁ? কোনো দিনতো দেখলাম না দুই বলদের এক বলদও একটা মেয়ে পটাইতে। খালি বলদের মতোন সাদাদিন একজন আরেক জনের নাম ডাকিস। তুই ঝপিস রিদ ভাই, রিদ ভাই করে, আর তোর রিদ ভাই মরে আসিফ আসিফ করে। এখন আমরা তোদের প্রেমিক-প্রেমিকা মনে করতেই পারি।

‘ নাউজুবিল্লাহর কথা বার্তা বইলেন না দাদাভাই। রিদ ভাইয়ের ভাবি আছে। ভাই শুনলে আমাকে ঝাড়বেন।

‘ রিদ ভাইয়ের ভাবি আছে মানে? রিদ কি ভাবিতে ইন্টারেস্ট নাকি?

আমতা আমতা করে আসিফ বলল…

‘ না মানে রিদ ভাইয়ের ভাবির সাথে সম্পর্ক আছে।

আরাফ খান আবাক হওয়ার মতোন করে বলে।

‘ কি বলিস এসব? রিদ শেষমেশ কোন ভাবি সাথে সম্পর্কে জড়াল আসিফ? বউটা কার? কার বউয়ের সাথে পরকীয়া করছে রিদ?

ভয়ে ভয়ে ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আসিফের। কথায় কথায় সে অনেক কিছু বলে ফেলেছে আরাফ খানকে। যদি এসব কথা রিদের কানে যায় তো আসিফকে আস্ত রাখবে না। রিদ পছন্দ করে না ওর পার্সোনাল লাইফ সম্পর্কে কাউকে শেয়ার করা। আসিফ আরাফ খানের কথার ফ্যাসাদে পরে কিভাবে কিভাবে যে মুখ ফস্কে কথা গুলো বেড়িয়ে গেছে। এখন আসিফ যদি আর কিছুক্ষণ আরাফ খানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে তিনি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বাকি কথা গুলোও আসিফের পেট থেকে বের করবেন নিশ্চিত। আসিফ নিজেকে বাঁচাতে হঠাৎ করে দৌড় লাগাল বাড়ির ভিতর দিকে। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে যায় আরাফ খান। তিনি যখন বুঝতে পারেন আসিফ উনার থেকে বাঁচতে দৌড় লাগিয়েছে ঠিক তক্ষুনি আসিফের যাওয়ার পথে খানিকটা চেচিয়ে উঠলেন তিনি। বললেন….

‘ আরে আরে বলদ বলে-তো যাহ। রিদ কার বউয়ের সাথে পরকীয়া করে বেড়াচ্ছে? মেয়েটা কে?

আসিফ দৌড়ে পালাতে পালাতে খানিকটা চেচিয়ে জানাল…
‘ মেয়েটা আপনাদের আত্মীয় হই দাদাভাই।

আত্মীয় কথাটা মাথা আসতেই আরাফ খানের মাথায় প্রথমেই শশীর’ নামটা ঢুকলো। মেয়েটার সাথে রিদের সম্পর্কে কথা শুনেছিল উনারা আরও কয়েক বছর আগে। দুজনকে বিয়েও দিতে চেয়েছিল উনারা কিন্তু শশীর বয়স কম হওয়ায় বা শশীর পড়াশোনা শেষ হয়নি বলে বিয়ের আর হয়নি। তারপর কি হলো কি জানি। রিদ বিয়ে করবে না বলে একেবারে বেঁকে বসল। আরাফ খানের মনে হলো রিদ আবারও হয়তো শশীর সাথে প্রেমে সম্পর্কে মজেছে। যদি তাই হয়। তাহলে এবার দুটোকে ধরে হাতে হাতে বিয়েটা সেরে ফেলবেন উনারা।
~~
বহমান নদীর স্রোতের মতোই সময় তার নিজস্ব গতিতে যাচ্ছে। রিদ মায়ার উপর রাগ নিয়ে চট্টগ্রাম শহর ছাড়লো আজ গোটা পয়ত্রিশ দিন হলো। এতে মায়ার অবশ্য ভাবান্তর নেই। সে রিদের জন্য মোটেও চিন্তিত নয়। বরং সে সেদিনের পর নিখোঁজ স্বামীকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। রিদ চুক্তিপত্রের কাগজ গুলো মায়াকে ফিরত দেয়নি। উল্টো মায়াকে হুমকি ধামকি দিয়ে শাসিয়ে গেল। এখন মায়ার ভয় হয় যদি রিদ কোনো ভাবে মায়ার নিখোঁজ স্বামীর ক্ষতি-টতি করে বসে তো? মায়ার নিজের স্বামীর জন্য অস্থির, উম্মাদনা হয়ে সেদিন রিদের হাতে মার খেয়ে বসায় এসে প্রথমে নিজের স্বামীকে ফোন দিয়েছিল খোঁজ নিতে। রিদ মায়ার স্বামীর ক্ষতি করার আগেই সাবধান করতে চেয়েছিল লোকটাকে। কিন্তু আফসোস! মায়ার ফোন কলই সেদিন হতে আজ পযন্ত লোকটা রিসিভ করেনি আর না কল ব্যাক করেছে। মায়া জানে না কেন লোকটা মায়ার কল রিসিভ করে না। মায়া মনে করলো সেই প্রথম রাতে ওহ লোকটার সাথে রাগারাগি করে অনেক কিছু বলে ফেলেছিল বিদায় এখন মায়ার স্বামী অপমানিত হয়ে ওর কল রিসিভ করছে না। আসলে দোষটা মায়াই। মায়া বাড়াবাড়ি করে অনেক কথা বলে ফেলেছিল সেদিন। প্রথম ফোন আলাপে এতো বাজে ব্যবহার করা ঠিক হয়নি মায়ার। মায়া কষ্ট বাড়ে। সেই সাথে সঙ্গী হয় কান্না। দিশেহারা মায়া হঠাৎ করেই কেমন যেন উদাসীন হয়ে পরলো সবকিছু উপর। কিশোরী মনটাকে বুঝাতে না পেরে প্রায় প্রতিদিন নিখোঁজ স্বামীর খোঁজ নিতে কল দেয় রিদকে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলে হয়তো রিদ মায়ার কল রিসিভ করতো। স্বাভাবিক ভাবে অপরিচিত থেকেই বউয়ের সাথে ফোন আলাপ চালাত। কিন্তু বিষয়টা রিদের কাছে স্বাভাবিক ঠেকল না। যবে থেকে বুঝতে পারলো মায়া রিদকে নিয়ে পজিটিভ কিছু চিন্তা করছে না তবে থেকে সে অস্থির হলো। রিদ মায়ার স্বামী হয় এই সত্যিটা যদি মায়া কখনো জানতেও পারে তাহলে সে রিদকে স্বামী হিসাবে মানতে নারাজ হবে, তার থেকে তালাক চাইবে। এই কথাটা রিদের মাথায় আসতে রিদের শরীর রাগে টগবগিয়ে উঠে তিরতির করে। এই রাগে, জিদে রিদ মায়ার কোনো ফোন কল রিসিভ করে না। আর না কল ব্যাক করে। বরং রিদ ইচ্ছা করেই মায়াকে ইগনোর করে। রিদ শুরু থেকে মায়ার সাথে সম্পর্কে ছড়াতে চায়নি। বরং তার অজানা বউ সম্পর্কে প্রথমে জানার কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে মায়াকে প্রথম দেখে সে সন্দেহের বশে অজানা বউয়ের খোঁজ করল। তারপর বউয়ের হদিশ না পাওয়ায় রিদ এক প্রকার জেদ নিয়েই বউকে খোঁজে বেড়ায়। খোঁজে খোঁজে যখন রিদ দিশেহারা হয়ে উঠছিল বউকে না পেয়ে তখন রিদের মনে অজানা অচেনা বউয়ের প্রতি অস্থির টান আর প্রচুর ইন্টারেস্ট জম্ম নিলো। তারপর সেই ইন্টারেস্ট থেকেই আজ এই পযন্ত এসে দাঁড়াল। অবশেষে বউকে খোঁজে পেল। কোনো এক অজানা অধিকার নিয়েই বউকে খোঁজে পাওয়ার প্রথম দিনই থাপ্পড় মেরে বসল রাগে। তারপর রিদ কেমন কেমন করে যেন বউয়ের প্রতি নজর রাখতে শুরু করলো। বউয়ের চারপাশটা তাঁর হাতের মুঠোয় রাখল। তবে তখনো রিদ বউকে নিয়ে শিওর ছিল না তাঁরা ভবিষ্যতে একত্রে হবে কিনা। বা আদৌও সে এই লুকায়িত সম্পর্কটা সাথে জড়াতে চায় কিনা। কিন্তু যবে থেকে বুঝতে পারলো বউ তার জন্য দিশেহারা অস্থির পাগল হয়ে আছে তারই খোঁজে। তবে থেকে রিদের দৃষ্টি বদলায়। বউ তাকে না দেখে, না জেনেই ভালোবাসে! সে খারাপ কোনো মানুষ হতে পারতো, এমনটা জেনেও তার সাথে সংসার করতে চাওয়া মনোভাবটা রিদকে খুবই আকৃষ্ট করেছে। এই যে তার বউ তাঁকে খোঁজে পাওয়ার জন্য দিশেহারা হয়ে আছে এটা রিদকে প্রচুর মানসিক শান্তি দেয়। ভাবে তার বউ তাঁকে ভালোবাসে। আর বউয়ের এই ভালোবাসাটা অনুভব করতে গিয়েই কিভাবে যেন রিদ বউয়ের মায়ায় পা পিছলে পরে যায় একেবারে নাম মুখ ডুবিয়ে। সেই মায়া কাটিয়ে উঠার সাধ্য আর রিদের নেয়। রিদ অনুভব করতে পারে তার বউয়ের প্রতি টানটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তার মনে হচ্ছে সে খুব শীঘ্রই এই বউয়ের জন্য পাগল টাগল হয়ে যাবে। এখন তার এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে তার বউ যায়ই করুক না কেন, সবই তার ভালো লাগে। মনে হয় তার সাথে এমন আধা পাগল বউটাকেই মানায়। জীবনে এন্টারটেইনমেন্ট জন্য হলেও এমন একটা আধা পাগল বউ থাকা জরুরি। এই যে তার বউ তাঁকে এতো আগ্রহ নিয়ে দিনে দিনে অবসেশন জেদ্দি
পাগল বানাচ্ছে। আর সে দূর্বল হার্টে পরিণত হয়ে পাগল হচ্ছে। এখন যদি শুনতে হয় তাঁর বউয়ের ভালোবাসা মূলত তার জন্য নয়। তাহলে কেমনডা লাগে? কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তি কি স্বাভাবিক থাকতে পারবে? অস্বাভাবিক নেয় মাথা গরম হয়ে যাবে না? রিদের অবস্থাও সেইম। সে পারছে বউকে থাপ্পড়িয়ে লাল লাল করে দিতে। বেয়াদব বউ একটা কপালে জুটেছে তার। এই বউয়ের জন সারাক্ষণ রিদের মন মেজাজ গরম হয়ে থাকে। সে এমনই রাগী রগচটা মানুষ। অল্পতেই রেগে যাওয়ার ব্যামো আছে। সেখানে বউটার জন্য মাথাটা তার আরও গরম হয়ে থাকে আজকাল। মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনায় রিদ ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলল। অফিস কক্ষে থাই গ্লাস বেঁধ করে তাকাল ব্যস্ত শহরে দিকে। বউটার জন্য কেমন মন পুরছে তার। কিন্তু তারপরও সে নিরুপায়। সে বউকে নিজ থেকে ধরা দিবে না বলে জিদ ধরে বসে আছে। আর সেই জেদি এখন মন পুরছে। রিদ হাতে হাতে ল্যাপটপের শাটার টেনে বন্ধ করলো। কিছুই ভালো লাগছে না বলে রিদ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টেবিলে উপর রাখা অবহেলিত আধুনিক ফোনটা তক্ষুনি ভাইব্রেটস করে উঠলো। রিদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সেদিকে তাকাল। চোখে ভাসমান হলো ‘ বেয়াদব বউ’ নামটি। রিদ কলটি রিসিভ করলো না। বরং অবহেলিত ভাবেই ফোনটা জায়গায় পরে থাকল। সে আপাতত বউয়ের ফোন রিসিভ করবে না বলে জেদ করে আছে। যেভাবে রিদের মনটা পুরছে ঠিক সেভাবে বউকেও তার দহনে পুরাবে বলে স্থির করলো।

রিদ ফোন রিসিভ না করায় মায়া উদাস মনে কান থেকে ফোন নামিয়ে টেবিলে উপর রাখল। হাতাশার ভারি নিশ্বাস ফেলে আবারও কল দিতে চাইলে পাশ থেকে বাঁধা দিল জুই। রাগান্বিত গলায় বলল।

‘ তুই এতো আত্মসম্মানবোধ ছাড়া কিভাবে হলি রিতু? একটা মানুষ তোর ফোন রিসিভ করে না তারপরও বেয়ামি করে রোজ রোজ কেন কল দিস তুই? তোর লজ্জা থাকা উচিত।

কলেজ ক্যানটিনে দ্বি-তলায় কোণার টেবিলে গোল হয়ে বসে চার বান্ধবী। মায়া মুখোমুখি জুই বসে কপাট রাগ দেখিয়ে কথা গুলো বলল মায়াকে। মায়া জুইয়ে কথার উত্তর দিয়ে দৃঢ় মনে বলল।

‘ লজ্জা, আত্মসম্মানবোধ দুটোই আছে আমার জুই। কিন্তু তাই বলে সব জায়গায় আত্মসম্মানবোধ দেখাতে নেই। বিশেষ করে একটা সম্পর্ক সুস্থ রাখতে গেলে মাঝেমধ্যে নিজের আত্মসম্মানবোধ ও খুঁয়াতে হয়। সব জায়গায় সবকিছু চলে না। আমার সম্পর্কটাও ঠিক তাই। ভিষণ নড়বড়ে একটা সম্পর্ক। তাই আমার অসুস্থ সম্পর্কটাকে আগে সুস্থ করি তার না-হয় আত্মসম্মান বোধটা দেখানো যাবে। শ্রম না করে ভালো ফসলের চিন্তা করা যেমন বোকামি, ঠিক তেমনই একটা সম্পর্কে ভালোবাসা তৈরি না করে তার উপর অভিমান করে আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বসে থাকলে ওপাশের মানুষটা কখনো আমার কদর বুঝবে না। আমার কদর বা গুরুত্ব সামনের মানুষটাকে বুঝাতে গেলে আমাকে অবশ্যই সেই মানুষটাকে স্পেশাল ফিল করাতে হবে। তবেই না সে আমার জন্য পাগল হবে। এখন দুনিয়াটায় গিভ এন্ড টেকের নিয়মে চলছে জুই। একহাতে দাও, তো অন্য হাতে নাও। তাই আমাকে কিছু পেতে হলে অবশ্যই কিছু দিতে হবে। আজ আমি তাঁকে পাত্তা দিচ্ছি কাল সে আমাকে গুরুত্ব দিবে। এটাই তো নিয়ম তাই না?

মায়ার জ্ঞানী জ্ঞানী কথায় বেশ অসন্তুষ্ট হলো জুই। তারপরও রাগ রাগ নিয়ে বলল জুই।

‘ তুই এতো পাত্তা দেওয়ার পরও যদি, ঐ লোকটা থেকে গুরুত্ব না পাস তাহলে কি করবি তুই তখন?

মায়া উত্তর আসল একই ভাবে। দৃঢ়তা দেখিয়ে বলল…

‘ সে আমাকে গুরুত্ব দেয় জুই। আর দেয় বলেই সে আজ পযন্ত আমার কলটা কখনো কেটে দেয়নি আর না আমার নাম্বারটা দেখে ব্লক লিস্টে ফেলেছে। আমার কি মনে হয় জানিস জুই? লোকটা কোনো কারণে হয়তো আমার উপর রাগ করে আছে। আর সেই রাগ নিয়ে হয়তো আমার সাথে কথা বলতে চাইছে না। হতে পারে আমার প্রথম দিনের ব্যবহারে লোকটা অসন্তুষ্ট। আমার উচিত হয়নি তার সাথে ঐভাবে রেগে কথা বলার।

মায়ার কথায় এবারও জুই অসন্তোষ্ট গলা ঝেড়ে বলল।

‘ তোর কাছে আদৌ তোর জামাইর কোনো দোষ পাওয়া যাবে বলে তো মনে হয় না। তোর জামাই তো নিষ্পাপ মানুষ।

মায়া ফোন চালাতে চালাতে ছোট করে সম্মতি দিল…
‘ হুম।
জুই নাক মুখ কুঁচকে বলল…
‘ জামাই পাগলী।

জুইয়ের অসন্তোষ্ট গলা কথাটা বলল। মায়া শুনেও না শুনার মতো বসে রইল ফোনে চোখ দিয়ে। হাতের টাচে আবারও কল লাগাল রিদকে। কিন্তু এর মাঝেই ফোড়ন কেটে শ্রেয়া মায়ার কল কেটে দিয়ে হড়বড় করে বলতে লাগল।

‘ মায়া একটা কাজ করলে কি হয়? তোর জামাই কেমন লোক, তার চরিত্রের একটা পরীক্ষা করে দেখ আগে। তুই তো তাঁকে ভালোবাসিস তাই না? তোর জানা উচিত লোকটা কেমন চরিত্রে। তাছাড়া লোকটা তোর কল রিসিভ করে না হয়তো পরিচিত নাম্বার দেখে। তুই একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে লোকটাকে কল দিয়ে দেখ রিসিভ করে কিনা। বা অপরিচিত মেয়েদের সাথে সে কেমন স্বভাব রেখে কথা বলে, এই নিয়ে একটা পরীক্ষা তো করাই যায় তাই না?

মায়া সরল চোখে তাকাল শ্রেয়ার দিকে। কথাটা মন্দ বলেনও শ্রেয়া। একটা পরীক্ষা তো মায়া করতেই পারে জামাই চরিত্র পরীক্ষা করতে তাই না। মায়ার নাম্বারটা দিয়ে তো একবার কথা বলেছিল ওরা, সেজন্য হয়তো লোকটা মায়ার নাম্বার চিনতে পেরে এখন রিসিভ করে না। তাই মায়ার শ্রেয়ার কথাটা এই মূহুর্তে বেশ যুক্তি সংগত মনে হলো। কিন্তু কথা হলো কার ফোন দিয়ে কল করবে। এই কথাটা জানাতেই নাদিয়া তক্ষুনি নিজের ব্যাগ থেকে মোটামুটি দামী একটা ফোন বের করে দিল মায়াকে। মায়া সেটা সহজ ভাবেই গ্রহণ করলো। নাদিয়া বেশ ভালো পরিবারের মেয়ে। অনেক টাকা পয়সা আছে নাদিয়ার বাবার। সেক্ষেত্রে নাদিয়ার হাতে একটা দামী ফোন থাকা অস্বাভাবিক কিছু না। মায়ার রিদের মুখস্থ নাম্বারটা হাতে হাতে নাদিয়ার ফোনে টাইপিং করে রিদকে কল লাগাল। মায়া বেশ দৃঢ় ছিল রিদ এই অপরিচিত নাম্বারটা দেখে কলটা রিসিভ করবে না। কিন্তু রিদ মায়ার দৃঢ়তাব্যঞ্জক করে কয়েক সেকেন্ড মধ্যে কলটা রিসিভ করে ফেললো। এতে মায়া হতাশ হলো। মায়া ভারি হতাশায় ডুবে গিয়ে বলল…

‘ হ্যালো বাবু!
‘ কে?
‘ আমি তোমার বাচ্চার মা!
মায়াকে ফের হতশায় ডুবিয়ে দিয়ে রিদ উৎফুল্লতা দেখিয়ে কথা মিলিয়ে বলল।
‘ হ্যাঁ বাবু বলো!
‘ আই মিস ইউ।
‘ আই মিস ইউ টু বাবু।
মায়া উদাস গলায় বলল…
‘ আমার বাবু কি করে?
‘ তোমার বাবু তার বাবুর আম্মুকে বসে বসে মিস করে জান।
‘ তাহলে আজকে বাসায় তাড়াতাড়ি চলে আসো। আমি অপেক্ষা করছি।
‘ হ্যা বাবু আর একটু পরই চলে আসবো। আমার বাবু ডেকেছে আর আমি না এসে পারি বলো? আজকে রাতে খেলা হবে জান। তুমি আর আমি।

মায়া লজ্জা থমথমে খেয়ে বসল। লোকটা এমন উলোটপালোট কথা বলবে সেটা ধারণাতে ছিল না মায়ার। মায়া থমথমে খেয়ে চোখ তুলে তাকাল মুখোমুখি বসা জুই, শ্রেয়া আর নাদিয়া দিকে। সবাই উৎসুক হয়ে ওদের কথা শুনছে আগ্রহ নিয়ে। ফোনটা লাউডস্পিকার দেওয়া। মায়া এক পলক জুই, নাদিয়া, শ্রেয়াকে দেখে নিয়ে থমথমে গলায় বলল…

‘ বাবু?
‘ হ্যাঁ বাবু!
মায়া আমতাআমতা করে বলল..
‘ আই লাভ ইউ!
‘ আই লাভ ইউ টু বাবু।
রিদের কথা বলার সময় আসিফ তাড়াহুড়ো করে ঢুকেছিল কক্ষে হাতে কিছু ডকুমেন্টস নিয়ে। রিদকে ‘ভাই ‘ ডাকতে রিদ আসিফকে থামিয়ে দিয়ে বলল…

‘ এই ডিস্টার্ব করিস নাতো। দেখিস না আমার বাবুর আম্মু ফোন করছে। ব্যস্ত আমি। তুই বাহিরে যাহ।

আসিফ হতবুদ্ধি হয়ে ড্যাবড্যাব করে রিদের দিকে তাকিয়ে থেকে বেড়িয়ে গেল আস্তে করে। মূলত আসিফের মাথায় রিদের কথার আগামাথা কিছুই ঢুকলো না। এই বাবুর আম্মুটা আবার কে? রিদ কখন বাবু জম্ম দিল তাও বুঝল না। আসিফ বেড়িয়ে যেতেই রিদ একই উৎফুল্লতা দেখিয়ে বলল..

‘ হ্যাঁ বাবু বলো! বাচ্চারা কি খেয়ে ঘুমাইছে?
‘ হ্যাঁ!
‘ তা কি খাওয়ালে? মার্কেটের দুধ তো শেষ। আমিতো এখনো আনি নাই। তা তুমি কোত্থেকে দুধ খাওয়ালে?

রিদের বেগতিক কথায় মায়া হড়বড় করে কলটা মিউট করল। লজ্জা সিঁটিয়ে জুইয়ের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল।

‘ আমি আর কথা বলবো না। তুই কথা বল জুঁই। লোকটা কেমন কেমন করে যেন কথা বলে। আমার লজ্জা লাগে।

মায়ার কথায় নাক মুখ কুঁচকে জুই বলল…

‘ আমি কেন কথা বলতে যাব? তোর জামাই তুই কথা বল। তাছাড়া এসব বেফাঁস কথা তুই আগে শুরু করেছিস। তুই কেন আগে আগে বলতে গেলি তুই তাঁর বাচ্চার মা হুস। এখন তো সে এসব বলবেই। বাচ্চাদের খোঁজ নিবে না?

পাশ থেকে শ্রেয়াও জুইয়ের কথায় সম্মতি দিয়ে বলল।

‘ ঠিক ঠিক জুই ঠিক বলছে! মায়া তুই আগে কথা শেষ কর। কলটা বেশিক্ষণ মিউট করে রাখলে লোকটা বুঝে যাবে আমাদের ফন্দি।

শ্রেয়ার কথায় মায়া তক্ষুনি কল আনমিউট করে ফের কলটা লাউডস্পিকার রেখে বলল।

‘ জান?
‘ হ্যাঁ জান। কল মিউট করে কোথায় গিয়েছিলে? বাচ্চারা কি কান্নাকাটি করে তোমাকে বেশি জালাচ্ছে? তুমি কি তাদের দুধ খাওয়াচ্ছ?

রিদের এমন ভয়ংকর ঠোঁট কাটা কথায় মায়া ভারী লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বসল। সাথে এটা ভাবলো মায়ার জামাই রয়েল না। সে ভিন্ন নারীর সাথে এমনই ফ্লাটিং করে বেড়ায়। মায়ার চোখে মুখে লজ্জা চেয়ে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট হলো। ভারী হতাশ গলায় বলল..

‘ আপনার বাচ্চারা দুষ্টু! আপনার মতোই।
‘ না জান। এই ক্রেট তুমি নাও। আমার বাচ্চারা মা মতোই ন’টি হয়েছে।

মায়া যখন রিদের সাথে কথায় পেরে উঠছিল না, তাই অবশেষে হার মেনে বলল…

‘ আপনি আমাকে চিনেন?
‘ কেন চিনব না? তুমি মাত্রই আমার জম্ম নেওয়া বাবুদের আম্মু। তোমাকে না চিনলে হবে বলো?

মায়া হতাশার মুখ ভার করে চুপ করে রইল। মনটা খারাপ। মায়ার স্বামী অপরিচিত নাম্বারেও মেয়েদের সাথে ফ্লাটিং করে বেড়ায় এই কষ্ট মায়া কোথায় রাখবে? মায়ার কলিজাটা ভিষণ পুরছে। সে আর কথায় বলবে না। মায়াকে হুট করে চুপ হয়ে যেতে দেখে রিদ বলল।

‘ কি ম্যাডাম কথা শেষ? স্টক খালি?
‘ হুম।
‘ তো এরকম ফাজলামো কি আমার সাথেই প্রথম নাকি লিস্টে আরও আছে?
‘ আপনি প্রথম।
‘ আর আমিই যেন শেষ হয়। মনে রাখবেন।

মায়া চমকে উঠলো। তারমানে লোকটা ওকে চিনে এতক্ষণ কথা বলছিল? কিন্তু কিভাবে চিনলো? মায়াতো পরিচয় দেয়নি। তাহলে? মায়া অধৈর্য্যের গলায় তক্ষুনি জানতে চেয়ে বলল।

‘ আপনি আমাকে কিভাবে চিনলেন? আমিতো পরিচয় দেয়নি?
‘ আপনাকে চিনা আমার জন্য কঠিন কিছু নয় ম্যাডাম। বরং সহজ ভাবেই চিনে কথা বলছি। তবে ওয়ার্নিং দিচ্ছি! এই রকম ফাজলামো যেন অন্য কোনো ছেলে সাথে না হয়, নয়তো থাপড়িয়ে গাল ফাটিয়ে ফেলব স্টুপিড।

মায়া মিনমিন করে বলল…
‘ আপনি খালি বকা দেয়। গুরুত্ব দেন না।
‘ গুরুত্ব আগে অর্জন করো, তারপর!
‘ কল রিসিভ না করলে অর্জন করবো কিভাবে?
‘ জানি না।
রিদ একই ভাবে উদাস গলায় বলল কথাটা। মায়া রিদের কথায় কষ্ট পেয়ে বলল।
‘ আমার মন পুরে আপনার জন্য।

মায়া যেন হুট করেই রিদের মনে কথাটা বলে ফেলল। মন তো তারও পুরে বউয়ের জন্য। রিদ ভোঁতা মুখে কতক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে স্বভাবগত ভাবেই ত্যাড়ামি করে বলল…
‘ এসব মিথ্যা নাটকের ভাষা আমি বুঝি না। রাখছি।

রিদ কল কাটতেই মায়া ঠোঁট উল্টায়। লোকটা যে ত্যাড়া স্বভাবে হবে মায়া এতো দিনে বেশ কয়েকবার বুঝতে পেরেছে। আজকে আবার প্রমাণ হলো লোকটা আসলেই ত্যাড়া মানুষ। এই লোককে সোজা বানাতে বানাতে মায়া না আবার বাঁকা হয়ে যায় আল্লাহ জানে। তক্ষুনি নাদিয়া ব্যস্ত গলায় মায়াকে বলল…

‘ মায়ু তোর স্বামীতো অনেক ধুরন্ধর লোক। অপরিচিত নাম্বার থেকেও তোকে কেমন চট করে চিনে ফেলল।

‘ হুম।

কেমন হতাশা ভারি নিশ্বাস ফেলল মায়া। এই জামাইর খোঁজ সে ইহজীবনে আর পাবে কিনা আল্লাহ জানে।
~~
তারপর? তারপর দিন গুলো একই ভাবে কাটছে। নিখোঁজ স্বামীকে খোঁজ না পাওয়ার উদাসীনতা যেন মায়ার দিনদিন বাড়ছেই। রিদ মায়ার সাথে ফোনে কথা বলে না। ঐ একদিনের অপরিচিত ভেবে ফোন আলাপ হয়েছিল ব্যস এতটুকুই। তারপর আরও একটা মাস কিভাবে কিভাবে যেন কাটলো। মায়া, জুই আরিফের সঙ্গে বাড়িতে এসেছে বড় বোনের বিয়ে উপলক্ষে। ফাহাদ বাবাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে ফিরেছে গোটা এক সাপ্তাহ হলো। ফাহাদের বাবা এখন পুরপুরি সুস্থ না হলেও মোটামুটি ঠিকঠাক তিনি। উনার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশের ডাক্তারদের আওতায় আছে। ঔষধ চলছে আরকি। মায়ার পরিবারের সবারই গিয়েছিল ফাহাদের বাবকে দেখতে। মুক্তা যায়নি। আরও যায়নি মায়া আর জুই। ওদের না যাওয়ার পিছনে কারণ ছিল অবশ্য। দুই পরিবারের মানুষজন বসে আলাপ আলোচনা করে মুক্তা আর ফাহাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ের ডেট ফিক্সড করল সেজন্য। সামনে শুক্রবার বাদ রেখে এর পরের শুক্রবারের বিয়ে। মায়াদের বাড়ির মধ্যে হৈচৈ কান্ড। মায়া জুই কত্তো খুশি বোনের বিয়ে বলে কথা। খুশিতে আত্মহারা হয়ে লম্বা লিস্ট বানিয়েছে বিয়েতে কি কি কেনা কাটা করবে তা নিয়ে। মায়া বাবা খানিকটা চিন্তিত মুখে ছোট মেয়ে মায়ার উল্লাস দেখলেন। তিনি বেশ কয়েকদিন ধরেই একটা বিষয় নিয়ে চিন্তত। উনার ছোট ভাই জামাল সাহেবের সঙ্গেও এই বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। তিনি বড় ভাই শফিকুল ইসলামের উপর দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছে যাহ ভালো হয় তাই করতে। আপাতত শফিকুল ইসলাম তিনি দ্বিধায় ভুগছেন বলে, উনার বড় ছেলে আরিফকে ডেকে পাঠালেন জরুরি তলবে। খাবার টেবিলে সবাই বসে। মায়া, জুই খেয়েদেয়ে আগে আগে চলে গেল রুমে বোনের বিয়ে কেনাকাটা বাজারজাত তালিকা করতে। সেই ফাঁকে খাবার টেবিল খালি পেয়ে মনের কথা গুলো পরিবারের সামনে রাখতে চাইলেন শফিকুল ইসলাম। প্রথমে তিনি ছেলের মনোযোগ আর্কষণ করতে চেয়ে গলা ঝেড়ে বললেন।

‘ আরিফ তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা ছিল।

বাবা কথায় খাওয়া থেকে মুখ উঠাল না আরিফ। বরং খেতে একই ভাবে বলল।

‘ আমি শুনতে পারছি বাবা। বলো।

শফিকুল ইসলাম এক পলক উপস্থিত সকলের দৃষ্টি পরখ করে নিল। ছোট ভাই জামাল ব্যতীত কেউ উনার দিকে আপাতত তেমন মনোযোগ নেই। উনার স্ত্রী ছেলে মেয়েদের বেড়ে খাওয়াচ্ছে। ছোট ভাইয়ের বউ আরিফের পাতে তরকারি তুলে দিচ্ছে এমতাবস্থায় উনার কথা গুলো বলা অনুচিত হবে কিনা জানা নেই। তারপরও তিনি গম্ভীর গলায় ভারী আওয়াজে বলেন।

‘ মায়ার জন্য চেয়ারম্যান সাহেবের বড় ছেলের বিয়ে প্রস্তাব এসেছে। আমি তাতে মত দিয়েছি।

অমনোযোগী চোখ গুলো হঠাৎ করেই চমকে উঠে শফিকুল ইসলামের দিকে তাকাল একত্রে সবাই। প্রত্যেকের চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে সবাই বেশ চমকিয়েছে উনার কথায়। উনি একত্রে এতো গুলো মানুষের দৃষ্টিতে পরে খানিকটা অপ্রস্তক হলো। এর মধ্যে আরিফ অসন্তুষ্ট গলা আওড়াল।

‘ মায়া এখানো এসব কিছুর জন্য ছোট বাবা। মাত্রই আমরা মুক্তার বিয়েটা দিচ্ছি। এর মধ্যে মায়ার বিয়ের কথা আসলো কোথায় থেকে? তাছাড়া তুমি এসব বিষয়ে মত দাও কিভাবে? মায়া সবার ছোট। ওর বড়ো জুইয়ের বিয়ে নিয়েই আমরা এখনো চিন্তা করিনি। সেখানে মায়ার বিয়ের কথা কিভাবে চিন্তা করো তুমি?

ছেলের রাগান্বিত মুখটার দিকে তাকিয়ে শফিকুল ইসলাম ভারী গলায় বলল…

‘ চেয়ারম্যান সাহেবের বড় ছেলেকে তোমার অচেনা নয় আরিফ। দেখাশোনা, লেখাপড়ায় বেশ দারুণ ছেলেটা। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট! আচার-ব্যবহারেও বেশ অমায়িক। ছেলেটা স্টুডেন্ট ভিসা পেয়ে অ্যামেরিকা যাচ্ছে। ঐখানে পড়াশোনা শেষ করে গ্রীন কার্ড পেয়ে বাংলাদেশে আসতে আরও পাঁচ বছর লাগবে। সেজন্য ওরা চাচ্ছিল ছেলেকে বিয়ে করিয়ে রাখতে মায়ার সঙ্গে, যাতে ঐখানে কাবিননামা দেখিয়ে বউয়ের জন্য ভিসা পাওয়া যায়।

আরিফ তাতেও তীব্র অমত পোষণ করে বলল…

‘ সামান্য একটা ভিসার জন্য তুমি মায়ার বিয়ে এক্ষুনি দিতে চাও বাবা? মায়া এখনো বেশ ছোট মানুষ, আঠারো হয়নি। এসব বিয়ের ঝামেলায় ওকে এই মূহুর্তে টানলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আগে পড়াশোনাটা শেষ করুক, ততদিনে না-হয় ছেলেও পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকা থেকে ফিরুক। তারপর না-হয় বুঝ পরামর্শ করে দুজনের সম্মতিতে বিয়েটা দেওয়া যাবে বাবা।

আরিফের কথার অনিহা পোষণ করলো জামাল সাহেব ও শফিকুল ইসলাম। শফিকুল ইসলাম কিছু বলবে তার আগেই জামাল সাহেব আরিফের উদ্দেশ্য বলে…

‘ এই রকম ভালো সম্বন্ধ হাতে কাছে পেয়ে ফেরানোটা উচিত হবে না আরিফ। তাছাড়া আমরা এক্ষুনি মায়াকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিচ্ছি না। চেয়ারম্যান সাহেবের বংশ ভালো। ছেলেটাও ভালো। আমাদের হাতের কাছের ছেলে। কতো নম্র ভদ্র। তাছাড়া ওরা শুধু চাচ্ছে দুই পরিবারের মধ্যে আকদ করে রাখতে। মায়া এক্ষুনি সংসার শুরু করবে না, ছেলে দেশে ফিরার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে দেওয়া হবে মায়াকে। আমরা কেউ মায়ার খারাপ চাইব না আসিফ। বাপ-চাচার কথা একে বারে ফেলে না দিয়ে তুমি কিছু দিন সময় নাও। চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে কথা বলো। ছেলেটাও পরখ করো। তোমার যদি কোনো কিছুতে খারাপ মনে হয় তখন না-হয় আমরা সম্বন্ধটা ফিরিয়ে দিব। কিন্তু কোনো যাচাই-বাছাই না করে হুট করে বিয়েটা ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। আমি আর ভাই এই বিয়েটা নিয়ে বেশ কয়েক ধরে যাচাই করেছি খারাপ কিছু চোখে পরেনি। তুমি এই বাড়ির বড়ো ছেলে এবার দায়িত্ব তোমার। তুমি বিয়েটা নিয়ে যাচাই-বাছাই করো। মুক্তার বিয়েটা পযন্ত অন্তত সময় নাও। মুক্তা বিয়েটা পর না-হয় আমাদেরকে জানাও তোমার মতামত কি। তবে আমরা আশা করবো তুমি ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নিবে না। মায়া আমাদেরও মেয়ে হয়। ওর চিন্তা আমাদেরও আছে।

জামাল সাহেবের কথায় আরিফ হ্যাঁ বা না তেমন কিছুই বলেনি। শুধু ধীরস্থির ভাবে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ হলো। আরিফকে চুপ করে যেতে দেখে জামাল সাহেব বুঝলেন আরিফ ওদের কথায় সম্মতি জানিয়ে। সে এই বিয়েটা নিয়ে ভাববে। উপস্থিত সবাই খাবার টেবিলে নিশ্চুপ হয়ে খেতে লাগল। কেউ আর আগ-বাড়িয়ে কোনো কথা বলল না। শফিকুল ইসলাম খেতে খেতে নিরবতা ভেঙ্গে আবারও গম্ভীর গলায় বলল।

‘ তুমি চট্টগ্রামে ফিরে যাচ্ছে কবে?
‘ কাল রাতের ট্রেনে ফিরবো বাবা।
‘ আবার কবে আসবে?
‘ এক সাপ্তাহ পরই ফিরে আসব। হাতে কাজ গুলো শেষ করেই চলে আসব।
‘ মায়া আর জুই যাবে না তোমার সাথে?
‘ না বাবা। ওদের নিব না। এখন গিয়ে আবার এক সাপ্তাহ পর ফিরে আসাটা ঝামেলা হয়ে যাবে। ওরা থাক। বিয়ের শপিং টপিং করুক। আমি খুব জলদি ফিরে আসব।
‘ হুম!

খাবার টেবিলে খাওয়ার দাওয়ার পাট চুকিয়ে সবাই যার যার মতো করে চলে গেল। অথচ মায়া জানলই না ওর অগোচরে ওর বিয়ের তোরজোর চলছে বড়দের মধ্যে। আরিফ বাপ-চাচার কথা মতো সে চেয়ারম্যান সাহেবের বড় ছেলে নাদিমের সঙ্গে দেখা করলো। নাদিমকে আরিফের বেশ ভালোই লাগল। বেশ আন্তরিকতা ছেলে। তেমন খারাপ কিছু চোখে পরেনি। তারপরও আরিফ এই মূহুর্তে তার মতামত দিতে পারলো না। ভাবল আগে মুক্তার বিয়েটা শেষ করুক তারপর না-হয় সে এই বিয়েটা নিয়ে চিন্তা করবে।

#চলিত….

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here