#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৭৪)
রোজীর মা বাবা জামাইয়ের ফোন পেয়ে খান বাড়িতে এসেছে। তামিম নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। রোজীর বাবা মাকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছে। সবটা দোষ তাদের উপর ই গড়িয়ে দিয়েছে। তামিমের মতে সন্তান যে হালেই থাকুক না কেনো তাকে দেখেশুনে রাখা বাবা মার দায়িত্ব। মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দেওয়া যেমন জরুরী সঠিক পথ দেখানোও তেমন জরুরী। এমন বাবা মা না থাকুক যারা মেয়ের সর্বনাশের কথা জেনেও তাকে আটকায় না। সঠিক পথে ফিরিয়ে আনে না। রোজীর বাবা মুখ তুলে তাকাতে পারছেন না। মাথা নিচু করে আছেন। রোজীর মা মুখে আঁচল চেপে গুনগুন করে কাঁদছেন। সোহানা ইসলাম চুপচাপ বসে আছেন। অবশ্য এসব নিউজ পাওয়ার পর পর ই রিসোর্ট বুকিং ক্যান্সেল করে দিয়েছেন । তার মনে একটা কথাই বারবার ফিরে ফিরে আসছে , ” সব আলোই সুখের আলো হয়না।” লাবিবা ঠোঁট ফুলিয়ে বসে একহাতে ফোনে টাইপ করছে। চ্যাট বক্সে আছে তানভীরের সাথে। মূলত এখানে কি হচ্ছে কি না হচ্ছে সব তানভীরকে ইনফর্ম করছে। তানভীর তামিমের ডাক পেয়ে কলেজ থেকে ছুটে গিয়েছে।
কিছুক্ষন বাদে তামিম বাসায় ফিরে। তীব্র গতিতে রোজীর বাবা মাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু তামিমকে দেখে মাথা নিচু করে রাখা রোজীর বাবা অপরাধী গলায় জানতে চাইলো,
” আমার মেয়েটাকে কোথায় রেখে এলে বাবা?”
” যেখানে তার থাকার কথা সেখানেই আছে। ”
গম্ভীর গলায় উত্তরটুকু করেই তামিম উপরে চলে গেলো। তামিমের রুমের টুং টাং আওয়াজ পেয়ে সোহানা লাবিবাকে কাছে ডাকলো।
” উপরে যাও তো মা। দেখ আমার ছেলেটা যেন নিজেকে আঘাত না করে। ”
লাবিবা মাথা নাড়িয়ে পা বাড়ালো। সোহানা থায় বসে থাকলো। উঠার কোনো ইচ্ছে দেখা গেলো না।
লাবিবা দরজার সামনে আসতেই দেখে রুমের অবস্থা পুরো খারাপ করে ফেলেছে তামিম। এদিক সেদিক হন্যে হয়ে খুঁজছে। লাবিবা ডাকলো, ” ভাই….”
” ওহ। ছোট বউ। আসো আমাকে হেল্প করো। ফ্লোরে যে জিনিস গুলো আছে একটু একসাইডে গুছিয়ে রাখো। ”
লাবিবা গুছাতে লাগলো যত তামিম জিনিস পত্র নতুন করে ততো ছুঁড়তে লাগলো। লাবিবা মনে মনে বললো,
“এরা দুই ভাই জিনিস ছুড়া আর পাগলামি সমান সমান।”
তামিম বহু সময় ব্যায় করার পর সফল হলো। খাটের ড্রয়ারে কম্ফোটের নিচ থেকে একটা বক্স বের করলো। বক্স খুলতেই বেরিয়ে এলো কাঙ্খিত জিনিস। তামিম রোজীর বুদ্ধির তারিফ করে তাচ্ছিল্য হাসলো। কেউই হয়তো ভাবতে পারবেনা সমস্ত ঘরে এতো জায়গা রেখে এখানেও কেউ লুকাতে পারে।
লাবিবা দেখেই মুখ চেপে ধরলো। হাত দিতে গেলেই তামিম হাত ধরে ফেললো।
” হাত দিও না। ”
“ভাইয়া এগুলোই ড্রাগস? প্রথম দেখলাম। কি নাম?”
” ইয়াবা, হিরোইন। ”
” তাঐ মাঐ জানতো? নিষেধ করেনি? এতোদিন তো আমাদের কাউকেও কিছু বলেনি। ”
” এখন এখান থেকে যাও। আমি একটু একা থাকবো।”
” বক্সটা নিয়ে যাই? সবাইকে দেখাবো?”
তামিম চোখ মুখ খিচে তাকালো।
” যেতে বলেছিনা আমি?”
ধমক খেয়ে লাবিবা দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তামিমের জন্য ভীষণ দুঃখ লাগলো। এই অকাজ টাতো সে নিজে করেছিলো। এতো বড় কথা লুকিয়ে রেখেছিলো। যদি জানতো রোজী ড্রাগ এডিক্টেড তাহলে ভুলেও তামিমের সাথে লিংক হতে দিতো না।
তামিম জোর কদমে এসে দরজা লক করে বীভষ্য চিৎকার করলো। নিজেকে দমাতে না পেরে নিজেই নিজের চুল টেনে ধরলো। রিপোর্ট টা এখনো চোখের সামনে ভাসছে। রোজীর কথা মোতাবেক সন্দেহ তালিকায় ছিলো রোজী অন্য কারো জন্য হয়তোবা তার প্রাক্তনের জন্য অসুস্থ। বন্ধু ডাক্তার হান্নান যখন বললো,
” মেয়েদের ইয়াবার নেশা শুরু হয় ঘুমের বড়ি থেকে। নানা ধরনের মানসিক যন্ত্রণার কারণে তারা যখন রাতে ঘুমাতে পারে না তখন তারা ঘুমের বড়ির আশ্রয় নেয়। তারপর ধীরে ধীরে ইয়াবার মতো অন্যান্য মাদকেও আসক্ত হয়ে যায়। ইয়াবা খেলে একজন মানুষের খিদে কমে যায়। সে তখন কম খায়। তার পেশীকে ক্ষয় করে ফেলে। মাংসপেশি শুকিয়ে গেলে একটু শুকনা মনে হয়, গাল ভেঙে যায়। হেরোইনের বেলাতেও দ্রুত গতিতে স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। কারণ তারা ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে পারে না। তাদের খাওয়ার প্রয়োজনও খুব একটা পড়ে না। কারণ হেরোইন বা ফেনসিডিল খেলে ক্ষুধা কেটে যায়। তাদের সাধারণ পুষ্টি চাহিদাও পূরণ হয় না। যার কারণে তাদের শরীরে সব ধরনের ভিটামিনের অভাব দেখা দিতে শুরু করে।
ফেনসিডিল ও হেরোইন খেলে শরীরে ঘুম ঘুম ভাব আসে। তন্দ্রার মতো হয়। একটা জায়গায় বসে তারা ঝিমুতে থাকে। যতদূর মনে হয় ভাবী অনেক দিন থেকে ড্রাগ সেবন করছে । ইয়াবা খেলে শরীরে একটা তাপ তৈরি হয় যা কিডনির ক্ষতি করতে পারে। যেহেতু এটিকে ধোঁয়া হিসেবে নেওয়া হচ্ছে তাই ফুসফুসে পানিও জমে। ভাবীর কিডনি এখনো অক্ষত থাকলেও ফুসফুসে পানি জমেছে। ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস হবার আগেই যে জানতে পেরেছিস আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর। ”
সেই মুহূর্তে তামিম স্তব্দ হয়ে রোজীর দিকে তাকিয়ে ছিল। একজন এডাল্ট বিবেকধারী হয়ে কিভাবে নিজের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে? আর কিভাবেই বা জেনে বুঝে তামিমের জীবনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারে ভাবতে পারছেনা। তামিমের জীবনে কম বড় ঝড় বয়ে যায়নি। সেতো মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়নি। তামিমকে তার পরিবার সামলিয়েছে। তাহলে রোজীর পরিবার কেনো মেয়েকে দেখে রাখলো না। বরং রোজীর প্রথম বিয়ে তারাই দিয়েছে। লোভে পড়ে খোঁজ খবর নিয়েই বিয়ে দিয়েছে। রোজীর আজকের যে অবস্থা সেজন্য একমাত্র তার ফ্যামিলিই দায়ী। রোজীর অবস্থা জানার পরও আবার লোভে পড়ে তামিমের হাতে তুলে দিয়েছে। এরা পেয়েছেটা কি? যেখানে নিজের মেয়ের জীবন অনিশ্চিত তখন সাহস হয় কি করে আরেকজনের দিকে হাত বাড়াতে? রাগের বশে রোজীর বাবাকে তার আসল জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছে। সন্তানের শত্রু যখন নিজের বাবা মা ই হয় তখন সন্তানের মৃত্যু নিশ্চিত।
তামিম নিজেকে সামলে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসে। রোজীর মা সোহানা ইসলামের হাত ধরে রোজীর বিষয়ে বলে যাচ্ছে। আর রোজীর বাবা মাথা নাড়িয়ে সায় দিচ্ছে। তাঁদের কথাবার্তা থেমে গেলো তামিম এসে দাঁড়াতেই। রোজীর বাবা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে মোটেই তামিম টললো না। বরং প্রস্তাব জানালো, ” বাবা, মা। এখন আপনাদের মেয়েকে নিয়ে তো আর সংসার করা যাচ্ছে না। এমনিতেই আপনাদের মতো মিডিল ক্লাস ফ্যামিলিতে বিয়ে করে নিজের মান খুইয়েছি। এখন মাদকাসক্ত বউ ব্যাপারটা লোকজনকে জানিয়ে আর জলটা আর ঘোলা করতে চাইছিনা। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো। মেয়েকে রিহাব থেকে নিয়ে বাসায় চলে যাবেন।”
রোজীর মা চিৎকার করে উঠে, “এসব কি বলছো বাবা? আমার মেয়ের দ্বিতীয় সংসার এটা। ”
” কোন ব্যাপার না। কিছু টাকা দিয়ে দিবো অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিবেন। লোভে পড়েই তো আজ এই অবস্থা। আমার সাথে পাঁচ দিন পর দেখা করবেন। কাবিনের টাকা সহ ডিভোর্স পেপার সাথে নিয়ে যাবেন। এখন আসতে পারেন। ”
রোজীর মা সোহানার হাত ঝাঁকিয়ে বলে,
“বেয়ান আপনি কিছু বলেন। আমার মেয়ে তো আপনার ও মেয়ে। জামাই বাবাজিকে বোঝান।”
সোহানা একটা কথাও বলেনা। রোজীর বাবা কাঁদতে কাঁদতে তামিমের পা জড়িয়ে ধরে , ” এতো বড় সর্বনাশ করোনা বাবা। আমার মেয়েটাকে তোমার পায়ে ঠায় দাও। বড্ড ভালো মেয়ে আমার। ও নিজে থেকে কোনো পাপ করেনি। ওকে আমরাই পাপের দিকে ঠেলে দিয়েছি। ওকে বুঝতে চায় নি। আমরা তো জানতাম না আমার মেয়েটা এতোটা যন্ত্রনায় দিন পার করছে। যখন ড্রাগ সমেত পেলাম তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্যই তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি। আমার মেয়েটাকে একটু বুঝো বাবা। এতো বড়ো শাস্তি দিও না। জেনে বুঝে আমরা পাপ করেছি আমাদের তুমি যা বলার বলো আমার মেয়েটাকে ঠায় দাও বাবা। ”
” আমার একটা শর্ত আছে। ”
” তোমার যে কোনো শর্তে আমি রাজি বাবা। শুধু আমার মেয়েটাকে আবার সংসার ছাড়া করো না। ”
” সম্পর্ক শেষ করতে হবে আমার রোজের সাথে। সারাজীবনের মতো। ”
কথাটা শোনা মাত্রই রোজীর বাবা মার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। রোজীর মা বলে উঠে,
” কী বলছো বাবা? মেয়েকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবো আমরা?”
” যেভাবে মেয়ের প্রথম সংসারের সময় ছিলেন। তখন মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে বছরের পর বছর না দেখে কাটিয়েছেন। আর এখন না হয় আপনার মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই আমি আপনাদের থেকে তাকে সারাজীবনের জন্য দূরে সরিয়ে দিলাম।”
রোজীর বাবা মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তামিমের দিকে। তামিম তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বললো, ” ফোনে মিসবিহেভ করার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কি করবো? মাথা ঠিক ছিলো না। বার বার একই ভূল কেনো করেন আপনারা? বড়লোক বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দিয়ে ভেবেছিলেন অনেক পাবেন। ছোট ছেলেরও লাইফ সেট । অথচ মেয়েটাই মরতে বসেছিল। তারপর যখন এমপির ছেলের প্রস্তাব এলো মেয়ে বিপথ যাত্রী জেনেও লোভ সামলাতে পারলেন না। একবার ভাবলেন না সবটা জানার পর আপনার মেয়ের আদৌ এখানে জায়গাটা হবে কিনা। যার গোড়াতেই মাটি নেই তাকে দিয়ে ফল লাভের আশা ছাড়ুন। অপশন দুটো। হয় মেয়ে সমেত টাকা নিয়ে চলে যান। নাহয় মেয়েকে ভালো রেখে নিজেরা দূরে কেটে পড়ুন। ”
রোজীর বাবা চোঁখের জল মুছে নিলো। বললো,
“তাই হবে বাবা। আমরা আর যোগাযোগ রাখবোনা। মেয়েটাকে একবার দেখতে চাই বাবা। ”
” তার ঠিকানা পাবেন না। আপনার ছেলে আসছে আপনাদের নিতে। ছেলের সাথে চলে যান। আর কখনো এদিক মুখী হবেন না। ”
(গল্পটি সম্পূর্ণরুপে কপি পোস্ট করা নিষেধ। তবে শেয়ার দিতে পারেন। অনান্য আইডি বা পেইজে কপি, ওয়েবসাইটে পোস্ট, ইউটিউব ভিডিও বা থিম কপি করার অনুমতি নেই। )
চলবে___
@লাবিবা তানহা এলিজা