#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
১০.
সকাল নয়টা বাজছে। হামজার ঘুম ভাঙল জয়ের গলাভাঙা গানের স্বরে। পুরো বাড়িতে তার গানের স্বর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হিরিক বেঁধে গেছে যেন গানের।সে কোনোসময় বিষণ্ন থাকেনা, সিচুয়েশন যেমনই হোক, অল টাইম চিল! এটা তার স্লোগান! যেকোনো পরিস্থিতিতে ইচ্ছেমতো আচরণ করে পরিবেশের রঙ বদলানোর দক্ষ হাত রয়েছে। ভেসে আসছে টুংটাং গিটারের সুর আর আধভাঙা গলায় তোলা সুর,
~মনে পড়ে বারবার, সময়ের কারবার, রাস্তারা ফেরোয়ার হারিয়েছে আজ..
চাওয়াদের শেষ নেই, জানি তবু পারি কই, চড়ে বসি বারবার স্বপ্ন জাহাজ..
চাইলে চলে যা যদি, না থাকে উপায়,
সুঁতোয় বাঁধা জীবন ছেড়ে পালাবি কোথায়…..
হাতের ব্যান্ডেজ নিয়েই শুরু করে দিয়েছে টুংটাং গিটার বাজানো! নড়তে চড়তেই হামজার মুখচোখ কুঁচকে উঠল গায়ের ব্যথায়! পাশ ফিরে দেখল, রিমি নেই। প্রতিদিনের ব্যাপার, তবে অস্বাভাবিক হলো, রাত থেকে মেয়েটা কথা বলছে না। সে যে এতখানি জখম হয়েছে তাতেও কোনো ব্যতিব্যস্ততা দেখায়নি, আর না কথা বলেছে। সকালে উঠে চুপচাপ রান্নাঘরে চলে গেছে। একবার ডকেও নি, অথবা কাছেও আসেনি। জিজ্ঞেস অবধি করেনি, এসব কী করে হলো, কতটা ব্যথা পেয়েছেন? কম্বল সরিয়ে উঠে বসল বিছানার ওপর। গলা বাড়িয়ে ডাকল, “জয়..জয়! এদিকে আয়। জয়..ʼʼ
গানের আওয়াজ থামলো। জয় গিটার রেখে বারান্দার মোড়া থেকে উঠে দাঁড়াল। পরক্ষণেই অতিষ্ট হয়ে চেঁচাল, “চালু হয়ে গেছে তোমার ভাঙা রেডিও! ওটা থামাও তো, ঘ্যারঘ্যার করছে।ʼʼ
হামজার রুমে ঢুকে সোজা গিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়ল বিছানার ওপর হামজার পাশে। হামজা জিজ্ঞেস করল, “আমার ডাক শুনতে ভাঙা রেডিওর মতো ঘ্যারঘ্যারে লাগছে?ʼʼ
জয় চোখ বুজে ছিল, ওভাবেই বলল, “এত ভালোও লাগেনা শুনতে। ওই ধরো..ʼʼ
কুশন তুলে মুখের ওপর ছুঁড়ল হামজা, “তার চেয়েও খারাপ, কীসের মতো লাগে তাইলে?ʼʼ
সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল জয়, “বললে চাকরি থাকবে না।ʼʼ
-“চাকরি তোর এমনিতেও থাকবে না। আমি যদি তোর গানের গুণগান করি, তুই তো মেয়েলোকের মতো হাত-পা আঁছড়ে কাঁদতে লেগে যাবি! সেই হিসেবে আর হারুণফাটা মার্কা গলায় গান গাইবি না, বাড়ি থেকে পাছায় লাত্থি মেরে বের করব তোকে।ʼʼ
জয় ভাব নিয়ে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্টের পকেটে একহাত রেখে দাঁড়াল, “তোমার বাপের এই ঘুনপোকা ধরা ভেঙরি বাড়িতে আমি আছি, শুকরিয়া আদায় করো!ʼʼ
-“বিশাল কামাই করছিস থেকে! যা ভাগ!ʼʼ
-“ও তুমি বুঝবা না, ব্রোহ! মামির কাছে জিজ্ঞেস কোরো, সে বুঝিয়ে দেবে, আমি হলাম সোনার ডিম দেয়া রাজহাঁস!ʼʼ অকপটে খোঁচা মারা কথা বলে দাঁড়িয়ে রইল জয়।
হামজা হাই তুলে বলল, “যা, গিয়ে পড়তে বস। তার আগে ওখান থেকে আমার তোয়ালেটা দে।ʼʼ
জয় চোখ ছোট করে তাকায়, “ক্যান, তুমি উঠতে পারতেছ না? পরনে কোনো জাঙ্গিয়া-টাঙ্গিয়া নাই নাকি?ʼʼ
একলাফে বিছানা থেকে নামল হামজা, দাঁত খিঁচল, “এদিকে আয় হারামি, তোর জাঙ্গিয়া খুলে তোকে শহর ঘুরিয়ে আনবো আজ আমি!ʼʼ
দৌঁড়ে ঘর ছাড়তে ছাড়তে জয় চেঁচায়, “ছিহ ভাই! ছোট ভাইয়ের ইজ্জত মানে জাঙ্গিয়া নিয়ে টান পাড়াপাড়ি করতে বাঁধলো না তোমার? আমি ভার্জিন একটা, সরল-সহজ নিরীহ ছেলে, ভাই! সব রেখে সোজা জাঙ্গিয়াতে হামলা? নাউযুবিল্লাহ! এই মুখ আর সমাজে দেখানোর যোগ্য রাখলে না আমার!ʼʼ
পা থামিয়ে হেসে ফেলল হামজা। হাতের কুশনটা সজোরে ছুঁড়ে মারল। ততক্ষণে জয় রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। গোসলে যাবার জন্য তোয়ালে ঘাঁড়ে করে রিমিকে ডাকল কয়েকবার। কোনো জবাব এলো না, বরং খানিক বাদে তরু এলো, “কী হয়েছে, বড় ভাইয়া? কিছু দরকার?ʼʼ
গম্ভীর চেহারায় মাথা দুলালো হামজা, “হুম, তোর ভাবীকে দরকার!ʼʼ
মুখ লুকিয়ে ফিক করে ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল তরু। দ্রুত বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। কিছুক্ষণ বাদে রিমি এলো, তার মুখ ভার। এসেই বিছানা গোটাতে শুরু করে রিমি। হামজা এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জাপটে ধরল রিমিকে, কাধের ওপর থুতনি ঘষে বলল, “কী হয়েছে মেডামের? কথা না বলার ব্রত রেখেছেন নাকি?ʼʼ
রিমি ছাড়ানোর চেষ্টা করল হামজাকে, হামজা আরও শক্ত করে পেট চেপে ধরল। তার লোমশ বুকটা ঠেকল রিমির পিঠে। দমল না রিমি, মুচরামুচরি করছে খুব। হামজা এবার রিমির হাত দুটো মুঠো করে চেপে ধরে নিজের দিকে ঘোরালো। হামজার বিশালদহী শরীরের তুলনায় নেহাত ছোটোখাটো অভিমানিনী মেয়েটা। হামজা কপট চিবিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে, এমন করছ কেন? আমার দিকে তাকাও, রিমি!ʼʼ
তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় রিমি, জবাবদিহি চাওয়ার মতো শক্ত মুখে বলে, “মাজহার ভাইকে মেরেছেন আপনি? কেন?ʼʼ
হামজা নরম হলো, ব্যান্ডেজ করা হাতটা শিথিল করে রিমির থুতনিতে বুলাতে বুলাতে বলল, “তোমাকে বলেছি না! আমার কাজ এবং পার্টির ব্যাপারে না ভাবতে। এসব বিষয় তোমার মাথায় রাখতে হবে না, এই নিয়ে রাগ করে আছ? চ্যাহ! আমার দিকে তাকাও, এদিকে দেখো!ʼʼ থুতনি উচিয়ে ধরল হামজা।
এবার যেন ক্ষোভ ঝরে পড়ল রিমির গলা দিয়ে, তড়াক করে মুখ সরিয়ে নিলো, “আপনার পার্টির ব্যাপার? এটা আপনার পার্টির ব্যাপার বলে মনে হয়? মাজহার আমার চাচাতো ভাই!ʼʼ জোর গলায় বলল।
হুট করে হামজা শক্ত হলো যেন, ঘাঁড় কাত করল, “আর আমি?ʼʼ
-“আর আপনি কী? অমানুষ স্বামী আমার! তাই তো? মাজহারকে ওভাবে কেন মেরেছেন জানোয়ারের মতো?ʼʼ
-“আমার ক্ষতগুলো নজরে আসছে না তোমার?ʼʼ
-“আপনার ক্ষত? সেটা মাজহারকে মারতে না গেলে তো হতো না! ওকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কতটা মারলে তা করতে হয়? কী মার মেরেছেন ওকে? মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন? ও আপনাকে আগেই মেরেছে? নাকি আপনার জানোয়ার মার্কা হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আপনাকে আঘাত করেছে?ʼʼ
হামজা শাসিয়ে উঠল, চোখ লাল হয়ে উঠেছে তার, ওভাবেই চিবিয়ে বলল, “মাজহার জয়কে মেরেছে। তুমি বেশি কথা বলছো, রিমি!ʼʼ
-“একদম ঠিক বলেছেন, নেতাবাবু! আজ একটুও কম কথা বলার ইচ্ছে নেই আমার। জয়কে মেরেছে বলে আপনি ওকে মেরে ফেলার মতো করে মারবেন?ʼʼ
কথা শেষ না হতেই বলে উঠল হামজা, “জীবিত কবর খুঁড়ে মাটি দিয়ে দেব। বুঝেছ তুমি! কেউ জয়ের গায়ে হাত লাগালে, তার হাতটা গুঁড়ো করে ফেলব ভেঙে।ʼʼ চিবিয়ে উঠল হামজা।
-“বাহ বা! নেতাবাবু! জয়ের সামনে সবাই পর? আর আপনি আপনার শীতল স্বভাবের বিপরীতে এক পশুর সমান? কেউ আপনার কেউ না? আমাকেও চিনতে পারছেন না? জয় এতই আপন আপনার?ʼʼ
-“তুমি তোমার নিজের কথা বলোনি, রিমি! মাজহারের হয়ে উকালতি করছো, দরদ দেখাচ্ছ। কেন? সে তোমার চাচাতো ভাই বলে? ওয়েল! তাহলে, জয় আমার জান। এবার বোঝো, ওর শরীর থেকে
র ক্ত ঝরলে আমার কোথায় ব্যথা লাগে! তোমার চাচাতো ভাইকে বলে দিও, দরকার পড়লে আমাকে যেন কুপিয়ে চারভাগ করে ফেলে আমার ওপর রাগ থাকলে, কিন্তু জয়ের গায়ে আঁচ লাগলে, জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলব!ʼʼ
রিমি অবাক হবার সাথে সাথে কেঁদে ফেলল, গলা ও থুতনি ভেঙে এলো তার, “তার মানে আপনার কাছে নিজের অথবা আমার কোনো মূল্য নেই?ʼʼ এগিয়ে এসে হামজার ব্যান্ডেজ করা কব্জিতে হাত রাখল আলতো করে, “আপনার কিছু হলেও সমস্যা নেই? আমি তারপর ভেসে বেড়াব আপনাকে ছাড়া, তাতেও সমস্যা নেই আপনার? শুধু জয়ের কিছু হলে ব্যথা লাগে আপনার বুকে?ʼʼ
-“অবুঝের মতো কথা বলো না!ʼʼ হামজা নরম হয়ে উঠল যেন রিমির কান্নাভেজা মুখের দিকে চেয়ে।
-“অবুঝের মতো তো এতদিন ছিলাম! আজ প্রথমবার বুঝলাম, আমার জায়গাটা কোথায় আপনার জীবনে! আমি শুধুই একটা অপশন অথবা উদ্বাস্তু হয়ে রয়ে গেছি আপনার কাছে! সামান্য এক জয়ের জায়গা নিতে পারিনি আপনার ভেতরে..ʼʼ
হামজা ছটফটিয়ে উঠল, “আমায় রাগিও না, রিমি! এই চিনেছ এতদিনে আমায়? একটা মানুষের ভেতরে সবার জন্য আলাদা আলাদা স্থান থাকে। জয়ের জন্যও তেমনই আলাদা একটা বিশেষ স্থান আছে আমার ভেতরে! তার মানে এই নয়, তোমাকে আমি ভালোবাসি না। ভালোবেসেই বিয়ে করে এনেছিলাম, ভুলে বসেছ সব? এক চাচাতো ভাইয়ের খাতিরে তুমি আমার অবস্থান ভুলে যাচ্ছ মনেহয়!ʼʼ
-“আপনিও তো জয়ের সামনে আমার অবস্থান ভলে বসেছেন।ʼʼ
-“শুরুটা কাল রাত থেকে তুমি করেছ, রিমি! আমি যখন জখম হয়ে রুমে এলাম, তোমাকে ডেকেও বারান্দা থেকে রুমে আনতে পারিনি, শরীরের ব্যথা নিয়ে ওভাবেই কাতরাতে কাতরাতে শুয়ে পড়েছি। তারপর টের পেয়েছিলে, জয় উঠে এসে কম্বল টেনে দিয়ে, ব্যথার ওষুধ খাইয়ে, আবার একচোট ঝগড়া করে গিয়েছে রুম থেকে? জয় আমার জীবনে বিশেষ কিছু, এটা অনস্বীকার্য সত্য!ʼʼ
-“বিশেষ নয়, গোটাটাই ওর আপনি!ʼʼ
-“না বুঝে কথা বোলো না। জয় পুরো দুনিয়ার জন্য জঘন্য এক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠলেও, সেদিনও আমার কাছে, এবং চিরদিন ও আদরের। লোকের সাপেক্ষে না, আমার সাপেক্ষে বিচার করলে ওকে ভালোবাসা আমার জন্য জায়েজ। কোনোদিন ওর শার্টটা খুলে পিঠের দিকে নজর দিও। দেখতে পাবে, এখনও দগদগে একটা ঘায়ের দাগ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে পিঠে। যখন তুমি এসেছিলে না আমার জীবনে তোমার ভালোবাসা নিয়ে, যখন নেতা হয়ে উঠিনি আমি, ভিসি নির্বাচনের আগের রাতে, সেকালেও জয় নিজের শরীরে গুলি খেতে আমার সামনে এসে পিঠ পেতে দিয়েছিল, যখন আমি ছাত্রনেতা হয়ে উঠিনি। ওর সেই পিঠ পেতে খাওয়া গুলি আজ আমায় বাঁচিয়ে না রাখলে তোমার ভালোবাসা অবধি পৌঁছাতাম না আমি। তার আগেই আমার কিচ্ছা ফুরিয়ে যেত। আমার বুকের গুলি পিঠে খাওয়া ওই নষ্ট ছেলেটাকে এই হামজা পাটোয়ারী খুব ভালোবাসে। ও আমার ফুপাতো ভাই না, আমার জান! পর্ববর্তিতে তুমি ওর বিপক্ষে কোনোদিন কথা বলতে এসো না, আমি চাই না এ নিয়ে কোনো ভাগাভাগি হোক! আমার জীবনে জয়ের তুলনা শুধু জয়, ও আসলেই আমার বিজয়-জয়।ʼʼ
রিমি কেন জানি ফুঁপিয়ে উঠল। জেদি, অভিমানী মেয়ে এসবের কিছু বুঝল নাকি নিজের ভাবনাতে অটল রইল কে জানে! হামজা দুটো শ্বাস নিয়ে রিমির একদম কাছে গিয়ে দাঁড়াল, “রাজনীতিবিদের বউ হতে গেলে বহু পারিপার্শ্বিক বুঝ আর ধৈর্য্য থাকতে হয়। আমি ভাবতাম, তোমার তা আছে। আজ তা ভুল লাগছে। মাজহার তোমার চাচাতো ভাই হওয়ার আগে, আমার প্রতিপক্ষ। তার সঙ্গে ঝামেলা হলে তুমি তোমার স্বামী অথবা ভাই, কার পক্ষে থাকবে সেটা তোমার বিষয়। কিন্তু আমি আমার গতিবিধি থেকে পিছপা হতে পারি না, রাজনীতিতে চলতে গেলে, বহু সম্পর্কে জবাই করে সামনে এগোতে হয় এক পা এক পা করে। তাই করে এগিয়েছি!ʼʼ
-“তাহলে জয়কে জবাই করেননি কেন আজও? ওর সাথেকার সম্পর্ককে জবাই করবেন কবে?ʼʼ
কপাল জড়িয়ে ফেলল হামজা, খানিক পরে ধাতস্থ হয়ে জবাব দিলো, “ও কখনও আমার পথে বাঁধা হয়ে আসেনি।ʼʼ
-“আর যদি আসে?ʼʼ
কিছুক্ষণ রিমির জেদি মুখের দিকে চেয়ে কেন যেন থেকে হেসে ফেলল হামজা, “তুমি দেখছি জয়কে নিজের সতিনের মতো হিংসা করো!ʼʼ
একরোখা কণ্ঠে বলল রিমি, “তার চেয়েও খারাপভাবে। আমার ওকে সহ্য হচ্ছে না, একটুও না।ʼʼ
-“কেন?ʼʼ
-“ওর কাছে গিয়ে আপনি ভাগ হয়ে গিয়েছেন আমার থেকে। আজ আমার সাথে চোখ রাঙিয়ে, আমাকে শাসিয়ে কথা বলতে দ্বিধা করেননি। আর কিছু বললে গায়ে হাতও তুলতেন!ʼʼ
এবার হামজা একটু সপ্রতিভ হলো। কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে নরম সুরে নিজেকে উপস্থাপন করার সুরে বলল, “এতটা নিচু আর কাপুরুষ আমি কখনোই হতে পারব না, যে কোনো নারী, বিশেষ করে তোমার গায়ে হাত উঠবে। আর সবটাই ভুল ধারণা তোমার!ʼʼ
অভিমানে জড়ানো কণ্ঠে বলল রিমি, “তাই হোক, তবে এই ভুল নিয়েই বাঁচতে চাই।ʼʼ
-“এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তুমি।ʼʼ
রিমি কথা বলল না আর। মাথা নুইয়ে নিলো। বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল হামজা রিমির নত মুখটার দিকে। চঞ্চল, জেদি এই নারিটির অচঞ্চল ভাব খুব ব্যথা জাগায় হামজার পুরুষ মনে। কোনো নারী দুঃখিত হলে তার নিজেকে বাজে ধরণের কাপুরুষ বলে মনে হয়। সেই মুহুর্তে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল এবার রিমির থুতনি বেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে গাল উঁচিয়ে ধরল রিমির। নোনা পানিটুকু মুছে দিয়ে কপালে একটা শব্দ করে চুমু খেল হামজা। নিজেকে গুটিয়ে মুখটা রিমির মুখের সমানে রেখে নিচু স্বরে বলল, “রাত থেকে তোমার সেবা পাইনি, খুব পিপাসার্ত আমি, সাথে অসুস্থ তো বটেই। শরীরের ব্যথা আরও বেড়েছে তোমার সেবা না পেয়ে। এবার একটু আরাম দাও, আমায়।ʼʼ এরপর একটা শ্বাস ফেলে ক্লান্ত স্বরে বলল, “আই ব্যাডলি নিড ইউ, বউ। আসলেই একটা মানুষের ভেতরে আলাদা আলাদা মানুষের জন্য আলাদা স্থান থাকে। কারও জায়গায় প্রতিস্থাপিত হয়ে কেউ সেই জায়গাটা পূরণ করার সক্ষমতা রাখে না। যে শান্তি ও সুখটুকু তোমাকে কাছে আছে, তা জয় দিতে পারবে না আমায়। জয়ের হাতের ছোঁয়ায় তা পাব না আমি। তার জন্য তোমাকে প্রয়োজন, শুধুই তোমাকে।ʼʼ
হামজা আজ বের হলো না। জয়কে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তারও বের হওয়া যাবেনা। অথচ সকাল দশটা অবধি ঘরে বসে থেকে দম আটকে গেল জয়ের। তরু এসে দুবার দেখে গেছে। ওষুধ দিয়ে গেছে সকালে।
এরপর থেকে ছাদে বসে আছে। ছাদে দুটো বিভাজন। ছোট্ট এক টুকরো জায়গা তরু জয়ের কাছে চেয়ে নিয়েছে শখের ফুল গাছের টবগুলো রাখার জন্য। বাকি প্রকাণ্ড ছাদটা জয়ের চিলেকোঠা, ছোটো আমগাছ, আর বাকিটা কবুতরের খাঁচা। পুরো ছাদটাই কবুতরের বসতি হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। কবুতরগুলোকে দানা দিয়ে, তাদের পাশেই চিলেকোঠার এক কিনারায় বসেছে বই মেলে।
তরু এসেছিল কয়েকবার দেখতে। শরীর ভাঙা, অথচ জেদ করে যেন বসে পড়ছে রোদে গা এলিয়ে। পরে গোছলের পানি ভরে, জিজ্ঞেস করতে এসেছিল, জয় গোসল করবে কিনা! জয়ের নাক লাল, কণ্ঠস্বর বসে গেছে, বারবার নাক টানছে। তরুর কাছে মাথা ব্যথার ওষুধ চেয়ে নিলো বেলা এগারোটার দিকে। জ্বর আসেনি এখনও, তবে ঠান্ডা লেগে গেছে ভালো রকমের।
ছাদে পা মেলে বসে, কোলের ওপর বই রেখে তাতে চোখ বুলাচ্ছে আবার কখনও পাশ থেকে গিটারটা তুলে নিচ্ছে, তো কখনও ঠান্ডা হয়ে পড়ে থাকা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে দেখল অগোছালো এই জয়কে তরু। কাছে গিয়ে উবু হয়ে বসে একবার জিজ্ঞেস করল, “শরীর খারাপ লাগছে?ʼʼ
জয় বিরক্ত স্বরে বলল, “না লাগার কথা? ঊনিশ শতকের মেয়েলোকের মতো ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছি, তো শরীর আর মন আবার লুঙ্গিডান্স দেবে নাকি এই অবস্থায়! যা তো তুই! কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করিস না, মা! মেজাজ চটে যাচ্ছে যেকোনো কিছুতেই! যাহ!ʼʼ
দুপুর দেড়টার দিকে এই শরীরেই বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। সম্ভব নয় এভাবে ঘরে পড়ে থাকা। হামজা তখন ব্যথার ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে নিজের রুমে।
—
বেশ ভালো রোদ বেরিয়েছে দু’দিন বাদে। আগের দু’দিন সূর্যের তেজ কম ছিল। ক্লাস শেষে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে শহীদ মিনারের সম্মুখে এসে দাঁড়াল অন্তূ। সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার আর দিনকয়েক বাকি আছে। একটা ছেলের কাছে স্যার কিছু নোট দিয়েছে, তার কাছ থেকে নিয়ে নিতে বলা হয়েছে। অন্তূ তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল ওখানেই। সেই সময় কে যেন ডেকে উঠল পেছন থেকে। কণ্ঠস্বরটা মস্তিষ্কের স্মৃতিতে পৌঁছানো মাত্র চোয়াল শক্ত হলো অন্তূর। জয় আবার ডেকে উঠল, “অন্তূ!ʼʼ
পেছন ফিরে তাকাল অন্তূ। প্যান্ট-শার্টের ওপর সাদা রঙা বিশাল একটা শাল জড়ানো জয়ের শরীরে। উদ্ভট ব্যাপার। ভালো রকমের রোদ বেরিয়েছে, তাতে এই চাদরের প্রয়োজন নেই। চোখ-মুখ বিমূঢ় দেখাচ্ছে, কণ্ঠস্বর বসে গেছে। ঘৃণায় চোখ নত করল অন্তূ। জয় সামনে এসে দাঁড়াল, “তোমার নাম কে রেখেছিল?ʼʼ
-“আপনার কাছে প্রয়োজনীয় কোনো টপিক থাকে না, তাই না? অবশ্য যুক্তিযুক্ত বিষয় আপনার সাথে যায়ও না!ʼʼ
নাকে হাত চেপে আঙুল ঘষাঘষি করে নাক টানলো জয়, এরপর হাসিমুখে সুন্দর করে বলল, “থাপড়ে তোমার মুখের নকশা বদলে দিই, তার আগে প্রশ্নের উত্তর দাও!ʼʼ
অন্তূ বিরক্তি গিলে চোখ বুজে বলল, “আব্বু রেখেছ। এখন আমি যাই?ʼʼ
জয় যেন শুনতে পেল না শেষের কথাটা। প্রথমটার প্রসঙ্গে বলল, “তোমার বাপ এই ভেটকি মার্কা নাম ছাড়া মুল্লুক ঘুরে আর কোনো নাম পায় নাই? অন্তূ, আরমিণ! কীসব বেওড়া নামের বাহার!ʼʼ
অন্তূ নাক কুঁচকে তাকাল, কীসব ভাষা! এসবের আদৌ কোনো অর্থ আছে? অন্তূর জয়ের সামনে দাড়ালে নিজেকে খুব অসহায় লাগে, একটা ঘৃণ্য, অসহ্য মানুষের সামনে না চাইতেও মুহুর্তের পর মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, কথা বলতে হয়। এর চেয়ে বড়ো সহায়হীনতা আর কী হতে পারে? অন্তূ বেশ স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেবার চেষ্টা করল, “তখন গিয়ে শুধরে দিয়ে আসতেন, তা তো আর দেননি। এখন সেই পুরনো পুঁথি গাওয়ার মানে হয়না। কোনো প্রয়োজন আছে আমার সঙ্গে?ʼʼ
চমৎকার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, “হু! আছে তো, সুইটহার্ট! তোমার সাথে বহুত প্রয়োজন আছে আমার। তবে আপাতত কথা আছে তোমার সঙ্গে।ʼʼ
-“আমার সঙ্গে কী কথা আছে আপনার?ʼʼ নাক শিউরে উঠল অন্তূর।
জয় পিছনের দলের উদ্দেশ্যে মুখ বেঁকিয়ে অসহায়ত্বের ভান করে বলল, “উফফ! কেউ বোঝা একে, আমার সাথে তেজ না দেখাতে। আমি ডিস্টার্বড হই খুব।ʼʼ
অন্তূ তাড়া দিলো, “জলদি বলুন। আমার কাজ আছে।ʼʼ
জয় নাক টানলো আবারও, গলার স্বর বসে গেছে, শুনতে আতিফ আসলামের মতো লাগছে কণ্ঠস্বর, “উহহু রে! এত হুটোপাটা করলে তোমাকে দেখতে আরও বেশি গরম লাগছে, সুইটহার্ট!ʼʼ
অন্তূর খুব কানে লাগল কথাটা। কপাল জড়িয়ে ফেলল, “সুইটহার্ট!ʼʼ
কাধ ঝাঁকালো জয়, “ইয়াপ! সুইট-হার্ট! আমার সাপেক্ষে তুমি একটা সুইটহার্ট। আমি তো ভালো না। অথচ তোমার কাছে একটা সুন্দর, মিষ্টি হৃদয় আছে, সুতরাং তুমি সুইট-হার্ট অথবা মিষ্টি-হৃদয়!ʼʼ
জয় যে এসব ওকে জ্বালাতে বলছে, রসিকতা কোরে, তা বুঝে অন্তূ তাচ্ছিল্য হাসল, “সেই সূত্র অনুসারে তো আমি সকলেরই সুইট-হার্ট!ʼʼ
জয় হুট করে দাঁতে দাঁত পিষলো, “জানে মেরে ফেলব, খালাস হয়ে যাবে একদম দুনিয়া থেকে, আমি বাদে তুমি আর যার যার সুইটহার্ট! আমি ডেকেছি এই নামে, সুতরাং শুধুই আমি ডাকব।ʼʼ
নিজস্বতা দেখানোর এই ভঙ্গিমাটাও কেবলমাত্র জয়ের রসিকতারই অংশ, বুঝে অন্তূ চুপ রইল।
জয় আবার বলল, “চলো! কোথাও বসি!ʼʼ
অন্তূ হাসল, “আপনার মাথা নষ্ট, রাইট?ʼʼ
ঘাঁড় নেড়ে সম্মতি জানায় জয়, “তা একটু আধটু অবশ্যই! তাই বলে তুমি খোঁটা দিতে পারো না
আমায়!ʼʼ ঢং কোরে নাটকীয়তার সাথে বলল জয়।
অন্তূ সুন্দর করে হাসল, “নাটক শেষ হয়েছে আপনার? শো শেষ হলে এবার আমি যাই?ʼʼ
জয় মাড়ির দাঁতে জিহ্বা ঠেকিয়ে হাসল, “নাটক ভালো লেগেছে তোমার? ভালো লাগলে আর একটু করি!ʼʼ
-“খুব বাজে ছিল!ʼʼ
জয় ঘাঁড় চুলকালো, “হু! শুনেছিলাম, প্রেমে পড়লে মানুষের মেধা হারিয়ে যায়। আমারও নাটক কথার গুণ হারিয়ে গেছে, তোমার প্রেমে পড়ে। উফফ! কী যে প্রেম প্রেম পাচ্ছে তোমায় দেখে! এত প্রেম কেন তোমার মধ্যে? প্রেমের গোডাউন যেন!ʼʼ
জয়ের নাটক দেখে অন্তূর ঘৃণার উদ্রেক হওয়ার সাথে সাথে হাসিও পেল। একটা মানুষ কতটা খারাপ মানসিকতার হলে কাউকে জ্বালাতন করতে এমন বাজে পন্থা অবলম্বন করতে পারে?
শহীদ মিনারের সিঁড়ির ওপর বসে পড়ল জয়। বসার সময় চাদর উঠে গেল খানিকটা হাতের ওপর থেকে। তাতে অন্তূর নজরে এলো, জয়ের ব্যান্ডেজ করা হাতটা। হুট করে কৌতূহল জাগলেও পর মুহুর্তে টের পেল তার কেন জানি খুব শান্তি লাগছে ভেতরে, জয়ের ক্ষত দেখে। পৈশাচিক এক আনন্দ খেলছে। যে লোকটা একটা মেয়েকে রোজ নিয়ম করে এভাবে হ্যারাস করতে পারে, তার শরীরে যে লোক আঘাত করতে পেরেছে, তাকে খুব করে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করল অন্তূর। জয় দিনদিন ওর কাছে এক জঘন্যতম, নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য চরিত্র হয়ে উঠছে। নিত্যদিনকার এক ঘোর আজাবের নাম, জয়। এই যে ভার্সিটির মাঠে বসে এভাবে ওকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, লোকে দেখছে। প্রতিদিন এই ব্যাপার নিয়ে নিত্য নতুন কাহিনির উৎপত্তি হয়ে চলেছে গোটা ভার্সিটি জুড়ে। জয় অন্তূর ভাবনা ছিন্ন করে হুট করে বলল, “অন্তূ!ʼʼ
অন্তূ যেন খুব মনোযোগী জয়ের কথায়, এভাবে তাচ্ছিল্যের সাথে জবাব দিলো সঙ্গে সঙ্গে, “হু!ʼʼ
-“চলো বিয়ে করে ফেলি! কত বয়স হয়ে গেল আমার, কতকাল একা ঘুমাব অত বড় বিছানায়?ʼʼ
অন্তূ অতি ধৈর্য্যের সাথে হাসল, “ভাবনাটা ভালো। তবে সব ভাবনা বাস্তবায়িত করতে হবে কেন?ʼʼ
জয় দুপাশে মাথা দুলায়, “ভাবনা বাস্তবায়িত না করলে চলে। কিন্তু, চাহিদা! সেটা পূরণ না করলে কী করে চলবে?ʼʼ
ঠোঁট উল্টে সায় দিলো অন্তূ, “যুক্তি আছে যুক্তিতে! এই সৌভাগ্য আমার কোনো নেকির ফল, যে আমি আপনার চাহিদা হয়ে উঠেছি!ʼʼ
জয় বেশ উৎসাহিত কণ্ঠে বলল, “এক্সাক্টলি! কোনো না কোনো নেকির কাজ তো করেছিলেই জীবনে, এজন্যই তো আমি তোমার প্রেমে মজে যাচ্ছি দিন দিন। কী জাদুটাই করলে, লালমরিচ তুমি! মেরে ফেলো আমায়!ʼʼ
কবীর একটু নড়েচড়ে উঠল এবার, কাশল গলা খাঁকারি দিয়ে। জয় দ্রুত পিছে ফিরল, “কী রে! তুই আবার অস্ত্র বের করছিস নাকি? আরে শালা, প্রেমিকার প্রেমে মরা আর তোর মতো ব্রয়লারের অস্ত্রের আঘাতে মরা এক না রে পাগলা! তার ওপর প্রেমিকার সামনে তোর হাতে জখম হয়ে মরলে মান-ইজ্জত কিছু থাকবে?ʼʼ
পেছনের ছেলেগুলো হেসে উঠল সশব্দে। অন্তূ ঠান্ডা চোখে চেয়ে রইল জয়ের বদমায়েশী হাসি ঝুলানো মুখটার পানে। কত সাবলীল ভাবে নাটকীয়তার সাথে নোংরা কথাগুলো অবলীলায় বলে চলেছে! অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “আপনার জরুরি কথাটা বললেন না এখনও!ʼʼ
তড়িৎ গতিতে জবাব দেয় জয়, “আ’লাভিউ! প্রেমে পড়ে যাও আমার!ʼʼ
অন্তূ হাসল, “এই জনমে তো না!ʼʼ
-“পরের জনম অবধি অপেক্ষা করতে বলছো?ʼʼ
-“জি, একদম! যেটার কোনো অস্তিত্ব নেই।ʼʼ
-“তাহলে তো যা হওয়ার আর করার, এই জনমেই করতে হবে।ʼʼ
-“এত খারাপ দিন আমার জীবনে কোনোদিন আসবে না।ʼʼ অন্তূর শীতলভাবটা কেমন ন্যাপথলিনের টুকরোর মতো বাষ্প হয়ে যাচ্ছে যেন, কড়া হয়ে উঠছে কণ্ঠস্বর।
জয় উঠে দাঁড়াল, “তোমার জীবনে এত ভালো দিন আমি রাখব না, যে তুমি আমায় ভালো না বেসে পার পাবে! চ্যালেঞ্জ কোরো না আমায়। আমি সিরিয়াস হয়ে গেলে খুব বাজেভাবে ফেঁসে যাবে!ʼʼ
কথাটা দারুণ প্রভাবিত করল অন্তূকে। কর্কশ গলায় বলে উঠল, “ধরুন, চ্যালেঞ্জ করলাম! এতটুকু দৃঢ়তা তো আমার এই আমির ওপর রাখি আমি, যে এমন কোনো দূর্বলতার অস্তিত্ব নেই এই জগতে, যেটা আপনার মতো সভ্যতাহীন, আদিম পশুকে ভালোবাসতে বাধ্য করতে পারে আমায়! যেখানে স্বয়ং মৃত্যুকে আমি চ্যালেঞ্জ করছি এর পেক্ষিতে। মরণ স্বীকার করলাম আপনার কথার বিপরীতে।ʼʼ
জয় হঠাৎ-ই সপ্রতিভ হয়ে উঠল, তার মুখটা গাঢ়, গভীরতায় ছেয়ে গেল। এতটা আন্তরিক ভঙ্গিতে আগে দেখা হয়নি জয়কে। সতর্ক করার মতো করে করে শান্ত স্বরে বলল জয়, “আরমিণ, তোমার এসব কনফিডেন্স আমায় আবার সিরিয়াস না কোরে তোলে, দেখো!ʼʼ
অটল হলো অন্তূর কণ্ঠস্বর। “আপনার এই কথাটাই আমার জিদের আগুনে কেরোসিনের দ্রবণ ঢালছে।ʼʼ
-“খুব খারাপভাবে হারবে তুমি!ʼʼ
-“খুব ভালোভাবে পিছু হটবেন আপনি। আমার মান-মর্যাদা ও সম্মান ছাড়া আমার এই গোটা জীবনে দ্বিতীয় কোনো পিছুটান বা দূর্বলতা রাখিনি আমি।ʼʼ তীব্র জিদ যেন দগদগ করছে অন্তূর উচ্চারিত প্রতিটা বাক্যে!
জয় আর কথা বলল না। চমৎকার মুচকি হাসল। যেন নীরবে মেনে নিয়ে গিলে ফেলল সে অন্তূর কথাটাকে। অন্তূ খুব ভালোভাবে বোঝে, জয় প্রথমদিন থেকে শুরু কোরে আবধির কোনো একটা দৃশ্যপটও মাথা থেকে সরাতে পারেনি। সেইসব মাথায় রেখে, সেসবের চ্যালেঞ্জগুলো মুখস্ত রেখেই অন্তূর সাথে সাবলীল ভঙ্গিমায় বারবার কথা বলতে আসে।
জয় মাথা দুলিয়ে ইশারা করল অন্তূকে চলে যেতে। অন্তূ দাপুটে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল ভার্সিটির ফটক পেরিয়ে। জিদে তার সর্ব-শরীরে বিদ্যুতের ছলকানির মতো তেজস্ক্রিয়তা নিসৃত হচ্ছে যেন। তার এই তীক্ষ্ণ আত্মমর্যাদার ওপর প্রতিনিয়ত ক্ষয়কারী আচরণ ঢালছে জয়। সহ্য সীমা পেরিয়েছে যেদিন জয় বাড়ি অবধি পৌঁছে গেছিল। কতই তো চুপ থাকল সম্মানহানি বা জয়ের আক্রোশের শিকার হবার ভয়ে, অথচ জয়ের থামার নাম নেই। প্রতিনিয়ত চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে তার নোংরামির মাত্রা। অন্তূর ভেতরে শক্ত করে এঁটে বেঁধে রাখা জিদের দুয়ারের গিঁটটা কখন জানি খুলে ফেলল আজ জয়! আর কোনো ভয় কেন জানি কাজ করছে না, জয়ের ওই নোংরা শান্ত হাসিটাও কোনো প্রভাব ফেলল না পুরো পথ অন্তূর ওপর। জিদে ঘেরাও করা এক ঘোরের মধ্যে পৌঁছে গেল বাড়ির দরজায়।
চলবে..
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। এখন কেউ এটা বলবেন না, নায়ক এমন বাজে চরিত্রের কেন হবে? আমি কিন্তু একবারও বলিনি জয় আমির নায়ক। এই উপন্যাসে নায়ক উহ্য, যেটা হয়ত শেষ অবধি খুঁজে পাওয়া গেলেও যেতে পারে, এবং সেটা খুঁজে নেবার ভার পুরোটা পড়ে পাঠকের। কোনো ট্রিপিক্যাল, প্রচলিত ধারার উপন্যাস থেকে আলাদা এটি। নায়ক-নায়িকার স্বাভাবিক প্রণয় নিয়ে এগোবে না উপন্যাসের গতিবিধি। ভালোবাসা আমার পাঠকসকলকে🤍]