#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৫.
রাত দশটার দিকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি নেমেছে। হামজা বাড়ি ঢুকল রাত এগারোটার দিকে। দোতলার সিঁড়িতে ছাতা বাঁধিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকল। রিমি বসে ছিল স্বামীর অপেক্ষায়। দোতলার সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই একপাশে ডাইনিং রুম, তার আরেক বিভাজনে বসার ঘর। রিমি উঠে এগিয়ে গেল স্বামীর দিকে, হামজার হাত থেকে ওয়ালেট, ফোন, এবং ভেজা হাতঘড়িটা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এত দেরি হলো কেন? হাতে কী হয়েছে আপনার? ভিজেছেন কেন, ছাতা ছিল না সাথে?ʼʼ
হামজা সব কথা এড়িয়ে পাঞ্জাবী ঝারতে ঝারতে বলল, “একটা গামছা দাও, আগে।ʼʼ
রিমি বুঝল, কোনো কারণে মুড থমকে আছে আপাতত লোকটার। গামছায় মাথা মুছতে মুছতে তরুকে ডাকল হামজা, “তরু! এদিকে আয়!ʼʼ
তরু বেরিয়ে এলো, “কী হয়েছে, ভাই?ʼʼ
-“তুলিকে ডাক!ʼʼ পাঞ্জাবীর বোতাম খুলতে খুলতে এগিয়ে গেল হামজা টেবিলের দিকে। হাত-মুখ খেয়ে ধুবে হয়ত। রিমি রান্নাঘরে ছুটল। তরু ফিরে এলো একটু পর, আস্তে করে বলল, “ভাই! আপু আসতে চাইছে না।ʼʼ
হামজা কিছু বলল না আর, তরুকে বলল, “খেতে বস।ʼʼ
শাহানা এসে দাঁড়ালেন ছেলের পাশে। রিমিকে ভাতের পাত্র আনতে ইশারা করে বসলেন হামজার পাশে, হামজাকে বললেন, “ওই বাদর ফিরবে না? কত রাত হলো, বাড়ি ফেরে কখন সে?ʼʼ
হামজা গামছায় মাথা মুছতে মুছতে বলল, “যখন ফেরে প্রতিদিন, তখনই ফিরবে।ʼʼ
-“তা ক্যান ফিরবে? তুই শাসন করার বদলে আশকারা দিয়েই দিন দিন বেয়ারা বানাইছিস ওরে!ʼʼ
হামজা মায়ের দিকে তাকাল, “নির্বাচনের ঝামেলা এগিয়ে আসছে। এখন একটু ব্যস্তই থাকবে। এই নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করার কী আছে? ও তো ছোটো বাচ্চা না, ওকে নিয়ে টেনশন করতে হবে কেন?ʼʼ
ভাত তুলে দিলেন শাহানা হামজার প্লেটে। একটু নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “নির্বাচন আসতেছে বুঝলাম। তোরা কী করতেছিস কিছুই মাথায় ঢুকতেছে না আমার। তোর বাপ আসবে কখন?ʼʼ
প্লেটে হাত নাড়তে নাড়তে বলল হামজা, “মাথায় না ঢুকে যদি ভালো থাকা যায়, তাহলে আর ঢুকানোর চেষ্টা কোরো না। লবন দাও। বাবা থানায় গেছে।ʼʼ
চমকে উঠলেন শাহানা, “থানায়? আবার থানায়? মরল তো মরল, আমার বাড়ির মানুষগুলারে ফ্যাসাদে ফেলে রেখে গেল! মেয়েটারে পাইলে ধরে থাপড়াইতাম আমি। মরছে তো কার না কার হাতে, ওসব মেয়েলোক কি ভালো হয়? নিজেই হয়ত গেছিল কোথাও কারও সাথে! পরে..ʼʼ
হামজা বিরক্ত হয়ে তাকাল, “চ্যাহ, আহ আম্মা! চুপ থাকো তো! বাবা যদি থানা-কাচারি না ঘুরবে, তো মেম্বার হয়েছে কেন? জনগণের সমস্যায় এগিয়ে যাওয়া বাবার কাজ, কাজ করছে সে। থানায় গেলেই তো আর গ্রেফতার হয়ে যাবেনা! আর গ্রেফতার হবেই বা কেন?ʼʼ এরপর গলা উঁচিয়ে রিমিকে ডাকল, “রিমি!ʼʼ
রিমি লেবু কেটে এনে দাঁড়াল। হামজার প্লেটে দুটো শশা ও টমেটোর টুকরো তুলে দিয়ে, হামজার ভেজা চুলে আঁচল নেড়ে চুল মুছে দিলো রিমি। পাঞ্জাবীর কলারটাও ভেজা। অসময়ের বৃষ্টিপাত! শীত চলে আসার পর বৃষ্টি নেমেছে আজ প্রকৃতিতে। আরও একটা ডিম তুলে দিলেন শাহানা ছেলের পাতে। হামজার ডিম খুব পছন্দ। মাঝেমধ্যেই প্রেশার হাই হয়ে যায় এই বয়সেই, তবুও কোনো কিছুতে মান্যি করতে দেখা যায়না তাকে। হামজা খেতে খেতে মাকে জিজ্ঞেস করল, “শরীর কেমন এখন তোমার?ʼʼ
শাহানা মাথা নেড়ে ‘ভালোʼ বললেন। হামজা রিমিকে বলল, তরুকে ডেকে নিয়ে তিনজনে খেতে বসো। তুলিকে জয় এসে খাওয়াবে।ʼʼ
রিমি খেতে বসল না। এখন খেতে বসলে চলবে না। হামজা গোসল করবে, বিভিন্ন প্রয়োজনে ওকে দরকার হবে। শাহানাকে বলল, “আম্মু, আপনি খেয়ে নিন। আপনার ওষুধ খেতে হবে। আমি আর তরু পরে খেয়ে নেব, জয় ভাইয়া আসুক, সকলে একসাথে খাবো।ʼʼ
খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে পাঞ্জাবীটা খুলে গোসলে ঢুকল হামজা। রিমি লুঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বাথরুমের আধখোলা দরজার বাইরে। হামজা লুঙ্গি পরে এসে বসল বিছানায়। চুল থেকে পানি পড়ছে এখনও, প্রতিদিন রাতদুপুরে গোসল করার প্রয়োজনীয়তাটা কী? ঠান্ডা লাগে না এই লোকের নাকি? বোঝে না রিমি। তামাটে গায়ের রঙে, পুরু চামড়ার হূষ্ট-দেহি পুরুষটিকে দেখল চেয়ে ক্ষণকাল রিমি। কোনোদিন ভালোভাবে মাথা মুছে আসেনা। পরে রিমির মুছিয়ে দিতে হয়।
শুকনো তোয়ালে এনে মাথাটা ভালো করে মুছতে মুছতে বলল রিমি, “একটু যত্ন নিলে কী হয় নিজের? এত উদাসীন কেন আপনি? হাত কেটেছে কী করে এখনও কিন্তু বলেননি!ʼʼ
হাতটা টেনে ধরে কোলে বসাল রিমিকে হামজা। শাড়ির লুটিয়ে পড়ে থাকা আঁচল কাধে তুলে দিয়ে, পেটসহ কোমড় জড়িয়ে ধরল। কপট চিবিয়ে বলল, “আমিই যদি আমার যত্ন নেব, তাহলে তোমাকে তুলে এনেছি কেন?ʼʼ
রিমি মাথাটা নুইয়ে নিলো। গম্ভীর হলো হামজার মুখ, একহাত রিমির কোমড় থেকে সরিয়ে ফোন তুলে কাউকে কল করল। রিমি উঠে দাঁড়াল হামজার হাত ছাড়িয়ে। ভেজা মাথায় আরও দু একবার হাত বুলিয়ে স্যাভলন আর তুলা এনে বসল হামজার পাশে। হামজা ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে দিলো বিরক্ত হয়ে। রিমি তার হাতের ক্ষতটা পরিষ্কার করতে করতে বলল, “দেবর মশাই কল ধরছে না, তাই তো? আশাই বা রাখেন কেন? তার ফোন এখন কোথাও পড়ে আছে, সে হয়ত ফোন থেকে দূরে কোনো বিছানায় পড়ে আছে কারো সাথে!ʼʼ
হামজা ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “পুঁচকে মানুষ খুব বুঝতে শিখেছ এ বাড়ির ছেলেকে?ʼʼ
-“এ বাড়ি, ও বাড়ি কী? ছোটো থেকে এসব দেখে বড়ো হয়েছি। না বুঝলেও বুঝতে হয়েছে। কে কী করছে কখন, কার স্বভাব কী! বিশেষ করে রাজনীতিবিদ আর নেতাদের চরিত্র ভালো হতে নেই বলেই জানি।ʼʼ
-“তাই নাকি? তো আমার ব্যপারে কী খেয়াল তোমার? আমি কেমন, তুমি ছাড়াও…ʼʼ
হামজার হাতটা খামচে ধরল রিমি, “জানে মেরে ফেলব একদম! চেনেন তো আমার বাপ-ভাইদের! কেটে ছিঁড়ে খাওয়াব তাদের দিয়ে।ʼʼ
হামজা হেসে ফেলল রিমির দিকে তাকিয়ে। এরপর হাতের দিকে তাকালো। যেই ক্ষততে মলম লাগাচ্ছিল এতক্ষণ সযত্নে, সেখানে খামচে ধরে আছে, রক্ত বের হচ্ছে নখের আচড়ে। হামজা কিচ্ছু বলল না, তার চোখে দুষ্টু হাসি খেলা করছে, তা খেয়াল করে দাঁত খিঁচে জিদের সাথে বলে উঠল রিমি, “আর জয় ভাইয়ার ব্যাপারে খুব ভালোই জানি।ʼʼ
রিমি জানে হামজা জয়ের ব্যাপারে খারাপ কথা সহ্য করতে পারেনা। কাজ হলো ওর কথায়। হামজা মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল হামজা, “অন্য কোথাও তো থাকতে পারে, কোনো বিপদও হতে পারে!ʼʼ
-“তার আর কী বিপদ হবে? সে নিজেই একটা আস্ত বিপদ মানুষের জন্য, বিশেষ করে মেয়ে মানুষের জন্য!ʼʼ
জয়ের ব্যাপারে রিমির এসব ত্যাড়ছা উক্তি শুনতে ভালো লাগছে না হামজার। গম্ভীর হলো মুখশ্রী তার, “কেন? তোমার ওপর কোনোদিন খারাপ নজর দিয়েছে?ʼʼ
-“না, তা দেয়নি..ʼʼ
-“তাহলে?ʼʼ
রিমি তাকাল হামজার কঠিন হয়ে আসা মুখটার দিকে। হাতে এন্টিসেপটিক লাগানো শেষ করে উঠে দাঁড়াল। হামজা বলল, “জয় দুষ্টু, বেপরোয়া, অসভ্য, সেসব সত্যি। কিন্তু মিথ্যাবাদী বা বিশ্বাসঘাতক নয়। আর এখানেই ওর ওপর যত দুর্বলতা আমার।ʼʼ
রিমি কথা বলল না। হামজা হাত ধরে টেনে এনে পাশে বসালো ওকে। এরপর চট করে পা টান করে শুয়ে পড়ল রিমির কোলে মাথা রেখে। চোখ বুজে ঢোক গিলে বলল, “কথা বলছো না কেন?ʼʼ
-“আমার চেয়ে জয় ভাইয়া বেশি ইম্পর্টেন্ট আপনার কাছে, তা জানি। কিন্তু কেন?ʼʼ
হামজা চুপচাপ শুয়ে রয় চোখ বুজে। জবাব না পেয়ে রিমি জিজ্ঞেস করল, “হাত কেটেছে কীভাবে?ʼʼ
-“দেয়ালে ঠেস লেগেছিল।ʼʼ
-“দেয়ালে ঠেস লাগলে এভাবে কাটে না হাত।ʼʼ
ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল হামজা, “হুঁশিয়ারী করছো আমার সঙ্গে? ইন্টারেস্টিং! তো বলো দেয়ালে ঠেস লাগলে কীভাবে কাটে হাত?ʼʼ
রিমি খানিক মাথা ঝুঁকালো নিচের দিকে, হামজার চাপ দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে ধীর কণ্ঠে বলল, “ক’দিন বাদে আপনি হবেন মেয়র, এরপর মেম্বার অব পার্লামেন্ট। আমি হব তার ঘরনী। আব্বু বলতো, রাজনীতিবিদের বউদের বড়ো রাজনীতিবিদ হতে হয়, তবেই না চলবে সংসার! জানেন! আপনার মতো এমন রাক্ষুসে লোকের সাথে আব্বু আমার বিয়ে দিতে কোনোভাবেই রাজী ছিল না! আমি বললাম, বিয়ে করলে এই রাবনটাকেই করব।ʼʼ
হামজা খপ করে রিমির হাতটা ধরে ফেলল, আরও শক্ত করে কোল চেপে শুয়ে বলল, “তা, কেন তোমার মতো পুচকে এই রাবনকে বিয়ে করতে চাইল? ভয় করল না তোমার, যদি খেয়ে ফেলি?ʼʼ
নিঃশব্দে হাসল রিমি। হামজা একেবারে পেচিয়ে ধরে ফেলার আগেই একলাফে গা ঝেরে উঠে সরে দাঁড়াল। হামজা আধশোয়া হয়ে বসে বলল, “রিমি! দরজা আটকে দিয়ে এসো!ʼʼ
রিমি দূরে দাঁড়িয়ে ঘাঁড় নাড়ল, “পারব না।ʼʼ
হামজা ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকাল, “আমি উঠে গিয়ে ধরলে কাল সকালে তোমার খবর ‘আমাদের সময়ʼ পত্রিকায় বের হবে, আমাকে টলারেট করতে পারবেনা কিন্তু! অবাধ্যতা পছন্দ না আমার।ʼʼ
নাক কুঁচকাল রিমি, “ছিহ! কী মুখের ভাষা! আর আমি আপনার পার্টির মেম্বার না, বউ আপনার! আপনার পছন্দ অপছন্দ আমার কাছে চলবে না।ʼʼ
হামজা ফোন হাতে তুলে নিয়ে বালিশ খাঁড়া করে ঠেকিয়ে তাতে পিঠ হেলান দিয়ে বসল। ফোন কানে ধরে রিমির উদ্দেশ্যে বলল, “তোমাকে বলেছি আমার কাছে ঘেষবে না ভালো চাইলে, অথচ দেখলাম তুমি নিজের ভালো চাও না। দ্রুত কাছে এসো..ʼʼ
ওপাশ থেকে কল রিসিভ করল জয়, “হ্যাঁ, ভাইয়া!ʼʼ
-“কোথায় তুই? রাত বাজে কয়টা?ʼʼ
-“দেরি হবে আসতে। ক্লাবে আছি।ʼʼ
-“ক্লাবে কী করছিস?ʼʼ
-“ক্যারাম খেলছি।।ʼʼ
-“খেলছিস নাকি ঢকঢক করে গিলছিস?ʼʼ
জয় কথা এড়াল, “তুমি বাসায় গেলে কখন? মামা এসেছে বাসায়?ʼʼ
রিমি এসে কাছে দাঁড়াতেই এক হেচকা টান দিয়ে ফেলে দিলো বিছানায় ওকে। দাড়ি-গোফের মুখটা গলায় ঠেকাল। একহাতে রিমিকে শক্ত করে বিছানার সাথে চেপে ধরে রেখে, অপর হাতে ফোন কানে ধরে বলল, “আসেনি এখনও! তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। দুপুরের পর পৌরসভায় কাজ ছিল, যাসনি। আমার হাতে থাপ্পড় খাসনি বহুদিন! ঘন্টাখানেকের মধ্যে বাড়িতে পা পড়ে যেন! নয়ত থাপড়ে ত্যাড়ামি সোজা করে দেব।ʼʼ
কলটা কেটে দিলো জয়। রিমির দিকে তাকিয়ে বলল, “স্বামীর খেদমতে গাফলতি করতে নেই, জানো না? এই অবাধ্যতা মেনে নেব না আমি।ʼʼ
রিমি হামজার খোলা পিঠ খামচে ধরল, “জয়কে এতো প্রশয় কেন দেন আপনি? ওকে খারাপ করার পেছনে শতভাগ হাত আপনার রয়েছে। এটা কি ওর ভালো চাওয়া, নাকি ওকে ধ্বংস করা?ʼʼ
হামজা রিমির ঠোঁটের এক কিনারে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, “ধ্বংস আর সৃষ্টির মাঝে যে দেয়ালটা, তা খুব মসৃণ, রিমি! বলতে পারো, মুদ্রার এপিট-ওপিঠ। পদার্থ একই, শুধু পাশ বিপরীত। জয় স্বাধীনচেতা ছেলে, ও জীবনকে যেভাবে ইনজয় করতে চাচ্ছে, আমি ওকে সেভাবে চলতে বলিনি, ও যা করে, শুধু বাঁধা দিতে ইচ্ছে হয়না ওর কোনো কিছুতে। দেখোনা, ও যখন শব্দ করে হাসে, দেখতে আর শুনতে কী চমৎকার লাগে! ওর হাসির মায়ায় আমার মতো পদার্থগত কঠিন পুরুষটাও পড়েছে। তার চেয়েও বড়ো কথা, দিনশেষে আমি নিজেও শতভাগ শুদ্ধ নই।ʼʼ
—
সকাল সাতটা বেজে গেছে ঘুম থেকে উঠতে। আজকাল প্রতিরাতেই ঘুমাতে বেশ দেরি হয়ে যায় অন্তূর। ফাইনাল এক্সাম কাছে এগিয়ে আসছে, রাত জেগে পড়তে হয়। মাঝেমধ্যেই অন্তূর ইচ্ছে করে, একরাতে যদি অনার্সের এই চার বছর শেষ হয়ে যেত, আর সে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে যেত স্নাতক করতে! তার কিছুদিন পর উকিলের ওই সাদা-কালো পোশাকটা গায়ে চড়াতে পারতো! অথচ আরও দুটো বছর শেষ করতে হবে অনার্সেই!
ঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠল, সূর্য উঠে আলো ছড়িয়ে গেছে, দ্রুত অযু করে এসে ফজরের নামাজে বসল। আম্মা উঠেছে, রান্নাঘর থেকে ঠুকঠাক আওয়াজ আসছে। দরজা খুলল না, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো কচুরিপানা জন্মেছে পুকুরে। আজ আর ডাহুক পাখির দেখা পেল না। গ্রিল ধরে দাঁড়াল। মাথায় সারাটাদিন প্যাচ কাটে আজকাল। সকাল থেকে শুরু হয়, গভীর রাতেও শেষ হবার নাম নেয় না। সেদিন চাদনী বলেছিল, একবার সাবধান না হয়ে একটা হারিয়ে গেছে! এ দ্বারা কী বুঝিয়েছিল? কী হারিয়েছে! এই পরিবারটায় কি ঘাপলা আছে কোনো! আব্বুর কাছে গতরাতে জিজ্ঞেস করেছিল অন্তূ, হামজা পাটোয়ারীর ব্যাপারে।
হামজা ভার্সিটির ভিসি এবং ছাত্রলীগ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। তার অনেক উন্নয়নমূলক কাজের নজির আছে জেলায়! বাপের কাউন্সিলর হবার পেছনে তার বিশেষত্ব রয়েছে। তার বাপকে কেউ ভোট দিতো না কোনোকালে, তার বদৌলতে ভোট পেয়ে কাউন্সিলর হয়েছেন হুমায়ুন পাটোয়ারী। হামজা চতুর এবং বাহ্যিক নিখুঁত চলনের এক তরুণ রাজনীতিবিদ। এ বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষের কাছে তার নাম ভগবানের মতোই, তারা জপে বেলায় বেলায়! আবার তরুণদের কাছেও বেশ সমাদৃত! অথচ তবুও কোথাও যেন ঘাপলা রয়ে গেছে তার মাঝে! ক্ষমতার নেশাও বলা চলে সেই ঘাপলাকে। নেশার পিছনে খুব ক্ষিপ্রগতিতে ছুটছে হামজা। এবার বাবাকে কাউন্সিলর পদ থেকে সরিয়েছে। চাইলে হুমায়ুন পাটোয়ারী আবারও কাউন্সিলর এবং সে মেয়র হতে পারতো। জেলার দুই সমাজসেবক নেতাকর্মী পাটোয়ারী পরিবারেই থাকতো। অথচ তা করেনি হামজা। এখানেই হামজাকে চতুর এবং ক্ষুরধার এক রাজনীতিবিদ বলার সুযোগটা আসে। সে যা নাম কামিয়েছে জনসাধারণের কাছে, তা থেকে অনায়াসে বাপ-ছেলে পদপ্রার্থী হলে জিতে যেত দুজনেই। অথচ এখানেই মানুষের মাঝে একটা কৃতজ্ঞতাবোধের জায়গা রেখেছে যে, হামজা সুযোগ এবং ক্ষমতা থাকতেও তা কাজে লাগিয়ে পদ নেয়নি। বরং সে শুধুই সমাজসেবকের ভূমিকায় অধিষ্ঠিত হতে চায়।
আব্বুর বলা কথাগুলো শুনে অন্তূর মনে হলো, নিঃসন্দেহে হামজা রাজনীতিবিদ হিসেবে হিসেবী চাল-চলনসম্পন্ন। তাহলে মানুষ হিসেবে কেমন? এটাও নিশ্চিত প্রায়, হামজা জিতে যাবে এবার। অন্তূকে আব্বুকে জিজ্ঞেস করেছে, “এরপর সরাসরি সংসদ নির্বাচন করবে তাই তো?ʼʼ
এটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। অন্তূ অবাক হলো, সে এতদিন যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছে, সেখানে মনে হয়েছিল ওই পরিবারকে তার মতোই সবাই ঘৃণা করে। অথচ এখন মনে হচ্ছে, শুধু মাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ ওই পরিবারকে দোষারোপ অবধি করবেনা। অর্থাৎ, আঁখির পরিবার দ্বিধায় রয়েছে, আর সে? সে ঝুলে আছে জয়ের পক্ষ থেকে আসা সম্ভাব্য একশনের জন্য। আবার মনে হচ্ছে, জয় কিছুই করবেনা। করলে করতো তো!
হামজা বিয়ে করল, মেয়র সাহেবের ছোটো ভাইয়ের মেয়ে রিমি আহসানকে। মেয়রের ভাই ফারুক আহসানের সঙ্গে কীসের এক আলোচনা বেঠকে গিয়ে প্রথম দেখেই রিমিকে পছন্দ হয়েছিল। তরুণ নেতাকর্মী হিসেবে ভালো নাম এবং প্রতিপত্তি তো কামিয়েছে হামজা এই বয়সেই। তবে তার নাম খারাপ করার জন্য আছে একজন, যাকে সে খুব যত্নে পালছে— জয় আমির। হামজার ফুফাতো ভাই। জয়ের বেপরোয়া কার্যক্রম সকলের কমবেশি জানা। তবুও সে ভার্সিটির ছাত্রদলের লিডার। কেন, কীভাবে এটাও ভাবার বিষয়! তা যদি ছাত্রদের কাছে জিজ্ঞেস করা যায়, তারা সমস্বরে স্বীকার করবে, তাদের নেতাকর্মীকে খুব পছন্দ তাদের! জয় ভালো লিডার তাদের। তার চঞ্চলতা এবং দুষ্টুমি ছাড়া আর কিছু একটা অবর্ণনীয় রয়েছে, যেটা আকর্ষণীয়। দায়িত্বজ্ঞানহীন, তা বলা চলে না। রাজনৈতিক কাজকর্মে যেমন ষোলো আনা, তেমনই দুষ্টু কাজেও সে ব্যাপক পারদর্শী। সামনেই পৌরসভা নির্বাচন আসছে। বাপের বদলে হামজা নির্বাচনে অংশ নেবে, এই রব মুখে মুখে উঠে গেছে। সরাসরি ছাত্রনেতা থেকে সাংসদ নির্বাচনের বিষয়ে বিভিন্ন জনরব ছড়িয়েছে তার নামে। চতুর হামজা এতো তাড়াতাড়ি এতদূর উড়ার মতো বোকামি করবে না, সংসদ নির্বাচনকে হাতে রেখে আপাতত সে এবারের মেয়র পদপ্রার্থী।
এ কথা সকলের জানা, আমজাদ সাহেব অন্তূকে এগুলোই শুনিয়েছেন। অন্তূর রাজনৈতিক বিষয়াদিতে আগ্রহ না থাকলেও রয়েছে সমাজ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা। নিজের নামের সামনে যেকোনো মূল্যে অ্যাডভোকেট যুক্ত করার প্রয়াসে দৌঁড়ে চলেছে। দুবছরে অনার্স শেষ করে ল তে ভর্তি হতে হবে তাকে।
মাথা জট পাকিয়ে যায় এসব ভাবতে শুরু করলে। সে এতো আগ্রহ নিচ্ছে কেন এসব বিষয়ে? বারবার দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, আরও জড়িয়ে ধরছে এই জটলা ওকে। কাউন্সিলর সাহেব চাঁদনীকে বলেছিলেন, টাকা নেবেন। সেদিন রাতেই সেই টাকা কেউ বা কারা এসে লুটে নিয়ে গেল। এর মধ্যে কাউন্সিলর এবং তার ছেলে হামজার হাত থাকাটা অসম্ভব নয়। তবে, কেউ যদি নিজের আবাস ছেড়ে উঠতে না চায়, টাকা দিয়ে বাসভূমি ফেরত নিতে চায়, তাহলে তার বিনিময়ে এত জঘন্য প্রতিদান কোনো সুস্থ মানুষ দেবে না। হুমকি দিতে পারতো, তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে শর্ত দিতে পারতো! অথচ অমানুষিক বর্বরতা একটা মেয়ের সাথে!
অন্তূ চোখদুটো বুজে নিয়ে মনোযোগ ভ্রষ্ট হবার চেষ্টা করল। বারবার চোখের সামনে আঁখির বস্ত্রহীন, এক ফালি কাপড়ে ঢাকা দেহটা চলে আসছে। সহ্য করা দায়! এই জীবনে এসব ঘটনা সে কেবল আব্বুর পড়ে রেখে দেয়া সংবাদপত্রের কাগজে পড়েছে, নিজের সামনে ঘটা ঘটনাটা সে এতো স্বাভাবিকভাবে নেবার সাহস পাচ্ছে কোথায়, এটা ভেবে হয়রান সে। এটাও নিশ্চিত—কোনো এমন কথা লুকিয়েছে চাঁদনী, যা বলার মতো নয়। একটা নয়, এমন বহু কথা লুকিয়েছে ওই রহস্যমানবী! আবার যদি অন্তূ যায়, বলবে সেসব? সম্ভাবনা নেই, চাঁদনী তূখর বুদ্ধিমতি আর শান্ত চিন্তার মেয়ে। শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতায় পারদর্শী মেয়েটাকে খুব পছন্দ হয়েছে অন্তূর।
দরজায় ধাক্কা পড়ল। ধাক্কাটার ধরণ দেখে অন্তূ বুঝল, ধাক্কাটা কার। হতাশ শ্বাস ফেলল, জানা নেই কোন উদ্ভট পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তাকে এখন! দরজা খুলল অন্তূ। মার্জিয়া ঘরে ঢুকে আশপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখল, যেন কোনো সন্দেহভাজন অপরাধীর ঘরে ঢুকেছে। অন্তূকে জিজ্ঞেস করল, “পড়ালেখার কী খবর তোমার?ʼʼ
বহুরূপী ভাবীর বহুরূপী মুখের কথা! ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল অন্তূ, “জি, ভালো। বসুন আপনি।ʼʼ
বসল মার্জিয়া, খুব আন্তরিক স্বরে বলল, “শোনো, তুমিও তো আমার বোনের মতোই! তুমি আমায় যতটা পর ভাবো, আমি কি আসলেই অতটা খারাপ?ʼʼ
-“জি না, অতটা খারাপ না।ʼʼ
-“তার মানে একটু খারাপ?ʼʼ
অন্তূ বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইপত্র তুলে নিয়ে গিয়ে টেবিলে সাজাতে সাজাতে বলল, “কী বলতে এসেছেন?ʼʼ
-“এমনি আসতে পারি না?ʼʼ
অন্তূ ফিরে তাকাল, “অবশ্যই পারেন। তবে এমনি আসেননি।ʼʼ
-“তোমার তো অনার্স সেকেন্ড ইয়ার শেষের দিক। তোমার প্রতি একটা দায়িত্ব আছে তো নাকি? তোমাকে এসে আমার ছোটো বোনের মতো পেয়েছি, সেই হিসেবে তোমার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবার অধিকার আছে না? এখন তো একটু ভাবতে পারো..
-“জি ভাবছি, ভাবছি আমি বিয়েশাদীর কথা। মনের মতো পেলে বিয়ে করে নেব। আপনি শুধু শুধু এতো টেনশন করবেন না, ভাবী।ʼʼ
মার্জিয়া এক পলকের ব্যবধানে চেতে উঠল, “তোমার মনের মতোন ছেলে ফ্যাক্টরিতে অর্ডার দিয়ে বানায়ে আনি, কী বলো? তোমার মনের মতো কোনো ছেলেও আছে এই আল্লাহর দুনিয়ায়? কীরকম চাও তুমি, যে তোমার এইসব কটকটে শক্ত কথা মেনে, বিলাইয়ের মতোন তোমার পিছপিছ চলবে এইরকম চাও তো তুমি! তোমার মতো মেয়েকে কোনোদিন কেউ বিয়ে করে নিয়ে বাড়ি তুলবে না। ছেলে মানুষ কি গোলাম? কামাই রোজগার করে খাওয়াবে, আবার তোমার আলগা ভাব দেখবে? ভাব দেখে বাঁচি না আমি তোমার।ʼʼ
অন্তূ স্বাভাবিক স্বরে বিনয়ের সাথে বলল, “মরেও তো আর যাচ্ছেন না, তাই না! আর আপনি আপনার ঘরে থাকেন, আমি আমার ঘরে, এমন নয় সবসময় আমার ভাব আপনার চোখের সামনে থাকে। সামনে আসলেও চেষ্টা করবেন, চোখ বুজে অথবা দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখতে। দেখবেন, আর আমার ভাব আপনার চোখে পড়ছে না। আর এমন তো মোটেই নয়, যে আপনার অথবা আপনার স্বামীর কামাই খাচ্ছি এ বাড়িতে। তাহলে আপনার আসলে ব্যথাটা কোথায়?ʼʼ
নাক শিউরে উঠল অন্তূর জবাবে মার্জিয়ার। সর্বোচ্চ রাগটা মার্জিয়ার ওঠেই অন্তূর সুবিন্যস্ত ভঙ্গিমায় শান্ত স্বরে বলা দায়সারা কথাগুলোতে। রি রি করে উঠল সে, “তোমার কথাটা একবার বিশ্লেষন করছো তুমি? মরিনি এই নিয়ে আফসোস তোমার! আবার ব্যথা! এই ব্যথা কী, হ্যাঁ? তোমার মুখে জুতা মারা উচিত! আজ কয়দিন আমার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না, আবার কিছু করে আসছো কবিরাজের কাছে আমার জন্যও নিশ্চয়ই! যাতে তাড়াতাড়ি মরি, এইটাই তো বুঝাইলা তোমার কথার মাধ্যমে!ʼʼ
অন্তূ ঘাড়ে হাত দিয়ে পিঠ বাঁকাল, “সোজা একটা সিনকে উল্টো করে এমন নাটকীয় বানিয়ে তোলার নিখুঁত টেকনিকটা কোথা থেকে রপ্ত করা আপনার?
আমাকে মানসিক অত্যাচার করে পান কী আপনি? আমি আসলেই চাই, আপনার সাথে বিনয়ী হয়ে থাকতে, আপনি আমার বড়ো ভাবী। কখনও কোনোদিন আগ বাড়িয়ে আজে আচরণ করিনি, তা আপনিও জানেন! অথচ আপনি একটুও চান না আমার বিনয় দেখতে। সত্যি বলতে, আমার ভেতরে একটা জলন্ত শয়তান আছে, যেটা অযৌক্তিক, ছোটোলোকী আচরণ এবং কথার সামনে খুব খারাপভাবে বেরিয়ে আসে। শান্তভাবে খুব তীক্ষ্ণ কথা শুনিয়ে দিতে পারে সেই শয়তান। আমার নিয়ন্ত্রণ নেই তার ওপর। আপনি বারবার তাকে খুঁচিয়ে বের করে আনেন। আপনি না খুঁচালে সে আসবে না, খুঁচালে ছেড়ে দেবে না। থাকুন না আপনি আপনার মতো, আমি আমার মতো! আমাকে নিয়ে আপনার সমস্যাই বুঝিনি আজ অবধি।ʼʼ
দাঁত খিঁচিয়ে উঠল মার্জিয়া, “তোমাকে নিয়ে সমস্যা যে কোথায়, সেটা তো আমি নিজেও বুঝি না! আসলে তোমার ভাব আমার সহ্য হয়না, অন্তূ! ওইটাই আমার সমস্যা। তোমার কথাবার্তা সহ্য হয়না আমার। শোনো, কাল আমার চাচাতো ভাইয়ের বাড়ির লোক আসতেছে তোমায় দেখতে, যদি কোনো উল্টাপাল্টা করো, আর আমি বাপের বাড়ি চলে যাই, তোমার ভাই যে তোমাদের শান্তি রাখবে না, তা জেনে রাখো।ʼʼ
অন্তূ আর কথা বলল না। তার রুচিতে বাধছে কথা বলতে। মার্জিয়া বের হয়ে গেল। দিনকাল ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে তার। চারদিক থেকে সংকটময়, সংকীর্ণ হয়ে উঠছে তার এগোনোর পথগুলো। ভাবী তাকে বিয়ে কেন দিতে চায়, সেটাও সে জানে। অন্তূ এ বাড়ি থেকে চলে গেলে শুধু শশুর শাশুড়ির ভার তারা গ্রহন করে এ বাড়ির নায়ক-নায়িকা হয়ে উঠবে দুজন। এখনও সবটা আয়ত্ত্ব করে আছেন আমজাদ সাহেব। অথচ মার্জিয়ার বাপের বাড়ির লোক এই নিয়ে মজা করে, এতদিন বিয়ে হয়েও সংসার নিজের করতে পারেনি মার্জিয়া! সে এখন আর এসব নিতে পারেনা। দ্রুত অন্তূকে বিদায় করলে, শশুড় মশাই এমনিতেই থেমে যাবেন। আমজাদ সাহেব খুব গম্ভীর আর শীতল মানুষ, শিক্ষিত মানুষটার ব্যক্তিত্ব প্রখর। তাতে দাগ না লাগাতে তিনি সব করবেন। অন্তূ কথা বলে, অথচ আমজাদ সাহেবের নীরবতার মাঝেই যেন যত তেজ নিহত।
কাল আব্বুর কাছে একজন পাওনাদার এসে বসে থেকে গেছে ঘন্টাখানেক। আব্বু লোকটাকে বেশ তোষামোদ করছিল, যেটা আব্বুর আত্মমর্যাদার খেলাপি অনেকটাই! লোকটার মুখে সন্তুষ্টি নেই, অথচ আব্বু ক্রমাগত চেষ্টা করছিল লোকটাকে একটু খুশি করার, দুটো দিন সময় চেয়ে নেবার। যেটা দেখে ভালো লাগেনি অন্তূর। আঁখির কথা মাথায় এলো আবার, এভাবেই সময় চেয়েছিল নিশ্চয়ই আঁখির পরিবার! আচ্ছা, আঁখির এই বিভৎস অবস্থার পেছনে এ ছাড়াও কি আরও কিছু আছে?
ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তার পাগল পাগল লাগে আজকাল। না! এভাবে এটুকুতেই হয়রান হলে তার নামের পাশে অ্যাডভোকেট উপাধি মানাবে না আগামী কালে! তাকে সবকিছুতে স্বাভাবিক থাকার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সে চেষ্টা করছে তা-ই। আঁখির ডেডবডির কথা মাথায় আসলেই ভেতরে ভেঙেচুড়ে আসে, মাথায় ভয়াবহ চাপ পড়ে, প্যানিক এসে জড়ো হয়! আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে ভেতরের নারীসত্তাটা। মানসিক ভারসাম্য হারানোর জোগাড় হয়, তবুও শান্ত রেখেছে নিজেকে। এই দুনিয়ায় ভঙ্গুর হওয়া যাবে না, একুটুও না।
দশটায় ক্লাস আছে। বেলা পৌনে দশটা বাজতে যাচ্ছে। ক্যাম্পাস এই ক’দিনে শান্ত হয়ে গেছে। গেইট দিয়ে সরাসরি ঢুকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগটা পড়ে একপাশে একটু ভেতরে। গাছপালায় ছেয়ে আছে বিল্ডিংয়ের আশপাশের চত্বরটা। অন্তূ সেদিকে এগোলো। কেউ একজন পেছনে এসে খুব কাছে দাঁড়িয়ে তার নাম ধরে এমনভাবে ডাকল, যেন বহুদূর থেকে গলা উঁচিয়ে ডাকছে। ম্যান পারফিউমের কড়া গন্ধটা! চমকে উঠে ছিটকে দূরে সরিয়ে দাঁড়াল, বুক কাঁপছে মৃদু। ফিরে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করল না মানুষটাকে। গা গুলানো ঘেন্না কাজ করছে। জয় সামনে এসে দাঁড়িয়ে আবার ডাকল, “অন্তূ!ʼʼ
ডাকটা শুনতে এমন লাগছে যেন বহুকালের পরিচিত, এবং ডেকে অভ্যস্ত জয়! অন্তূ নির্বাক চোখে চেয়ে আছে। খুব কাছে এসে দাঁড়াল জয়, অন্তূ মুখটা বাঁকিয়ে নিলো। জয় হেসে এদিক-ওদিক তাকাল,, “কুকুর দেখে ভয় পাও দেখছি! চ্যাহ! আমি কাহিনি ঠিক বুঝলাম না, একদিন কুকুরকে সিনিয়রের সংজ্ঞা শেখাও, আরেকদিন ভয়ে কুঁকড়ে যাও, ব্যাপার কী?ʼʼ
অন্তূ জবাব দিলো না। জয় ঘাঁড় বাঁকা করে দেখল অন্তূকে। যেন ওর মুখে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু খুঁজছে। সোজা হয়ে দাঁড়াল, মুখের অভিব্যক্তি বদলে দাঁত পিষল, “জবাব দিচ্ছ না কেন?ʼʼ অন্তূর মুখের ওপর নজর আটকে হেসে ফেলল চট করে, “জানো! আমি সিংহ বা বাঘ নই! খপ করে থাবা দিয়ে শিকার ধরি না, আমি বাহাদুর নই! তোমার ভাষ্যমতে কুকুর আমি। কুকুরের অনেকগুলো স্পেসিফিক স্বভাব থাকে! তার মধ্যে একটা হলো, ছ্যাঁচড়ামি। আমি কুকুরের সেই স্বভাবের অনুসারী। কৌশলে ধীরে সুস্থে নির্লজ্জতার সাথে ধরব তোমায়, তুমি ঝরঝর করে ঝরে পড়বে।ʼʼ
অন্তূর বুকটা কাঁপল, পশমগুলো শিউরে উঠল অকারণেই। জয়ের মুখের নির্বিকার ওই হাসি গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। শান্ত, স্বাভাবিক স্বরে বলছে কথাগুলো! লোকে দেখছে ওদের, কেউ কেউ তাকিয়ে আছে, কেউ তাকিয়ে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তাদের ধারণা, সিনিয়র হিসেবে জুনিয়রকে শিষ্টাচার শেখাচ্ছে। একটু পিছিয়ে গেল জয়। ডানপাশে ঘাঁড় ঘুরিয়ে উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি রেখে অন্তূকে জিজ্ঞেস করল, “আমার এলাকায় গেছিলে কেন সেদিন?ʼʼ
অন্তূ চোখ বুজল। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। জয় দেখেছে ওকে! এবারেও জবাব দিলো না। জয় অন্তূর দিকে ফিরল, “কেন গেছিলে?ʼʼ
অন্তূ কথা বলল না। সুন্দর দৃষ্টি মেলে তাকাল জয়। সুন্দর করে বলল, “ইচ্ছে করছে একটানে তোমার নেকাবটা খুলে ছিঁড়ে ফেলি। ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে খুব কাঁচা আমি। কেন গেছিলে ওদিকে?ʼʼ
ধৈর্য্যতে মানল না জয়ের কথাটা, নাকের পাটা শক্ত হলো অন্তূর, “আমি কোথায় যাব অথবা না, তার রেস্ট্রিকশন আপনি দেবেন আমায়?ʼʼ
কেমন করে যেন হেসে ফেলল জয়, “ছিহ! তা দেব কেন? জিজ্ঞেস করছি কেন গিছিলে? রেগে যাচ্ছ কেন?ʼʼ
জয়ের হাসিতে গা শিউরে উঠল অন্তূর। শরীরটা পিছিয়ে যাচ্ছে ভেতর দিয়ে, অথচ পা টলছে না। জয় একহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে, অথচ অন্তূর মস্তিষ্ক ওকে তাড়া দিচ্ছে আরও খানিক দূরত্ব বাড়াতে। ক্যাম্পাস ভর্তি লোক, বেইজ্জতমূলক কিছু না ঘটুক, তা সামলাতে এতক্ষণ চুপ ছিল। জয়ের স্বাভাবিক আচরণ ছাপিয়ে চোখের চাহনিতে যা ফুটে উঠতে দেখা যাচ্ছে, তা অন্যরকম। আশপাশের সবার নজর ঠেকে আছে ওদের দিকে। অন্তূ জবাব দিলো, “ঘুরে দেখতে গেছিলাম।ʼʼ
-“ভিক্টিমের বাড়ি?ʼʼ
নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল অন্তূ, “এবার সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে আপনাদের ওপর।ʼʼ
হতাশাজনক শ্বাস ফেলল জয়, “হাহ! ইনভেস্টিগেশনে নেমেছ তাহলে! তাতে তোমার প্রোফিট কী? আর আমাকেই বা দোষী করতে চাইছ কোন সুখে? আচ্ছা বাদ দাও সেসব। বলো, সন্দেহ সত্য হলে কী করবে?ʼʼ
অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “কিছুই করার নেই?ʼʼ
জয় কাধ ঝাঁকালো, “তুমিই বলো, কী করার আছে?ʼʼ
-“সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করুন, তিনি ছেড়ে দেন না।ʼʼ
জয় মাথার উপরে হাত তুলে আলস্য ভঙ্গিতে বলল, “ধরেও তো না!ʼʼ
অন্তূর মুখটা কুঁচকে এলো ঘৃণায়, “তিনি ধরলে আর পালানোর পথ পাবেন না।ʼʼ
জয় হাসল, “তাকে বলো দ্রুত ধরতে। একবার পুলিশ অবধি গ্রেফতার করেনি আমায়, জানো! পুলিশের সাথে রেষারেষি না থাকলে নিজেকে খুব দূর্বল লাগে! তুমি প্লিজ কিছু একটা করো, যাতে আমাকে পুলিশ ধরে। আর তুমি নিজের চেয়ে বেশি আমার চিন্তা করছো, প্রেমে পড়েছ আমার?ʼʼ
অন্তূ কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইল জয়ের চেহারার দিকে। গোল বা লম্বা আখ্যা দেয়া যায়না চেহারাকে। ফর্সা বা কালোও নয়, শ্যামলাও নয়! তামাটে ইট রঙা চেহারা। নাকটা সরু, হাসিটা অদ্ভুত, জড়ানো। গলায় চেইন ঝুলছে, তাতে ইংরেজি ‘Jʼ লেটার লকেট হিসেবে রয়েছে। বাম হাতে আজ রিস্টলেটের বদলে একটা রূপালি বালা, ডানহাতে ঘড়ি পরেছে। কী বিশ্রী অদ্ভুত!সাজটাই সাইকো টাইপের, অস্বাভাবিক। চুলগুলো সুবিন্যস্ত। অথচ জয়ের আজব মুগ্ধ হবার মতো চেহারা এবং গড়নে অন্তূর ঘেন্না উতলে এলো। এই সুন্দর, বিন্যস্ত কাঠামোতে বিশাল গোপন জাহিলী দেখতে পেল অন্তূ। দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, “কী করবেন আপনি আমার? কী করেছি আমি? কীসের নোংরা খেলায় মত্ত হবার পরিকল্পনা নিয়ে বসে আছেন?ʼʼ
জয় হেসে ফেলল, “ভয় পাচ্ছ, আরমিণ?ʼʼ
অন্তূ ভ্রু কুঁচকাল, এই নামে সাধারণত কেউ সম্বোধন করেনা তাকে। চোখ নামিয়ে বলল, “ভয় পাওয়া উচিত নয়? আপনার মতো নোংরা মানসিকতার মানুষের কাছে একটা মেয়ে ভয় না পেয়ে যাবে কোথায়?ʼʼ
জয় শান্ত স্বরে বলল, “তুমি এসেছ আমায় খুলতে, আমি গেছিলাম না আমার রঙ দেখাতে তোমার কাছে। সেদিন আমার দেয়া সিগারেট তুমি পায়ে পিষে চলে গেলে? যাক, ধরো নির্বাচনের ঝামেলায় সেটা নাহয় ভুলে যেতাম। তুমি কাল গেছিলে ওই বাড়িতে। কেন? আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে?ʼʼ
-“শিক্ষিত মানুষ মূর্খের মতো অযৌক্তিক কথা বলবেন না, বেমানান লাগে। কিছুই করিনি আমি তেমন!ʼʼ চাপা গর্জন করে উঠল অন্তূ।
জয় আশপাশে তাকাল, “গলার আওয়াজ উচু যেন না হয়, খেয়াল রেখো।ʼʼ পা দিয়ে মাটিতে থাবা দিয়ে ইশারা করল, “এই মাঠে কবর দিয়ে দেব একদম! কী করেছ, খুব জানার ইচ্ছে তোমার! আমার সঙ্গে কথা বলার সময় ম্যানার্স কোথায় থাকে তোমার? আমায় কি বালবেটা মনে হয়? সকলে যেমন সমাদার করে ভাই বলে ডাকে, তুমি দেখোনা তা? এই তো দু’দিন দেখা হলো সামনাসামনি, এর মাঝেই বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছ নিজের প্রতিবাদমূলক কাজকর্মে! তোমায় দমাতে হবে না? যা করার নয়, তা করে চলেছ! চ্যাহ! আরমিণ, তুমি কী চাইছ সেটা বলো তো! আমার বিপরীতে খেলে পারবে তুমি?ʼʼ
অন্তূ চোখ নামিয়ে নিলো। অস্থির লাগছে। লোকে দেখছে, এই নিয়ে আবার কথা ছড়াবে ভার্সিটিতে, সামনে কোন তামাশা অপেক্ষা করছে জানা নেই।
চলবে..