অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ১৮.

0
618

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

১৮.

বাড়ি থেকে অন্তূ বের হলো আছরের নামাজ আদায় কোরে। তার আগে ছুটে বেরিয়ে আসতে নিলে মুস্তাকিন থামিয়েছিল। এরপরেও যখন বেপরোয়ার মতো বেরিয়ে আসতে অগ্রসর হয়, তখন একটা কঠিন ধমক মেরেছে মুস্তাকিন। রাবেয়ার আনা চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করেছিল, “বাহাদুরী করে একা যাবেন ঠিক আছে, এরপর আপনার সাথে কী হবে, তা দেখার জন্য ওখানে কে থাকবে? প্রথমে অন্তিক, পরে স্যার, এরপর আপনি, এরপর এ বাড়ির কার পালা?ʼʼ

অন্তূ নিশ্চুপ। মুস্তাকিন বলেছিল, “আমি ফোর্স ডাকি, তারা গোপনেই আপনাকে প্রোটেক্ট করবে, ওরা জানতে পারবে না কেউ গিয়েছে আপনার সঙ্গে। এবং তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমার।ʼʼ

অন্তূ রাজি হয়নি, প্রয়োজন নেই, অফিসার! আমি কোনো ধরণের ছোট্ট একটা রিস্কও নিতে প্রস্তুত নই। আমার মন বলছে, ওরা ভয়ংকর। কথার খেলাপি হলে খারাপ কিছু হতেই পারে!ʼʼ

রাবেয়া কান্না লুকালেন শাড়ির আঁচলে। অন্তূ নিস্তেজ পায়ে এগিয়ে গিয়ে আলতো কোরে একবার আম্মুকে জড়িয়ে ধরেছিল। বেরিয়ে আসার সময় মুস্তাকিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “এক ঘন্টা সময়। এর পরে আমি ফিরে না আসলে, আপনি ইচ্ছেমতো পদক্ষেপ নিতে পারেন।ʼʼ

মুস্তাকিন কেমন কোরে যেন চেয়ে ছিল মিনিটখানেক অন্তূর চোখের দিকে। এরপর আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বিদায় জানিয়েছিল। বিরবির কোরে বলেছিল, “গড ব্লেস, ইউ।ʼʼ

বাঁশের হাঁটের ওপর থেকে গাড়িতে কোরে নয়াবাগ যেতে কমবেশি আধঘন্টা সময় লাগে। যখন অন্তূ নয়াবাগ মসজিদের সামনে পৌঁছাল, তখন বিকেল প্রায় শেষের দিকে। তার মনে হলো, আরও একটু আগে আসার ছিল। শীতের মৌসুম, দিনের বেলা ছোট। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।

নয়াবাগ মসজিদের অদূরে দাঁড়িয়ে থেকে তার ভেতরে এক প্রকার ছটফটানি কাজ করছিল। আবার ভাবতে বসে গেছিল, জীবনে সাথে আসলে ঘটছেটা কী? এই অনিশ্চিত প্রবাহধারা তাকে ধাওয়া কোরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

মিনিট দুয়েক বাদে দুটো লোক এসে দাঁড়াল সামনে। অন্তূর গা’টা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল, লোমগুলো খাঁড়া হয়ে উঠেছে। লোকগুলোর মুখের অভিব্যক্তি ভীষণ রকমের চতুর। দেখে মনে হচ্ছে, অন্তূকে মেহমানদারীর উদ্দেশ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। চারপাশের লোক আসল ঘটনা আন্দাজ করতে পারবেনা এদের আচরণ দেখে, তাছাড়াও হয়ত বুঝলেও কিছুই বলবে না। রাজত্ব এদের, শাসন এদের, সমাজ এদের নোংরা পায়ের তালুর তলে পদদলিত।

তারা যে রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, রাস্তাটা ক্রমশ ঢালু হয়ে এগিয়ে গেছে। দুপাশে বন, জঙলি এলাকার মতো। এককথায় নির্জন একটি জায়গা। অন্তূ হাসল। তার হাসি পাচ্ছে, নিজের জীবনের ঘটনাপ্রবাহের ওপর, এবং অনিশ্চিত আগামী কালের ওপর। মন ভরে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হাসল। আব্বুর কথা খুব মনে পড়ছে, সেটাকে পাত্তা দিতে চাইল না। ওটা মাথায় জেঁকে বসলে তার মানসিকতা মেরুদণ্ডহীন এক কেঁচোর মাফিক হয়ে পড়বে। যাকে আলতো পায়ের চাপে পিষে মারা যায়। কিন্তু এখন দূর্বল হবার সময় নয়। জানা নেই, কী অপেক্ষা করছে। অথচ বেপরোয়া মন বেজায় শয়তান। ঘুরে ফিরেই আব্বুর মুখটা, মাঝেমধ্যে আবার অন্তিকের হাসি মুখটা খুব জ্বালাতন করছিল।

অন্তূ চারপাশে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে উঠল মৃদু স্বরে, সাহায্য চাইল। একদম নির্জন জায়গাটির কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে একটি বাংলো অথবা কোয়ার্টারের মতো বিল্ডিং। রঙচটা দেয়াল, মরিচা ধরা লোহার জানালাগুলো। ওর পেছনে হাঁটছিল লোকদুটো। এত কাছে, গা লাগিয়ে হাঁটছে, এতক্ষণে বেশ কয়েকবার প্রায় ছোঁয়া লেগেছে। অন্তূর সাহস ওদের চোরা নজরে বাঁধা পড়ে আছে যেন।

বাড়ির গেইটের ভেতর দিয়ে ঢুকতেই চোখে অন্ধকার দেখল। ঘুপছির মতো ভেতরটা, বিশ্রী গন্ধ আসছে চারপাশ থেকে। অন্তূর মাথা চক্কর কেটে উঠল অসহ্য দুর্গন্ধে। আন্দাজ কোরে নিলো, মদ এবং ড্রাগসের গন্ধ মিশে একাকার হয়ে একটা ভ্যাপসা পেট গুলানো দুর্গন্ধের সৃষ্টি করেছে। সিঁড়িতে ওঠার সময় বেশ কয়েকবার লোকদুটো যেন ওকে ইচ্ছে কোরেই ছোঁয়ার চেষ্টা করল।

অন্তূ হাসল কেবল। তার মনে হতো, সে প্রতিবাদী, অল্প হলেও। তার সামনে কোনো অন্যায় টিকার নয়। অথচ এই ভাবনাটা থেকে তাকে বের করতেই যেন প্রকৃতির আজ এত আয়োজন। কলেজের ছোকড়াদের, অথবা পাড়ার মহিলাদের সম্মুখে প্রতিবাদী আওয়াজ উঠানোটাই জীবনের জিত এবং নিরাপত্তা নয়, ওটাকে কোনো অর্থেই প্রতিবাদ বলে না। আজ মনে হচ্ছে, তার প্রতিবাদ বোধহয় শুধুই মহিলা এবং সাধারণ অসভ্যদের সামনে সীমাবদ্ধ। নয়ত এখানে কেন সে একটা চলন্ত পুতুলের মতো হেঁটে চলেছে এভাবে? কোনোই প্রতিবাদের ভাষা মুখে আসছে না, হাতে উঠছে না। শরীরে কম্পন ধরেছে, মনে নারীসুলভ দূর্বলতা বিরাজ করছে। অসহায়ত্বের চাদরে পুরো অন্তূ-সত্ত্বাটা বাজেভাবে ঢাকা পড়েছে। তার মানে এই সমাজের খারাপদের সম্মুখে টিকে থাকার মতো প্রতিবাদ রপ্ত করা সাধ্যের বাইরে? সে নাহয় পারেনি, আচ্ছা না-ই বা পারল! কিন্তু মুস্তাকিন? সে একজন এফবিআই অফিসার। তার কাছে হুমকি-চিরকুট আসে, শাসানো ফোনকল আসে। মাঝপথে কেইস দাবিয়ে দেয়া হয়! সমাজে আসলে কাদের বিচার এবং রাজ চলছে? কারা ভালো আছে? চিৎকার কোরে কেউ যেন কানের তালা ফাটালো এটা বলে—খারাপদের! খারাপরা, খারাপরা ভালো আছে। একমাত্র খারাপেরা তুলনামূলক ভালো আছে।

দোতলায় নিয়ে যাবার পর অন্তূর মনে হয়েছিল তাকে কোনো কক্ষে বন্দি কোরে দেয়া হবে। নারী-মন আতঙ্কে গুঙরে উঠছিল। কিন্তু তাকে বদ্ধ রুমগুলো পার করে রুফটপের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। চারপাশ ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায়। গোধূলি বেলা সবচেয়ে সুন্দর গোটা দিনের মাঝে। অথচ আজ তাকে বলি বোধহয় এই সুন্দর সময়েই দেয়া হবে? রুফটপটাও পুরোনো, সবুজাভ শেওলা পড়েছে, পুরোনো বিল্ডিং। মাগরিবের আজান শোনা গেল এবার। অন্তূ একটু চমকাল। লোকে বলতো, সে চমকায় না। আজ অল্পতেই খুব কাবু হয়ে যাচ্ছে যেন!

আজান শেষ হলো। রুফটপে পা রাখল, মাথা তুলে আশপাশ দেখল। লোকদুটো গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে।কয়েজন পুরুষের সম্মিলিত হাসির আওয়াজ পেয়ে সেদিকে তাকাল অন্তূ। চারদিকে কুয়াশা ঘন হয়ে আসছে, দিনের আলো ফুরিয়েছে। রুফটপটাকে বাইরে থেকে পুরোনো পরিত্যক্ত জায়গা বলে মনে হলেও এখন বুঝল, এক অভিজাত বৈঠকখানার চেয়ে কম নয় এটা। গোলাকার সারি কোরে সাজানো সোফার সেট, সেন্টার টেবিল। টেবিলের ওপর সারি ধরা মদের বোতল, ড্রিংকিং গ্লাস, সোডার কৌটা, মেডিসিনের পাতা, মোড়ানো কাগজ, ছুরি ইত্যাদি পড়ে আছে। সোফাতে গা এলিয়ে বসে আছে একজন পুরুষ। জ্বলজ্বলে বিড়ালের মতো চোখ, খাঁড়া নাক অনেকটা খিলানের মতো, পাটাগুলো যেন ফনা তুলে আছে। ঠোঁটে প্যাচপ্যাচে হাসি ঝুলছে। তার সম্মুখে পিঠ ফিরিয়ে বসে আছে আরেকটি লোক। এক মুহুর্তের জন্য অন্তূর মনে হলো, এই পিঠ ফেরানো পেছনের পৃষ্ঠটাকে সে চেনে।

অন্তূ চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। ততক্ষণে ধপ কোরে পুরো রুফটপে আলো জ্বেলে উঠেছে। সামনে বসা লোকটি তাকাল অন্তূর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে হাতের গ্লাসটি নামিয়ে রেখে কেমন যেন মনোযোগী দৃষ্টি মেলল অন্তূর গোটা শরীরে, যেন আকর্ষণীয় কিছু পেয়েছে হুট কোরে। পেছন ফিরে বসে থাকা লোকটা অনীহার দৃষ্টি মেলে দেখতে চাইল, যে কাকে আনা হয়েছে? তার দৃষ্টি কেঁপে উঠে বিদ্যুতের মতো ধাক্কা খেল যেন অন্তূর ওপর।

জয়! অন্তূ হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে দেখল জয়কে। ধীরে ধীরে বিস্ময়ভাবটা কেটে মন-মস্তিষ্ক ও গোটা শরীর জুড়ে এক বিদ্বেষী ঘৃণারা লাফিয়ে উঠল যেন। ঘেন্নায় চোখ জ্বালা করছে খুব। বুকের ভেতর ঝড় উঠেছে। এরা এত নিচে নামতে পারে? এত নিচে? কেন করেছে এসব জয়? তাকে এখানে জয় নিয়ে এসেছে? সম্মানহানি করতে? জয় সেদিন ভার্সিটি প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল, সেসবের জেরে এসব করছে? প্রশ্ন অনেক, উত্তর নেই যথাযথ।

অবাক ভাবটা কাটল, যখন চট কোরে ওর বাহু আঁকড়ে ধরে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সামনে ঠেলে দিলো পেছনে থাকা লোকটা। অন্তূর ভেতরে ধপ কোরে আগুন জ্বলে উঠল যেন। আরও দুটো ঠেলা তাকে সহ্য করতে হলো। অন্তূর মাথাটা চক্কর কেটে উঠল। শরীরটা ভেঙে আসছিল। মন-মস্তিষ্ক না চাইতেও একদম দূর্বল হয়ে আসছিল। সবশেষে সে একজন মেয়ে, মাংসাশী পশুর ডেরায় দাঁড়িয়ে থাকা এক ছোট্ট হরিণীর বাচ্চার মতোই দূর্বল।

জয় চট কোরে উঠে দাঁড়াল। তার চোখে-মুখে চাপা বিস্ময়। ভ্রু কুঁচকে রইল। হাতের ধৌঁয়া ওঠা কলকিটা টেবিলে ফেলে বলল, “ও কে? ওকে এখানে নিয়ে এসেছিস কেন? কী সমস্যা?ʼʼ

সোফায় বসা লোকটা চার হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে, তার নজর এখনও অন্তূর শরীরে। লোকদুটো তখনও অন্তূর খুব কাছে দাঁড়ানো। অন্তূ একদৃষ্টে চেয়ে আছে জয়ের দিকে। সে ঠিক বুঝতে পারছিল না পরিস্থিতিটা। জয় কি নাটক করছে? জয় এবার কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করল, “ওকে এখানে নিয়ে এসেছিস কেন? কী চলছে, মামা! কাহিনি কী?ʼʼ

প্যাচপ্যাচে হাসি শোনা গেল। বিড়ালের মতো জ্বলজ্বলে চোখগুলো কীসের নেশায় যেন জ্বলছিল। সরু নাকের খিলানের মতো পাটাটা কাঁপে, যখন লোকটি হাসে। অন্তূর ঘেন্না এলো সেদিকে তাকিয়ে। জয় খেঁকিয়ে উঠল, “হের বাল! ওরে ক্যান নিয়ে আসছেন এইখানে? এইডা জিগাইছি।ʼʼ

পলাশ তখনও অন্তূর দিকে চেয়ে। জয় দুই-ভ্রুর মাঝে আঙুল ঘষে দাঁত খিঁচল, “পলাশ ভাই, কিছু জিজ্ঞেস করতেছি। হাসি অফ করে জবাব দিয়ে এরপর হাসেন।ʼʼ

অন্তূ চমকে উঠল। পলাশ? দিনাজপুরের শীর্ষ সন্ত্রাস? বাজারের প্রতিটা দোকানে কসাইয়ের মতো চাঁদাবাজি থেকে শুরু কোরে নতুন নতুন পাপের সৃষ্টিকর্তা পলাশ ও রাজন। দেখেছিল না কোনোদিন লোকটাকে। আন্ডারওয়ার্ল্ড বলে একটা কথা আছে, আর সেখানকার জানোয়ারেরা আন্ডারগ্রাউন্ডেই বিচরণ করে সাধারণত। অন্তূর মাথায় এলো না, তাকে কেন এই নরকে আনা হয়েছে? মহাজন পলাশ। মানুষকে টাকা ধার দেয় সুদের চুক্তিতে। সময় এতটা কম দেয়, যে একজন ঋণী লোকের পক্ষে অত দ্রুত সুদসহ টাকা জোগাড় সম্ভব হয়না। পলাশ তার বদলে বউ-বাচ্চা, জমির দলিল, বাড়িঘর, ব্যবসা, সবশেষে জান নিয়েও নিজের সুদসহ টাকা আদায় কোরে নেয়। এমন বহু কথা শুনেছে অন্তূ পলাশের ব্যাপারে। এটাই কি সেই পলাশ? জয় এখানে কেন? অন্তূর খুব দূর্বলতা বোধ হচ্ছিল।

চারপাশে দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে আছে পলাশের লোকগুলো। দেখতে নর্দমার পাশে ক্ষুধার্ত অবস্থায় শুয়ে থাকা কুকুরের মাফিক রূপ সবগুলোর। পলাশ হাসল, “এত ক্যা ব্যস্ত হইতেছিস, বাপ! এমন টসটসে মাল ঘরে রেখে এসে কীসব আউল-ফাউল জিনিস বন্ধক রেখে মানুষ টেকা ধার নেয়, বোকার দল সবগুলা!ʼʼ

জয় নাক-মুখ জড়িয়ে বিরক্ত হয়ে মদের বোতল তুলে নিয়ে তাকে দুটো চুমুক দিলো। অন্তূর বাড়ির লোকও কি সুদের টাকা নিয়েছে নাকি পলাশের কাছে? আমজাদ সাহেবকে তো এমন লোক মনে হয়না? গলা জ্বলছে আজ, অল্প সোডা এবং পানি না মেশালেই না। তখনই ওকে পাশ কাটিয়ে পলাশ এগিয়ে যায় অন্তূর কাছে। খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। অন্তূ চেয়েও পেছাতে পারল না। পিছনে আরও দুটো কুকুর দাঁড়ানো। পলাশের শরীর থেকে যে দুর্গন্ধ আসছে, তাতে অন্তূর মনে হলো সে যখন তখন গলগল করে বমি করে ফেলবে। এতটা কাছে কোনো পুরুষ কোনোদিন আসেনি তার। বিরবির কোরে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে ওঠে অন্তূ। পলাশ জিব বের করা কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকছে ওর শরীরের। বোরকা এবং নেকাবের ওপর দিয়েই যেন কীসের পৈশাচিক স্বাদ পাচ্ছে জানোয়ারটা। অন্তূ চোখ বুজে ডুকরে উঠল নীরবে, ‘আল্লাহ পাক! পানাহ চাই এসব থেকে, তুলে নিন আমাকে, রক্ষা করুন।ʼ

পলাশ স্থির হয়ে দাঁড়াল। প্যাচপ্যাচে হাসি দিয়ে বলল, “তোমার ভাই যখন বউয়ের গয়না নিয়ে এসে টাকা চাইছিল আমার কাছে, আমি অবশ্য ওরে কইছিলাম বউয়ের গয়না দরকার নাই, বউডারে আনলেই পারতি! জীবনে আর টেকা পরিশোধ করা লাগতো না। ছেঁমড়া দেখলাম জ্বলে উঠছিল, অথচ টেকারও প্রয়োজন, কিছু বলবার পারেনাই, হাহাহা! পরে কইল, ‘না, আমি গয়নাই রাখতে চাই, ভাই। দোকানে যা কামাই হবে, তা দিয়ে মাসে মাসে আপনার টাকা দিয়ে সময় ফুরানোর আগেই শোধ করে দেব।ʼ শালার ছাওয়াল পারল তো না। সেই হয়রানি পেরেশানী হইলো, দোকানডাও গেল, রাখতে পারল না। শেষ পর্যন্ত দুইদিন আগে নাকি নিজেও পালাইছে। অথচ তোমারে আনলে খুশি হয়ে দেখা যাচ্ছে ওর ব্যবসাডারে নিজহাতে চিরদিন প্রোটেক্ট করতাম! তোমারে আনে নাই ক্যান আগে? পরে খোঁজ লাগাইয়া জানছি তোমার কথা!ʼʼ

এবার ঝুঁকে পড়ল পলাশ অন্তূর ওপর, “তাও জানতাম না যে তুমি এত সুন্দরী! জানলে অন্তিক ছেমড়াডার সুদ, আসল, চাঁদা, দোকানের কামাইয়ের ভাগ সবডা মাফ করে দিতাম। মেয়েলোকের ওপর কিচ্ছু নাই, কারবারও না। আমি মেয়েলোকের খাতিরে বহুত ত্যাগ করবার পারি,
হা হা হা! অন্তিক ছেড়াডা আমার থেকে লুকায়ে, না পালায়ে যদি তোমারে আনতো আমার কাছে, তোমার বাপডারও এত ভোগান্তি হইতো নাহ! ষেহ! আমি জানতামই না তুমি এরম..ʼʼ

অন্তূ এতক্ষণ কথাগুলো শুনছিল আর একটু একটু করে যেন পাতালে গেড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু এবার কলিজার ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে। বাপের ভোগান্তি! থাবা দিয়ে পলাশের শার্ট খামছে ধরে, “এই জানোয়ারের বাচ্চা, কী বললি তুই? আব্বু কোথায়? আব্বু তোর কাছে? কী করেছিস তুই আব্বুর সাথে? জারজ তুই, হ্যাঁ? কী করেছিস আব্বুর সাথে? আব্বু কই, কোথায় আব্বু? শুয়োরের বাচ্চা, আব্বু কইইইই?ʼʼ

ঝরঝর কোরে কেঁদে উঠল মেয়েটা। হুংকারটা কান্নার সাথে মিশে নির্মম আর্তনাদের মতো শোনালো। পলাশকে দেখে মনে হলো তার প্রিয় খাবারটা খেয়ে তৃপ্তির হাসি হাসছে, এতটা পৈশাচিক তার মুখের ভঙ্গি। অন্তূ শুনেছিল, মহাজন আর সন্ত্রাসরা পিশাচদের আরেক বংশধর। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছিল মেয়েটা। বুকে কাঁপন ধরেছে। পলাশ অন্তূর হাতটা ছড়ানোর নাম কোরে বাজেভাবে জড়িয়ে ধরে ছুঁয়ে দিলো। অন্তূ ঝটকা মেরে হাত ছড়িয়ে পিছিয়ে যায়। ধাক্কা খায় পুরো দেহটা দুটো পুরুষের সাথে। ঘেন্না আসল নিজের শরীরের ওপর। কোথাও পুরুষের ছোঁয়া লাগা বাকি রইল না যেন গোটা দেহে। ছটফট করতে করতে দূরে সরে দাঁড়াল। ফুঁপানো কান্নায় নেকাব ভিজে উঠেছে অসহায় বাপ পাগল মেয়েটির। জয় সোফা ঘুরিয়ে নিয়ে বসেছে, যেন সে যাত্রাপালা দেখতে এসেছে। তার হাতে স্বল্প মাত্রার বিয়ারের ক্যান। অন্তূর দৃঢ় বিশ্বাস জাগল, জয় সব জানে, সব। তবুও কেন নাটক করল প্রথমদিকে?

অন্তূ চেঁচিয়ে উঠল, “আব্বু কই?ʼʼ চেঁচানোও নিদারুণ আহাজারির মতো ন্যায় শুনতে লাগল, “আমার আব্বু কই রে? ও আব্বু? আমার আব্বুকে কোথায় রেখেছিস তোরা? কোথায় আমার আব্বু? আব্বু..ʼʼ সবে কথা বলতে শেখা ছোট্ট শিশুটির মতো অবুঝ স্বরে ডেকে ওঠে অন্তূ আবার, “আব্বু? ও আব্বু? আব্বু?ʼʼ—পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজল আব্বুকে। অবুঝ শিশু যেমন অচেনা জায়গায় কাতর হয়ে ওঠে, অন্তূ তার চেয়েও সহায়হীন এতিমের মত কাতরাচ্ছে রুফটপের এক পাশে দাঁড়িয়ে।

পলাশ বারবার দেখছে অন্তূর চোখদুটো। পলাশের মনে হলো, ভিজে ওঠা পাপড়ির জন্য মেয়েটার চোখদুটো তাকে বেশি মাতাল করছে। নোংরা চাহিদায় উতলা হয়ে উঠছে তার পুরুষ দেহ। অন্তূর আর্তনাদ একেকবার কানে যাচ্ছে আর কামনা-তাড়নার আগুনে কেরোসিনের ছিটা পড়ছে। এগিয়ে গেল অন্তূর দিকে। ক্ষুধার্ত পিশাচ যেমন রক্ত পেলে জ্বলজ্বলে হেসে ওঠে, ওরকম হেসে বলল, “আব্বুকে দেখতে চাও, সুন্দরী? তার মানে তুমি আমার কাছে কিছু চাও? লেনদেন বোঝো? নেয়া-দেয়া। তুমি কিছু চাচ্ছ, এর বদলে আমারও তো কিছু চাওয়া থাকতে পারে, তাই না? নেকাবটা খোলো, দেখি মুখটা। আমি তোমার মুখ দেখবো, তুমি তোমার আব্বুর মুখ!ʼʼ

পাথরে পরিণত হলো অন্তূ। নির্বাক চোখে দেখল পলাশকে। পলাশ এগিয়ে যায় আরেকটু ওর দিকে। বে-খবর আক্রমণ করে বসে অন্তূর ওপর। খপ করে অন্তূর মেয়েলি হাতদুটো নিজের পশুর মতো থাবায় পুড়ে অন্তূর পেছনে আটকে ধরে। তার শরীরের সিংহভাগ ছুঁয়ে যায় অন্তূর নারীদেহ।অপর হাত দিয়ে অন্তূর বুকের ওপরে গলার নিচে লেহন করার মতো হাত বুলায়, যেমন কোরে কুকুর তার খাবার চাটে জিহ্বা দিয়ে, ঠিক সেইভাবে। অন্তূ চোখ বুজে ফেলে, টপ টপ করে কয়েক ফোটা তপ্ত জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। চেঁচিয়ে ডেকে ওঠে, “আল্লাহ!ʼʼ আর কথা বলতে পারল না মেয়েটা, নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল ঝরঝরিয়ে, “আমি খুলছি নেকাব। তার বদলে আব্বুকে দেখতে চাই। দয়া করে ছেড়ে দিন আমায়…ʼʼ অন্তূর কণ্ঠনালিতে আঁটকায় এই নারকীয় জানোয়ারের কাছে অনুরোধ করতে, অথচ একদিকে সম্ভ্রম রক্ষা, অপরদিকে আব্বু। মেয়েটা আল্লাহর কাছে গোপনে কীসব বিচার দিলো, আসমানের মালিক বিচার গ্রহন করলেন কিনা কে জানে!

পলাশের সরতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও নিজেকে টেনে নিয়ে অল্প সরে দাঁড়াল যেন। অন্তূ কাঁপছে, কান্নার সাথে তার হেঁচকি উঠছে। নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করল মেয়েটা, অথচ ভেতরে যে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে, নিজের ইজ্জতের ওপর যে অভিশপ্ত আশংকার ছাপ ঘনিয়ে রয়েছে, কিছুতেই শান্ত হতে চাইছিল না ভেতরটা। হাত নেকাব অবধি উঠছে না খুলে ফেলতে। এতগুলো বছরে কোনোদিন কেউ মুখ দেখেনি তার। কিন্তু শরীরের ওপর ঘেন্না লাগছে। এই শরীরের বিভিন্ন জায়গা আজ নষ্ট হাতের ছোঁয়া পেয়েছে। নিজেকে একপেশে নষ্টা বলেই মনে হচ্ছিল তার। তবুও কেন যে নেকাব খুলতে হাত উঠছিল না মুখের ওপর।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here