#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩১
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পাশ ফিরে তাকাতেই দৃশ্যমান হলো জায়ানের টকটকে লাল মুখ খানা। আশেপাশে কোনো দিকে না তাকিয়ে পূর্বাশার হাত টেনেই হাঁটা ধরলো ভীর ঠেলে। পূর্বাশা বাঁধা দিল জায়ানকে। কিছুটা উঁচু কন্ঠেই বলল – আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?
জায়ান উত্তর দিল না কোনো। তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়ছে ছেলেটা। টানতে টানতে পূর্বাশাকে নিয়ে গেল কোথাও একটা। তৃষামও হন্তদন্ত হয়ে পিছু নিয়েছিল পূর্বাশা আর জায়ানের। কিন্তু কিছুটা দূরে গিয়েই সে হারিয়ে ফেলল ওদের। চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়লো তৃষামের। জায়ানের ক্রোধ সম্পর্কে সে ভালোভাবে অবগত। এর আগে জায়ানের তীব্র ক্রোধের সাথে বেশ অনেকবারই পরিচয় ঘটেছে তার। মেয়েটাকে এই ভাবে কোথায় নিয়ে গেল কে জানে? আবার ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যদি জায়ান ক্ষতি করে দেয় পূর্বাশার? তখন কি হবে? সে কি উত্তর দিবে পূর্বাশার বাবাকে। চিন্তায় যেন মস্তিষ্ক ফেটে যাওয়ার উপক্রম তৃষামের। সে বেশ ভালোভাবেই জানে জায়ান এই মুহূর্তে জায়ানকে হাজার কল দিলেও সে তার কল রিসিভ করবে না। তবুও নিজের চিন্তা থেকে নির্বাসন পেতে বার কয়েক কল করলো জায়ানকে। তবে জায়ন ধরলো না তার কল। চিন্তিত ভঙ্গিতে তৃষাম পূর্বাশা আর জায়ানকে খুঁজতে শুরু করলো আশেপাশে। সাথে অবশ্য চ্যাং ও আছে, সেও মরিয়া হয়ে খুঁজছে দুজনকে। জায়ান কোথায় যেতে পারে পূর্বাশাকে নিয়ে?
জায়ান পূর্বাশার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল কলেজের পাশেই এক পার্কে। নীরব নিস্তব্ধ চারপাশটা। জনমানবের দেখা নেই তেমন। দুই একজনের আবছা অবয়ব দেখা যাচ্ছে তাও কিছুটা দূরে। রাতের দিকে এসব পার্কে জনমানবের দেখা একটু কমই পাওয়া যায়। পূর্বাশা আশেপাশে তাকালো, স্থানটা পর্যবেক্ষণ করে বলল – আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?
জায়ান উত্তর দিল না কোনো। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে অগ্নিঝড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পূর্বাশার পানে। অতঃপর হুট করেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে। কম্পিত হলো মেয়েটার ছোট খাটো দেহখানা। বিদ্যৎতের ঝটকানিতে যেন স্তব্ধ হলো সে। অজানা, অদ্ভুত এক শিহরণে দাঁড়িয়ে গেল দেহের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোমকূপদ্বয়। এই প্রথম গভীরভাবে কোনো পুরুষের ছোঁয়া তার অঙ্গে। লজ্জা, সংকোচ, ভয়ে যেন জমে গেল মেয়েটা। ক্ষানিক সময় পর চৈতন্য ফিরলো পূর্বাশার। ফোঁস, ফোঁস আওয়াজ কর্ণে পৌঁছালো তার। হয়তো জায়ান নিজের ক্রোধ সংবরণের চেষ্টা চালাচ্ছে তাকে জড়িয়ে রেখেই। কিন্তু এর সাহস হলো কি করে একজন নারীর অনুমতি ব্যাতীত তাকে এভাবে স্পর্শ করার? চীনে হয়তো এটা সাধারণ বিষয়। এদেশে নিজেদের কুশলাদি বিনিময়ের জন্যও একজন পুরুষ আরেকজন নারীকে জড়িয়ে ধরে কিন্তু বাংলাদেশে এটা মোটেই সাধারণ বিষয় নয়। পূর্বাশা বাঙালি, এদেশে এসে সে তার অস্তিত্ব ভুলে যায়নি। আর জায়ান হয়তো বড় হয়েছে এদেশে কিন্তু বাঙালীদের সম্পর্কে বেশ ভালোই জ্ঞান আছে তার। তবে কি সে জানতো না একজন বাঙালি নারীকে চাইলেই যখন তখন এভাবে জড়িয়ে ধরা যায় না? ফুঁসে উঠলো পূর্বাশা। নিজের দুই হাত তুলে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল জায়ানকে। আকস্মিক ধাক্কায় দুই কদম পিছিয়ে গেল ছেলেটা। চোখ তুলে পূর্বাশার পানে তাকানোর আগেই সজোরে একটা থাপ্পর পড়লো জায়ানের ডান গালে। হতবাক হলো ছেলেটা, চোখ তুলে তাকালো পূ্র্বাশার পানে। মেয়েটা রণমুর্তির রূপ ধারণ করেছে যেন। আনমনেই জায়ানের হাত চলে গেল তার ডান গালে। পূর্বাশা ক্রোধিত হলো আরও। শক্ত কন্ঠে বলল – আপনার সাহস হলো কি করে আমাকে এভাবে স্পর্শ করার, এভাবে জড়িয়ে ধরার?
জায়ানের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। দাঁতে দাঁত চেপে সে জবাব দিল – কেন আমি স্পর্শ করলে বুঝি তোমার শরীরে ফোস্কা পড়ে আর ঐ ইয়ানটা স্পর্শ করলে ভালো লাগে?
– একদম বাজে কথা বলবেন না। ইয়ান আমাকে কখনও স্পর্শ করেনি।
– তাহলে সেদিন ওটা কি ছিল? সেদিন পার্কে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার সময় তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিল কেন ও?
আমতা আমতা শুরু করলো পূর্বাশা। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল – সে তো পড়ে যাওয়া থেকে আমাকে বাঁচাতে ধরেছিল। তাছাড়া ইয়ান আপনার মতো এত গাঢ়ভাবেও স্পর্শ করেনি আমাকে।
জায়ান মুখ বাঁকালো। গম্ভীর কন্ঠে বলল – কাউকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে যে জড়িয়ে ধরতে হয় তা আমার জানা ছিল না। আর তাছাড়া আমিও তোমাকে বাঁচানোর জন্যই জড়িয়ে ধরেছিলাম।
ভ্রু কুঁচকালো পূর্বাশা। সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করলো – আমাকে বাঁচানোর জন্য? তা কি এমন বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করেছেন আপনি শুনি।
– আমার ক্রোধ থেকে।
জায়ানের ভাবলেশহীন জবাব। গা জ্বলে উঠলো পূর্বাশার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল – ক্রোধ থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য জড়িয়ে না ধরে নিজের ক্রোধ কমালেই তো পারেন।
– সেটাই তো করলাম। তোমাকে জড়িয়ে ধরে তোমার স্পর্শেই তো নিজেকে এত তাড়াতাড়ি শান্ত করতে পারলাম। নয়তো তুমি যা করেছো এতক্ষনে তোমার ঘাড় থাকতো একদিকে আর মাথা থাকতো আরেক দিকে।
কপালে ভাঁজ পড়লো পূর্বাশার। কপাল কুঁচকে শুধালো – কি করেছি আমি?
জায়ানের মুখশ্রী থমথমে হলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল – ইয়ান যখন তোমাকে প্রেম নিবেদন করেছে তখন তুমি ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিলে। কই আমি প্রেম নিবেদন করলে করলে তো ওভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকো না উল্টো শক্ত কন্ঠে প্রত্যাখ্যান করে আমার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করো।
– আসলে ইয়ান যখন আমাকে প্রেম নিবেদন করেছিল আমি একটু চমকে গিয়েছিলাম। একে আমার মতো কুৎসিত চেহারার অধিকারী নারীকে কারো প্রেম নিবেদন করার কোনো কারন আমি দেখছি না। তার উপর পরপর দুজন সুদর্শন যুবক আমার সম্মুখে প্রেমের দাবি নিয়ে দাঁড়ালো তাই একটু আশ্চর্য হয়ে থম মেরে গিয়েছিলাম এ ছাড়া আর কিছুই নয়।
জায়ান তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো পূর্বশার পানে। থমথমে কন্ঠে প্রশ্ন করলো – তুমি কি আমার সাথে সাথে ইয়ানকেও সুদর্শন বললে?
চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে এলো পূর্বাশার। সন্দিহান কন্ঠে শুধালো – কেন সে সুদর্শন নয়?
– না ওর থেকে আমার কোবরাও ভালো।
পূর্বাশা অবাক হলো। কোবরা! কোবরা তো সাপের নাম। পৃথিবীর সবচেয়ে বি’ষা’ক্ত প্রজাতির সাপগুলোর মধ্যে কোবরা একটি। তার এক কা’ম’ড়ে বিশজন পর্যন্ত মানুষের জীবন কে’ড়ে নেওয়ার মতো বি’ষ থাকে। এই সাপ আবার এলো কোথা থেকে? তবে কি জায়ান সা’প পালন করে? করতেও পারে। বিদেশী মানুষের তো কত শখই থাকে। এরা অজগর থেকে শুরু করে সব প্রানী নিজেদের বশে আনতে পছন্দ করে। কিন্তু তাই বলে এতটা বি’ষা’ক্ত সাপ কেউ নিজের পোষ্য হিসেবে পালন করে? পূর্বাশা আর একটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য জায়ানকে প্রশ্ন করলো – কোবরা! এই কোবরাটা আবার কে?
– আমাদের কুকুরের নাম।
পূর্বাশা অবাক না হয়ে আর পারলো না। কু’ত্তা’র নাম শেষ পর্যন্ত কোবরা? মেয়েটার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো – আপনি একটা কু’ত্তা’র নাম কোবরা রেখেছেন জায়ান ভাই? যার একটি প্রজাতিকে সাপের রাজাও ধরা হয় আপনি কিনা সেই নাম একটা কু’ত্তা’কে দিয়ে দিয়েছেন?
মনে মনে এত কথা ভাবলেও মুখে কিছুই বলল না মেয়েটা। তাকে এখন হোস্টেলে ফিরে যেতে হবে। হুট করে কোথা থেকে এসে জায়ান হোস্টেলের সম্মুখে এসে তার নাম ধরে ডাকাডাকি করছিলো তখন নেমে এসেছিল পূর্বাশা। তারপর তো এত কাহিনী। এখন হোস্টেলে না ফিরলে দেখা যাবে হোস্টেল কতৃপক্ষ গেট আটকে দিয়েছে। আর গেট আটকানোর পর কতৃপক্ষ আর সহজে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দেয় না কাউকে। পিছন ঘুরে কলেজে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো পূর্বাশা। পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো জায়ান। থমকে দাঁড়ালো মেয়েটা। পিছন ঘুরে কিছুটা শক্ত কন্ঠে বলল – হাত ছাড়ুন, আমাকে হোস্টেলে ফিরতে হবে।
ওষ্ঠ বাঁকালো জায়ান। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল – কেন? ইয়ানের ভালোবাসা গ্রহন করতে?
– আমি কারো ভালোবাসাই গ্রহন করবো না। না আপনার আর না ইয়ান।
– কেন করবে না?
– সেই কইফিয়ত আমি আপনাকে দিতে বাধ্য নই।
জায়ানের কন্ঠস্বর নরম হলো কিছুটা। কাতর কন্ঠে বলল – আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি কৃষ্ণময়ী।
পূর্বাশা মুখ ঘুরিয়ে নিল। শক্ত কন্ঠে বলল – কিন্তু আমি বাসি না।
– এ কথা অনেকবার শুনেছি এখন অন্য কথা বলো। প্রত্যাখ্যান করতে হলেও অন্য কিছু বলে প্রত্যাখ্যান করো। এই এক কথা “ভালোবাসি না, ভালোবাসি না” শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ আমি।
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল পূর্বাশা। ভাবলো ছেলেটাকে এখন বলা উচিৎ কিছু। হয়তো অতীতের সবটা নয় অন্তত কিছুটা বলা উচিৎ। তাতে হয়তো জায়ান পিছু ছাড়বে তার। সত্যিই ভালোবাসুক বা অভিনয় করুক যেটাই হোক না কেন তাকে থামানো উচিৎ এখন। এই সকাল বিকাল এত ভালোবাসি ভালোবাসি নামক বি’ষা’ক্ত শব্দটা শুনতে আর ভালো লাগছে না তার। জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো পূর্বাশা অতঃপর জায়ানের পানে তাকিয়ে বলল – অতীতে আমিও কাউকে ভালোবেসেছিলাম।
হৃদয় কাঁপলো জায়ানের। পূর্বাশা ভালোবাসতো কাউকে? এখনও কি তাকেই ভালোবাসে মেয়েটা? যার জন্য বারংবার প্রত্যাখ্যান করছে তাকে? বক্ষস্থল যেন জ্বলে উঠলো জায়ানের। নিজের ভালোবাসার মানুষটার কন্ঠে অন্যকাউকে ভালোবাসার কথা শ্রবন করা যে কি নিদারুন যন্ত্রনার তা কাউকে সে বোঝাবে কি করে? অস্থির হলো ছেলেটার চিত্ত। কম্পিত কন্ঠে শুধালো – এখনও ভালোবাসো তাকে?
– না তবে সে….
এইটুকু বলতেই পূর্বাশাকে থামিয়ে দিল জায়ান। মেয়েটা এখন আর ভালোবাসে না তাকে এইটুকু তথ্যই যথেষ্ট তার জন্য। অতীতে কি হয়েছিল বা পূর্বাশার কন্ঠে অন্য কোনো পুরুষের সাথে তার ভালোবাসার গল্প শুনে নিজের হৃদয় ব্যথিত করার কোনো ইচ্ছে নেই তার। নিজের ভালোবাসার মানুষের কন্ঠে অন্য কাউকে তার ভালোবাসার কথা শ্রবন নিশ্চই কোনো সুখকর অনুভূতির জন্ম দিবে না। এমনিই এই রমনীর কন্ঠে সকাল বিকাল “ভালোবাসি না, ভালোবাসি না।” শুনতে শুনতে হৃদয় ক্ষত বিক্ষত তার। এমন হৃদয় এখন আবার মরিচ ছিটানোর কোনো ইচ্ছে নেই জায়ানের। সে বাঁধা দিল পূর্বাশাকে অতঃপর নিজে বলল – আর কিছু শুনতে চাইছি না আমি। তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং বাসবো এটাই সত্যি। এখন এতে যদি তোমার কোনো ভয়ংকর অতীত থাকে, চার পাঁচটা বাচ্চা কাচ্চা থাকে থাকুক তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। সবটা মেনেই আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং বাসবো।
মৃদু হাসলো পূর্বাশা। তাচ্ছিল্যের কন্ঠে বলল – সব আবেগ। আবেগ কেটে গেলে হয়তো আমিও কেটে যাব।
জায়ান এগিয়ে গিয়ে পূর্বাশার নিকটে দাঁড়ালো। একটু ঝুঁকে নিজের মুখটা নিল মেয়েটার কানের কাছে। মৃদু কন্ঠে বলল – একবার আমাকে গ্রহন করেই দেখো না কৃষ্ণময়ী। এই আবেগটাকেই তোমার দৃষ্টিতে ভালোবাসায় রূপান্তর করে ছাড়বো আমি।
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link