অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ১৬.

0
116

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

১৬.

সন্ধ্যার পর আরও দু’বার বমি করেছিল মার্জিয়া। সকালে যা খেয়ছিল তা উগড়ে দিয়েছে, পেট খালি। তবুও পেট গুলিয়ে বমি আসছিল বারবার। অন্তূ সোফার ওপর ছিটিয়ে থাকা কাপড়গুলো ভাঁজ করে ঘরটা ঝাড়ু দিয়েছে। অন্তিক খুব খিটখিটে মানুষ, বিছানার বসার সময় চাদরে হাত বুলিয়ে বসার অভ্যাস আছে। কিটে প্রেগনেন্সি পজিটিভ এসেছে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কেঁদেছে মার্জিয়া। রাবেয়া প্লেটে কোরে ভাত আনলেন। মার্জিয়া খেতে অস্বীকার করল, রুচি নেই তার। খেতে খেতেই বমি কোরে ফেলব। অন্তূ জিজ্ঞেস করেছিল, “নিজে টের পাননি শরীরের এই অবনতি দেখেও?ʼʼ

মার্জিয়া সে-সব এড়িয়ে কাতর স্বরে বলে, “তোমার ভাই আসছে না কেন, অন্তূ? আমার ভালো লাগছে না এমনিতেই শরীরটা, তার ওপর এই টেনশন!ʼʼ

-“টেনশন না করুন। আব্বু মসজিদ থেকে আসলে বলছি, কিছু একটা করা যাবে। আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকুন, পারলে কিছু খেয়ে নিন। এই সময় নিজের সাথে সাথে আরেকটা প্রাণের যত্নে থাকতে হবে আপনাকে।ʼʼ

রাবেয়া খুব জোর কয়েক লোকমা খাবার তুলে দিতে পারলেন মার্জিয়ার গালে। কেঁদে কেঁদে মুখ-চোখ বসিয়ে ফেলেছে। দিনশেষে মেয়েটা অন্তিককে খুব ভালোবাসে, এ চিরন্তন সত্য।

অন্তূ চলে এলো বাইরে। তার মাথায় বহু নেতিবাচক ভাবনা আসছে, সেসব কাটাতে চেয়েও পারছিল না। নিশ্চয়ই অন্তিক খারাপ পথে চলে গিয়েছে। সেদিন একটা গুণ্ডা ধরণের নোংরা লোকের সাথে কোথাও যাচ্ছিল অন্তিক। হতে কোথাও নেশা কোরে পড়ে আছে অথবা … অন্তিক জুয়া খেলে, বা আর কী খারাপ কাজে জড়াতে পারে পুরুষ?

অন্তূর মাথা ভার হয়ে এলো। কী অধঃপতন অন্তিকের। আমজাদ সাহেবকে তার ছেলের ব্যাপারে এমন কথা কীভাবে বলা যায়? অন্তূর গলা আঁটকে আসছিল। আব্বুকে কীভাবে সে এমন সব নোংরা সম্ভাবনার কথা বলবে? কীভাবে নেবেন আমজাদ সাহেব ছেলের এই পতন? এমনিতেই সারাক্ষণ বিষণ্নতার ঘোলা জলে ডুবে মরছেন। দিনদিন পারিবারিক পরিস্থিতি এত সংকটাপণ্ন হয়ে উঠছে কেন?

দু’বার ‘আব্বুʼ বলে ডেকেও কিছু বলতে পারছিল না অন্তূ।আমজাদ সাহেব গম্ভীর হলেন, “কথা কেন এমন গলায় আঁটকাবে? স্পষ্ট কথা বলতে শেখাইনি আমি? চোর বা অপরাধীরা কথা সাজাতে গিয়ে হুমড়ি খায়। তুই কি সেরকম কিছু বলতে যাচ্ছিস?ʼʼ

অন্তূ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার ছেলে কাল সকালে বেরিয়েছে, এখন অবধি বাড়ি ফেরেনি। মানে প্রায় দেড় দিন হলো তার পাত্তা নেই বাড়িতে। আব্বু, তুমি চিন্তিত না হও। সে বাচ্চা নয়, চলে আসবে। তবুও তোমাকে জানানো প্রয়োজন বলে মনে করলাম।ʼʼ

শেষের দিকে অন্তূ সামাল দেয়ার দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। যদিও কাজটা তার নিজের কাছেই বোকা বোকা লাগল। আমজাদ সাহেব তসবীহ রেখে উঠে গিয়ে পুকুরের পাশের জানালাটা আটকে দিয়ে বললেন, “বাচ্চা বোঝাচ্ছিস? আসলেই কি আমি এত দূর্বল আর অপদার্থ হয়ে উঠেছি, যে ছোট ছোট বিষয়গুলোও নিতে পারছি না আজকাল?ʼʼ

-“তেমনটা নয়। কিন্তু একের পর এক যা হচ্ছে…ʼʼ

-“এটাকেই তবে জীবন বলে, অন্তূ। যখন দেখবি জীবন সমতল রাস্তায় বেশ আরামে গড়িয়ে গড়িয়ে দুলদুলিয়ে চলছে, তখন বুঝবি তুই স্বপ্নে আছিস, অল্পক্ষণের মাঝে ঘুম থেকে জেগে উঠবি। কারণ, বাস্তবতা হলো পাহাড় কেটে বানানো সরু রাস্তা। যার পদে পদে বাঁক, উঁচু-নিচু খাদ আর যেকোনো সময় জীবন নামক গাড়িটা উল্টে পড়ার সম্ভাবনা দিয়ে ভর্তি। এসবে যেদিন ভয় পাবো, তার আগে আমি মাটির তলায় শায়িত হয়ে যাবো।ʼʼ

অন্তূ চেপে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলল। বিরবির করল, “প্লিজ আব্বু, প্লিজ চুপ করো। কিচ্ছু হয়নি, হবেও না।ʼʼ

আমজাদ সাহেব বের হবার মুহুর্তে অন্তূ কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে হাত চেপে ধরল হুড়মুড়িয়ে। আমজাদ সাহেব গোমরা মুখে বললেন, “পাগলামী না কোরে ঘরে গিয়ে পড়তে বোস। সেদিন পরীক্ষা দিয়ে এসে দুইদিন বেশ ফাঁকিবাজি করেছিস। আমি এখনই ফিরে আসবো।ʼʼ

-“আমিও।ʼʼ

-“আমিও কী?ʼʼ

-“এখনই ফিরে আসবো।ʼʼ

-“বড় হসনি? আর কবে বড় হবি? আমি কি শখে যাচ্ছি, যে পিছু নিতে হবে?ʼʼ

-“আব্বু, তুমিই বলতে–সন্তান বাপ-মায়ের কাছে কোনোকালে বড় হয়না। সে আমি যত বড়ই হই, আমার বয়স যতটুকু বাড়ছে, তোমারও বাড়ছে, সুতরাং তোমার তুলনায় আমি যা তাই রয়ে গেছি কিন্তু। ঠিক বলেছি না?ʼʼ

অন্তূ চাইল রসিকতার মাধ্যমে আব্বুর টেনশন কম করতে।
আমজাদ সাহেব হার মানলেন, মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, “চাদর নিয়ে আয়, যা। ঠান্ডা লাগেনা গায়ে?ʼʼ

অন্তিকের দোকান বন্ধ পাওয়া গেল। পাশের দোকানদার জানাল, কাল থেকে দোকানই খোলেনি। এরপর বেশ কিছুক্ষণ নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দু’জন রাস্তার পাশে। অন্তূ ঠিক বুঝতে পারছিল না আব্বুর অভিব্যক্তি। গম্ভীর মানুষদের এই এক সমস্যা, তাদের উত্তেজনা বা শান্তভাব সবই একরকম, চুপচাপ। সে বুঝতে পারছিল না, কী কোরে পরিস্থিতি সামলে নেয়া যায়? অন্তিক গতকাল বাড়ি থেকে দোকানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে দোকানেই আসেনি, তাহলে কোথায় গিয়েছে? এখন কোথায় খুঁজবে ওকে, কোথায় যেতে পারে? অবচেতন মস্তিষ্কে থেকে থেকেই নেতিবাচক ভাবনা উঁকি মারছে, অন্তূ ধমকে তাদের ভেতরে পাঠালো।

আমজাদ সাহেব আচমকা শক্ত কোরে চেপে ধরলেন অন্তূর বামহাত খানা। অন্তূর মনে হলো, সে এবার এই গোটা মহাবিশ্ব-ব্রক্ষ্মাণ্ড জয় করে ফেলতে পারবে নিমেষেই, তাতে তার গায়ে একটুও আচড় লাগার সম্ভাবনা নেই আর। চোখ বুজে দুটো শ্বাস ফেলে বলল, আব্বু, “তোমার ছেলের দুটো কলেজ লাইফের বন্ধুকে চিনি আমি। তুমিও তো চেনো।ʼʼ

আব্বুর হাত ধরে রাস্তা পার হলো অন্তূ। চাদরের এক প্রান্ত কাধ থেকে পড়ে গেছে। আমজাদ সাহেব অন্তূর হাত ছাড়লেন না, বরং বাম হাত দ্বারা চাদর কাধে তুলে দিয়ে একটা ধমক দিলেন, “সর্দি লাগলে এক পয়সার ওষুধ কিনে দেব না, মনে রাখিস। ভালোভাবে চাদর জড়িয়ে নে গায়ে, ঠান্ডা কিন্তু কম নয় বাইরে।ʼʼ

বন্ধুরাও এখন সংসারী হয়ে গেছে। পুরো শিক্ষককে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমজাদ সাহেব সকলের অনুরোধ নাকচ করে কেবল অন্তিকের খোঁজ করে বিদায় হলেন। সম্ভাব্য সকল জায়গায় খোঁজ করেও বিশেষ ফায়দা হলো না। এখনও অন্তিকের নম্বর দুটোই বন্ধ।

দুজন রাস্তার পাশে উঁচু ফুটপাতের ধারে বসল। অন্তূর বুক কাঁপছে। চুপচুপ বসে থাকা আব্বুর মনে কী বয়ে যাচ্ছে, তা আন্দাজ করতে চাইল। খুব কোরে মনে হলো, যদি সে ম্যাজিক জানতো, এখনই অন্তিককে এনে সামনে দাঁড় করাতো, এরপর এক লহমায় ভেঙে দিতো বাপ-ছেলের মাঝের কঠোর দেয়ালখানা। বুকের ভার সহ্য হচ্ছিল না ওর। অসহায় লাগছিল খুব। সে কেন পারে না, আব্বুর পেরেশানীর সহজ সমাধান হতে? সমস্যাগুলো তার নাগালের মাঝের হয়না কেন?

বেশ কিছুক্ষণ পর দুজন চুপচাপ পাশাপাশি বসে রইল। রাস্তার ওপাশে ফুটপাতে ভাপা পিঠা বিক্রি হচ্ছে। আমজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “পিঠা খাবি?ʼʼ

অন্তূ তাকাল আব্বুর দিকে। অল্প হাসল। মানুষটা বরাবর নিজেকে পাথর প্রমাণ করতে চেষ্টা করে, যেন এই জগতের কোনো ব্যথা বা উদ্বেগ তাকে কাবু করতে পারেনা। দিনশেষে পরিবারের কর্তব্য পালন করতে গিয়ে এত এত জটিলতা এবং দেনা-পাওনা ঘাঁড়ে কোরে বসে আছে, তবুও যেন মনে হয়না তার কর্তব্য সে ঠিকঠাক পালন করছে। অন্তূ মাথা নেড়ে বলল, উহু….আব্বু?

-“হু।ʼʼ আনমনে বললেন আমজাদ সাহেব।

-“থানায় একটা জিডি করলে হয়না?ʼʼ

-“আমিও ভাবছি।ʼʼ

থানায় একটা সাধারণ বিবরণে ডায়েরি করে দুজনে বেরিয়ে এসে থানার বাইরে দাঁড়াল। আমজাদ সাহেব ফোন করলেন কাউকে। অন্তূ ইশারায় জিজ্ঞেস করলে বললেন, “মুস্তাকিনকে জানিয়ে রাখি।ʼʼ

অন্তূ আর কিছু বলল না। তার মনে হলো, খুব শীঘ্রই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করার কারণ নেই, সে শুধু শুধুই এত বেশি ভাবছে।


টিকিট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে হাতঘড়িতে সময় দেখল জয়। ১১:৫৩ বাজে। সে ফ্লাট থেকে বের হয়েছে সোয়া এগারোটার দিকে। এরপর বিয়ার কিনতে গিয়ে দেরি হয়েছে। দৌঁড়ে বাসে উঠে একটু অবাক হতে হলো, এত রাতেও সবগুলো সিট বুক। তার জন্য একটা সিট রয়েছে একটা মেয়ের পাশে। মেয়েটা জানালার ধারে বসে আছে। জয় গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগ খুলতেই মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে খ্যাকখ্যাক কোরে উঠল, “একদম এখানে বসবেন না। আমি আপনার পাশে বসে যেতে পারব না। এখানে বসবেন না, আপনি, আমি বসতে দেব না।ʼʼ

বাস ছাড়বে এক্ষুনি। জয় রাগ সামলে বলল, “আর কোনো সিট ফাঁকা নেই, দুজনের বসার জন্য যথেষ্ট জায়গা রয়েছে দুটো সিটে। আপনি বসুন, অসুবিধা হবে না।ʼʼ

মেয়েটা এবার কর্কশ সুরে জোরে কোরে চেঁচিয়ে উঠল এবার, “বললাম না আমি আপনার পাশে বসে যাবো না। কোনো ছেলেমানুষের পাশে বসে আমি..ʼʼ

-“চুপ কর, শালি! চুপ!ʼʼ জয় চট কোরে নিয়ন্ত্রণ হারালো, “গলার ভেতরে এক খাবলা টিস্যু গুজে দেব আর এক ফোঁটা আওয়াজ গলা দিয়ে বের হলে, চুপ থাক।ʼʼ

সকলে উঠে দাঁড়িয়েছে এবার। কন্টাক্টর এগিয়ে এলো। জয় দাঁত খিচল, “এ নাম তুই, নাম। নাম বাস থেকে..ʼʼ মেয়েটা কেঁপে উঠল এবার। জয় আঙুল নাচিয়ে ইশারা করল, “বের হ, সিট থেকে বের হ, বের হর বের হ। নাম, যাহ! সিটের মায়রে… তোর এই বাসেই যাওয়া লাগবে না।ʼʼ

মেয়েটা কিছু বলতে নিলে জয় ঠোঁটে আঙুল চাপল, “চুপচাপ নেমে দাঁড়া, নয়ত একটা লাত্থি মেরে নামিয়ে দেব, পড়ে যাবি, মাজা ভাঙবে তোর।ʼʼ

কন্টাক্টর কিছু বলতে আসলে জয় থামাল, “তুই চুপ থাক। ওইদিক সরে দাঁড়া। উকালতি করতে আসলে খবর আছে কিন্তু!ʼʼ

মেয়েটার দিকে ফিরে বলল, “শালি! ভদ্রতা মারাও? ভদ্রতা শিখাস আমারে? যে মেয়ে কোনো ছেলের পাশে বসে যেতে পারবে না, সে রাত বারোটার সময় একা যাতায়াত করে হে? পাগল পাইছোস আমারে? ভাতের বদলে কি খড় খাই? ভদ্রতাকে কোনোমতো সম্মান দিতে ইচ্ছে করলেও ভদ্র সাজা বিষয়টা হজম হয়না আমার। তোরে দেইখা লাগতেছে না, তুই বিপদে পড়ছোস কোনো। তার মানে সেচ্ছায় রাত-দুপুরে একা সফর করবার পারো, আর ছেলে মাইনষের পাশে বসতে পারো না? সুশীলা নারী তুমি? শালি আমার! নাটক? তোরে আমি সিনেমা দেখাই, দাঁড়া।ʼʼ

পকেট থেকে মানিব্যাগ বের কোরে বলল, “দে, টিকেট দে। দে… টিকেট দে, তোর!ʼʼ

মেয়েটা মাথা নিচু কোরে টিকেট এগিয়ে দিলো, জয় টিকেটের দাম মেয়েটার হাতে শক্ত কোরে গুজে দিয়ে সিটে ফিরে এসে বসল। কন্টাক্টর তখনও দাঁড়িয়ে। জয় সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বলল, “আপনার আবার কী সমস্যা? মাথা কাজ না করলে বাসের দরজার সাথে একটা জোরে কোরে মাথাটআ ঠুকে দেন, ক্লিয়ার হয়ে যাবে। দুইটা সিটই আমার। এভার গাড়ি ছাড়েন, এমনিই পৌঁছাতে সকাল হবে।ʼʼ

বাসের লাইট অফ হলে শব্দ কোরে বিয়ারের ক্যান খুলে তাতে দুটো চুমুক দিয়ে কানে ইয়ারফোন গুজল।

ফজরের আজান যখন হলো তখন বাস দিনাজপুরে প্রবেশ করেছে। বাস থেকে নামার পরেও অন্ধকার ভালো কোরে কাটেনি। তার ওপর ঘন কুয়াশার আচ্ছাদনে এক হাত দূরের পরিবেশ স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হবার জো নেই। অন্ধকার কেটে আলোর একটা হালকা ছটা ছড়িয়েছে সবে। জয়ের পুরো ক্যানে কোনোমতো নেশা হয়। এখনও বেশ খানিকটা তরল বাকি ক্যানে। মাথা ঝিমঝিম টের পেল হালকা, হাঁটতে গিয়ে পা টলছে অল্প-সল্প। তবে বুঝতে পারল না তা ঘুমের জন্য নাকি তার হ্যাংঅভার চড়েছে?

নিচের তলার পুরোটা জুড়েই হামজার স্টিল-ওয়ার্কশপ। সেটা পেরিয়ে দোতলার সিড়ি ভেঙে দরজায় টোকা দিলো। কলিং বেল চাপার আগেই যেন হুট করে দরজাটা খুলে যায়। জয় চমকে গিয়ে আবার সামলালো নিজেকে। তরু দাঁড়িয়ে আছে দরজা খুলে। ভেতরে ঢুকে কাধের ব্যাগ নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ঘুমাসনি তুই?ʼʼ

জবাব দিলো না তরু। জয় জানে, সারারাত এভাবেই বসার ঘরে দরজার কাছে বসে ছিল তরু। জয় জেলার বাইরে গেলে যেদিন ফেরার কথা থাকে, প্রতিবারই মেয়েটা এভাবেই অপেক্ষা করে। দরজার কাছে থাকে, জয় আসলে যাতে দরজা খুলতে দেরি না হয়ে যায়! জয় বলল, “খাবার কী আছে রে? ক্ষুধা লাগছে, কিছু খাইতে দে, কুইক! তার আগে একটু গরম কালা কফি দে, গা গুলায়ে আসতেছে, আবার ক্ষুধাও লাগছে।ʼʼ

তরু ঠোঁট উল্টালো, “ছোটমাছ রান্না আছে।ʼʼ

জয় দাঁত খিঁচে আবার চুপ করল। জুতোটা খুলে বলল, “ওসব দিয়ে ভাত খাওয়া যায় নাকি? আমি খাই ছোটমাছ? ধূর!ʼʼ

-“তাহলে ডিম ভেজে দেই? নরমাল ফ্রিজে অল্প একটু মাংস রান্না আছে, গরম করে দেই ওটা। সকালে ভালো খাবার দেব। এখন এটুকু দিয়ে চালান।ʼʼ

জয় মাথা নেড়ে কমন বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। পা ফসকে যেতে চাইল একবার। তরু খেঁকিয়ে উঠল, “এসব কচু না গিললে কী খুব অসুবিধা হয়? ধরব আমি?ʼʼ

-“নাহ! মাতাল হই নাই আমি, একদম ফিট আছি। তুই তাড়াতাড়ি কফি বানা, তার আগে আমার তোয়ালে দিয়ে যা। বের হয়ে যেন সব রেডি পাই।ʼʼ

-“এটা গোসল করার সময় হলো? আজেবাজে জিনিস গিলবেন, আর বেখাপ্পা সময়ে গোসল কোরে সর্দি বাঁধাবেন !ʼʼ

জয় মাতালের মতো নাটকীয়ভাবে কাঁধ দুলিয়ে হাসল, “সভ্য হয়ে নিয়ম মেনে কোন শালা বড়লোক হইছে? আমি এত অসভ্য হয়েও বড়লোক।ʼʼ

কফি পড়ে রইল ওভাবেই। জয় গোসল কোরে বেরিয়ে সোজা এসে খাবার টেবিলে বসল। গোসল করে তার হ্যাংঅভার কেটে গেছে, কফি খাওয়ার মুডও নষ্ট হয়ে গেছে। এই পৌষের শীতে ভোর পাঁচটার দিকে গোসল করে কেউ এত নির্লিপ্ত থাকতে পারে? তরু নাক কুঁচকালো।

খাবার দিয়ে চলে যাবার সময় জয় ডাকল, “এএ চেয়ারে বস।ʼʼ

-“আপনি খান, আমি ঘুমাবো।ʼʼ

জয় শুনল না যেন। সে জানে মেয়েটা রাতে কিছুই খায়নি, এই ভোর রাতে জয় এসে খাবে, একসাথে বসে খাবে বলে না খেয়ে অপেক্ষা করেছে। জয় মৃদু ধমক দিলো, “তুই না বললেও খাবো আমি। বসে পড়, প্লেটে খাবার নে। একা একা খেতে ভালো লাগেনা আমার।ʼʼ

খেতে খেতে একবার তাকালো জয় তরুর দিকে। নির্দিধায় সুন্দরী, মায়াবতী উপাধি পাওয়ার যোগ্য তরু। আজ এই নির্ঘুম রাতের শেষে যেন ক্লান্ত না লেগে বরং আরও সুন্দর দেখতে লাগছে। হুট কোরেই চোখে ধরে গেল জয়ের। সে চোখ নামালে তরু তাকাল। ভেজা চুল, ঘাঁড়ে তোয়ালে। মাথা নিচু কোরে খাচ্ছে আর পা দোলাচ্ছে। তরুর দেখার মাঝেই হুট করে বলল জয়, “এভাবে তাকায়ে থাকিস না। তোর নজরের প্রেমে-টেমে পড়ে গেলে শেষে জাত যাবে।ʼʼ

তরু হেসে ফেলল, মাথা নুইয়ে নিলো। জয় দেখল, স্নিগ্ধ হাসি তরুর। মেয়েটা চঞ্চল, তবে তার সামনে আসলে খুব গুছিয়ে নেয় নিজেকে, একজন কর্তব্যপরায়ন নারী হয়ে ওঠে। জয় হাসল। তরু হাসি সামলে বলল, “প্রেমে পড়ার হলে কবে পড়তেন।ʼʼ একটু থেমে আবার বলল, “আপনার আসলেই ভালোবাসা আসেনি কোনোদিন আমার প্রতি?ʼʼ

জয় বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়ল, উহু! ভালোবাসা জিনিসটা আমার সিস্টেমের বাইরে, ওসব বুঝিনা আমি। তোর ওপর কোনোদিন ভালোবাসা আসেনি। তবে মায়া আছে একটা, এটা স্বীকার করি আমি।ʼʼ

তরু ভ্রু কুচকায়, “তা কেন?ʼʼ

-“কারণ আমায় কেউ কোনোদিন নিঃস্বার্থ ভালোবাসেনি, ভালোই বাসেনি। অথচ আমার মনে হয়, তুই একমাত্র একটা পাগল, যে আমাকে বিনা স্বার্থে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া মনোযোগ ও ভালোবাসা দিয়েছিস।ʼʼ

তরূ চমকে উঠল, “খালা, খালু আপনাকে…

জয় হেসে ফেলল কেমন করে যেন। হাত ধুয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল, “আমি বিশাল বড়লোকের
ছেলে।ʼʼ কথাটা বলেই চোখ মারল জয়, “বাপের সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র মালিক আমি। এমনিতেও আমি বেশিদিন দুনিয়ায় থাকব না, আমার পর সবকিছু অটোমেটিক্যালি আমার পালনকারীদের হয়ে যাবে। যেটাকে তুই তাদের ভালোবাসা বলতে চাইছিস, সেই তথাকথিত যত্ন আমি রাস্তার কারও কাছেও পেতাম। আমার নামে আমার ধোঁকাবাজ বাপ-মা মোটা টাকার গুদাম রেখে গেছে।ʼʼ

তরু অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু হামজা ভাই..ʼʼ

জয়ের হাসিটা এবার রহস্যজনক দেখতে লাগল, ঘাঁড়ে হাতের তালু ঘষে বলল, “ভালোবাসা আর প্রশ্রয়ের মাঝের পার্থক্য তুই বুঝিস না, না? আমিও বুঝতাম না।ʼʼ

মাঝখানে একটু থেমে দু’বার মাথা ঝাঁকি দিলো জোরে করে। এরপর বলল, “ভালোবাসায় প্রশ্রয় কম থাকে, খুব কম। সেখানে কঠোর শাসন থাকে, আবার ক্ষেত্রবিশেষ প্রবল ছাড়। রাস্তার অপরিচিতকে ধরে তুই শাসন করতে যাবিনা। যার ওপর টান লাগে, মায়ার টান… যেইটারে তোরা ভালোবাসা বলিস, তারে মানুষ শাসন করে। আমারে কেউ কোনোদিন শাসন করে নাই, জানিস!ʼʼ

তরু কেঁপে উঠল নিজের অজান্তেই। জয়ের উদ্ভট হাসির সাথে এমন সব কথাগুলো খুব বিঁধছে। জয় থামল না, বলে চলল, “আমি যখন একের পর সিগারেট ফুঁকে যাই, হামজা ভাই কোনোদিন ধমক দিয়ে বলে নাই, সিগারেট ফেল, আর ছুঁবি না। ক্লাস এইটে প্রথমবার সিগারেট ঠোঁটে রেখে আগুন জ্বালাইছি, হা হা হা! তখন গলা জ্বলতো খুব। একেকবার ধোঁয়া গেলার সময় গলা দিয়ে পুড়তে পুড়তে যেত নিকোটিন। কেউ সেদিন চটাং করে একটা থাপ্পড় মেরে কেড়ে নেয় নাই সিগারেটটা। গলা পুড়েছে, আমি ধোঁয়া টেনে গেছি। এক সময় সঁয়ে গেল, আর ছাড়তে পারলাম না। হামজা ভাই জানল, কিন্তু কিছু বলল না। কলেজে উঠার পর দেখতাম বন্ধুরা ইচ্ছামতো চুল কাটতে পারেনা, বাপ নাকি মারবে। আমি যেমন খুশি, যেভাবে খুশি, যা খুশি করে বেড়াতাম। সবাই আমায় এজন্য লিডার মানতে শুরু করল, আমি ওদের কাছে স্বাধীনচেতা, ভাবের গুরু হয়ে উঠলাম। তখন মনে হতো, শালার আমারই তো জীবন! আর কী লাগে? সবগুলা শালা দুর্ভাগা, কী জীবন ওদের? ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারেনা, বাপের গোলাম সবগুলা, সবগুলা খবিশ! হা হা হা!ʼʼ

টেবিলে ঝুঁকে পড়ে ঘাঁড় মুচড়ালো এদিক-ওদিক। পর পর চোখের পাতা ঝাপটালো কয়েকবার। চোখ বুজে হাসল আবার, “পরে বুঝলাম, ওদের মতো দুর্ভাগা আমি চাইলেও হইতে পারব না। ওরা দুর্ভাগা কারণ ওদের বাপ-মা আছে। চুল কেটে বাড়ি গেলে বাপ মারে, মা গালি দেয়, সিগারেট টানলে বাপ জানলে খবর খারাপ হবে। আমার এসব হওয়ার চান্স নাই, কারণ আমার তো বাপ-মা-ই নাই! হে হে হে! কে মারবে, গালি দেবে? আমাকে শাসন করার তো কেউ নাই? আমিই সিকান্দার, আমি বাদশা!ʼʼ

টেবিলের এক কোণে কফির মগ রাখা ছিল। কফি ঠান্ডা শরবত হয়ে গেছে, তাতে চুমুক দিয়ে বলল, “রাত করে বাড়ি ফিরলে হামজা ভাই জানলে দু চারটা গালি দেয় মুখে, কিন্তু তা ভয় পাওয়ার মতো লাগেনি কোনোদিন। মাল গিলে ঢুলতে ঢুলতে বাড়ি ঢুকলে মামি যত্ন করে ঘরে তুলে শুইয়ে দিয়ে যায়। আমার বন্ধুরা বলতো, রাত এগারোটার সময় বাড়ি ঢুকলে মা নাকি বাপের কানে অভিযোগ লাগায়, পরে বাপ পেদানি দেয় ইচ্ছেমতো। মা জাতের ওপর চরম রাগ হতো আমার! কই আমার মামি তো রাগ করে না, আমি শেষ রাতে বাড়ি ফিরলেও দিব্যি হাসিমুখে দরজা খুলে চুপি চুপি ঘরে তোলে আমায়! আমার মাও নাই, ভয়ও নাই। কেন এত সুখ পেয়েছি বলতো আমি? কারণ আমার অপরাধ আর বখাটেপনা দেখে দুই গালে কষে দুটো থাপ্পড় মারার মতো বাপ নামক বিপদটা ছিল না আমার, চুল বড় করে কাটলে তা ছোট করে কেটে আসতে ফের আবার সেলুনে পাঠানোর জন্য মা নামক ঘ্যানঘ্যানে রেডিও ছিল না আমার। দিনদিন পাওয়ার আর জিদ সমান্তরাল হারে বাড়ছে খালি।ʼʼ

দাঁত বের করল হাসল জয়, “মামার সাথে চাকরের মতো ব্যবহার করেও কোনোদিন একটা ধমক খাইনি।ʼʼ ডান কানে তর্জনী আঙুল ঢুকিয়ে ঝাঁকালো, দুবার চোখ ঝাপটে মুচকি হাসল আবার, “প্রতিমাসে ব্যাংক থেকে আমি যে পরিমাণ টাকা উঠাই, তার একভাগও লাগেনি আমার কোনোদিন এত আয়েস করে চলার পরেও। বাকিটা এই বাড়ি খেয়েছে। আমায় কোনোদিন শাসন করা হয়নি, আমায় ভালোবাসা হয়নি!ʼʼ

তরুর মনে হলো, জয়কে দেখে যতই মনে হোক সে মাতাল হয়নি, সে বেশ ভালো রকমের ভিনটেজ কনডিশনে আছে। নয়ত এসব কথা তার ওপর বোমা মেরেও বের করার উপায় নেই। জয় ওর সাথে আন্তরিক তবে কোনোদিন এরকম আন্তরিক হতে দেখেনি তরু। সে বিরবির কোরে বলল, “সব বুঝেও কেন খারাপ হলেন আপনি?ʼʼ

জয় উঠে দাঁড়াল, পরে আবার চেয়ার কনুই রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল, “যখন খারাপ হয়েছি, তখন বুঝিনি। আমায় কেউ ভালো হতে বলেনি অথবা খারাপ হওয়া থেকে আটকায়নি। তা বুঝলাম তো এই তো সেদিন। মানুষ আঠারো বছরে ম্যাচিউর হয়, আমি পঁচিশের কোঠা পেরিয়েও ঠিকমতো কিছুই বুঝিনি। যা বুঝছি তা বোঝা ঠিক হয়নি।ʼʼ

হুটহাট জিজ্ঞেস করল তরু, “আপনি বিয়ে করবেন না?ʼʼ

জয় ভাবুক হবার নাটক করল, “করলে তোকে করতাম। যত্ন তো কম করিস না আমার! কিন্তু বাইরের থালায় স্বাদ চেখে বেড়ানো পাবলিক আমি, শুধু শুধু কাউকে ঘরে তুলব ঘর পাহারা দিতে? তাছাড়া ভালো না বেসে বিয়ে করা ঠিক না, আমি কারও প্রেমে পড়িনি কোনোদিন। তুই মায়ায় বাঁধিস, কিন্তু আমি জানি ওটাকে ভালোবাসা বলে না। তোর যত্ন-মনোযোগ আমার ওপর অপরিহার্য তরু, কিন্তু কেন যে তোকেও ভালোবাসতে পারলাম না? ভালোবাসলে সত্যি বিয়ে কোরে বাড়ি নিয়ে যেতাম!ʼʼ

তরুর চোখদুটো সজল হয়ে উঠেছিল। ভাঙা কণ্ঠে ক্ষোভের সাথে বলল, “মায়া কেন লাগে? দয়া হয় আমার ওপর, তাই না?ʼʼ

-উহু! দয়া না, মায়া। যেটা তুই অর্জন করেছিস। বিশ্বাস কর তোর ওপর একটা গাঢ় মায়া আছে আমার, কিন্তু..

-“মায়া কেন আছে?ʼʼ

জয় এবার প্যাচপ্যাচে হাসল, “আমিও অনাথ, তুই বাপ-মা থেকেও অনাথ। শুনিস নি, সাধারণত অনাথরাই পরে অনাথ আশ্রম গড়ে। আমি-তুই একই জাতের মক্কেল। তুই আমি দুজনেই আশ্রিত। তাছাড়া, যদি ভালো না বেসে বিয়ে করি সেটা না-ইনসাফি হয়ে যাবে। বাইরের মেয়েদের মতোই ঘরে পরে থাকবে বউটা আমার। তাহলে আর বিয়ে করার মানে কী?ʼʼ

আকাশ পুরোপুরি আলোকিত প্রায়। জয় রুমে যেতে যেতে বলল, “খাওয়া শেষ করে একবার রুমে আয়।ʼʼ

তরু জয়ের রুমে ঢুকল মিনিট পাঁচেক পরে। জয় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছিল। তরুর উপস্থিতি টের পেয়ে বিছানার ওপর থেকে একটা ব্যাগ তুলে তরুর দিকে এগিয়ে দিলো, “তোর নাকি বিদায় অনুষ্ঠান সামনে?ʼʼ

তরু দেখল, ভেতরে একটা নীল শাড়ি। ডুকরে কান্না পেল। মাঝেমধ্যে এত নিষ্ঠুর আর রহস্যজনক লাগে জয়কে। কী বলে, কী করে বোঝার উপায় থাকেনা। জয় বারবার জিজ্ঞেস করে, কেন তরু ভালোবাসে জয়কে? আসলে ভালোবাসা কিনা জানা নেই। তবে জয়ের কথায় আজ সে নিজের অনুভূতির নতুন নাম পেয়েছে। মায়া। হ্যাঁ, মায়াই বটে। নয়ত কী? ছেলেটার জন্য অসীম মায়া লাগে তরুর। তরু জানে, জয় নোংরা। আবার সে এটাও মানে, সে নিজেও নোংরা তাই জয়ের প্রতি এই মায়া। হোক, সে নোংরাই তবে। এখন যেমন মন চাইছে, শক্ত ওই বুকে উত্তাল ঢেউয়ের মতো আঁছড়ে পড়তে। অথচ অনুমতি নেই প্রকৃতির, সায় নেই উদ্দীপনাবাহী সংবেদন কাঠামোর।


শুক্রবারের সকাল। রাতে জিডি করে আসার পর থেকে বিশেষ কোনো ভালো খবর পাওয়া যায়নি। তবু কেন যেন অন্তূ আশাহত হতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল সব ঠিক হবে, কিছুই হয়নি।

আমজাদ সাহেব বাজারে গেলেন, তখন সকাল দশটা। অন্তূ বসে পড়ছিল শীতের সকালের তপ্তহীন রোদে। যাওয়ার সময় আমজাদ সাহেব অন্তূর পাশে বসে ছোট্ট একটা লিস্ট তৈরি করে নিয়েছিলেন।

রাবেয়া রসুন-পেয়াজ কেটে রাখলেন সেই রোদেই। মার্জিয়াকে আর ডাকা হয়নি। সারারাত নিশ্চয়ই না ঘুমিয়ে সকালের দিকে ঘুমিয়েছে এই শরীরে!

ঘড়ির কাটা যখন দুপুর সাড়ে বারোতে, আমজাদ সাহেব এলেন না। অথচ উনার ফেরার কথা বড়োজোর সাড়ে এগারোটা। চারদিকে জুময়ার আজান ফুরিয়ে এলো, তিনি ফিরলেন না। অন্তূ বারবার কোরে গেইটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে এসেছে। আব্বুর দেখা না পেয়ে ফিরে এসেছে। রাবেয়া অতিষ্ট হয়ে বসে ছিলেন।

সময় পেরিয়ে দুপুর দুটো বাজল, আমজাদ সাহেব এলেন না। অন্তূর ভাবনার টনক নড়ল। সে কমপক্ষে বিশ-পঁচিশটা কল এতক্ষণে করেছে আব্বুর নম্বরে, বারবার বন্ধ বলার পরেও। ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে এলো, দূর রাস্তার মোড় অবধি চেয়ে রইল কতক্ষণ। আমজাদ সাহেবের পাত্তা নেই। রোদ গায়ে লাগছিল না অন্তূর। সে দাঁড়িয়ে রইল ছাদের রেলিং ঘেষে ঘোলা চোখে। মনটাকে কেটে ভেতর থেকে আলাদা করে ফেলতে ইচ্ছে করলো। আজেবাজে চিন্তারা ভিড় করছে সেখানে। খুব জ্বালাতন করছে।

দুপুরে রান্না হয়নি, খাওয়াটাও হয়নি। সকালে আব্বুর সাথে বসে ঘি-আলুভর্তা দিয়ে আম্মুর হাতের খিচুড়ি খেয়েছিল।

ছটফটানি বাড়ল যখন সন্ধ্যা হলো। সময়ের আবর্তন রাত দশটার কাঁটা অতিক্রম করল। আমজাদ সাহেব বাজার থেকে ফেরেননি এখনও।

অন্ধকার চারপাশ। পূর্ণচাঁদ আকাশে। ছাদে দাঁড়িয়ে থেকে অন্তূর খুব হিংসে হলো ওই আলোকিত চাঁদকে। আব্বু বাড়ি ফিরল না এখনও, তার খোঁজ তো চাঁদ রাখেনি। বরঞ্চ জ্বলজ্বল করছে আকাশ পানে। স্বার্থপর খুব চাঁদটাও। অন্তূর দুঃখে সে একটুও দুঃখী নয়। অন্তূ চেয়ে রইল পাড়ার সরু গলির মোড়ে চেয়ে। বারবার চোখে ভেসে উঠছে আমজাদ সাহেব বাজারের থলে হাতে সরু রাস্তাটাতে ঢুকছেন। ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে ব্যাগ অন্তূর হাতে ধরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলছেন, “আরে! একটা জরুরী কাজ পড়ে গেছিল। আমি কি বাচ্চা ছেলে? এত চিন্তা করতে হবে কেন তোর? ফোনে চার্জ ছিল না, বন্ধ হয়ে আছে।ʼʼ

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। রিচেইক করিনি। আর অপেক্ষা করানোর জন্য আমি খুব সরি, চেষ্টা করব এরপর নিয়মিত হওয়ার☹️🤍]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here