#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৬৮)
সৃষ্টি স্কুল এন্ড কলেজ। রোজীর হাত ধরে ভেতরে চললো তামিম। এখানকার তিনজন স্যার তামিমের ব্যাচম্যাট। হয়তো তাদের সন্তানরাও এখানেই লেখাপড়া করে। হারুন নামের একটা কমন ফ্রেন্ড ছিলো। তার মেয়ে এবার ভার্সিটিতে পা রাখবে। এদিকে তামিম এসেছে তার বউকে ভর্তি করাতে। ভেবেই তামিমের অসস্তি হচ্ছে। কিছু করার নেই। অসস্তি গুলো ঢুবিয়ে রেখে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। আর যাই হোক ডক্টর তামিম খানের ওয়াইফ মূর্খ থাকবে এটা মেনে নেওয়া পসিবল না। তামিম রোজীকে একবার জিজ্ঞেস করে নেয় ” সার্টিফিকেট সাথে আছে তো? ”
” আছে। ”
” কত বছরের গ্যাপ?”
রোজী উত্তর করলো না। মাথা নিচু করে করে হাঁটতে লাগলো। টিচারগণ তামিমের সাথে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলো। বেশ কিছু আলাপচারিতার পর তাদের রোজীর দিকে নজর পড়লো। তামিমকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, “কে?”
তামিম রোজীর দিকে ফিরে হাত এগিয়ে দিলো। ইশারায় এগিয়ে আসতে বললো। তামিমের একজন ব্যাচম্যাট জানতে চাইলো, “এডমিশন নিবে? কোন ক্লাস?”
” ফাস্ট ইয়ার ।”
“কি হয় তোর?”
“ওয়াইফ।”
“হুয়াট?”
রিয়েক্ট করে যেন ব্যক্তি নিজেই অসস্তিতে পড়ে গেলো। তামিমের নিশ্চল শান্ত দৃষ্টি। রোজীর এডমিশন ফর্ম ফিলাপ করা হলো। তামিমের চোখ রোজীর হাতে কলমের উপর। হাত ঘুরানোটা একভাবে দেখে যাচ্ছে। তামিমের ব্যাচম্যাটরা মুচকি মুচকি হাসছে। তামিম ওসবে পাত্তা দিলো না। বাড়তি কিছু বললোও না। এদের মতি গতি ভালো ঠেকছে না। কখন কি মুখ ফসকে বলে ফেলে বলা যায়না। বের হবার সময় দেখে একে একে তিনজনই বেরিয়ে এলো। তামিমের পিঠে হাত রেখে বললো,”রেস্টুরেন্টে চল। ভাবীর সাথে এই প্রথম দেখা। খাতিরদারি না করে ছাড়লে ভীষণ খারাপ লাগবে।”
” ভাবী এখন তোদের স্টুডেন্ট হয়। ”
” তাতে কি? চল বেটা।”
রোজীকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” আমরা চারজন একসাথে লেখাপড়া করেছি বুঝলেন ভাবী? দেওয়ানপাড়া যে স্কুল সেই স্কুলটায়। ”
” ও আচ্ছা। ”
” ইজি হয়ে যান ভাবী। স্কুলে আমরা স্যার হলেও বাইরে আমরা আমরা সবাই আপনার দেবর। ”
রোজী জোর করে একটু হাসি দেয়। বেচারা এমনিতেই নিজেকে গুটিয়ে রাখে। আর এদিকে! না জানি এখন থেকে প্রতিদিন বের হবে প্রতিদিন অসস্তিতে পড়বে। এরইমধ্যেই তামিমের সাথে দুইবার চোখাচোখি হয়ে গেলো। একজন তামিমের পিঠে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
” সামনে তাকা ব্যাটা। আমাদের বউও এককালে কচি ছিল। তোর কচি বউয়ের সাথে শুধু কথাই বলছি নিয়ে যাচ্ছি না। ”
কি বেশরম কথা! রোজী লজ্জায় মাথাটা আরো নীচে নামিয়ে নিলো। রেস্টুরেন্টে চেয়ার টেনে গুটি শুটি হয়ে বসলো। “তো মামা! খুব মজায় আছোস তাইনা?” চোখ দিয়ে রোজীকে ইশারা করে।
তামিম বিরবির করলো, ” যে শুঁটকি! ধরতেও ভয় লাগে। ”
রোজী শুনতে পেয়েই চট করে মুখ তুলে তাকালো। পরক্ষনেই ওয়েটারের রেখে যাওয়া কোল্ড কফি নিজের দিকে নিয়ে পাইপে চুমুক বসালো। নিজেই নিজেকে মানাতে চাইলো, ” ঠান্ডা ঠান্ডা! সব ঠান্ডা।” কিন্তু তামিমদের আলাপচারিতা তাকে ঠান্ডা হতে দিলোনা। বরং গাল দুটো গরম হয়ে উঠলো একেকটা দুষ্টু দুষ্টু কথাবার্তায়। এসব শুনতে হবে জানলে রোজী গাড়িতেই বসে থাকতো। ভুলেও স্যারদের সাথে আড্ডায় বসতো না। বাড়ি ফেরার পথে রোজী এটাই ভাবতে লাগলো প্রথম দিনেই যা লজ্জা পেল পরের দিন গুলোতে স্যারদের সাথে আদৌ সহজ হতে পারবে তো? তামিম লক্ষ্য করে একবার জিজ্ঞেস করলো,
” রোজ? কিছু ভাবছো?”
রোজী মাথা নাড়ালো। সে কিছু ভাবছে না। মিনিট দুয়েক পর ই চাঞ্চল্য ভাব নিয়ে প্রশ্ন করে ফেললো,
” তখন আপনি কিছু বললেন না কেন?”
” কি বলবো? বললে কি কারো মুখ চুপ থাকতো?”
রোজী কি উত্তর দিবে খুঁজে পেলো না। আবার চুপ হয়ে গেলো।
পুরো রাত এক ঘুমে কাটিয়েছে তানভীর। অনেক দিন পর শান্তিতে ঘুম হলো । চোখ খুলেই নরম কিছুর উপর নিজেকে আবিষ্কার করলো। চট করে মাথা তুলতেই দৃশ্যমান হলো ঘুমন্ত এক নিষ্পাপ মুখ। ঘন পাপড়িগুলো প্রত্যেকটা কথায় নেচে নেচে উঠে। এখন একদম শান্ত! ঘন নিঃশ্বাসের শব্দটাই ফিরে ফিরে আসছে। তানভীরের শরীর মনের উপর শিহরণ বয়ে গেলো। মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো স্ত্রীকে। পুরুষ্ট ঠোঁটজোড়া নজর কাড়লো। আনমনেই বুকের উঠা নামা গুনতে লাগলো। সময়ের পর সময় বয়ে গেলো তানভীরের ঘোরের মাঝেই কাটলো। ভেতর থেকে গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। এই মেয়েটার কাছাকাছি এলেই কেমন তৃষ্ণা পায়। প্রবল জোয়ারের তৃষ্ণা। তানভীর ধীরে ধীরে ঠোঁটের দিকে এগুলো। আলতো করে একটা চুমু দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো। ঘড়িতে আটটা পচিঁশ। সাড়ে নয়টার মধ্যে কলেজে উপস্থিত থাকতে হবে। এ কয়দিন ছিলো না। ভাইস প্রিন্সিপাল সব দায়িত্ব পালন করেছে। এবার জবে ফেরা উচিত। তানভীর রেডি হতে বাঁধলো বিপত্তি। তার ড্রেস সিলেক্ট করতে করতে চেয়ারে সোফায় জড়ো হলো কয়েকখানেক স্যুট। অবশেষে গ্ৰে কালার স্যুটে নিজেকে তৈরী করে নিলো। বের হবার সময় কিছুক্ষন লাবিবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। লাবিবার ঘুমে কাঁদা চেহারা দেখে এবার বেশ মায়া লাগলো। ক্রুর হেসে কপালে একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়ে বসতেই সোহানা ট্রে এগিয়ে দিলো। লাবিবাকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” ছোট বউ যাবে না? ক্লাস তো শুরু হয়েছে। আজও যাবে না?”
“কাল থেকে যাবে। আজ একটু ঘুমোক।”
” আচ্ছা। ”
তানভীর সোহানার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। সোহানা জিজ্ঞেস করলো, ” হাসছো কেন ? পাজি ছেলে!”
তানভীর আরও একবার হাসলো সোহানার ধারণার উপর। মানুষের চোখ পড়ার কৌশল তানভীর ছোট থেকেই রপ্ত করে আসছে। আর এ তো নিজের মম। সোহানা এবার চোখ পাকালো। ধমকে বললো,
” খাবারের দিকে তাকাও। নির্লজ্জ ছেলে। ”
” থ্যাংকস মম। তোমাদের ছোট বউ তোমাদের এতো পছন্দের ছিল কখনও তো বললে না। ”
” হুম। বলি আর তুমি তুলে নিয়ে আসো। পাপার মান সম্মান খোয়াও। আবার হাসছে। খবরদার হাসবেনা। তানভীর! ”
তানভীর খাবার শেষ করে হাত মুছে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পেছন থেকে সোহানাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল মিশিয়ে দিল।
” বাবাহ! বউকে ঘুমোতে দিয়েছি বলে এতো আদর?”
” উমমম। আগেকার বউকে দেখেছি ভোরে না উঠলেই তুমি ডেকে ডেকে তুলে দিতে। এই বউগুলোর সাথে তেমন করোনা কেন বলোতো?”
” বউরা সকালেই উঠবে। প্রথম প্রথম জাস্ট একটু ছাড় দিচ্ছি। সারাজীবন সংসার কি আমি সামলাবো? বউদের সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে না?”
” সংসারের দায়িত্ব একমাত্র তোমার ছোট বউমাই নিতে পারবে। তাকে নিজের মতো করে গড়ে নিও। ”
তানভীর কথাটা শুনেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পেছন ফিরে দেখলো তামিম আসছে। সোহানা তানভীরের কথপোকথন শুনেই মন্তব্য টা করলো। পেছন পেছন রোজীকেও দেখা গেলো। কলেজ ড্রেস পড়নে রোজীকে দেখতে একদম বাচ্চা মেয়ে লাগছে। ঘাড় থেকে ব্যাগ নামিয়ে তামিমের পাশে এসে চেয়ার টেনে বসলো। রোজীকে এডমিট করানো নিয়ে সোহানা বেশ খুশি হয়েছে। রোজী যে একটা ট্রমার মধ্যে আছে এটা তার ব্যবহারেই যেনো মাঝে মাঝে প্রকাশ পায়। তার একটা ফ্রেন্ড সার্কেল গড়ে উঠুক। তাহলে স্বাভাবিক হয়ে যাবে আশা করা যায়। পড়াশোনাটাও জরুরী। তানভীর জিজ্ঞেস করলো, ” তোমার কাছে এমন কেন মনে হয় ভাইয়া? বড়বউ হিসেবে মম ভাবীকে নিজের মতো গড়ে নিতে পারে।”
” আপাতত আমার মন মতো গড়ে তুলতে চাই। ”
তানভীর হেসে রোজীকে বললো,
” পিচ্চি ভাবী। তাড়াতাড়ি বড় হতে হবে। ”
সোহানা রোজীর টিফিন বাটি ভরে দিলো। এতো এতো যত্ন পাওয়া সত্বেও রোজীর মন কেঁদে উঠলো। সোহানা শ্বাশুড়ি কম যেনো মা বেশি। এতো ভালোবাসা দেয় অথচ কাজ ছাড়া কথা বলেনা। কেমন যেনো বিরক্ত মুখে তাকায় তার দিকে। লাবিবার মতো যখন তখন কাছ ঘেঁষতে পারে না। জড়িয়ে ধরতে পারে না। এতো মায়া কাজ করে মানুষটার উপর। একটু মন খোলে কথাও বলতে পারে না।
লাবিবার ঘুম ভাঙ্গে বেলা দুটো নাগাদ। ঘড়ির টাইম দেখেই বিছানা ছাড়তে গেলে ব্যাথায় টনটন করে উঠে শরীর। করবে নাইবা কেনো? সারারাত আশি কেজি একটা মানুষকে নিজের উপর নিয়ে থাকলে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে না? আস্ত আছে এটাই ভাগ্য। রুমের অবস্থা দেখে লাবিবার মাথা ঘুরে গেলো। আলমারির সব কাপড় এভাবে ফেলে রেখেছে কেনো? রাতে তো রুমটা গোছানোই ছিলো। তানভীর কি ড্রেসের উপর নিজের রাগ ঝাড়লো? লাবিবা ঘুমিয়ে ছিলো সেজন্য? লাবিবা ঝটপট কাপড় গুলো গুছিয়ে নিলো। আলমারিতে রেখে গোসল করে ডাইনিং এ দৌড়ালো। ক্ষিধেয় পেট চো চো করছে। বাসায় কেউ নেই। সবাই বেরিয়েছে। জবেদা লাবিবাকে খাবার এনে দিলো। লাবিবা জিজ্ঞেস করলো, ” সবাই খেয়েছে?”
” না। সবাই সবার কাছে। আপনে খাইয়ে নেন। জানেন নাতো বড়বউরে কি সুন্দরই না লাগতেছিলো স্কুলের জামা কাপড় পরে। মনে হইলো মাত্রই বয়সন্ধিকালে পড়লো।”
” স্কুল কেন ?”
” আপনে দেখি কিছুই জানেন না। বড়বউ পড়াশোনা করবে। বড় ভাইজান তারে স্কুলে ভর্তি করে দিছে।”
লাবিবা আর উপরে গেলো না। রোজীর ফেরার অপেক্ষা করলো। ফিরতেই গিয়ে সামনে দাঁড়ালো। ঘুরে ঘুরে রোজীকে দেখলো। রোজীর দিকে অসহায় দৃষ্টি ফেললো। মাথা চুলকিয়ে বিড়বিড় করলো,
” আমার বড় জা এবার স্কুল ছাত্রী হয়ে গেলো!”
( গল্পটি সম্পূর্ণরুপে কপি পোস্ট করা নিষেধ। তবে শেয়ার দিতে পারেন। অনান্য আইডি বা পেইজে কপি, ওয়েবসাইটে পোস্ট, ইউটিউব ভিডিও বা থিম কপি করার অনুমতি নেই। )
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা