#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
২০.
বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এসে ওরা যখন মাটিতে পা রাখল, চারদিকে ইশা’র আজানের ধ্বনি কুয়াশাচ্ছন্ন গুমোট পরিবেশটাকে মুখরিত তুলেছিল। ঠান্ডায় অন্তূ থরথর কোরে কাঁপছিল, অথচ তাকে দেখতে জড় পদার্থের চেয়ে বেশিই উদ্দীপনাহীন লাগছিল। ক্ষত-বিক্ষত আমজাদ সাহেবের অচেতন বিশাল দেহটা বহন করা মানসিকভাবে ক্ষত-বিক্ষত অন্তূর পক্ষে অসম্ভব। আমজাদ সাহেব এখন পুরোপুরি অচেতন।
সিঁড়ি দিয়ে যখন উনাকে নামাচ্ছিল জয়, তখন বলেছিল, এখানে নিয়ে আসার অল্পক্ষণ আগেই ড্রাগ দেয়া হয়েছে হয়ত। জয় যখন আমজাদ সাহেবকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসছিল, পলাশ কিছু বলেনি। হয়ত পিস্তল অথবা জয়ের ক্ষেপা স্বভাবের জন্য বলেনি তৎক্ষণাৎ কিছু। জয়ের জানা নেই পলাশের শিকার ছিনিয়ে নেয়ার পেক্ষিতে পলাশ কী করতে পারে পরবর্তিতে। সিঁড়িটা ঘুটঘটে অন্ধকার ছিল। একবার পা ফসকালে তিনজনই ঘাঁড় শিরা ছিঁড়ে মরার চান্স ছিল। জয় আমজাদ সাহেবকে নিজের লম্বাটে শরীরের সাথে ঠেকনা দিয়ে দাঁড় করিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের কোরে ফ্লাশ অন কোরে অন্তূর হাতে দিয়ে বলেছিল, “ধরো এটা।ʼʼ
অন্তূর বুকের ধরফড়ানি তখনও থামেনি, আর না ঘেন্না আগুন নিভেছে। অথচ সে খুব স্বার্থপর এবং কূটিল হয়ে উঠেছিল। জয়কে তার সে সময়ে টিস্যু মনে হয়েছে। যাকে সে ওয়ান-টাইম ব্যবহার করবে আব্বু এবং নিজেকে এখান থেকে উদ্ধার করার এক সতন্ত্র-অস্ত্র হিসেবে।
অন্তূ আব্বুর একটা বাহু আগলে ধরে হাঁটছিল। আমজাদ সাহেব অচেতন, ব্যথা বোধহয় টের পাচ্ছেন না। কিন্তু অন্তূর বুকের ব্যথা উপশমের ওষুধ কোথায়? এই বিদারক ঘা কি জীবনে ভরাট হবে?
জয় আমজাদ সাহেবকে ধরে নিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। হুট কোরে তার মাথায় এলো, সে এসব করছে? কেন? ননসেন্স কাজকর্ম সব। সে যুব-সেবক হিসেবে এসব করতেই পারে! তবে আরমিণের বাপের সাহায্য? জিদটা চেপেছে ভেতরে এই বলে—এটা আরমিণের বাপ নয়, বরং এক ভিক্টিম পাবলিক। আরমিণকে সে চেনে না।
চারদিকে ঝি ঝি পোকা ডাকছে। তিমির আঁধার রাত। অন্তূ খেয়াল করল, আকাশে চাঁদ নেই আজ। অন্তূ আব্বুর বাহু ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ নির্জন এলাকা ছেড়ে লোকালয়ের দিকে। অথচ তার ভয় করছে। জয়কে ভয় পাচ্ছে সে। ওখানে পলাশ এবং ওই লোকগুলোর তুলনায় জয় নিরাপদ ছিল। কিন্তু এখন এই নির্জন রাতের অভিশাপের কাছেও বরং জয় বেশি নোংরা আর ভয়াবহ।
অন্তূ টের পেল ঠান্ডায় অথবা আতঙ্কে তার হাত এবং হাঁটু বিশেষত, খুব বাজেভাবে কাঁপছে। শরীরের চাদরটা ওখানেই ধস্তাধস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। এখন এক টুকরো ওড়না আছে বুকে। মাথায় কিছু নেই। সে অল্প একটু ওড়না তুলে মাথায় রাখল। অভ্যাসবশত, যেই মুখটা আবৃত করার জন্য আপনা-আপনিই হাতের ওড়না মুখে উঠে যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে হাও নামিয়ে ফিক কোরে হেসে ফেলল, ধিক্কার দিলো নিজেকে, “বোকা মেয়ে! তুই তো জবাই হয়েই গেছিস! তোর আর কিছু বাকি আছে? মুখ ঢেকে এখন আর নাটক না করলেই নয়? যা সংরক্ষিত রাখতে হয়, তা শতভাগ অক্ষত রাখতে হয়। সেখান থেকে এক রত্তি দানা খসলে পুরো সংরক্ষণের মান হারায়, সেটা অসংরক্ষিত হয়ে ওঠে। ভুল কোরে একবার খুলে যায়নি তোর আরবণ! বরং খোলার পর তা দর্শনে কতকগুলো পুরুষ মজা লুটেছে! নাটক না কোরে সামনে হাঁট। বাইশ বছরের এই সংরক্ষণের খোলশে আজ ইঁদুর ঢুকেছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, প্রায় খোলশটা কেটে অল্প একটু বাঁধিয়ে রেখেছে পুরোটা ক্ষয় করা থেকে। তাও সেই ইঁদুর তাড়িয়েছে কে জানিস? আরেকটা পশু। যে তোকে ধরলে হয়ত শুধু তোর সম্ভ্রমই নয়, বোধহয় গোটা তোকে খাবলে খেয়ে ফেলবে।ʼʼ
জঙলি এলাকা ছেড়ে আরেকটু বেরিয়ে এলো যখন, একাধিক লোকের পদচারণার আওয়াজ পাওয়া গেল। অন্তূর বুকটা ছ্যাঁত কোরে ওঠে। মস্তিষ্কে আতঙ্ক জড়িয়ে গেছে, যেকোনো কিছুতেই সে শঙ্কিত হয়ে উঠছে।
দূর থেকে মুস্তাকিনের কেন জানি মনে হলো, অন্তূ আসছে। হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলার জন্য হাত তুলে আবার শেষ টান দিয়ে তা ছুঁড়ল ঝোপের ভেতরে। কীসের করল ভয়ে জানে না সে। কয়েক মুহুর্তের মাঝে অন্তূর পাশে আরও দুটো পুরুষ অবয়ব স্পষ্ট হতেই স্বভাববশত তার হাত গেল আগে হোলস্টারে। পিস্তলটা বের কোরেই তাক করে ধরল। জয় হেসে উঠল, “আরে! মুস্তাকিন সাহেব যে!ʼʼ
হাসি থামিয়ে কপট গম্ভীর হলো, “ভেতরে যাননি কেন? আর একটু হলেই খানিক পর তিনটা লাশ উদ্ধার করতে হতো আপনার! আমাদের কথা না-ই বা ভাবলেন, অন্তত লেডিস..ʼʼ
এই পরিস্থিতিতেও এমন নোংরা মশকরা…অবশ্য জয়ের কাছে আশা করাই যায়। অন্তূর দিকে চোখ যেতেই মুস্তাকিন থমকে যায়। মুগ্ধতায় অথবা বিস্ময়ে বোঝা গেল না। পর মুহুর্তে দ্রুত আমজাদ সাহেবকে আগলে নিলো জয়ের কাজ থেকে। অন্তূর অনাবৃত মুখটা তার বুকে ব্যথার উদ্রেক করছিল কেন, বুঝতে পারল না। আমজাদ সাহেবের নড়বড়ে দেহটা দুজন কনস্টেবলের ভারে দিয়ে শরীরে থাকা চাদরটা খুলে অন্তূর দিকে এগিয়ে দিলো। মুখে কিছু বলল না। অন্তূ ধাতব মানবীর ন্যায় হাত বাড়িয়ে চাদরটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নেয়। মুস্তাকিন প্রায় রুষ্ট কণ্ঠে বলল, “মুখ ঢেকে নিন, অন্তূ! ওখানে কী হয়েছিল পরে শুনছি।ʼʼ অধিকারবোধ অথবা কর্তব্য! যাই হোক, ছিল মুস্তাকিনের স্বরে।
জয় দাঁড়িয়ে রইল। মুস্তাকিনকে বলল, “তোহ! যান তবে। আমার গাড়ি আসবে।ʼʼ
মুস্তাকিন হাসল, “খুব শীঘ্রই দেখা হবে।ʼʼ
জয় হাত নাড়ল, “বেঁচে থাকলে, ইনশা-আল্লাহ!ʼʼ
ওরা চলে যেতেই জয় পেছনে তাকায়। পুরোনো দুতলার রুফটপ থেকে পলাশের জ্বলজ্বলে চোখদুটো যেন জয়কেই দেখছিল। পুরো দলসহ দাঁড়িয়ে দেখছে এদিকের কাণ্ড।
—
রাত দশটার মতো বাজছিল। মুস্তাকিনের ইচ্ছায় আমজাদ সাহেবকে প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তখনও রাবেয়া এসে পৌঁছাননি। মুস্তাকিন লোক পাঠিয়েছে উনাকে আনতে। অন্তূ বসেছিল বেঞ্চের ওপর। তার চেহারায় শুকনো নোনাজলের ছাপ খুব বাজে দেখতে লাগছিল। বেশ কিছুক্ষণ নির্লজ্জের মতো দেখল মুস্তাকিন মেয়েটাকে। আসলেই যা সহজে পাওয়া যায় না, তা হুট কোরে পেলে মানুষের আগ্রহ পেয়ে বসে। মুস্তাকিনও রেহাই পেল না সেই আগ্রহ থেকে। অন্তূকে দেখা যায়না, আজ যাচ্ছে। অথচ বিষয়টা মুস্তাকিনের ভালো লাগছিল না। কেন মুখ খুলে আছে? এমন একটা একগুয়েমি চাপছিল ভেতরে। ধীরে হেঁটে এসে অন্তূর পাশে বসল। চাদরটা এখনও অন্তূর গায়ে জড়ানো। ভালো লাগছিল ব্যাপারটা মুস্তাকিনের। হাতের ঘড়িতে সময় দেখে অন্তূর দিকে নজর দিলো।
রক্ত শুষে বেরিয়ে গেলে মানুষের মুখের বর্ণ বোধহয় অন্তূর মতো হয়! প্রাণ নেই মুখে, উদ্দীপনার বড্ড অভাব। হাঁটুর ওপর দুহাত একত্র কোরে থুতনিতে ঠেকিয়ে আনমনে চেয়ে আছে। কোথাও নজর নেই, অন্তূর দেহ সেখানে বসা ছিল, তার নজর ছিলনা এই জগতের কোথাও! সে হারিয়েছে, অনির্দিষ্ট এক গন্তব্যে তার দৃষ্টি আঁটকে আছে।
-“স্যারকে ওরা কেন নিয়ে গিয়েছিল?ʼʼ কথাটা একদম বিজ্ঞ পর্যবেক্ষকের মতোই লাগল। যে এক নজরে পুরো কাহিনি আয়ত্ত করে ফেলেছে।
-“কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।ʼʼ
একরোখার মতো বলে উঠল মুস্তাকিন, “আপনার ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিতে ইচ্ছে করছে না আমার।ʼʼ
অন্তূ সেই নিস্তেজ স্বরেই কিছুক্ষণ পর বলল, ইচ্ছে দুজনের দুটো। কারটাকে..
-“আমারটাকে!ʼʼএ পর্যায়ে জেদি লাগল মুস্তাকিনকে।
-“জোর করছেন?ʼʼ
-“যা ভাববেন তাই। কী হয়েছিল ওখানে? সময় এক ঘন্টা কেন দিয়েছিলেন আমাকে? আপনার প্রতিশ্রুতির চক্করে মাটিতে পা গেঁড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে আমাকে।ʼʼ
-“গিয়ে কী করতেন?ʼʼ অন্তূ হাসল, নিষ্প্রাণ হাসি।
-“কিছুই করার ছিল না বলে মনে হয় আপনার? এইহাতে মার্ডারও করেছি, ম্যাডাম! যখন উপরমহল থেকে ঘুষ খেয়ে আমাকে অর্ডার করা হয়েছে প্রমাণ নষ্ট কোরে আসামী ছেড়ে দিতে, রাতের অন্ধকারে লাশ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছি আসামীদের। সিনিয়রদের কথা অমান্য করিনি।ʼʼ মুস্তাকিনের কথাবার্তা উগ্র লাগছিল শুনতে, সেই চেনা ভদ্রলোককে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে এক গোপন বিপ্লবী সত্ত্বা।
অন্তূ কথা বলল না। তার নিজের কথা ভাবার অবকাশই নেই মস্তিষ্কে। সবটুকু জায়গা ভিড়ে আছে আব্বুর কানের সেই সিগারেটে পোঁড়া ক্ষত। না চাইতেও চোখে দৃশ্য ভেসে আসছে, পলাশ ঠোঁটের সিগারেট আঙুলে চেপে তা আমজাদ সাহেবের কানে ঠেসে ধরছে। অন্তূর চোখ ঘোলা হয়ে মাথার ভেতরে শিরাগুলোতে যেন রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে এলো। মাথার পেছনে ঘাঁড়ের কাছে মুচড়ে এলো। ছটফটিয়ে উঠল মেয়েটা। মুস্তাকিনকে ঘেন্না করছে তার। সে দেখেছে, মুস্তাকিন তখন সিগারেট ফেলছিল। সিগারেটে এক প্রকার প্যানিক চড়ে তার বসল মাথায়।
ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছিল কোনোদিকে। এই নোংরা দেহ, কুলষিত জীবনকে ফেলে নির্জন জনমানবশূন্যের দিকটা তাকে ডাকছিল। চোখের সম্মুখটা অন্ধকার হয়ে এলো যখন, তখন ওপার থেকে আমজাদ সাহেব ডাকছেন। ওই তো আমজাদ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। আরে! পরনে সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী! এত্ত অভিজাত লাগছে আব্বুকে দেখতে। অন্তূ ছুটে যায় আব্বুর দিকে। ওই তো আব্বু হাত বাড়িয়ে আছে। অন্তূ দৌঁড়ে গিয়ে আব্বুর ডান হাতের তর্জনী আঙুলটা চেপে ধরল। তারা হেঁটে যাচ্ছে। যাচ্ছে, যাচ্ছে, তারা চলছে.. আর আসছে না দৃশ্যটা। সবটা অন্ধকার। রাত হয়ে গেছে। এই তো সবে বসন্তের বিকেল ছিল। এত্ত তাড়াতাড়ি রাত নামল? সব ফুরিয়ে গেল!
মুস্তাকিন চমকে উঠল। ধপ কোরে পড়ে গেছে অন্তূর শরীরটা বেঞ্চি থেকে উপুড় হয়ে। ওকে ধরে উল্টাতেই মুস্তাকিন থমকাল। অন্তূর নাক বেয়ে রক্তের প্রবাহ নেমেছে। ঠোঁটের কাছে দাঁত আঁটকে আছে! দাঁত ছাড়ালে নিশ্চিত ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে আসবে।
ডাক্তার পার্লস রেট চেইক করতে কব্জি ধরেই বললেন, “কীসের ট্রমায় আছে এইটুকু মেয়ে! পোশাকের এই হাল কেন? আপনার কে হয় মেয়েটা?ʼʼ
মুস্তাকিন জবাব দিলো না। কে হয় অন্তূ ওর? জানেনা ও।
অন্তূকে জানানো হলো না মুস্তাকিনের, আঁখির কেইসটা হাতে নেয়ার পর পলাশই তাকে হুমকি দেয়া চিরকুট পাঠিয়েছিল। ফোনকলে বাজে ভাষায় গালি দিয়েছিল, খুন করার ধমকি দিয়েছিল। আঁখির রেপ এবং মার্ডারের সাথে অতপ্রোভভাবে জড়িত পলাশ! তবে সে একা নয়। আরও কেউ বা কারা আছে।
মাঝরাতেও অন্তূর সেন্স এলো না। ডাক্তার খুব চিন্তিত মুখে বেরোলেন। রাবেয়াকে নিলেন না কেবিনে। মুস্তাকিনকে ডেকে নিলেন আস্তে কোরে। মুস্তাকিনের মেরুদণ্ডে খুব জোর পড়ছিল। কেমন একটা গুমটে ভাব তাকে জড়িয়ে ধরছে। নতুন অভিজ্ঞতা। সে এভাবে নার্ভাস হয়েছে, তার আগের এমন ঘটনা মনে নেই।
চলবে…
[আজ কেউ জয়কে ডিফেন্স কোরে কমেন্ট করলে 🔪
আমি বারবার বলেছি জয় ন্যাগেটিভ ক্যারেক্টার, ন্যা-গেএ-টি-ভভভ ক্যারেক্টারর। এত কিছুর পরেও আপনাদের ওর প্রতি মনোযোগ দেখে আমি সেন্টি ছাড়া আজ কয়দিন অন্যসব খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।🙂
রিচেইক করিনি। বহুত টাইপিং মিসটেক থাকতে পারে]
লিখেছি দুপুরে। কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে আপলোড দেরি হলো।]