#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩৪
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
ফিরে তাকালো মিসেস শীওর পানে, কাতর কন্ঠে বলল – আমাকে তুমি মারলে মাম্মাম!
জায়ানের কন্ঠে “মাম্মাম” শব্দটা কর্ণকুহরে হানা দিতেই আশ্চর্য বনে গেল সবাই। মিসেস শীওকে জায়ান মাম্মাম বলে ডাকছে কেন? তিনি কি তাহলে জায়ানের মা? কিন্তু এতদিন হয়ে গেল তৃষাম আর চ্যাং থাকে জায়ানের সাথে অথচ তাদের কলেজের মেডিকেল সেক্টরের ডাক্তার জায়ানের মা কেউ জানতে পারলো না? এদের দুজনের ব্যবহার দেখেও তো কখনও মনে হয়নি এরা মা ছেলে। তৃষাম আর চ্যাং গোল গোল চোখে চেয়ে আছে মিসেস শীও আর জায়ানের পানে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললেন মিসেস শীও। সকলের পানে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে অতঃপর তাকালেন নিজের ছেলের পানে, থমথমে কন্ঠে বললেন – আমি তোমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছি জায়ান। ভালোবাসাকে আঘাত করতে নয়।
জায়ান একটু এগিয়ে গেল মায়ের কাছে। চোখে মুখে তার কাতরতার ছাপ স্পষ্ট। কিছুটা ব্যাকুল কন্ঠে সে সে বলল – কিন্তু কৃষ্ণময়ী, ও যে আমায় ছেড়ে চলে যেতে চাইছে মাম্মাম, ঠিক বাবার মতো। বাবা যেমন তোমাকে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমাদের ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল ঠিক তেমনভাবে।
ছেলের কথায় ক্রোধ বাড়লো মিসেস শীওর। ঝাঁঝালো কন্ঠে তিনি বললেন – আমি কতবার তোমাকে বলবো জায়ান, তোমার বাবা পালিয়ে যায়নি কিংবা আমাদের ছেড়েও চলে যায়নি। তিন আসবেন, আবার ফিরে আসবেন আমাদের কাছে।
ঠোঁট এলিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো জায়ান। পরক্ষনেই আবার চিৎকার করে উঠলো ছেলেটা। উত্তেজিত কন্ঠে বলল – মিথ্যা বলছো তুমি মাম্মাম। বাবা আর কখনও ফিরবে না আমাদের কাছে। তিনি আমাদের ভালোবাসে না মাম্মাম।
একটু থামলো জায়ান কাতর কন্ঠে আবার বলল – তার যদি ফেরারই হতো মা তিনি এতদিনেই ফিরে আসতো মাম্মাম। শৈশবে যখন স্কুলে বন্ধুদের সাথে তাদের বাবাকে দেখে ঘরে ফিরে এসে আমি বাবা বাবা বলে চিৎকার করে কাঁদতাম বাবার ফেরার হলে তখনই ফিরতো। পার্কে খেলতে গেলে যখন দেখতাম অনেকেই তার বাবার সাথে খেলছে তখন আমি মন খারাপ করে এক কোনে বসে থাকতাম বাবার যদি ফেরার হতো তবে তখনই ফিরতো। বাবাকে একবার দেখার জন্য যখন আমি ঘুমের মধ্যেও বাবা বাবা বলে চিৎকার করে উঠতাম বাবার ফেরার হলে বাবা তখনই ফিরতো। কৈশোরে বাবার সম্পর্কে স্কুলের বন্ধু বান্ধবদের প্রশ্নে প্রশ্নে আমি যখন জর্জরিত, সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছিলাম। নিজেকে বন্ধ করেছিলাম একটা কক্ষে বাবা তখনও ফিরে আসেনি। বাবা কখনও ফিরবেও না মাম্মাম। কারন সে আমাকে ছেড়ে তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে, পালিয়ে গেছে তার নিজের ঠিকানায়।
মিসেস শীও আর সহ্য করতে পারলেন না। নিজের ভালোবাসার মানুষের সম্পর্কে এমন কথা কেই বা সহ্য করতে পারে? তিনি ধমকে উঠলেন জায়ানকে, ধমকের সুরে বললেন – জায়ান!
– ধমকাবে না মাম্মাম। তুমি মানতে চাও বা না চাও বাবা কখনও আর ফিরবে না, আমাদের কাছে আর আসবে না তিনি। আর এটাই সত্যি।
ছেলের কথার প্রেক্ষিতে চুপ হয়ে গেলেন মিসেস শীও। তীব্র ব্যথায় জর্জরিত হয়ে উঠলো তার বক্ষস্থল। চোখ দু’টো ভরে উঠেছে চিকচিকে অশ্রুকনার সমারোহে।সত্যিই তো জাফর চৌধুরী এখনও ফিরেনি। সেই যে বহু বছর আগে তার হাত দু খানা ধরে বলেছিল – আমি ফিরে আসবো শীও। তোমাকে আমার স্ত্রীর যথাযথো সম্মান দিয়ে আমার দেশে নিয়ে যাব। আমার জন্য অপেক্ষা করো তুমি।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত মিসেস চৌধুরী অপেক্ষা করছে জাফর চৌধুরীর তার স্বামীর কিন্তু সে ফিরেনি। তবে কি জায়ানের কথাই সত্যি? সে সত্যিই কি সে পালিয়ে গেছে তাদের ছেড়ে? না কখনও না, জাফর ভালোবাসে তাকে। সে যখন একবার বলেছে সে ফিরবে তখন সে অবশ্যই ফিরবে মিসেস শীওর কাছে। মিসেস শীওকে চুপ থাকতে দেখে জায়ান তার সাথে আর কথা বাড়ালো না। ফিরে তাকালো সে তৃষামের পানে। অনুনয়ের সুরে বলল – দেখ তৃষাম ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমি সত্যিই ভালোবাসি পূর্বাশাকে। ওকে আমার কাছ থেকে প্লীজ তোরা কেড়ে নিস না।
তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো তৃষাম। এতক্ষন জায়ান আর মিসেস শীওর কথাপকথনে তার হৃদয় নরম হয়েছে একটু হলেও। কিন্তু তাই বলে এই অবস্থায় মেয়েটাকে জায়ানের হাতে ছেড়ে দিতে পারে না সে। জায়ানের ক্রোধ সম্পর্কে সে ভালোভাবেই অবগত। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে মাত্র এই টুকু সময়ের মধ্যে মেয়েটার কি অবস্থা করেছে জায়ান? আর যদি সারা বছর থাকে তাহলে ঠিক কি হবে? মেয়েটা বাঁচবে তো আদও? হতে পারে পূর্বাশা তৃষামের আপন বোন নয়। কিন্তু বোন তো, বোন ব্যাতীত পূর্বাশাকে কখনও অন্য চোখে দেখেনি সে। পূর্বাশার কথা ভেবেই কিছুটা শক্ত কন্ঠেই তৃষাম বলল – কিন্তু পূর্বাশা তোকে ভালোবাসে না জায়ান। আর তাছাড়া আজকের পর পূর্বাশা চাইলেও আমি ওকে তোর কাছে রাখবো না। মাত্র কয়েক মুহুর্তে মেয়েটার কি অবস্থা করেছিস একবারও দেখেছিস?
জায়ান অনুতপ্ত হলো। অপরাধীর কন্ঠে বলল – ক্রোধের বশে করে ফেলেছি আমি ইচ্ছে করে করিনি।
– এই ক্রোধ, এই ক্রোধই শে’ষ করবে তোকে।
তৃষামের কথার মধ্যেই ভেসে এলো পূর্বাশার কন্ঠস্বর। এতক্ষনে মুখ খুলেছে মেয়েটা। ভাঙা ভাঙা কন্ঠে সে বলল – আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যাবে তৃষাম ভাই?
জায়ানের হৃদয়টা যেন যন্ত্রনায় হাহাকার করে উঠলো। এতটা ক্রোধ, এতটা পাগলামী না করলেও তো সে পারতো। মেয়েটার কি অবস্থা করেছে সে। তৃষাম উত্তর দেওয়ার আগেই জায়ান উত্তর দিল, বলল – আমি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে।
কথাটুকু শেষে করেই জায়ান এগিয়ে গেল পূর্বাশার পানে। হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে ধরবে ঠিক তখনই তাকে বাঁধা দিল তৃষাম। অতঃপর বলল – অনেক করেছিস তোকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমার বোনকে আমিই নিয়ে যাচ্ছি।
তৃষাম ধরে মেঝে থেকে তুললো পূর্বাশাকে। মেয়েটা আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। জায়ান আবার এগিয়ে গেল পূর্বাশার পানে, ধরতে চাইলো তাকে। কিন্তু তৃষাম সরিয়ে নিল পূর্বাশাকে। বেশ ঠান্ডা কন্ঠেই জায়ানকে বলল – জানিস তো জায়ান,
“অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়, অতিরিক্ত ভালোবাসাও এক সময় বিপরীত পক্ষের মানুষের জন্য কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়ায়।”
এই টুকু বলে থামলো তৃষাম আবার বলল – আসলে “অতি” শব্দটাই ভালো নয়।
নিজের কথার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে আর এক দন্ডও তৃষাম দাঁড়ালো না ছায়ানটের ফ্ল্যাটে। পূর্বাশাকে সাথে নিয়ে পা বাড়ালো ফ্ল্যাটের বাইরে। চ্যাং ও পিছু নিয়েছিল তাদের কিন্তু বাঁধ সাধলো তৃষাম, বলল – তুই জায়ানের কাছে থাক ওকে সামলা।
চ্যাং আর গেল না তৃষাম আর পূর্বাশার পিছু পিছু থেকে গেল জায়ানের কাছেই। জায়ান চেষ্টা করলো ফ্ল্যাট থেকে বেরুতে, পূর্বাশার সাথে যেতে কিন্তু তাকে আবার আটকে দিলেন মিসেস শীও। জায়ান তাকালো মিসেস শীও পানে। অধৈর্য কন্ঠে বলল – আমাকে যেতে দাও মাম্মাহ, নয়তো ওরা আমার কৃষ্ণময়ীকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে।
মিসেস শীও চোখ মুখ শক্ত করলেন। থমথমে কন্ঠে বললেন – তুমি যেটা করেছো তারপরও আমি পূর্বাশার পিছনে তোমাকে যেতে দিতে পারি না জায়ান। আমি মানছি তুমি ভালোবাসো মেয়েটাকে তবে এই মুহূর্তে তোমার ভালোবাসাও ওর জন্য বি’প’জ্জ’ন’ক।
নিজের কথা শেষ করেই মিসেস শীও জায়ানকে আটকে দিলেন ফ্ল্যাটে। জায়ানের কাছে থাকা ডুবলিকেট চাবিটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। জায়ান উন্মাদের ন্যায় দরজা ধাক্কাচ্ছে কিন্তু খুলে দিচ্ছে না কেউ। অবশ্য খুলে দিতে চাইলেও তো খুলে দিতে পারবে না। ফ্ল্যাটের সব চাবি যে মিসেস শীওর কাছে। চ্যাং ভয় পেল একটু। জায়ানের মন মানসিকতা এমনিই ভালো নেই এখন। তার উপর ঘরে বন্ধ করে রেখেছে। ছেলেটা যদি উল্টো পাল্টা কিছু করে বসে? আবার মিসেস শীওর কাছে কিছু বলতেও সাহস হচ্ছে না তার। কিন্তু বন্ধুর যদি সত্যিই কিছু হয়ে যায় তবে পরে হাজার সাহস দিয়েও বা কি করবে সে? জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো চ্যাং অতঃপর আমতা আমতা করে মিসেস শীওকে বলল – এভাবে জায়ানকে আটকে রাখা কি ঠিক হচ্ছে ম্যাম? যদি উল্টো পাল্টা কিছু করে বসে ও?
চ্যাং এর কথায় হাসলেন মিসেস শীও অতঃপর বললেন – আমার ছেলেকে আমি ভালোভাবে চিনি চ্যাং। পূর্বাশাকে ফিরে পাওয়ার জন্য নিজের করে পাওয়ার জন্য হলেও ও বেঁচে থাকবে।
কথাটুকু বলে একটু থামলেন আবার বললেন – ওর এখন কিছুটা সময় প্রয়োজন চ্যাং। এই যে দেখছো এখন উন্মাদের ন্যায় দরজা ধাক্কাচ্ছে এরপর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়বে ও। ভাবতে শুরু করবে আজকে ওর করা প্রতিটি ছোট খাটো ভুল নিয়ে। তারপর কাল থেকে দেখবে ও নতুনভাবে আবার পূর্বাশার ভালোবাসা পাওয়ার চেষ্টা করবে। তবে সেই চেষ্টার মধ্যে আজকের করা কোনো ভুল আর তুমি খুঁজে পাবে না। ও আর ক্রোধের বশে হোক কিংবা ভুলবশত কখনও পূর্বাশাকে আঘাত করবে না।
_____________________________________
সময় প্রবাহমান। সময়ের চিরচেনা এই প্রবাহমান গতিতে কেটে গেল টানা পাঁচটা দিন। এর মধ্যে জায়ান আর পূর্বাশার দেখা হয়নি একবারও। এতগুলো দিন পূর্বাশার দেখা না পেয়ে পাগল প্রায় ছেলেটা। মেয়েটা কোথায় আছে কিভাবে আছে জানে না কিছুই। তৃষামকে অনেকবার সে জিজ্ঞেস করেছে পূর্বাশার কথা কিন্তু ছেলেটা একটা বারের জন্যও মুখ খোলেনি। না’ই’টি পড়া ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়েও এবার আর লাভ হয়নি কোনো। ছেলেটা একেবারে মুখে কুলুপ এঁটেছে যেন। জায়ান কোথায় কোথায় না খুঁজেছে মেয়েটাকে কিন্তু কোথাও পায়নি। এই পাঁচটা দিনের প্রতিটা দিন পূর্বাশার হোস্টেলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিল সে কিন্তু পূর্বাশার দেখা পায়নি একটা বারের জন্যও। কলের উপর কল দিয়েছে বারবার বন্ধ বলছে। উইচ্যাট থেকে তো আগেই ব্লক মেরে দিয়েছে। মেয়েটার ক্লাসেও হানা দিয়েছে অনেকবার, কিন্তু ক্লাসে তার টিকি টির দেখাও নেই। মেয়েটা কি তবে দেশে ফিরে গেছে? যেতেও পারে। সেদিন তো বারবার বলছিলো দেশে ফিরে যাবে সে। কিন্তু দেশে ফিরে গেলে তাকে ফিরে পাওয়ার উপায় কি? পূর্বাশার বাড়িঘর কিছুই তো চিনে না জায়ান। বাংলাদেশে গিয়ে যে তাকে খুঁজে আনবে তাও পারবে না। আর এই ব’দ’মা’ই’শ তৃষামটাও কিছু বলছে না। না এখন যা করার জায়ানকে নিজেকেই করতে হবে। আচ্ছা চীনে তো ফেসবুক ব্যা’ন্ড। এখানে ফেসবুকের পরিবর্তে উইচ্যাট ব্যবহার করা হয়। আর বাংলাদেশে আবার উইচ্যাট ব্যবহার করা হয় না সেখানে ফেসবুকই জনপ্রিয়। আরও কিছু সময় নিয়ে ভাবলো জায়ান। অতঃপর চ্যাং এর কাছ থেকে প্রয়োজন বলে তার মোবাইলটাও সাথে নিয়ে হোস্টেল ছেড়ে নিজ ফ্র্যাটে ফিরলো জায়ান। ফ্ল্যাটের দরজা ভালোভাবে বন্ধ করে ভিপিএন কানেকশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সার্ভার থেকে ফেসবুক ওপেন করলো জায়ান। আগে থেকেই অবশ্য ফেসবুকে তার আইডি ছিল একটা। বাঙালিদের প্রতি কৌতুহল, এবং বাঙালিদের জানার আগ্রহে আইডিটা খুলেছিল সে। আইডিতে ফ্রেন্ড সংখ্যা মোটামোটি হলেও কথা হয়নি কারো সাথে। কি বলবে সে? এমনিও হুট করে অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতে একদম স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না সে। তার উপর অনলাইনে এ তো একদম অপরিচিত। জায়ান তার সেই আইডি থেকে লাইভে আসার সিদ্ধান্ত নিল।
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link