অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ৪.

0
130

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৪.

ঢাকাতে আঁখির লাশ পাঠানো হয়েছে ফরেন্সিক টেস্টের জন্য। তা মুস্তাকিন চেয়েছিল না। সে দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেলে পাঠাতে চেয়েছিল, এবং ব্যবস্থাও করেছিল, সেখানকার মর্গ থেকে লোক এসেছিল। অথচ সিনিয়র ইনচার্জ তাতে রাজী হননি, বরং রাজধানীতে পাঠানো হয়েছে বডি। সে সময় মুস্তাকিন সেখানে উপস্থিত থাকলে হয়ত থামাতো ব্যাপারটা। আঁখির মা হাত ধরে কান্নাকাটি করেছিলেন, “আমার মেয়েটার শরীলটারে আর কোনো শুয়োরের হাতে দিসনা, বাপ! আমারে মা মনে কইরা, আমার কথা রাখ! আমার বিচার লাগবো নার আমার আঁখির দেহডারে দে, বাড়ি নিয়া যাই!ʼʼ

এ কথা ফেলার মতো নয়। মুস্তাকিন চেয়েছিল দিনাজপুরের হাসপাতাল মর্গেই তদন্তের কাজ চলুক। অথচ উপরমহল হুট করে সিদ্ধান্ত বদলেছে। এসব নতুন নয় এই লাইনে, তবে এর শেষ অবধি যেতে হলে তাকে সজাগ থাকতে হবে প্রতি পদে।

ডিআইজি স্যারের সাথে কথা বলে ব্রাঞ্চ থেকে বের হলো রাত আটটার দিকে। টিমের সকলেরই খুব খাটুনি হবে এই মামলায়, তা অনস্বীকার্য। এখানে কোথাও না কোথাও অতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক বিষয়াদী আর সমাজের উচু পর্যায়ের পদ্ধতিগত বলপ্রয়োগ! যার ঘাপলা খুলতে বেশ বেগ পেতে হবে তাদের। রাস্তা পার হবার জন্য দাঁড়াতেই ফোন বাজল তার। ফোন জিনিসটা নেহাত বিরক্তিকর, যখন সেটা বাজে। আম্মার কল! এখন পুরো দিনের ফিরিস্তি চাইবে। খাওয়া, গোসল, শরীরের যত্ন, বাড়ি ফেরার তারিখ! কল রিসিভ করল না। ক্লান্ত শরীর, ফ্লাটে ফিরে গোসল দিয়ে এরপর নিজেই একবার কল করে নেবে।

বিকেলে থানায় কাউন্সিলর সাহেব হুমায়ুন পাটোয়ারী এসেছিলেন। মুস্তাকিন গিয়েছিল সেখানে। সে প্রশ্ন করল হুমায়ুন সাহেবকে, “আপনি ভিক্টিমের পরিবারকে জায়গা থেকে উচ্ছেদ করতে চাইলেন, এরপর তারা গেল না, তার মেয়ের সঙ্গে এমন কিছু ঘটল। সন্দেহ যদি আপনার ওপর যায়, তা নিয়ে বক্তব্য কী আপনার?ʼʼ

হুমায়ুন পাটোয়ারী হাস্যজ্জল কণ্ঠে জবাব দিয়েছেন, “উচ্ছেদ করা কোনো কঠিন কাজ না, মুস্তাকিন। আর এমনও নয় তা আমি পারতাম না। তাই এরকম একটা সহজ ব্যাপারে তার সঙ্গে এমন খারাপ কিছু করার প্রশ্নও ওঠে না। তারা সময় চাইছে, আমি দিছি। না উঠলে উঠায়ে দিতাম, যেহেতু এইটা আমার কাজ। কিন্তু তাই বলে এমন কিছু..ʼʼ

মুস্তাকিন ঠোঁট উল্টে ধীরে ঘাঁড় ঝাঁকাল, “আপনার প্রতিপক্ষ দল কে?ʼʼ

হুমায়ুন পাটোয়ারী পান খাওয়া দাঁত বের করে চমৎকার হাসলেন, “সহজ হিসাব। আগের বার যে মেম্বার ছিল এই এলাকার সে, আর এইবার যেহেতু আমি বা হামজা মেয়র পদপ্রার্থী হয়ে নির্বাচনে দাঁড়াব, তাইলে বর্তমান মেয়র সাহেবও বলা চলে আমার বিরোধী। সে কিন্তু আবার আমার বেয়াইয়ের ভাই লাগে!ʼʼ

মুস্তাকিন আসলে বুঝতে পারছে না, এই কথার ওপর ভিত্তি করে তার এই দুটো লোককে সন্দেহের তালিকায় রাখা উচিত কি-না! হুমায়ুন পাটোয়ারী যা বোঝাতে চেয়েছে তা হলো, তারা হুমায়ুন পাটোয়ারীকে বদনাম করার জন্য আঁখির সাথে এই বিভৎস খেলায় মত্ত হতে পারে। আচ্ছা! আর কি কোনো সাসপেক্ট থাকতে পারেনা এই খু নের দায়ে! আঁখির পরিবারের সাথে একটা বিশদ আলোচনা দরকার। হতে পারে আরও কেউ কোনো সাহায্য করতে পারবে। কোমড় বেঁধে নামতে হবে, তবে তার আগে ল্যাবটেস্টের রিপোর্ট চাই। সেখান থেকে বহু তথ্য বেরিয়ে আসার রয়েছে, আশা করা যায়, যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে তো!

মুস্তাকিনের মাথা গরম হলো। এখন সে কাজ থেকে প্যাক-আপ করে বাড়ি যাচ্ছে, তবুও এই প্যাঁচ মাথায় ঘুরবে কেন? মাথা ব্যথা করছে সেই সন্ধ্যা থেকে। ফরেন্সিক বা মর্গের কোনো রিপোর্ট হাতে না আসলে তদন্তে নামার প্রশ্নই ওঠেনা। এখন জিজ্ঞেআসাবাদ করতে তথ্য প্রয়োজন, যেটা ফরেন্সিক টেস্টের পর আসবে। দুবার দুপাশে মাথাটা ঝাঁকি দিলো। গাড়ি চালাচ্ছে তার সহকারী, মাহমুদ। হোটেল দেখে তাকে বলল, “গাড়ি থামান।ʼʼ

মাহমুদ গাড়ি থামাল। মুস্তাকিন নেমে গিয়ে হালকা পাতলা কিছু খাবার কিনে নিলো। ফ্লাটে রান্না করার চাচিটা দু’দিন হলো আসে না। এখন গিয়ে রান্না করার এনার্জি তার নেই, না খেয়ে ঘুমাতে হবে কিছু নিয়ে না গেলে।

এপার্টমেন্টের গেইট দিয়ে ঢোকার সময় দারোয়ান এগিয়ে এলো, “স্যার, তোমার চিঠি আইছে।ʼʼ

মুস্তাকিন ভ্রু কুঁচকাল। দারোয়ান দেলোয়ারের মুখে দুষ্টু হাসি। মুস্তাকিন হেসে ফেলল, “চিঠি শুধু প্রেমিকার কাছ থেকে আসে, এই ধারণা কে ঢুকিয়েছে তোর মাথায়? আজকাল আর প্রেম চিঠিতে হয় না, উন্নত দুনিয়ার প্রেম হয় উন্নত উপায়ে, উন্নত ডিভাইসের মাধ্যমে হয়। হতে পারে দেখ, এটা আমার মৃত্যুর পরওয়ানা পাঠিয়েছে কোনো এক শুভাকাঙ্ক্ষী ভালোবেসে!ʼʼ

দেলোয়ার দাঁত বের করে হাসল, “তোমারে আর কেডা মারার সাহস করবো? যত বড়ো একখান পিস্তল প্যান্টের ভিত্রে নিয়া ঘোরো!ʼʼ

নাকে আঙুল ঘষে অপ্রস্তুত হাসল মুস্তাকিন, “প্যান্টের ভেতরে পিস্তল? তাও আবার ওত বড়ো? তুই রাইফেল আর পিস্তলকে গুলিয়ে ফেলছিস মনে হচ্ছে! আর প্যান্টের ভেতরে পিস্তল রাখে কেমনে? কোথায় রাখে?ʼʼ

মুস্তাকিনের বলার ভঙ্গি আর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল এবার দেলোয়ার। মুস্তাকিন ঢুকে গেল ফ্লাটে। দরজা লাগিয়ে খাবার টেবিলের ওপর রেখে, চিঠি নিয়ে বসল। চিঠিটা রেখে দিলো পরিত্যক্ত হালে। বিশেষ আগ্রহ আসছে না তা নিয়ে। এ ব্যাপারে মাঝেমধ্যে নিজের কাছেই অদ্ভুত লাগে অবশ্য তার। কিছু বিষয়ে, যেখানে সাধারণভাবে খুব বেশি উত্তেজনা এবং কৌতূহল কাজ করার কথা, সেখানে সে উল্লেখযোগ্য কৌতূহল পায়না নিজের মাঝে। এখন যেমনটা হচ্ছে। একবার ভাবল, গোসল, খাওয়া সেরে এসে চিঠিটা পড়তে পড়তে শুয়ে পড়বে। শরীরের ক্লান্তি বেশ গায়ে লাগছে। আবার কী মনে করে দায়সারা হাতে চিঠিটা তুলে নিলো হাতে। যা ভেবেছিল তা-ই! বেনামী চিঠি এসেছে—

‘কী জানি পরিচয় দাও তুমি নিজের? ও হ্যাঁ!

সৈয়দ মুস্তাকিন মহান, ইনভেস্টিগেটর অব পিবিআই ডিপার্টমেন্ট,
কেইস থেকে সরে যাও, অফিসার! তুমিও ভালো থাকো, আর আমরাও! নয়ত তোমার এক পিস্তল কতক্ষণ কতভাবে রক্ষা করতে পারবে তোমার জান? চাকরি করতেছ, জানের সওদা না। আর যদি সেরকম ইচ্ছা থাকে, তাইলে তোমার রুহুর জন্য মঙ্গল আর মরার পরে বেহশত কামনা করি।ʼ

মুস্তাকিন চিরকুটটা হাতে মুড়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলল। শার্ট খুলে সোফাতে ছুঁড়ল। আরও মাথায় চেপে বসাচ্ছে এরা কেইসটা। এতক্ষণ তাও ঘুম ঘুম পাচ্ছিল একটু ক্লান্তিতে। এখন আচমকা উত্তেজনা বাড়ল কেইস নিয়ে, আরও সিরিয়াস হয়ে উঠল মনটা কেইসের শেষ দেখার জন্য। এতো মজার চ্যালেঞ্জ পেলে মনটা যে কতটা মনোবল পায় যেকোনো জটিল কেইস সভল করে সেই অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝোলাতে! এই মনোবল প্রদানকারী চিরকুটটাকে তুলে ডায়েরীতে তুলে রাখতে ইচ্ছে করল মুস্তাকিনের। তোয়ালে ঘাঁড়ে করে বাথরুমে ঢুকল। গোসল সেরে দ্রুত বসতে হবে তদন্তের কাজে। মস্তিষ্কে আন্দোলন শুরু করেছে পুরো ব্যাপারটা।


রিক্সা এসে পাড়ার রাস্তার সামনে নামিয়ে দিলো অন্তূকে। আর ভেতরে যাবেনা রিক্সাওয়ালা, রাস্তা খারাপ। জায়গাটা অন্তূ চিনতো, বাড়িটা চিনলো এক চাচাকে জিজ্ঞেস করে। রাস্তাটা ভেঙে গেছে, ক’দিন আগের বৃষ্টিতে পিচ ক্ষয়ে নিচু হয়ে যাওয়া স্থানগুলোতে পানি জমেছে। সামনেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ক্লাব ঘর। যার বাইরের দেয়ালে সেঁটে রাখা বিভিন্ন রাজনৈতিক পোস্টার, রঙ-বেরঙের কালিতে রাজনৈতিক সংগঠনের নাম-ধাম লেখা সব। ক্লাবের সামনে রাস্তার ওপারে চায়ের দোকান। ক্লাব ঘরের সামনে লাল চেয়ার পাতা কয়েকটা। বাঁশের স্ট্যান্ডের ওপর ক্যারাম বোর্ড রাখা। চেয়ারে দুয়েকজন বসে পা দোলাচ্ছে, সিগারেট টানছে, কেউ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।

রাস্তার এই করুণ দশা দেখে অন্তূর প্রথমে যা মাথায় এলো, কাউন্সিলরের ক্লাবঘরের সামনের রাস্তার যদি এই হাল হয়! অথচ সেই কাউন্সিলর আগামীতে মেয়র পদের প্রার্থী হয়ে বিভিন্ন সম্মেলনে কত কী করে দেবার অঙ্গীকার দিচ্ছেন জনতাদের! আজকালের মাঝে একটা বিশাল সম্মেলন অবশ্য আছে প্রাইমারী স্কুলের মাঠে। সেখানে নিশ্চয়ই হামজা, জয় জম্পেশ একটা করে বক্তব্য রাখবে! এদের জিহ্বা কয়টা? আর বিবেক এবং লজ্জাই বা কোন ফেরিওয়ালার কাছে বিক্রি করে বাদাম কিনে খেয়েছে!

ক্লাবঘর পার হবার সময় ভুলেও সেদিকে তাকাল না। থুতনি বুকে ঠেকিয়ে হেঁটে পার হলো ক্লাবঘরের সামনের রাস্তাটুকু। ক্লাবের ছেলেরা নিশ্চয়ই একবার দু’বার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কালো বোরকা ও কালো ওড়নার নেকাবে মুখ ঢাকা অন্তূর। ক্লাবঘরের একদম পাশেই সালমা খালার ছোটো বাড়িটা। মাঝে অল্প একটু জায়গা জুড়ে ঝোপঝাড় গজিয়েছে।

টিনের গেইট। তাতে আঙুলের টোকায় দু-তিনবার শব্দ করল। নিঃশব্দে গেইটটা খুলে দিলো কেউ। অন্তূ তাকাল, চাঁদনী গেইট খুলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অন্তূ নিজেই পরিচয় দিলো, “ভয় পাবেন না, ভাবী। আমি খালার ভার্সিটির এক ছাত্রী।ʼʼ

চাঁদনী একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ভেতরে আসার ইশারা করল। ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকল অন্তূ। টিনের চাল, টিনের বেড়া। তার সামনে একটা ইটের গাথুনিতে তোলা ঘর। যেটার মেঝে হয়নি, উপরে শুধু টিনের ছাঁদ লাগানো হয়েছে, নিচের মেঝে কাঁচা, জানালা-দরজাও লাগানো হয়নি। চাঁদনী অন্তূকে নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে বসাল। যাবার সময় গেইটের সাথে লাগোয়া যে ঘর পার করল অন্তূ, সেখানে এই অসময়ে নামাজে বসেছেন সালমা খালা। অঝোরে কাঁদছেন জায়নামাজে বসে। করুণ সেই স্বর তার কান্নার। অন্তূর বুক ভার হয়ে এলো সেই কান্নার গুনগুন আওয়াজে, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চাঁদনীর পেছনে হাঁটল। চাঁদনী ওকে বিছানায় বসিয়ে উঠে যেতে অগ্রসর হয়। অন্তূ চাঁদনীর হাতটা চেপে ধরে অনুরোধ করল, “ভাবী প্লিজ! কোনো আনুষ্ঠানিকতা দেখিয়ে আমায় ছোটো করবেন না। আপনি বসুন, দু মিনিটি কথা বলি! সব মিটলে একদিন এসে নাস্তা করে যাব।ʼʼ

চাঁদনী মানতে চায়না, অন্তূ জোর করে বসাল। জীর্ণ একটা সেলোয়ার-কামিজ পরনে চাঁদনীর। চুলের বেণী উলকো-খুশকো। মুখে মলিনতার ছাপ! দেখতে ভালো চাঁদনী, চোখ দুটো ডাগর ডাগর, তাতেও কালি পড়েছে, বসে গেছে চোখের কোটরে। বসতে বসতে অন্তূকে জিজ্ঞেস করে, “নাম কী তোমার?ʼʼ

-“অন্তূ বলে ডাকে সকলে।ʼʼ বলেই অন্তূ নিজে থেকে বলল আবার, “যদি আগেই চলে যেতেন এখান থেকে, তাহলে হয়ত আঁখির এই হাল হতো না..ʼʼ কথাটাতে বেশ জড়তা ছিল অন্তূ, নিজেই অবাক হলো, সে কথা বলে অতি-স্পষ্ট শোনায় তার অথচ আজ কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। দিনশেষে অন্তূ সাধারণ মেয়ে, মানুষের রক্তে গড়া মানুষ—এটাই প্রমাণ করে বিষয়টা।

মলিন হাসল চাঁদনী প্রত্যুত্তরে, “বহুতদিন থেকেই ক্লাবের ছেলেদের নজরে পড়ছিল আঁখি, আঁখিরে খুব জ্বালাতো ওরা। যাওয়া, আসার সময় আজেবাজে কথা বলতো। একবার ক্লাবের একজন বাড়িতে আসছিল তার কোনো বড়ো ভাইয়ের সাথে আঁখির কুপ্রস্তাব নিয়ে। আম্মা তারে একটা খাপ্পড়ও দিছিল।ʼʼ

চাঁদনী থামল। অন্তূর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল, সেই বড়ো ভাইটা কি জয়? আপনার কি সন্দেহ হয়না জয়ের ওপর?

করল না প্রশ্নটা। সে নিজেও শুধুই শুনেছে জয়ের ব্যাপারে। একবার একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটেছিল তার সঙ্গের তার জের ধরে তিলকে তাল বানানো মূর্খতা নয় তো কী! জয়কে কালপ্রিট ভেবে বসে থাকা তো যায়, তবে তাতে এমন কি হতে পারেনা! যে আসল অপরাধী সামনেই এলো না জীবনে! আচ্ছা, আসল অপরাধী সামনে এলেই বা কী করা যাবে? কী করতে পারবে প্রসাশনের ফোর্স, আর অন্তূরই বা করার কী আছে! সে এতো ভাবছেই বা কেন? সে শুধু এসেছে সমবেদনা জানাতে, ব্যাস!

মাথা নত করে হতাশ শ্বাস ফেলল অন্তূ। এরপর বলল, “আপনি যে টাকা ফেরত দিতে গেছিলেন মেম্বার সাহেবকে, তা দিয়ে অন্য কোথাও তো জায়গা কিনে চলে যেতে পারতেন!ʼʼ

চাঁদনী হাসল আবার, “তুমি ঘটনা লোকমুখে শুনছো তাই না?ʼʼ অন্তূ জবাব দিলো না। চাঁদনী নিজেই বলল, “পুরাটা আর আসলটা শোনো নাই।ʼʼ

-“এখন শুনি, আপনি বলুন।ʼʼ

চাদনী বিছানার ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড়গুলো ভাজ করতে করতে বলল, “আমি বাপের বাড়ির পাওনা জায়গা আর বিয়ের গয়না বেঁচে আমার ভাইরে সাথে নিয়ে মেম্বারের কাছে গেছিলাম টাকা ফেরত দিতে। টাকাগুলা দেখল আর মেম্বার সাহেব বলল, ‘আচ্ছা! টাকা যখন যোগাড় করছো, নেয়া যাবে। আমি ওই লোকের সাথে কথা বলে দেখি।ʼ যেভাবে বলছিল, আমরা নিশ্চিত ছিলাম, টাকা নিবে, জায়গা ফেরত পাব।ʼʼ

থামল চাদনী। অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “নিলো না টাকা?ʼʼ

চাঁদনী খুব মনোযোগ দিয়ে কাপড় ভাজ করতে করতে বলল, “সেই রাতে বাড়িতে লুট হলো।ʼʼ কী যে অদ্ভুত নির্লিপ্ত শুনতে লাগল চাঁদনীর কথাটা!

কপাল জড়িয়ে ফেলল অন্তূ, “চেনেননি তাদের?ʼʼ

চাঁদনী আলতো হাসল, কাপড়গুলো একপাশে রেখে বলল, “তুমি কখনও ডাকাতি দেখোনি, না?ʼʼ

-“না দেখিনি।ʼʼ

-“ওরা মুখোশ পরে ছিল। আর চিনলেই বা কী? যাবার সময় অস্ত্র দেখায়ে খুব ভালো করে সাবধান করে গেল। আর আমরা সাবধান হয়ে গেলাম। একবার সাবধান না হয়ে হারাই গেছে একটা।ʼʼ

অন্তূর বুঝে এলো না শেষের কথাটা। এবারেও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল, আপনি কি আঁখির মেজো ভাইয়ের কথা বলছেন? যে ক্যান্সারে মারা গেছে? এখানেও কি রহস্য আছে। বলল না কিছু। চেয়ে রইল ক্ষণকাল চাঁদনীর নির্বিকার মুখটার দিকে। অসীম ধৈর্য্য আর বুঝ মেয়েটির। এমন নিম্নবিত্ত পরিবারে এতো শীতল মস্তিষ্কের একটা বউ! তার চোখের চাহনি, কথা বলার ধরণ, মুখের ভঙ্গিমা –সবই যেন অ-সাধারণ, একটুও সাধারণ নয়! সেদিন শাশুরিকে যেভাবে বুকে জড়িয়ে থামাচ্ছিল, সে এক বিরল দৃশ্য! আজও কেমন অনড় শক্তিময়ী লাগছে এই মেয়েটাকে! প্রথম সাক্ষাতে কেমন নির্দিধায় কথা বলছে ওর সঙ্গে! একটুও ইতস্তত বা অপ্রস্তুত নয় যেন! মার্জিয়া কি এমন হতে পারতো না? অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “পড়ালেখা জানেন?ʼʼ

-“এসএসসি পাশ করছিলাম। মুখ খুললে না তুমি? দেখলাম না তো তোমায়!ʼʼ

অন্তূ নেকাবটা খুলল অল্প একটু। চাঁদনী চেয়ে দেখল, বেজায় মায়াবতী দেখতে অন্তূ! সবচেয়ে বেশি মায়া লেপ্টে আছে ওই ঘন পাপড়িওয়ালা চোখে, চোখের মণি কুচকুচে কালো, তাতে মুক্ত দানার ন্যায় ভাসছে আলোর প্রতিসরিত বিন্দুরেখা। এক দেখায় আটকে যাবার মতো, অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটা। কালো নেকাবের প্রান্ত এসে ঠেকেছে ফর্সা কপালটার ওপর, থুতনিটুকুও বের হয়নি। কালো পর্দার আবরণের ভেদে ঝিরঝিরে মোহময়ী চেহারা! চাঁদনী কিছুক্ষণ অন্তূর নত মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “খুব সুন্দর তুমি।ʼʼ

অন্তূ তাকাল চোখ তুলে, মুচকি হাসল, “অথচ আপানাকে দেখে ঘোর লেগে যাচ্ছে আমার।ʼʼ

গেইটে শব্দ হলো, কেউ ভেতরে প্রবেশ করল। অন্তূ দ্রুত মুখে নেকাব পরে নিলো। সোহেল ঘরের দরজায় এসে থেমে গেল, তার চোখে-মুখে কৌতূহল। অন্তূ সোহেলের অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে নিজেই বলল, “ভাই, আমি অন্তূ! ভার্সিটিতে পড়ি। ভাবীর সঙ্গে এমনিই দেখা করতে এসেছিলাম। আপনি ভেতরে আসুন।ʼʼ

সোহেল ঢুকল না, দু কদম পিছিয়ে হাত দিয়ে বাঁধা দেবার মতো করে বলল, “বসো তুমি। কথা কও, আমি পরে আসব। বসো, বসো!ʼʼ

অন্তূর কেন জানি খুব ভালো লাগছে এই বাড়িতে! এটা বাড়ির বিশেষত্ব নাকি বাড়ির মানুষগুলোর শুদ্ধতা! দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় অন্তূ দরজার দিকে, “না, ভাই। আপনি আসুন, আমি বেরিয়েই যাচ্ছিলাম।ʼʼ

সোহেল দূরে পিছিয়ে দাঁড়িয়ে অন্তূকে বের হবার জায়গা করে দিলো। বাড়িটা গুমোট হয়ে আছে, শোকের ঘন ছায়া কালবৈশাখীর মেঘের মতো ছেয়ে আছে পুরো বাড়িটা জুড়ে। অন্তূ গিয়ে কান্নারত অভাগী মায়ের পাশে মেঝেতে বসে পড়ল। হাতটা চেপে ধরে বলল, “চেনেন আমায়?ʼʼ

চিনল সালমা অন্তূকে। ভার্সিটিতে কমনরুমে দেখেছে বহুবার। অন্তূ উনার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, “আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন? ক্লাবঘরেও পৌঁছাচ্ছে নিশ্চয়ই আপনার কান্নার স্বর! পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছে ওদের আপনার এই আর্তনাদ!ʼʼ মাথাটা নিচু করে বলল আবার, “যখন কেউ কষ্ট দেবার লক্ষ্যে কষ্ট দেয়, তখন একদম উচিত নয়, কষ্ট পাওয়াটা তাদের দেখানো। হয় সেই পরিমাণ সেইভাবে ফিরিয়ে দিতে হয়, অথবা চুপ থাকতে হয়র অন্তত তাদের সামনে।ʼʼ

সালমা খালা অন্তূর এই ভারী কথা বুঝলেন কিনা কে জানে! কেঁদে ফেললেন, “কিন্তু ওরা তো করে নাই কিছু!ʼʼ

অন্তূ জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, “নিজেকে সান্ত্বণা দিচ্ছেন?ʼʼ

কান্নায় ভেঙে পড়লেন সালমা বেগম অন্তূর হাতে ওপর। অন্তূর গলা ভেঙে আসে এক অসহায় সম্ভ্রম ও প্রাণহারা মেয়ের নিঃস্ব মায়ের কান্নার ধ্বনিতে। সালমা বেগম কান্না সামলালেন কিছুক্ষণ পর, এরপর বললেন, “ওরা কিচ্ছু করেনি, অন্তূ! কেডা করছে, আল্লাহ মাবুদ জানে! ওই পুলিশরা আমার বেটির লাশ দিতেছে না ক্যান! আবার কই নিয়া গেছে আমার বেটিরে! আমার বিচার লাগবো না। ওরা রাজনীতি করে, শক্তিশালী সব। আমার বিচার লাগবো না, কিচ্ছু লাগব না আমার। আমি চলে যাব এইখান থেইকা, বহুত দূরে যাব। আমার মেয়েটারে ওই পুলিশ আবার জানি কই নিয়া গেছে!ʼʼ

খপ করে কথা ধরে ফেলল অন্তূ, “কারা রাজনীতি করে? এই তো বললেন, ওরা কিছু করেনি!ʼʼ কথাটা শেষ করার কেন যেন মনে হলো, সে বোধহয় টেনে হিচড়েই জয়কে এসবের পেছনে দাড় করাতে চাইছে! কেন? তার সঙ্গে সেদিন খারাপ আচরণ করেছিল বলে? সেটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, আর বারবার জয়কে অপরাধীর জায়গায় নজর আসছে। কিন্তু এটা ঠিক না। এরপর তো আর কিছু করেনি জয়, শুধু শুধু সব কিছুতে ওকে টানাটা কতটা যুক্তিযুক্ত? বেশি ভাবছে সে জয়কে নিয়ে। কথাগুলো ভেবে রাগ হলো অন্তূর।

সালমা খালা বললেন, “হ! কিচ্ছু করে নাই ওরা।ʼʼ অনবরত মাথা নাড়তে থাকলেন তিনি। পাগলের মতো প্রলাপ করতে করতে বুক চাপড়াতে শুরু করলেন আবার। চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন সিজদায় পড়ে। অন্তূর বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।

ক্লাবঘর পার হওয়ার সময় আড়চোখে তাকাল সেদিকে। বুকে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। তাকে চিনে ফেলার মতো কেউ যদি এখন ক্লাবে থাকে, কোনো তামাশা না হয়ে যায় এখন। যদি জয়ই দেখে ফেলে! ক্লাবঘরের সামনে বড়ো পোস্টারে কাউন্সিলর হুমায়ুন পাটোয়ারীর ছবি টাঙানো। পাশেই আরেক পোস্টারে তার ছেলে হামজার ছবি। এবার ক্যারাম বোর্ডের সামনে ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে, এটা আড়চোখে নজরে এলো। আর ভুলেও তাকালো না সেদিকে।

চোখ নামিয়ে নিলো। মাথা নিচু করে দ্রুত হেঁটে পার করল জায়গাটা। বহুত ঘাপলা খেলে যাচ্ছে মাথায়। চাঁদনীর কিছু কথার মানে স্পষ্ট নয়। ওরা বিচার চায় না আবার কিছু হবার ভয়ে। আসলেই যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে তারা কালপ্রিট তো! কাদের সন্দেহ করা হচ্ছে? অন্তূ ঠোঁট কামড়াল। হামজা অথবা জয়ের মুখটা সামনে চলে আসছে কেন? শুধু শোনা ঘটনার ওপর ভিত্তি করে এমন পোক্ত ধারণা পোষণ কতটা যুক্তিযুক্ত!


সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভাঙল জয়ের। ফোনের এলার্ম এখনও বাজছে। উঠে বসে নোংরা ভাষায় দুটো গালি দিলো এলার্মকে। মুখে-চোখে পানি দিয়ে আসার পরেও ঝিমুনিটা ছাড়ছে না। প্রথমে ঝুড়িতে, পরে একে একে সম্ভাব্য সকল আসবাবে কাঙ্ক্ষিত শার্টটা খুঁজল, পেল ন্। চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, “মামণি! মামণি?ʼʼ

ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠছে তার কণ্ঠস্বর। বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন শাহানা, “কী সমস্যা? ষাঁড়ের মতো গলা ফাঁড়তেছিস ক্যান? এই বাড়ির ব্যাটাছেলেদের জন্মগত বদরোগ এই!ʼʼ

জয় দাঁত খিঁচে উঠল, “আমার শার্ট ধোয়া হয়নি কোন দুঃখে? কী পরব আমি এখন?ʼʼ তার হাতে ডেনিম শার্ট। সেটা দেখিয়ে বলল।

শাহানা কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালেন, “তোর শার্টের খুব আকাল হয়েছে? আলমারী খুললে ছোটোখাটো একটা শার্টের গোডাউনের খোঁজ পাওয়া যাবে, বাদর! সবসময় তোমার শার্টের পেছনেই তো দৌড়াই আমি, আর কোনো কাজ নেই বাড়িতে। অন্যটা পরে বের হওয়া যেত না?ʼʼ

জয় মুখ খুলতে গিয়েও নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে। এখন মুখ খুললে বকা ছাড়া কিছু আসার সম্ভাবনা নেই, মামিকে বকা যাবে না। দাঁতে দাঁত ঘষে চোখ বুজে গিলল বাজে ভাষাগুলো। এরপর কথা বলতে গিয়ে ওই ক্ষ্যাপা স্বরই এলো ওর, “তো একটা বের করে দাও সেই গোডাউন থেকে, পরে বের হই। তোমাদের মতো তো হুদাই ঘরে বসে থাকি না আমি। কাজ আছে, উঠতেই দেরি হয়ে গেছে, আবার শার্টের বালডা নিয়ে রঙ্গ করতেছি আর আধঘন্টা!ʼʼ

তরু বেরিয়ে এসে দাঁড়াল সেন্টার রুমের একপাশে। জয় ওর দিকে ফিরল, কঠিন স্বরে আদেশ করল, “তরু, আমার একটা শার্ট বের কর, যা! কুইক!ʼʼ

তরু আস্তে করে হেঁটে পাশ কাটিয়ে জয়ের রুমে ঢুকল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল। এই ঘরে ঢুকলেই পুরুষালি একটা গন্ধ পাওয়া যায়, যাতে মাতাল মাতাল লাগে ওর! ঘরে বাস করা পুরুষটাই যখন সর্বক্ষণ ওর মাতাল হয়ে থাকার কারণ, এই ঘরটাও ওর কাছে বড়ো কাঙ্ক্ষিত। প্রতিদিন জয় উঠে বেরিয়ে যাবার পর সে পুরো ঘরটাকে পারলে নতুন করে উলোট-পালোট করে, আবার শুরু থেকে গোছায়, বেশিক্ষণ এই ঘরে অবস্থান করার লোভে। যতক্ষণ এখানে থাকবে, বুকের ভেতর কী যে এক শিরশিরানি নেচে বেড়ায়।

আলমারিটা খুলে খুঁজে খুঁজে একটা কালো-লালচে রঙা শার্ট বের করল। পরক্ষণেই আবার দ্রুত ঢুকিয়ে হ্যাঙ্গারে বাঁধিয়ে ঝুলিয়ে রাখল। এসব অবশ্য তারই গোছানো। এই ঘরের প্রতিটা বিন্দুকণা যেন তার হাতে সাজে প্রতিদিন। চেক শার্ট বের করল একটা। সেটাতেও মন লাগল না। ভুলভাল শার্ট নিয়ে গেলে, পছন্দ না হলে নিশ্চিত একটা জঘন্য ভাষায় গালি দিয়ে ছুঁড়ে ফেলবে শার্টটা জানালা দিয়ে। তা আর পরবর্তীতে তুলে এনে জয়ের সামনে ধরার সাহস নেই কারও। শেষমেষ একটা ছাই রঙা, বলা চলে সাদা আর ছাই রঙের মিশ্রণে অদ্ভুত এক রঙা শার্ট নিয়ে বের হয়ে এলো রুম থেকে। জয়ের সবকিছু যেখানে অদ্ভুত, শার্টের কালেকশনও। জয়ের কেনা শার্টের প্রতিটা কালার দেখে তরুর ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলতে। নাম না জানা সব কালারের শার্ট বেছে বেছে কিনে আনে। এমনকি শার্ট যেটা কেনে সেটা দোকানে দাঁড়িয়েই গায়ে চড়িয়ে পরনেরটা ব্যাগে করে আনে। পরেরদিন নতুন সেই শার্ট ধুয়ে, আয়রন করে আলমারিতে তোলা হয়। এরকম হাজারো পাগলাটে স্বভাবসমপন্ন, বদরাগী পুরুষটিকে কেন এতো ভালো লাগে মনে মনে তরুর? লোকে শুনলে নিশ্চয়ই বলবের রুচির দোষ আছে তরুর, নয়ত জয়ের মতো নোংরা স্বভাবের ছেলের প্রমে পড়া যায়না। সব মঞ্জুর, তবুও ভালো লাগে ওই ছেলেটাকে।

জয় কিছু বলল না, চুপচাপ শার্টটা পরল গায়ে। নিজে আর রুমে ফিরল না। তরুকে দিয়েই পারফিউম আনিয়ে নিলো। এই যে এই ব্যাপারটা তরু কতটা উপভোগ করে, তা নিশ্চয়ই জানে না জয়! তার মন নেচে ওঠে যখন জয় ধমক দিয়ে এটা ওটা ঘর থেকে আনতে বলে তাকে। মনে হয় যেন এই তো তরু ঘরনী জয়ের! তাকে গুছিয়ে, সাজিয়ে, আগলে রাখার দায়টুকু তরুর!

আজ পৌরসভা অফিসে বৈঠক ছিল। নির্বাচন বেশি দূরে নয়। হামজা বলেছিল, ঠিক দুপুরের পর পৌরসভায় পৌঁছে যেতে। আগামী সপ্তাহের শুরুতেই বিশাল এক সম্মেলন নির্বাচন নিয়ে। সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা চলবে। জয় পৌরসভায় না গিয়েগিয়েছিল ভাঙা বাড়িতে। সেখানে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে, ক্লাবে গিয়ে ক্যারাম খেলেছে আধঘন্টার মতো, এরপর বাড়ি ফিরে ঘুম দিয়েছে সন্ধ্যা অবধি।

কবীর ড্রাইভিং করতে করতে জিজ্ঞেস করল, “ভাই, আমরা যাচ্ছি কই এখন?ʼʼ

-“চেয়ারম্যান কাকা ডেকেছে।ʼʼ

কবীর দ্রুত ঘাঁড় ঘুরাল, “চেয়ারম্যান কাকা, আপনাকে ডাকছে? ক্যান?ʼʼ

-“সম্পত্তির ভাগ লিখে দেবে। তোর কিছু চাই সেখান থেকে?ʼʼ

বোকা হাসল কবীর, “না মানে! আপনারে ক্যান ডাকছে? উল্টাপাল্টা কিছু করবে না তো?ʼʼ

চুলে হাত দিলো জয়, মুখে বদমায়েশী হাসি ফুটল, “উল্টাপাল্টা কিছু? বউ নাই নাকি চেয়ারম্যানের? আমায় কেন টার্গেট করবে?ʼʼ

হাসল কবীর। জয় বলল, “আয় তোর এই গেছো বাদরের মতো হাসির একটা ছবি তুলি। বাই এনি চান্স অকালে টপকে গেলে ছবিতে মালা চড়াবো।ʼʼ

ব্যাক ক্যামেরা অন করে কবীরের দিকে ধরল। সেই মুহুর্তে হঠাৎ-ই একটা বোঝাই ট্রাক সামনে এসে পড়ল ওদের গাড়ির! গাড়ি চালানোর সময় এই মজা বোধহয় কাল হয়ে উঠল ওদের। কবীর প্রথমত নিয়ন্ত্রণ হারাল, দ্রুত স্টিটিয়ারিং ঘুরাল গাড়ি এক সাইডে নেবার জন্য। অথচ ততক্ষণে ডান পাশে আরেকটা গাড়ি এসে পড়েছে। ওদিকে সরার জায়গা নেই। ওদের গাড়ি যে পজিশনে রয়েছে তাতে ট্রাক ওদের গাড়িকে পিষে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ওপাশে চাপার জায়গা নেই। কয়েক সেকেণ্ড পাশের গাড়িটা আরও স্লো হয়ে ওদের পাশ আটকে চলল মনে হলো। দুজনে প্রস্তুত হলো খারাপ কিছুর সম্মুখীন হবার জন্য। কিচ্ছু করার নেই আর, ট্রাক ওদের সামনে খুব কাছে প্রায়। আচমকা পাশের গাড়িটা পাশ থেকে দ্রুত এগিয়ে গেল ওদের গাড়ি পার করে। সেদিক দিয়ে ট্রাকটা চলে গেল ওদের বাঁচিয়ে। ট্রাক চলে গেল নাকি কবীর নিপুন হাতে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো, বলা যায়না! সেকেণ্ড বিশেকের মধ্যে ঘটে গেছে পুরো ঘটনাটা।

জয় গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল ট্রাকটাকে একবার। এখনও হৃদযন্ত্র নিজের সহজাত আচরণের ফলে আতঙ্কিত হয়ে দিপদাপ বিট করছে। জয় বেশ কিছুক্ষণ পর পেছন থেকে সমনে ঘাঁড় ফিরিয়ে তাকাল। কবীরকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল, “ট্রাকটা কার জানিস?ʼʼ

চলবে..

[কথা হলো, এটা একটা পলিটিক্যাল থ্রিলার বলা চলে। এখানে ভালো, সহজ, সরলতা, সাধুবাদ খুঁজলে পাওয়া যাবেনা। আবার বলা চলে সবই থাকবে। তবে এমন নয়, সকল প্রধান চরিত্র সুন্দর মনের হবে। সকল চরিত্রের একেকটা পরিণতি এবং সংজ্ঞা রয়েছে, যা ধীরে ধীরে সামনে আসবে, শেষ হবে। নায়ক-নায়িকা বলতে কিছু নেই। কিছু প্রধান চরিত্র রয়েছে, যাদের ঘিরে উপন্যাস নিজ গতিতে এগিয়ে যাবে। আর সবশেষে এখানে, একশন, ড্রামা, রোমান্স, থ্রিল, সাসপেন্স সবই থাকবে। সবে শুরু হয়েছে, একই সাথে একই পর্বে সব খুলে দেয়া সম্ভব নয়। তাই ধৈর্য্য ধরে পড়তে থাকলে আশা করি, নতুন নতুন মোড় এবং চমক আসবে…😐]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here