অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ১৭.

0
109

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

১৭.

বাড়িতে শুধু তিনজন মেয়ে মানুষ। রাত বারোটার দিকে রাবেয়ার চেঁচামেচিতে ছাদ থেকে নেমে এসেছিল অন্তূ। বাড়ির মেইন দরজা আটকাতে গিয়ে আরও কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল আব্বু অপেক্ষায়। আব্বু আসলই না!

জানালার ধারে বই নিয়ে বসে জানালাটা খুলে দিয়েছিল। রাবেয়া ঘরে এসে আরেক দফা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন জানালা খোলা নিয়ে। ঠান্ডা হাওয়া আসছে, তা যেন শুষে নিচ্ছিল অন্তূ। একদৃষ্টে চেয়ে ছিল বাইরের অন্ধকার কুয়াশাচ্ছন্নতায়।

চুপচাপ এভাবে বসে থাকায় বুকের ব্যথাগুলোয় যেন আগুনে তুষের ছিটা পড়ছিল। মনের আশংকাজনক ধুকপুকানি মনোযোখ পাচ্ছিল। ধিকধিক করে জ্বলছিল। অন্তিক আজ তিনদিন বাড়ি ফেরেনি। আব্বু সকালে বেরিয়েছে, রাত দুটো বাজল, সেও ফিরল না। কিন্তু কেন ফিরল না? এত স্বার্থপর কেন হলো, আব্বু? এই যে সে সারাদিন মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করছে, মাঝেমধ্যেই বুক ছেঁড়া কান্না গুলোকে চোখের সীমানা পেরিয়ে যেতে দিচ্ছে, আবার কখনও শক্ত হয়ে উঠছে চোয়াল। এতক্ষণ নানাভাবে ভেবেও কোনো রকম ব্যাখ্যা বের করতে পারেনি। অন্তিক কোথায় গেছে, আব্বু আসছে না কেন? মনটা বাচ্চা হয়ে উঠছিল, কিছুতেই শক্ত হয়ে ভাবতে পারছিল না। বোকা বোকা ভাবনা আর অনুভূতিরা ভিড় করছিল ভেতরে।

রাবেয়া আজ অন্তূর ঘরে ছিলেন। কেন জানি তিনি অনেকটা সময় নিয়ে লম্বা একটা মোনাজাত করলেন নামাজ শেষে। আম্মুর কান্নার গুনগুনানি অন্তূর কানে গলিত লোহা হয়ে ঢুকছিল। বাইরে রাত বাড়ার সাথে সাথে যখন ঝি ঝি পোকার ডাক প্রকট হয়ে এলো, তখন চোখের পানি শুকিয়ে রাবেয়া কাত হয়ে শুয়েছেন কোনোরকমে। অন্তূ কম্বল তুলে দিলো উনার গায়ে। এরপর তিন-চারবার আব্বুর নম্বরে ডায়াল করল। রিসিভ হলো না। অযু করে এসে তাহাজ্জদের নামাজে বসেছিল, তখন রাত তিনটা ছুঁই-ছুঁই। নামাজে খুব বিঘ্ন ঘটছিল, কেন জানি কান্নারা বাঁধ মানছিল না। কান্নার তোড়ে সিজদা লম্বা হচ্ছিল, নাক টানতে হচ্ছিল বারবার। বুকের ভেতর আটকে এসে কয়েকবার দম আটকালো। এসবের কারণ স্পষ্ট নয় অন্তূর কাছে। তবে বুকে তুমুল ঝড় উঠেছে, কঠোর আশংকারা নেচে নেচে কীসব অলুক্ষুনে কথাবার্তা বলতে চাইছে। অন্তূ কান দিলো না সেসবে। সেজদায় পড়ে রইল বহুক্ষণ যাবৎ। খুব বেশি দেরিও নেই ফজরের আজানের ধ্বনি শোনা যাবার।


জয় এসেছে, তা হামজা জানতে পারল সকাল দশটার দিকে। জয়ের রুমে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। অথচ তার এতক্ষণ চিৎপটাং হয়ে পড়ে থাকার কথা। বেড-সাইড টেবিলের ওপর বিয়ারের ক্যান উল্টে পড়ে আছে। বিছানায় কম্বল ছড়ানো। হাতঘড়ি, ওয়ালেট, পারফিউম—সব নিজেদের জায়গায় পড়ে আছে। তার মানে জয় আশেপাশেই কোথাও আছে, দূরে বের হলে এসব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একাকার হয়ে থাকতো । তরুকে ডাকল হামজা। তরু এলো না, গলা উঁচিয়ে জবাব দিলো।

-“জয় কখন এসেছে কাল রাতে?ʼʼ

তরু চেঁচিয়ে জবাব দিলো, “ভোর রাতে।ʼʼ

-“আবার তাহলে বের হয়েছে কখন?ʼʼ

-“সকাল আটটার দিকে বের হয়ে গেল। বলে গেল, এক্ষুনি আসবে। আপনি কল করুন।ʼʼ

হামজা এসে সোফায় বসে রিমিকে ডাকল, “এক কাপ কফি বা চা কিছু একটা দাও।ʼʼ

রিমি আস্তে করে বলল, “আসছি।ʼʼ

হামজার মনে পড়ল, আজ সকালে ছোট্ট একটা মিটিং ছিল ক্লাবে জয়ের। মাঝখানে আর দু’দিন তিনরাত বাকি নির্বাচনের। চারদিকটা এতটা ঠান্ডা থাকার কথা না থাকলেও ঠান্ডা, কারণ আসল প্রতিপক্ষ এখনও হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ির ওপর আছে। মাজহার এখনও হাসপাতালে ভর্তি। লোক মারফতে খবর পাওয়া গিয়েছে খুব শীঘ্রই রিলিজ করা হবে ওকে। হামজা মনে মনে প্রস্তুত যেকোনো কিছু মোকাবেলার জন্য। তবে হাঙ্গামা নির্বাচনের পর হলে সুবিধা হয়। আর সেটার শতভাগ চেষ্টা করতে হবে।

রিমি কফি দিয়ে চলে যেতে অগ্রসর হলে পেছন থেকে ডাকল হামজা, “আজ যাবে ওই বাড়ি?ʼʼ

-“না।ʼʼ

হামজা চোখ তুলে তাকিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি নিয়ে যাব, আমার সঙ্গে চলে আসবে।ʼʼ

কফির গরম ঠোঁটে লেগে নড়েচড়ে উঠল হামজা। দ্রুত কাপ নামিয়ে বলল, “এত গরম কেন? পরের বার কফি বানালে এত গরম পানি ব্যবহার করবে না।ʼʼ

-“আপনারই বা এত তাড়াহুড়ো কীসের? ঠান্ডা হতে তো ঘন্টাখানেক সময় লাগবে না।ʼʼ

গম্ভীর স্বরে কথাটা বললেও তাতে অল্প একটু অভিমানও যেন শুনতে পেল হামজা। অথচ মেয়েটার অভিমান তার ভালো লাগেনা। নির্বাচনের মুহুর্তে সকলের মনোনয়নের পাশাপাশি রিমির সম্পূর্ণ মনোযোগ চাই তার, নয়ত বেশ নার্ভাস ফিল হবে।

-“যাও, তৈরি হও।ʼʼ

-“যাব না, আমি। আর এমনিতেও মাজহার ভাই বাড়িতে আসেনি এখনও।ʼʼ

হামজা যেন শুনল না কথাটা, বলল, “এ জন্যই নিয়ে যাব। ও আসলে তুমি এমনিতেও ওই বাড়িতে যাবার অনুমতি পাবে না। তৈরি হয়ে নাও।ʼʼ

-“যাব না আমি। আপনি আমায় আপনার বন্দিনী করে রাখতে চান? ক্ষমতার লোভ আপনাকে অমানুষ করে তুলছে দিনদিন, তা বুঝতে পারছেন না। আপনাকে আমি ভালোবেসেছিলাম কোনোদিন, এটা ভাবতেও নিজের ওপর ঘেন্না লাগে আজকাল। দয়া করছেন আমার ওপর, ও বাড়ি নিয়ে যাবার অফার কোরে? আপনার দয়াতে থুতু ফেলি আমি…থুহ!ʼʼ যথাসম্ভব অশিষ্ট ভাষায় কথাগুলো বলল রিমি।

হামজা কফির মগ সেন্টার টেবিলে রেখে হাসল, অসীম ধৈর্য্যশীল এক পুরুষের মতো নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “নিজেকে চেনা যতটা মুশকিল, তার চেয়েও বেশি কঠিন হলো নিজের মানুষদের চিনতে পারাটা। তুমি চিরকাল ওই বাড়ির সকলের হাসি মুখ আর আদুরে আচরণ পেয়ে বড় হয়েছ, ওদের ব্যাপারে তোমার ধারণা ওই অবধিই সীমাবদ্ধ, কিন্তু ওটা শুধুই নিজের পরিবারের জন্য বরাদ্দ। যেমন আমি এই বাড়ির জন্য এক হামজা, গেইট পেরিয়ে রাস্তায় পা রাখলে আরেকটা কেউ। মাজহার আমার কাছে এত এত ছাড় পেয়েও বহুত কিছু করেছে এতদিনে, এবার তাহলে ভাবো এবার সুস্থ হয়ে কী করতে পারে? আর এবার ও ফিরে যা করবে, আশাকরি আমার ওপর দিয়ে যাওয়া সেই চাপ দেখে তোমার ভাইয়ের ওপর ভালোবাসায় একটু চিড় ধরতে পারে।ʼʼ

কথাগুলো বলে রিমির হাত চেপে ধরল হামজা। রিমি তা ছিটকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “আমার ভালোবাসায় চিড় ধরাতে খুব চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তাই না? আল্লাহ জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দিক আপনার চেষ্টাকে। দরকার পড়লে এই বাড়িতেই পচে মরবো, যখন আপনার মতো জাহিলের সাথে বিয়ে হয়েই গিয়েছে, তখন আপনার বাড়িতেই মরণ হোক আমার! আপনার মতো অমানুষ শত্রুতা পুষবে, এটা আর এমন অস্বাভাবিক কী? কিন্তু যে মাজহার ভাই আমাকে আপন বোনের মতো বুকে চেপে মানুষ করেছে, তার রক্ত ঝরার কারণকে না আমি ক্ষমা করতে পারি, আর না কোনো বিবেচনা!

-“শত্রুতা আমি শুরু করিনি। শত্রুতা ওরা শুরু করেছে, এবং সেটাও বহুদিন আগে। যেবার প্রথম আমি ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলাম, মাজহারের ছেলেদের মাঝে কারও বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রোল হাতানোর ছিল, সেটা না পারায় এই শত্রুতার শুরু। এরপর দিনদিন আমার জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়া তোমার চাচা, চাচাতো ভাই, বাপ এদের শত্রুতার আগুনে পেট্রোল ঢেলেছে। তোমাকে বিয়ে করতে চাইলাম। প্রথমে রাজি হলো না, পরে রাজী কেন হলো জানো? ভেবেছিল, আমি বাড়ির জামাই হয়ে গেলে ওদের হাতের লাঠি হয়ে যাব, আমার ক্ষমতা এবং জনপ্রিয়তার ভাগ পাবে ওরা। তা যখন হলো না, তখন একের পর আক্রমণ পেয়েছি এই কয় বছরে ওদের থেকে। কিছুই বলিনি কোনোদিন। কিন্তু আমার পর যখন জয় ভিপি হলো, তখন আবার নতুন কোরে জ্বলে উঠেছে তোমার বাপ-চাচার। এবার বলো, শত্রুতা কারা পুষছে, আর এর সমাধান কী? কোনো সমাধান নেই, এভাবেই যতদিন চলে।আর এরপরেও তুমি অবুঝ হলে, তোমার ওপর কঠোর হতে বাধ্য হবো বোধহয় আমি ʼʼ

রিমি আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না। তখনই গান গাইতে গাইতে ঢুকল জয়, “হামজা ভাইয়ের হবে জয়, ও ভাবী গো.. হামজা ভাই খারাপ লোক, জয়ের মালা তারই হোক, উড়ছে পাখি দিচ্ছে ডাক, হামজা ভাই জিতে যাক… ও আমার ভাবী গো, ও প্রাণের ভাবী গো..ʼʼ

হামজা চট করে হেসে ফেলে তাকাল জয়ের দিকে। পরনে দুধের মতো সাদা ধবধবে একটা লুঙ্গি। তার ওপর ছাইরঙা শার্ট পরেছে। কোলে কোয়েল। পেছনে কবীর ঢুকেই কপালে হাত ঠুকে সালাম করল। ওকে বসতে ইশারা করল হামজা। তার পেছনে দুজন একটা মস্ত বড় অ্যাকুরিয়াম বয়ে নিয়ে এসে বসার ঘরের মেঝেতে রাখল। হামজা ভ্রু কুঁচকে বলল, “এসব টেনে এনেছিস কোন দুঃখে? অল্প একটু টেমপার উঠলেই যাতে ওটাকে আগে ভাঙা যায়?ʼʼ

কোয়েল জয়ের কোল থেকে নেমে দৌঁড়ে এসে মামার কোলে চড়ে বসে। জয় লুঙ্গি একহাতে উঁচিয়ে ধরে রুমে গিয়ে কিছু টাকা এনে লোকদুটোকে দিয়ে বিদায় করল। হামজার পাশে বসে কোয়েলকে বলল, “যা, এবার তোর মাকে ডেকে আন। তোর মার কাঁদার পানির চোটে সবগুলো বালিশের তুলো পঁচে গেছে।ʼʼ

তুলি কোথা থেকে দৌঁড়ে এসে কোয়েলকে কোলে তুলে নিয়ে এ-গালে ও-গালে চুমু খেতে লাগল, এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলল। হুট করে কিছু মনে হতেই কোয়েলকে নামিয়ে জয়কে জিজ্ঞেস করল, “তুই কী করেছিস ওই বাড়ি গিয়ে? মেরেছিস সীমান্তকে, তারপর এনেছিস কোয়েলকে?ʼʼ

জয় বিরক্ত হয়ে বলল, “সাংবাদিক মাসুদ আর মহিলা মানুষ কোনোদিন ভালো হবেনা? তোকে মেরে মুখের নকশা বদলে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছে, মেয়েটাকে রেখে দিয়েছিল জোর করে, তারপরেও কলজে ফাটতেছে সোয়ামীর জন্য? সামনে থেকে যা, ন্যাকা কান্না দেখলে ডায়াবেটিস বাড়ে আমার। সুগার আছে ন্যাকামিতে।ʼʼ

কোয়েল এসে কোলে চড়ে বসে আধভাঙা স্বরে জিজ্ঞেস করল, “জয়! ওই মাছগুলোকে বের করে খেলি আমি? বের করে দাও একটাকে?ʼʼ

জয় মাথা নাড়ল, “তার আগে তোমাকে আমি পানিতে চুবিয়ে খেলবো দশ মিনিট, এরপর মাছকে পানি থেকে বের কোরে তোমার কাছে দেব খেলার জন্য।ʼʼ

হামজা কেড়ে নিলো কোয়েলকে, জয়কে বলল, “লাত্থি মারবো একটা? শয়তানে সবসময় লাড়ে-চাড়ে তোরে?ʼʼ

-“শয়তানকে আমি লাড়ি। এটা আমার প্রিয় কাজ, ব্রো!ʼʼ

হামজা গম্ভীর হলো হুট করে, “সীমান্তকে মেরেছিস?ʼʼ

জয় সোফায় পা তুলে বসে বলল, “না, সুন্দরমতো জিজ্ঞেস করেছি কেন মেরেছিস তুলিকে?ʼʼ

-“তো কী বলল?ʼʼ

-“কাম নাই করার মতো, বাল নাই ছেঁড়ার মতো, তো বউ পিটাইছে। আমারও কাম অথবা বাল ছিলনা হাতে, আমিও দুই চারটা লাগায়ে আসছি। পরে বাপের মার খাওয়া দেখে এই কোয়েলের ডিম কাঁদা ধরল, তারে নিয়ে যাইয়া অ্যাকুরিয়াম কিনে দিয়ে শান্ত করছি।ʼʼ

-“মিছিল হয়েছে সকালে? ঝামেলা হয়েছে কোনো?ʼʼ

-“না। শুনলাম মাজহার শালার পায়ে নাকি খাঁটি স্টেইনলেস স্টিল ঢুকাইছে! ওই শালা দিনাজপুর ব্যাক না করা অবধি বিশেষ ঝামেলা হবার কথা না। পেছনে যতই বদনাম পাবলিক করুক, জয়ের নামে ডরায় তো সবাই! এইটুকুই যথেষ্ট! মাজহার আসবে নির্বাচনের আগের দিন। রিলিজ করবে কাল-টাইল মনেহয়!ʼʼ

তখনই রিমি এসে জয়ের পাশে বসল। তার হাতে খাবারের প্লেট। খাবার তুলে জয়ের মুখের সামনে ধরে বলল, “খাননি সকালে?ʼʼ

-“সেহরীর সময় খাইছিলাম। আসলেই চরম খিদে লাগছে, ধুর, ওই মাছ দিয়েন না, ডিমের টকরোটুকু দেন।ʼʼ

রিমি কপাল জড়িয়ে বলল, “আপনার এত আহ্লাদ আসে কোত্থেকে?ʼʼ

জয় নির্লজ্জের মতো হাসল, “দয়ালের কাছ থেকে সরাসরি সাপ্লাই হয় আমার কাছে।ʼʼ

হামজা টাউজারের পকেট থেকে ফোন বের করল। রিমি এক আজব চরিত্রের মেয়ে। সব কিছুকে ছাপিয়ে তার জিদ। যে জয়ের ওপর তার রাগ, আজ তার সাথে মিছেমিছি মিল বজায় রাখছে হামজাকে জ্বালাতে। জয় রিমির নাটক বুঝেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে না, এটা তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য!

জয় খাবার চিবোচ্ছিল, হামজা বলল, “ভোট কেন্দ্রগুলোতে এক্সট্রা নিরাপত্তার জন্য কিছু পলাশ ভাইয়ের লোকের দরকার পড়বে। আমি চাচ্ছিনা অন্তত সেদিন কোনো তামাশা হোক। বদনামসহ ভোট লাগবে না আমার। হামজা পাটোয়ারী নিখিল ভোটে, মানুষের মনোনয়নে জিতেছে, এই রব যেন লোকের মুখে মুখে থাকে। দুপুরের পর পলাশ ভাই ডেকেছে তোকে, ত্যাড়ামি না করে গিয়ে দেখা করে আসিস। তার হেরফের হলে কিন্তু অবস্থা খারাপ হবে তোর!ʼʼ

জয় উঠে অ্যাকুরিয়ামের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে মাছগুলোকে পর্যবেক্ষণ করল। আঙুল দিয়ে কাঁচের ওপর খুঁচিয়ে বেশ জ্বালালো মাছগুলোকে। ভেতরে একটা গোল্ডফিশ, দুটো অ্যাঞ্জেল ফিশ, আর এক জোড়া কালশিটে রঙের অস্কার ফিশ এনেছে। গোল্ড ফিস সে একটা কিনেছে কেন, সে-ই ভালো জানে। বহুবার ছোটো-বড় বহু ধরণের অ্যাকুরিয়াম কিনেছে, আবার রাগের সময় ওগুলোকে আগে ভাঙে। কবুতর, মাছ, খরগোশ—যেকোনো একটা কিছু পোষা প্রাণী হিসেবে থাকে সবসময় তার সংগ্রহে। মাছের সামনে থেকে উঠে বলল, “দুপুরে যেতে পারবো না, ঘুমাবো আমি। বিকেলে গোসল করবো, খাবো। যাবো ঠিক সন্ধ্যার আগে। দু এক কলকি টেনেও আসবো তাহলে!ʼʼ

হামজা বকে উঠল, “কলকি টানার খবর পেলে এক কোপে বলি দিয়ে দেব, শুয়োরের বাচ্চা। যে কাজে পাঠাচ্ছি, তা কোরে ফিরে আসবি।ʼʼ


সকাল থেকে বাড়িতে রান্না হয়নি। কারও পেটে ক্ষুধাও নেই। তবে মার্জিয়ার না খেয়ে থাকা চলবেনা এই অবস্থায়! দুপুর গড়িয়ে গেছে, তখন রাবেয়া নিজেকে টেনে নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে। অন্তূ সিঁড়ির ওপর বসে ছিল। চোখদুটো খুব জ্বলছে, মেরুদণ্ডে অদ্ভুত রকমের যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে। সারারাত না ঘুমানোর ফল।

মার্জিয়ার ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল অন্তূ, সকালে একবার বমি করেছে মার্জিয়া। সেই মুহুর্তেঘরের ভেতর অন্তূর ফোনটা বেজে উঠল। অন্তূ দিন-দুনিয়া ভুলে ঘরে ছুটলো, নিশ্চয়ই আব্বু ফোন করেছে। স্ক্রিনে অপরিচিত একটা আনসেভড নম্বর। তবুও অন্তূর চোখ ভিজে উঠল, কণ্ঠনালি থেকে কান্না ছিটকে এলো এক মুহুর্তে। আব্বুর ফোনে চার্জ নেই, সে সঠিক ধারণা করেছে তাহলে। অন্য কারও নম্বর দিয়ে কল করেছে। কাল সারাবেলা সে অকারণে চিন্তা করেছে! কল রিসিভ করেই ঝারি মারল একটা, “বয়স বাড়ার সাথে সাথে আক্কেল জ্ঞান কি গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছ? একটা কল করি জানিয়ে দেয়া যেত না, যে কোনো কাজে আটকে গেছ? বাড়ির প্রতি তোমার না হয় টান নেই… আমারও তোমার ওপর টান নেই, তবে জলজ্যান্ত একটা মানুষ উধাও হয়ে গেলে একটু ভাবনা হয় তো নাকি?ʼʼ

রাবেয়া দোড়ে এসে দাঁড়ালেন মেয়ের পাশে। অন্তূ ফোনে বলে চলল, “তো কখন আসবে বাড়িতে? আর…ʼʼ

-“হ্যালো!ʼʼ ভরাট এক ধাতব কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ফোনের ওপাশ থেকে। অন্তূ থমকালো। আব্বুর কণ্ঠস্বর গম্ভীর, তবে তা চির-পরিচিত, এটা নয়। পিপাসার্ত মুখে চুপ রইল অন্তূ, তার ঠোঁট ফাটফাট করছে, ঠিক বুঝতে পারছে না বিষয়টা।

-“বেশি প্যাচাল না পেরে যে ঠিকানাটা বলছি, সেখানে চলে আসিস। আর..আর একটা পাখিও যেন সাথে না আসে বা জানতে না পারে কিছু।ʼʼ সংক্ষিপ্ত এক হুমকি-বাণী শুনতে এতটা কর্কশ এবং হিংস্র লাগতে পারে, অন্তূর ধারণা ছিল না। লোকে বলে, অন্তূ নিজেও নাকি কথা বলে খুব দৃঢ় আর কঠোর স্বরে।

পর মুহুর্তে কল কেটে গেল। সাথে সাথে একটা মেসেজ এলো। সেখানে একটা ঠিকানা লেখা—কাহারোল থানার নয়াবাদ সীমান্তে নয়াবাদ মসজিদ।

অন্তূ কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইল ফোনের দিকে। রাবেয়া ঝাঁকাচ্ছেন ওকে অনবরত, বাবরার প্রশ্ন করেছেন, জবাব দিলো না কোনো। যে ঠিকানাটা পাঠিয়েছে, ওর ধারণা সঠিক হলে জায়গাটা ঢেপা নদীর তীরে নির্জন এলাকার দিকেই নির্দেশ করছে। অন্তূর মাথা কাজ কথা বন্ধ করে দিয়েছে ইতোমধ্যেই।

সে অবচেতনায় চলে গেল এক পর্যায়ে। রাবেয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেয়ে ছটফট করছেন। অন্তূ চট করে মুস্তাকিনকে কল করে বসল। কেন করল, সে জানেনা। ফোনে পরিস্কার জানিয়ে দেয়া হয়েছে, একটা পাখিও যেন টের না পায়। তবুও ফোন করেছে অন্তূ। সতন্ত্র এক এফবিআই অফিসারকে ডাকছে সে।

মুস্তাকিন এলো ঠিক বিশ মিনিটের মাথায়। ততক্ষণ অন্তূ ঠিক একই জায়গায়, একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল, জড় পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। মুস্তাকিন এসেছে টের পেয়ে নিস্তেজ হাতে মুখটা ওড়নার প্রান্তে আড়াল করে দাঁড়াল। মুস্তাকিন ঘটনা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করল, অন্তূ জবাব দিলো গা ছাড়া ভাবে। তার চোখের কাতরতা মুস্তাকিনের দৃষ্টি এড়ানোর নয়, তবুও যথাসম্ভব শান্ত সে। ফোনের রেকোর্ডার অন ছিল, কাকতালীয়ভাবেই যে ঘটেছে এটা। যা কথা হয়েছে কাকতালীয়ভাবেই সব রেকর্ড হয়ে গেছে। সেটা শুনে মুস্তাকিন যেন চমকে উঠল। এর আগে মুস্তাকিনকে এমন চমকাতে দেখা যায়নি। হাতঘড়িতে সময় দেখে অল্প সময় নিয়ে বলল, “আঁখির রে প এন্ড মা র্ডা র কেইসটা হাতে নেবার পরের দিন আমার কাছে একটা চিরকুট আই মিন হুমকি-বার্তা এসেছিল, যার হুমকির ভাষা অনেকটা এরকম ছিল। তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, তার কিছুদিন পর একটা ফোনকল এসেছিল, যেখানে এই কণ্ঠস্বরটাই আমাকে আবারও হুমকি দিয়েছিল। দুয়ে-দুয়ে চার না হয়ে কেমন যেন পাঁচ হয়ে যাচ্ছে, মেডাম। আপনি ভয়েসটাকে চেনেন অথবা আগে শুনেছেন?ʼʼ

শান্ত-উদ্বেগহীন স্বরে বলা মুস্তাকিনের কথাগুলোয় অন্তূ হতবিহ্বল হয়ে তাকালো, কোনো জবাব দিলো না। কেমন গোলমেলে লাগছে সব, বেজায় গোলমেলে!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here