#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
১৫.
মনোয়ারা রেহমান চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ছিলেন। অন্তূ অনুমতি চাইলে চোখ মেলে বললেন, “এসো।ʼʼ
অন্তূ চেয়ারে বসল। মনোয়ারা চশমা চোখে আটলেন। অন্তূকে দেখলেন দু’বার। পরে বললেন, “বুঝতে পারছো তো, কেন ডেকেছি?ʼʼ
-“জি, বুঝতে পারছি।ʼʼ
-“জয় আর তোমার সম্পর্ক কতদিনের?ʼʼ
অন্তূর মস্তিষ্ক হুটহাট বিষয়টা ধরতে পারল না। কয়েক সেকেন্ড পর হুট করে কথাটা বোধগম্য হতেই কপাল টান করল। কেন যেন মনে হলো, ম্যাম ওকে ভড়কাতে বলেছেন কথাটা। অন্তূ বলল, “আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই, ম্যাম!ʼʼ
-“হু, নেই। ছিল তো! সেটা কতদিনের ছিল?ʼʼ
মনোয়ারা আশা করেছিলেন অন্তূ থতমত খাবে, অবাক হবে, অথবা লজ্জা পাবে নয়ত উত্তেজিত হয়ে উঠবে। অথচ ওনাকে অবাক করে দিয়ে অন্তূ শান্ত চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “এ কথা কোথা থেকে শুনেছেন?ʼʼ
-“সম্পর্ক ছিল কিনা সেটা বলো। থাকলে কতদিনের কতদিনের ছিল?ʼʼ কঠিন হতে চাইলেন মনোয়ারা রেহমান।
অন্তূ নির্বিকার স্বরে বলল, “আমি এবং জয় এই দুটো শব্দের সাথে সম্পর্ক শব্দটা মাত্রাতিরিক্ত বেমানান, ম্যাম। কথাটা আপনি হয় আমাকে ডিস্ট্র্যাক্ট করতে বলছেন, অথবা যদি কারও কাছে শুনে থাকেন, তবে সেটা গুজব ছিল। বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।ʼʼ
ভেতর ভেতর থমকালেন মনোয়ারা। একটা ছোট্ট ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে এতটা নির্লিপ্ত, স্পষ্টভাষী আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিধার হয় নাকি? হুট করে উনার মনে হলো, ওই নীরব অগ্নি-প্রজ্জ্বলিত চোখ মিথ্যা বলতে পারেনা, বানোয়াট কথা বলার জন্য বিবেককে যতটা নিচে নামাতে হয়, সেই সিঁড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে অন্তূর চোখের আওয়াজহীন হুংকারে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন মনোয়ারা। অন্তূ এর ফাঁকে স্বল্প আওয়াজে জিজ্ঞেস করল, “কে বলেছে এই কথা, ম্যাম!ʼʼ
মনোয়ারা অন্তূর কথা অগ্রাহ্য করে বললেন, “নিকাবটা খোলো।ʼʼ
অন্তূ খুলল। মনোয়ারা কয়েক সেকেন্ড যাবৎ খুঁটিয়ে দেখলেন। চোখ ফিরিয়ে বললেন, “এসবের মাঝে ফাঁসলে কী করে, মেয়ে?ʼʼ
অন্তূ শ্বাস নিলো একটা, ঠোঁট কাঁমড়ে বলল, “জানিনা, ম্যাম। কীভাবে কীভাবে জানি কোথা থেকে জলের প্রবাহ কোথায় গড়াচ্ছে, বুঝতে পারছি না।ʼʼ
মনোয়ারা এতক্ষণে সম্পূর্ণ মনোযোগ অন্তূর ওপর নিক্ষেপ করলেন, হাত দুটো একত্র করে টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে জানালেন, “জয়ের তো মাথা খারাপ। তুমি ওর নজরে পড়লে কী করে? ও বদ্ধ পাগল একটা। পাগল না ঠিক। পাগলরা তো মানুষ নিয়ে খেলতে জানেনা, মজাও পায়না তা কোরে। অথচ জয় হলো ক্ষুধার্ত পশুর মতো, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। কী করেছিলে? ওকে অপমান করেছিলে? এতটা বিদ্রোহী হওয়া শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর, বুঝলে? ভার্সিটিতে র্যাগিং খায়নি কে? তবুও মুখ বুজে থাকে কেন? এ ব্যাপারে আগে শোনোনি কোনোদিন? সমাজটা ক্ষমতার, ক্ষমতা সব জয়দের গোলাম। তুমি একটা সাধরণ মেয়ে এত প্রতিরোধ গড়তে গেছো কোন শখে? তোমার অতি মূল্যবান সম্মানকে জয় সাবানের মতো পানিতে ভিজিয়ে ঘষে ঘষে একটু একটু করে ক্ষয় করবে। প্রতিদিন পানিতে ভেজাবে, ফেনা উঠবে। তোমার সম্মান ক্ষয়ে ধুয়ে যাবে পানির সাথে।ʼʼ
অন্তূর বুকের ভেতর জ্বলন শুরু হলো। মস্তিষ্কে চাপ অনুভূত হচ্ছে। এসব যে সে আন্দাজ করেনি, তা নয়। জয় বলেছিল, সে সিংহের মতো থাবা দেয়না, কুকুরের মতো পিছনে লেগে থেকে অল্প-অল্প করে ঘায়েল করে। তবুও জয়ের সাময়িক ঢিল দেয়াতে ব্যাপারটা ভুলে যাচ্ছিল, আর সেই সাহসে একটা বড় পাপ করে বসেছে। জয় ভার্সিটির ভিপি, আর তার বিরুদ্ধে সে অভিযোগ করেছে সাধারণ সম্পাদকের কাছে। ভেতরটা অস্থির, তবুও অটল বসে রইল। মনোয়ারা বললেন, “ধৈর্য্যের এত ঘাটতি তোমার মতো বুদ্ধিমতি মেয়ের সাথে সাথে মানাচ্ছে না, মেয়ে। এই যে শীতল, কঠোর, কেয়ারলেস ভাবটা, এটার আসল প্রয়োজন ছিল জয়ের সামনে।ʼʼ
দৃঢ় হলো অন্তূর কণ্ঠস্বর, “ম্যাম! নিজের সামনে নিজের আত্মমর্যাদাকে এক-কোপে বলি হতে দেখেও ধৈর্য্য ধারণ করার মতো পুরু ধৈর্য্য নেই আমার। আমার ধৈর্য্যের প্রাচীর এইসব ক্ষেত্রে খুব পাতলা, মসৃণ। নিজের অজান্তেই তা চিরে প্রতিরোধ বেরিয়ে আসে।ʼʼ
মনোয়ারা অদ্ভুত হাসলেন, “আমাদের সমাজে ক্ষমতাবানদের দুটো ধরণ আছে। কেউ কেউ ক্ষমতার জোরে তৎক্ষণাৎ থাবা দিয়ে ধরে, আর কেউ ছাই হাতে মাখিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে যত্ন করে ধরে। তবে ভয়ানক দ্বিতীয়টা। ছাই দিয়ে মাছ ধরলে আর ছুটতে পারেনা, জানো তো! জয় খুব জেদি। তোমার অপমানগুলো কতটা বাজেভাবে পুষে রেখেছে ভেতরে, তা জানা নেই আমার। তবে ওর মাথা নষ্ট। ও বহু পুরোনো জিনিস পুষে রেখে খুব জঘন্যভাবে তার কর্যা চুকিয়ে নেয়। সে এমনি এমনি ভিপি হয়নি, নিজের চতুরতা এবং জিদের তেজে শক্ত ভিত গড়ে বসেছে। যখন অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হলো, এক ছাত্রনেতার সাথে ঝামেলা হয়েছিল। ছেলেটা জয়কে লেজকাটা, বেজন্মা বলেছিল। জয় হেসেছিল সেদিন। দু বছর পর সেই ছাত্রনেতা বেরিয়ে গেল অনার্স শেষ কোরে। ততদিনে জয় একটা পাকাপোক্ত খুঁটি গেড়ে ফেলেছিল ছাত্রদলে। জুনিয়ররা মান্য করতে শুরু করেছিল ওকে। এরই মাঝে হামজা সাধারণ সম্পাদক থেকে ক্রমান্বয়ে ভিসি অবধি হয়ে গেল। পুরো ভার্সিটি তার চোখের তারায়। এরই মাঝে এমন বহুত কর্মকাণ্ড দুজনে রে ফেলেছিল, যাতে কোরে দুজন আলোচনায় এসেছিল, মানুষ ওদের চিনেছিল। এরপর লেগে গেল গণসেবায়। ধীরে ধীরে নেতৃত্ব ছড়ালো দুজনের। লোকজনের মনোযোগ পেয়ে গেল হামজা। ছাত্ররা দিনদিন জয়ের পিছনে স্রোতের বিপরীতে ছুটে আসা পিঁপড়ের মতো ভিড় করতে শুরু করল। পরের ছাত্র নির্বাচনে ভিপি হলো জয়।
সে বছর সেই ছাত্রনেতার বোন ভর্তি হলো ভার্সিটিতে। রাতের বেলা গার্লস হোস্টেলের দেয়াল টপকে রুমে গিয়ে জয়ের পার্টির দুটো ছেলে মেয়েটাকে নোংরা স্পর্শ করেছিল। ভিডিও বানিয়েছিল সেটার। সেটা পরেরদিন পুরো ভার্সিটি দেখল। ছেলেদুটোর মুখ চেনা গেল না। সেই ছাত্রনেতা এলো। জয় সামান্য হেসে বলেছিল, ‘ভাই, আপনি যে কারণে আমাকে বেজন্মা, জারজ, লেজকাটা বলেছেন। সেই কারণটা যথেষ্ট ছিল না এই নামগুলো ধারণ করার। এজন্য ওই গালিগুলো আমার ওপর জায়েজ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়ে দিলাম। আমি যা না, তা বলে গালি দিয়ে আপনি মিথ্যাবাদী হবেন, পাপী হবেন কেন? আমার বাপ-মা নেই, কিন্তু জন্ম তো আমায় অবৈধভাবে দেয়নি। কিন্তু আপনি বকলেন তা বলে। হয় আমার নিজেকে প্রমাণ করতে হতো যে আমি অবৈধ না, অথবা অবৈধদের মতো কাজ করে প্রমাণ করতে হতো যে আপনি ঠিকই বলেছেন। তাই আপনি যা বলেছেন তা কায়েম হোক, আমিই আপনার গালাগালির জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে নিলাম আমার নোংরা কাজ দ্বারা।ʼ
তার পরের দিন সেই মেয়ে আত্মহত্যা করল।ʼʼ
মনোয়ারা অদ্ভুতভাবে হাসলেন এ পর্যায়ে, “জানো তো, ওর বাপ-মা নেই। বেজন্মা কথাটা খুব লেগেছিল ওর। ওকে এতিম বলা চলে, কিন্তু জারজ তো না ও। এতিমকে জারজ বলাটা ঠিক না। এটা ওরই বক্তব্য। আমার কাছে এভাবেই নিজের সাফাই গেয়েছিল। আমরা যে বিষয়টাকে সিম্পলি চিন্তা করি, ও সেটাকে নোংরাভাবে, কঠিনভাবে সাজায়। তুমি কাউকে শয়তান বললে সে উল্টো তোমাকে গালি দেবে, শোধ হয়ে যাবে। জয় তা করবে না। বরং তোমার বলা শয়তান কথাটাকে সত্যি করতে নিজে এমন কিছু করবে, যাতে সত্যিই ওকে শয়তান বলা জায়েজ হয়। ও রাজনীতিতে এসে বহুবার বহুভাবে জখম হয়েছে, মার খেয়েছে, সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু কোনোদিন কেউ ওর সামনে ওকে গালি দেয়না।
এটাকে জিদ অথবা পাগলামী বলো, সবশেষে জয়ের কর্মকান্ড আসলেই জারজ সন্তানদের মতোই। ওর জিদ ওকে এই পদ দিয়েছে,পাওয়ার দিয়েছে। আবার দিনশেষে দুই ভাইয়ের নিখুঁত চতুরতা জনগণের কাছে ওদের সব কুকর্মকে ছাপিয়ে নেতা কোরে তুলেছে। আমাদের দেশের লোকজন খুব ভুক্তভোগী। তারা অল্প একটু সুবিধা পেলেই যে কারও যেকোনো রকম নোংরামি ভুলে তাকে সালাম ঠুকতে শুরু করে। সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে সমাজ সম্বন্ধে এই ধারণাটুকু স্পষ্ট।ʼʼ
অন্তূ যেন চেয়ারের সাথে মিশে যাচ্ছিল। তার নার্ভগুলো শিথিল হয়ে আসছিল, কাজ করছিল না আর। এত নোংরা জয়? এতদিন বখাটে মনে হয়েছে, হামবড়া লেগেছে। কিন্তু এরকম নিকৃষ্ট, কলুষিত জিদের অধিকারী মনে হয়নি জয়কে। আসলেই এতদিন যা ভয় সে পেয়েছ জয়কে, তা বরং আজ নিজের দুঃসাহস মনে হচ্ছে। ভয় যেন এবার তৈরী হলো জয়ের জন্য ভেতরে। কম্পিত বুকে টলমলে পায়ে বেরিয়ে এসেছিল অন্তূ প্রফেসরের রুম থেকে। তানিয়া প্রথমদিনই কী সুন্দর করে সচেতন করেছিল ওকে, একটুও আমলে নেয়নি সে। চারদিকের কোলাহল, চলমান পরিবেশ কোনো প্রভাব ফেলতে পারল না অন্তূর ওপর।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ-ই একটা ডাক শুনে থামল অন্তূ। আব্বুকে দেখে বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। পুরো শরীরের প্রতিটা লোমকূপ শিহরিত হয়ে উঠল। যদি কখনও খারাপ সম্মানহানিকর কিছু হয় ওর সাথে, এই মানুষটা সহ্য করতে পারবে? পারবে না। তখন অন্তূ কী করবে? শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল অন্তূর। আমজাদ সাহেব ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এলেন, “এ জগতে আছিস তুই?ʼʼ
অন্তূ হাসার চেষ্টা করল, “তুমি এসেছ নিতে? চলে যেতাম আমিই।ʼʼ
হাঁটতে হাঁটতে গম্ভীর হলেন আমজাদ সাহেব, “সেই কখন থেকে এসে দাঁড়িয়ে আছি। পিয়ন যদি না জানাতো প্রফেসর ডেকেছেন তোকে, আমি চলেই যেতাম।ʼʼ
অন্তূ খেয়াল করল, আব্বু খুব ঘামছে। শীতের দুপুরের রোদ কড়া নয় মোটেই, তার মাঝেও মুখটা সিক্ত লাগছে। অন্তূ বলল, “আব্বু, সোয়েটারটা খোলো।ʼʼ
-“কেন? দরকার নেই..ʼʼ
-“খুলতে বললাম, খোলো। আমি দাঁড়াই খোলো ওটা তুমি ওটা। কাল রাতে বোধহয় প্রেশারের ওষুধ খাওনি তাই না? কোথায় গেছিলে এখন?ʼʼ কড়া লাগল অন্তূর কণ্ঠস্বর।
আমজাদ সাহেব সোয়েটার খুললেন, অন্তূ তা নিয়ে নিজের কনুইতে বাঁধিয়ে রেখে বলল, “কোথায় গেছিলে, বলোনি কিন্তু এখনও!ʼʼ
আস্তে কোরে বললেন আমজাদ সাহেব, “মুস্তাকিনের সাথে দেখা করে এলাম।ʼʼ
-“তুমি তোমার পেরেশানী থেকে আমায় দূরে রাখতে চেয়ে কী প্রমাণ করতে চাও? যে আমি তোমার বাড়ির ক’দিনের অতিথি, তোমার দুঃখ-কষ্টের কথা জানানো উচিত নয় আমায়। কোনোমতো উপর-উপর হাসিমুখে ফর্মালিটি দেখিয়েবিদায় দিলে মিটে যাবে, এমন কিছু?ʼʼ
পাগলি ক্ষেপে গেছে, তা বুঝে আমজাদ সাহেব আর কথা বললেন না। রিক্সায় উঠেও অন্তূ আর কথা বলছিল না। অথচ যতক্ষণ উনার সাথে অন্তূ বাহিরে থাকে, দু’বছরের শিশু হয়ে যায়। এটা কী, আব্বু? ওটা কী, ওখানে কী হয়েছে, এটা কেন হয়েছে? দেখো কী হচ্ছে, এই-সেই—সব প্রশ্নের ভিড়ে টিকে থাকা মুশকিল হয় আমজাদ সাহেবের।
অন্তূর নীরবতা সহ্য হচ্ছিল না আমজাদ সাহেবের। রিক্সার হুড তুলে দিলেন, রোদ মুখে লাগছিল। আনমনেই বললেন, “পেরেশানী ছাড়া জীবন চলার উপায় নেই। এ তো লেগেই আছে। সেই সব যদি পিড়ি পেতে তোর কাছে বলতে বসি, তারপর নিজের ঝামেলায় তোকেও জড়িয়ে ফেলি—বাপ হিসেবে যে ছোটোলোকিটা প্রকাশ পাবে আমার মধ্যে তার দায় তুই নিবি? এসব কথা তোর কানে কেন দেব আমি? এমনিই তো সারাদিন নিজের চেয়ে বেশি সংসারের চিন্তায় লেগে আছিস। এই দায়িত্ব তোর, ঠেকা নিয়েছিস এসবের? বলেছি, তোর কাজ শুধু পড়ালেখা করা, সেটা করবি। সংসারের চিন্তা করার ইচ্ছে থাকলে পরের বাড়ি পাঠিয়ে দিই, সংসারের টানপোড়েন ঘাঁড়ে তুলে দেবার হলে বাড়িতে রাখবো কেন তোকে?ʼʼ
গম্ভীর স্বরে বলা কথাগুলোকে উপেক্ষা কোরে বলল অন্তূ, “তুমি তোমার লেকচার থামাও, আব্বু। এটা তোমার ক্লাসরুম অথবা আমি তোমার ছাত্রী নই। বলবে না, বলবে না। আমিও জানার জন্য মরে যাচ্ছি না।ʼʼ
কথা শেষ কোরে দুজন দুজনের দিকে শক্ত চোখে তাকালো একবার।
—
বিকেলের দিকে অন্তূ সিঁড়ির নিচে পাটি বিছিয়ে পড়তে বসেছিল। রাবেয়া পাশেই বসে চাউল খুঁটছিলেন। মার্জিয়া ধীর পায়ে এসে একবার কাপড়-চোপড় নিয়ে গেছে। রাবেয়া বলতে চেয়েও চুপ রইলেন, এই অসময়ে গোসল কোরো না। পাছে আবার খিটখিট করে উঠবে মার্জিয়া।
রাবেয়া অন্তূকে পেলে কোনোসময় চুপ থাকেন না। বোকা বোকা কথা বলে অন্তূর কাছে কড়া কথা শোনা, অথবা নিজের অতীতের গল্প শোনানো, নয়ত হাসি-মজা করেন। অথচ আজ চুপচাপ আনমনে চাউল খুঁটছেন। অন্তূ বই রেখে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? চিন্তায় আছো নাকি?ʼʼ
কেমন কোরে যেন একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামালেন রাবেয়া। অন্তূ ভ্রু কুঁচকাল, “কাহিনি কী? চুপ কোরে আছো কেন? কী হয়েছে, আম্মা?ʼʼ
রাবেয়া নিচুস্বরে বললেন, “ওই হারামী কাল রাতে বাড়ি আসেনি। কী যে করতেছে কোথায়, আল্লাহ মাবুদ জানে। আমার আর ভাল্লাগেনা এসব।ʼʼ
অন্তূ সপ্রতিভ হলো, “ভাই, বাড়ি আসেনি রাতে? আব্বু জানে?ʼʼ
-“চুপ কর। আস্তে কথা কইতে পারিস না, মেয়েমানুষ!ʼʼ এদিক-ওদিক তাকালেন রাবেয়া আতঙ্কিত চোখে।
-“না, পারিনা। কোনো পাপ তো করিনি, যে তা লুকাতে বিরবির করতে হবে। গতরাতে বাড়ি আসেনি, আবার রাত আসতে যাচ্ছে তুমি আব্বু বা আমায় জানানোর প্রয়োজন করোনি?ʼʼ
অন্তূ উঠে দাঁড়াল। রাবেয়া থামানোর বৃথা চেষ্টা কোরে হার মানলেন। মার্জিয়ার ঘরে ঢুকে দম আঁটকে এলো অন্তূর। জানালা-দরজা কিছুই খোলেনি বোধহয় সকালে। শরীর ভালো যাচ্ছে না মার্জিয়ার। কিন্তু মার্জিয়া খুব সুফি মেয়ে। ঘরবাড়ি সবসময় ঝকঝক করে তার বদৌলতে। আজ পুরো ঘর একটা পরিত্যক্ত গুদামের চেয়ে কম লাগছে না। অন্তূ ঘরে ঢুকতেই বাথরুম থেকে আওয়াজ পেল মার্জিয়ার। দৌঁড়ে গেল বাথরুমে। বেসিনের ওপর ঝুঁকে হরহর করে বমি করছে মার্জিয়া। অন্তূ দ্রুত বাহু চেপে ধরল মার্জিয়ার। আজ আর তেজ দেখালো না মার্জিয়া, সে নিজেও অন্তূকে চেপে ধরে প্রায় ভর ছেড়ে দিলো নিজের। কোনোমতো ধরে এনে বিছানায় শোয়ালো ওকে অন্তূ।
পাশে বসে বালিশ ঠিক করে দিয়ে লাইট জ্বালালো ঘরের। চারদিকে বন-জঙ্গলের মতো হয়ে আছে। অন্তূ মাসেও একবার এ ঘরে ঢোকেনা। চারদিকের হাল দেখে অবাক হলো। মার্জিয়ার কাছে বসল। কপালে হাত চেপে বলল, “কী হয়েছে আপনার? এত শরীর খারাপ কিছু বলেননি তো! নিজেকে কী ভাবেন আপনি, আর আমাদেরই বা কী ভাবেন? আমরা কি আপনাকে খেয়ে ফেলার ওঁত পেতে আছি, এমন মনে হয়? আপনার সাথে শত্রুতা কোরে দু-চার পয়সা পেলে তাও নাহয় ভেবে দেখতাম আপনার সাথে শত্রুতা বজায় রাখার।ʼʼ
মার্জিয়া চুপচাপ চেয়ে রইল, জবাব দিলো না। অন্তূ বেশ ভালোই অবাক হলো এতে, মার্জিয়ার কাছে এমন নমনীয়তা আশা করা যায়না। আস্তে আস্তে চোখ ভিজল মার্জিয়ার, গলা ভেঙে এলো, “ও গতকাল সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো খবর নেই, ফোন বন্ধ।ʼʼ
অন্তূর চোয়াল শক্ত হলো, “তা কাকে বলছেন? চেনেন আমাকে? আমার বাপ-মা আমি এই বাড়িতেই পাশের ঘরেই থাকি, তা জানেন আপনি? এসব পার্সোনাল কথা আমাদের অচেনাদের কাছে বলবেন না, ভাবী। ক্ষতি কোরে বসলে তো আর উঠে আসবে না! গোপন কথা গোপন রাখুন।ʼʼ
ভারী পা ফেলে বেরিয়ে এলো অন্তূ ঘর থেকে। মাঝেমধ্যে জাহিল মনে হয় মার্জিয়াকে, ঘেন্না ধরে যায় কিছু ওর কিছু আচরণে। আপন ভাবতেই পারেনা যেন ওদের।
বোরকা পরে বেরিয়ে যাবার সময় রাবেয়া হায়হায় চরে উঠলেন, “কোথায় যাচ্ছিস তুই? অন্তূ? এই…ʼʼ
অন্তূ সোজা হেঁটে দরজার কাছে গিয়ে বলল, “ডাকাতি করতে। যাবে সঙ্গে? সাহস নেই অত তোমার, আমিই বরং যাই।ʼʼ
রাবেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অন্তূর রাগ সহজে পড়েনা। কিন্তু তিনি ভেবছিলেন, অন্তিক আজকের মধ্যে ফিরে আসবে, জানানোর দরকার নেই কাউকে। অন্তূকে বললে তা তৎক্ষণাৎ আমজাদ সাহেবের কানে যাবে, একটা তামাশা হবে। রাবেয়া উঠে দাঁড়ালেন, দরজা পর্যন্তই গেলেন ব্যস্ত পায়ে।
খানিক বাদেই অন্তূ কঠিন মুখে একইভাবে ফিরে এলো। রাবেয়ার কোনো কথার জবাব দিলো না। সোজা মার্জিয়ার রুমে গেল। পেছন পেছন দৌঁড়ে এলেন রাবেয়া। অন্তূ মার্জিয়াকে ধরে ওঠালো। হাতে প্রেগনেন্সি কিট ধরিয়ে দিয়ে বাথরুম অবধি এগিয়ে দিয়ে বলল, “যান, টেস্ট কোরে আসুন। মুখের দিকে চেয়ে থেকে সময় নষ্ট করবেন না, দ্রুত যান।ʼʼ
রাবেয়া অবাক হলেন। অন্তূ প্রেগনেন্সি কিট কিনতে গিয়েছিল! বললেন, “আমি তো কিছুই বুঝিনি..মার্জিয়া গর্ভবতী?ʼʼ
-“তা শিওর হলে তো আর আবার পরীক্ষা করার মতো উদ্ভট শখ জাগতো না আমার।ʼʼ
রাবেয়া চুপ রইলেন। একটু পর আবার নিজেই বিরবির করলেন, “অন্তিক কোনদিনও রাত বাইরে কাটায় না, অন্তূ।আমার ভাল্লাগতেছে না। কই গেছে, সন্ধ্যা লাগতে যাচ্ছে, এখনও আসলো না।ʼʼ
চলবে..
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]