অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ২.

0
153

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
২.

ক্লাস শেষে খুব ক্লান্তবোধ হলো খুব অন্তূর। তবুও ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে অন্তূ চলল প্রফেসরের কামরার দিকে। তাকে ডাকা হয়েছে, ডাকার কারণ স্পষ্ট নয়। পিয়ন থামালো দরজার সামনে, “দাড়ান আপনে। স্যার বিজি আছে। মিটিং চলতেছে ভিতরে।ʼʼ

অন্তূ দাঁড়াল। ভেতর থেকে প্রফেসর ইউসুফ সিরাজীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “ভেতরে আসতে দাও ওকে।ʼʼ

অন্তূর একটু সন্দেহ হলো, কোনো গুরুতর বিষয়? সে প্রফেসরের মনোযোগে পড়েছে কেন? ভেতরে প্রবেশ করে সালাম জানাল। ইউসুফ সিরাজী মাথা নাড়লেন, “এসো!ʼʼ

আরও কয়েকজন বড়ো বড়ো শিক্ষক রয়েছেন কক্ষে, এবং টেবিলের সামনে ডানপাশে চেয়ারে বসে আছে এক লম্বামতো পুরুষ, পরনে পাঞ্জাবী, মুখে চাপদাড়ি। যার মুখভঙ্গি একদম স্বাভাবিক, নিচের দিকে তাকিয়ে আছে শীতল দৃষ্টি মেলে। একে অন্তূ চেনে, ভার্সিটির ছাত্র সংসদের সভাপতি— হামজা পাটোয়ারী। ইউসুফ সিরাজী জিজ্ঞেস করলেন, “সকালে কী হয়েছিল?ʼʼ

অন্তূ ইতস্তত না করে বলল, “আমাকে র‌্যাগ দেয়া হয়েছিল, স্যার!ʼʼ

-“সে তো আর নতুন কিছু নয়। তুমি কী করেছ?ʼʼ কড়া শোনাল প্রফেসরের কণ্ঠস্বর। অন্তূ দমল না, বলল, “আমাকে সিগারেটে টান…ʼʼ

-“আহ!ʼʼ ব্যাপারটা যেন শুনতে আগ্রহী নন স্যার, বিরক্ত হলেন, “তুমি কী করেছ সেটা বলো!ʼʼ

অন্তূ স্যারের সম্মানে বিনয়ের সঙ্গে তবে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমাকে ধূমপান করতে বলা হয়েছিল, স্যার। আর তাতে অভ্যস্ত নই আমি। তাই সিগারেটটা নিয়ে ফেলে পা দিয়ে নষ্ট করে দিয়েছি।ʼʼ

মুখভঙ্গি শক্ত হলো প্রফেসরের। চোখ পাকালেন তিনি, চাপা স্বরে ধমকে উঠলেন, “এই শিখেছ? কার সঙ্গে এই আচরণ করেছ কোনো জ্ঞান আছে সে বিষয়ে? অভদ্র মেয়ে! সিনিয়রদের সঙ্গে এই আচরণ শিখেছ এতদিনে? আদবের বালাই নেই ভেতরে! তুমি জানো, এতে তোমার এডমিশন ক্যানসেল হতে পারে? নাম কী?ʼʼ

অন্তূ অবাক হলো, উল্টো তাকে ব্লেইম করা হচ্ছে! অবশ্য চমকানোর কিছু নেই। দুনিয়ার সংবিধানের নাম যেখানে অরাজকতা ও সুশাসনহীনতা! সেখানে এটা নেহাত স্বাভাবিক ব্যাপার! নাম বলল সে, “মাহেজাবিন আরমিণ অন্তূ।ʼʼ

-“বাবার নাম?ʼʼ

একটু ভয় হলো অন্তূর, এসব আব্বুর কানে গেলে…আব্বু সম্মানী মানুষ, তামাশা নিতে পারবেন না। জবাব দিলো, “আমজাদ আলী প্রামাণিক।ʼʼ

-“স্কুল মাস্টার আমজাদ নাকি?ʼʼ

-“জি!ʼʼ

-“এখনও মাস্টারি করে?ʼʼ

-“জি না। রিটায়ার করেছেন বছরখানেকের মতো।ʼʼ

ইউসুফ সিরাজী হামজাকে জিজ্ঞেস করলেন, “হামজা! তুমি কিছু বলবে?ʼʼ

হামজার মুখভঙ্গি দুর্বোধ্য। বোঝার চেষ্টা করল অন্তূ, অথচ বিশেষ অভিব্যক্তি নেই মুখে। অন্তূর দিকে তাকাল না চোখ তুলে, মৃদু একবার ঘাঁড় নেড়ে দাম্ভিকতার সাথে ডানহাত তুলে ইশারা করল অন্তূকে বের হয়ে যেতে। জলদ গম্ভীর প্রতিক্রিয়া তার।

কক্ষ থেকে বেরিয়ে অন্তূ থমকাল। সে কি কোনো অনিশ্চিত ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছে! কোনো ফ্যাসাদের আভাস ছিল এসবের মাঝে? মনটা কু গাইছে খুব। একটা অজানা বিষণ্নতা টের পেল সে ভেতরে, যা যুক্তিহীন বলেও মনে হচ্ছে, আবার কিছু একটা খোঁচাচ্ছে ভেতরটায় খুব। ভিসি কেন বসেছিল ওখানে? আজ প্রথমবার অন্তূ হামজাকে এতো কাছ থেকে দেখল। আগে দেখেছে বিভিন্ন পোস্টার এবং প্রোগ্রামের ব্যানারে, নয়ত ভার্সিটি প্রোগ্রামে বক্তব্য দেওয়া বা নেতৃত্ব প্রদানের সময়।
শহীদ মিনার চত্বর পেরিয়ে যাবার সময় মেয়েলি ডাক কানে এলো। মেয়েটাকে পরিচিত, নাম তানিয়া। ওর দুই ইয়ার সিনিয়র। এগিয়ে গিয়ে বলল, “জি আপু!ʼʼ

-“আজ আবার কী হয়েছিল ভার্সিটিতে?ʼʼ

অন্তূ বসল সিড়ির ওপর, “আজ আবার? কেন, এর আগেও কি কিছু ঘটেছে নাকি ভার্সিটিতে?ʼʼ

তানিয়া জিজ্ঞেস করল, “কোন ইয়ার যেন তুমি?ʼʼ

-“সেকেন্ড ইয়ার।ʼʼ

-“ও আচ্ছা! ছুটিতে ছিলে তোমরা! ভার্সিটিতে হওয়ার কি আর কোনো কমতি আছে? একের পর এক হয়-ই। তোমার কী হয়েছে আজ, জয় আমিরের সঙ্গে?ʼʼ

অন্তূ কপাল জড়াল, “জয়?ʼʼ

প্রশ্নটা খুব অপছন্দ হলো তানিয়ার, বিরক্ত হলো, “দুই বছর ভার্সিটিতে পড়ছো, এবার কি বলবে জয়কেও চেনো না নাকি? ভার্সিটির ভিপিকে চেনো না? কাউন্সিলরের ছেলে হামজা পাটোয়ারীকে চেনো?ʼʼ

-“জি, চিনি।ʼʼ

-“আর ভিপি কে? হামজার ফুফাতো ভাই, জয় আমির।ʼʼ

-“ও আচ্ছা! জি চিনি তো, তবে নামের সঙ্গে মুখ চেনা নয় হয়ত!ʼʼ

তানিয়ার জয়ের হুলিয়া বর্ণনা করতে শুরু করল, “দুই বছর আগে এখান থেকে অনার্স শেষ করেছে। শ্যামলা বর্ণের লম্বা করে, থুতনির কাছে একটা তিল আছে। গলায় চেইন, তাতে J লেটার আছে। ডানহাতে ঘড়ি পরে আর বামহাতে ব্রেসলেট..ʼʼ

অন্তূর সেসব শুনতে ইচ্ছে করছিল না। বুঝল, যে তাকে সিগারেটে টান দিতে বলেছিল, সে-ই জয়! ভিপির এই আচরণ ভার্সিটির জুনিয়রদের সাথে? আর শুনতে চাইল না এই বিশদ বর্ণনা, দ্রুত মাথা নাড়ল, “জি, এবার চিনেছি।ʼʼ

-“কী করেছে ওরা তোমার সঙ্গে?ʼʼ এমনভাবে কথাটা বলল তানিয়া যেন কোনো বিশেষ গোপন রহস্যের ব্যাপারে খোঁজ করছে। অন্তূ বলল, “বিশেষ কিছু নয়, র‌্যাগ দিয়েছিল।ʼʼ

এবার তানিয়া আরও সতর্ক হয়ে উঠল, “আরে! লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না, এসব হতেই থাকে, বলো কী করেছে ওরা তোমার সঙ্গে?ʼʼ

অন্তূ অবাক হলো, “আশ্চর্য! লজ্জা পাওয়ার প্রশ্ন কেন উঠছে? বললাম তো, সাধারণ র‌্যাগ দিয়েছে। আর কীসব হয়ে থাকে?ʼʼ

তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠল তানিয়াসহ পাশের মেয়েগুলো। তানিয়া মুখ বিকৃত করে বলল, “কেন? তুমি বোধহয় জানো না, র‌্যাগিংয়ে মেয়েদের সাথে কী কী করা হতে পারে?ʼʼ

-“জি, জানি। তবে আমার সঙ্গে তেমন কিছু হয়নি।ʼʼ

তানিয়া কেমন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল, “তাই নাকি? যাক, তা যদি সত্যি হয়, তো ভালো। কিন্তু তুমি কী করেছ? তোমাদের নিয়ে কানাঘুষা চলছে ভার্সিটিতে। তোমার সাহস বেশি হয়েছে নাকি?ʼʼ

-“কানাঘুষা? কী কানাঘুষা চলছে? কানাঘুষার মতো কিছু তো হয়নি! আর সাহসের কী আছে এতে! যা আমার পছন্দ নয়, তাতে আমি সাফ মানা করে দিয়েছি।ʼʼ

তানিয়া চোখ উল্টালো, “মেয়ে, তোমার তো মাথায় দোষ আছে মনে হচ্ছে! তুমি সিনিয়রের সাথে বেয়াদবি করে এসে বলছো কানাঘুষার কিছু হয়নি! হয় তুমি পাগল, নয়ত বোকা অথবা দুঃসাহসী বলা যায়! কিন্তু এখানে দুঃসাহস টেকার না। তুমি সিনিয়রদের সাথে এরকম অবাধ্যতা করলে কোন সাহসে! জয়কে তো দেখছি তাহলে আসলেই চেনোই না তুমি? ভার্সিটিতে কি ঘাস কাটতে আসো, খবর বা রুলস কিছুরই জ্ঞান রাখো না নাকি!ʼʼ

অন্তূর খুব বলতে ইচ্ছে করল, ঘাস কাটতে যদি নাও আসি, তবে এসব খবর রাখতে নিশ্চয়ই আসি না! আসি পড়ালেখার জন্য, তা শেষ করে ফিরে যাই। চেপে গেল, শঙ্কিত হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যেই ভেতরটা। বুক আটকে আসা শ্বাস জড়ো হচ্ছে ভেতরে। ভয়টুকু সে চাপল ভেতরে, প্রশ্ন করল, “কীসের খবর রাখার কথা বলছেন?ʼʼ

মেয়েগুলো একে অপরের দিকে তাকাল, একটু তাচ্ছিল্যে হাসল সকলে। তানিয়া বলল, “এর আগে বহু মেয়ে ভার্সিটি ছেড়েছে জয়ের কারণে, তোমরা তখন এডমিশন নাওনি, তখন জয় ফাইনাল ইয়ারে ছিল, একটা মেয়ে হলের ছাদ থেকে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। ওরা কী করেছিল মেয়েটার সঙ্গে জানা নেই। কিন্তু একটা কথা পরিস্কার, জয় এক অভিশাপ! আবার ভালোও!ʼʼ

-“আবার ভালোও কেন?ʼʼ

-“রাজনীতির চাল বোঝো না? সমাজসেবার কাজবাজ করে দুই ভাই মিলে। পুরো ছাত্র সংগঠনের বেশ ভালোই যোগান দেয় দুজন। এক কথায় এরিয়ার লোকের মনোযোগ কেড়েছে নিজের নেতৃত্বের জেরে অথচ বখাটেপনা ছাড়তে পারেনি, তবে সেটার কোনো প্রমাণ থাকে না, বুঝলে!ʼʼ

অন্তূ একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের ছুটির মধ্যে কী হয়েছিল ভার্সিটিতে?ʼʼ

তানিয়া চারদিকে ভালোভাবে তাকাল কয়েকবার, বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইল। এরপর নিচু আওয়াজে বলল, “হামজার বাপ কাউন্সিলর এলাকার, তা তো জানো! আর হামজা এখনকার ভিসি, সাথে পুরোপুরি রাজনৈতিক নেতাকর্মী। আমাদের কমনরুমের আয়া সালমা খালাকে তো চেনো। ওনার বাড়ি হামজাদের ক্লাবের পাশে। ওনার ছোটো ছেলেটার হঠাৎ-ই কী থেকে যেন আঘাত পেয়ে কী হলো! পায়ে ক্যান্সার হলো। এরপর খালা বাড়ির জায়গা অর্ধেক দাম নিয়ে পাওয়ার-দলিল করে এক হিন্দুর কাছে বন্ধক রেখেছিল, বলা চলে বিক্রিই করেছিল। তবে শর্ত ছিল খালা নির্দিষ্ট সময়ে টাকা পরিশোধ করলে জায়গা ফেরত পাবে, যেহেতু বসত বাড়ি। কিন্তু চিকিৎসা করেও সেই ছেলে বাঁচেনি আর। একবছরের সময় ছিল, খালা সেই সময়ে টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। তার ওপর প্রতি মাসের কড়া সুদের টাকা জমে পুরো জমির দাম উসুল হয়ে গেছিল ওই লোকের। ওই লোক এরপর জায়গাটা খালাকে না জানিয়ে অন্য কারও কাছে বেঁচে দিয়েছিল। তারা এসে তাগাদা দিতে থাকল বাড়ি খালি করার। খালা সময় চেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু পরে বিচার শালিশ বোর্ডের কাছে চলে গেল। মানে মেয়র, কাউন্সিলর, এলাকার মাতব্বর, সমাজসেবকেরা সব ছিল। সব শেষে নাকি বিশাল ঝামেলা হয়েছিল। পরে হামজা আর জয় মিলে সালমা খালাকে সময় দিয়েছিল আরও কিছুদিন। তখন খালার বড়ো ছেলের বউ বাপের বাড়ি জায়গা বিক্রি করে এনে টাকা দিয়েছিলেন কাউন্সিলর হুমায়ুন পাটোয়ারীর কাছে। পরে আর খালা টাকা নিয়ে আসেনি। এরপর বেশ কয়েকবার হামজা ভাই বাড়ি খালি করতে বলেছিল খালাকে। তারা যায়নি, তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। কয়েকদিন হলো খালার মেয়ে আঁখিকে পাওয়া যাচ্ছে না। লোকে বলছে এদের মধ্যেই কেউ হয়ত আঁখিকে তুলে নিয়ে গেছে। জানা নেই মেয়েটার সঙ্গে কী হয়েছে, কী হালে আছে..ʼʼ

আর শোনার ধৈর্য্য হলো না অন্তূর! ছটফটিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোনোমতো কাটিয়ে বেরিয়ে এলো ভার্সিটির ক্যাম্পাস থেকে। বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ আন্দোলন চলছে, আওয়াজটা খুব কানে বাজছে, নিকাবের নিচে মুখটা ঘেমে উঠেছে। পানি পিপাসা বোধ করল। সে কি কোনো ভয়ানক পরিণতির আভাস পেল আজ! আঁখি! দেখেনি কখনও মেয়েটাকে, হৃদযন্ত্রটা খুব লাফাচ্ছে! আচ্ছা! আঁখি কোথায়? পাওয়া যাচ্ছে না কেন ওকে? সামনের দিনগুলো কি খুব অন্যরকম কাটবে জীবনে?


এরপর দু’দিন আর ভার্সিটিতে যায়নি অন্তূ। তার সাহসে জুটছে না। সেদিন তো জয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে এক ফোঁটাও আতঙ্কের উদ্রেক হয়নি, অথচ আজ দুটো দিন বুকে ভারী কোনো শঙ্কা চেপে আছে, নিশ্বাস-প্রশ্বাসে বাঁধা হয়ে আছে সেই শঙ্কাটুকু। আঁখি মেয়েটাকে সে দেখেনি কখনও, নাম ছাড়া কিছু জানা নেই। তবুও আজ দুটো দিন ঘরে বন্দি হয়ে ওই অপরিচিতা মেয়েটার জন্য পরাণ দাপায়। নিজের পরিণতি সম্বন্ধে মাথায় চেপে বসে অকল্পিত এক ভয়!

বাড়ির দরজায় ধাক্কা পড়ল। অলস ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সে। মার্জিয়া ভেতরে ঢুকেই হাতের ব্যাগটা ধপ করে মেঝেতে রাখল। অন্তূ বলল, “কী হয়েছে, ভাবী! ভাই আনতে যায়নি?ʼʼ

মার্জিয়া জবাব দিলো না। অন্তূ আবার বলল, “আপনি বোরকা খুলে আসুন, আমি খাবার আনছি, একসাথে খাই।ʼʼ

মার্জিয়া খ্যাকখ্যাক করে উঠল, “অ্যাই, নাটক করবা না তো, অন্তূ! সহ্য হচ্ছে না গায়ে।ʼʼ

অন্তূ স্বাভাবিকভাবে বলল, “গায়ে একটু ঠান্ডা পানি ঢেলে আসুন। ভালো লাগবে।ʼʼ

ছ্যাঁত করে উঠল মার্জিয়া, “তোমার মতো ডাইনির মুখে এর চেয়ে ভালো পরামর্শ শোনার আশা রাখিই বা কই আমি? কথাই বলো গা জ্বালানো সব।ʼʼ

-“কী হয়েছে? ক্ষেপে আছেন কেন? কার রাগ আমার ওপর দেখাচ্ছেন?ʼʼ

-“তোমার মতো মা তা রী ননদ থাকতে রাগ আর কার ওপর হবে?ʼʼ

অন্তূর কণ্ঠস্বর দৃঢ় হয়ে উঠল, “মুখ সংযত করুন আপনার। আপনি জানেন, বেশিক্ষণ আমি আপনার এই ছোটোলোকী আচরণ নিতে পারব না।ʼʼ

-“কী করবা তুমি? কী করবা ডাইনি, তুমি? আমার বোনের সংসার যেভাবে খাইতে লাগছো, আমারেও তাড়াবা এইখান থেকে?ʼʼ

অন্তূ হতবিহ্বল চোখে তাকাল ভাবীর দিকে। বোধগম্য হচ্ছে না এই সস্তা কথাগুলোর মানে কিছুই। রাবেয়া যোহরের নামাজে বসেছিলেন, দ্রুত সালাম ফিরিয়ে উঠে এলেন, “কী হইছে, মার্জিয়া। কীসব ভাষা এইসব? মুখ খারাপ করতেছ ক্যান?ʼʼ

মুখ ঝামটি মারল মার্জিয়া, “শখ আমার খুব যে, তাই।ʼʼ

অন্তূ বলল, “ভনিতা না করে রহস্য উন্মোচন করুন, আমি কী করেছি? আপনার শখ পরেও মেটাতে পারবেন।ʼʼ

মুখ বিকৃত করল মার্জিয়া, “জানো না তুমি, না? তাসিন যখন তোমার পিছেপিছে ঘুরছে তখন মন লাগে নাই। এখন যেই আমার বোনের সাথে বিয়ে হইছে, তোমার পিরিত জাগছে? কয়দিন খুব কবিরাজের কাছে গুরাঘুরি করলা দেখলাম মা-মেয়ে। তাই তো বলি, হঠাৎ-ই আমার বোন-জামাইরে দাওয়াত করে খাওয়াবা ক্যান তোমরা? অন্য মেয়ের ঘর ভাঙতে অন্য পুরুষকে জাদুটোনা করা, কবিরাজী গাছ খাওয়াচ্ছ, লজ্জা করে না তোমার? তাসিন বীথিকে তালাক দিতে চায়। ক্যান চায়? বেহায়া মেয়েলোক..

সশব্দে একটা থাপ্পড় মারলেন রাবেয়া মার্জিয়ার গায়ে, “আস্তে কথা কও। হুশজ্ঞান করে কথা কও। কী দিয়ে কী বলতেছ টের পাইতেছ না?ʼʼ

মার্জিয়া চিটপিট করে উঠল, “হু হু! আস্তেই তো বলা উচিত এসব কথা! নইলে পাড়ার লোকে আপনার মেয়ের আর আপনার কুকীর্তি জানলে কেলেঙ্কারি হবে যে! অথচ আপনি মেরে থামাতে পারবেন না আমায়। আমার বোনের ঘর ভাঙলে আপনার মেয়েকে দেখি এই বাড়িতে রাখে কে?ʼʼ

রাবেয়া গর্জে উঠলেন এবার মৃদু স্বরে, “আমার মেয়েকে বের করার বা রাখার তুমি কে? আমার মেয়ের বাপ-মা মরে যায়নি এখনও, যে তুমি আমার মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করবা! আমার মেয়েকে তাড়াবা, তার আগে আমি বের করতে পারব না তোমায়? এখনও বেঁচে আছে আমার মেয়ের বাপ।ʼʼ

-“বের হয়ে আসলো আসল মনের কথা, দেখলেন? এখন আমাকেও সংসার থেকে বের করার যে গোপন বুদ্ধি চলতেছে সেটাও বের হয়ে আসলো। আপনারা ক্যান পড়ছেন আমার আর বোনের পেছনে?ʼʼ

অন্তিক বাড়ি ঢুকল, “কী ব্যাপার! কীসের চেঁচামেচি চলতেছে?ʼʼ

মার্জিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, “এই বাড়িতে আমার জায়গা হওয়া না হওয়া নিয়ে লাগছে।ʼʼ

অন্তিক বুঝল না ব্যাপারটা, “মানে?ʼʼ

অন্তূ কপালে আঙুল চেপে চোখ বুজে ছিল। চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, “আল্লাহর ওয়াস্তে ভাবী, কথা ঘুরাবেন না। আর প্লিজ অপবাদ দেবেন না। আল্লাহ এমন না করুক, আপনার জিহ্বায় পোকা ধরল!ʼʼ

হায়হায় করে উঠল মার্জিয়া, কান্না মেশানো গলায় বলল, “অপবাদ দিচ্ছি? কেবলই আম্মা বলল না, আমাকে বাড়ি থেকে বের করার কথা?ʼʼ

অন্তূ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তার আগের পটভূমিটুকু ভুলে গেছেন? তার আগে কিছু হয়নি? হয়েছে? আপনি বাড়িতে বাড়িতে ঢুকার সাথে সাথেই আম্মা আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে রাইট? ভাবী, ইন্ডিয়ান বাংলা সিরিয়াল চলছে না এখানে। বাপ, মা তো একটাই আপনার তাই না? তাহলে গালে জবানও একটাই রাখুন, নয়ত জন্মের ব্যাপারে সন্দেহ চলে আসে আমার।ʼʼ

মার্জিয়া মুখে হাত চেপে ধরে স্বামীর দিকে তাকাল। কেঁদে ফেলল সে। রাবেয়া বেগম এসে দ্রুত মেয়ের মুখ চেপে ধরলেন। অন্তূ ঝটকা দিয়ে সরাল মায়ের হাত, “ছাড়ো তো! তোমার মতো সুশীলা, অবলা মা পাশে থাকলে মেয়ে যে কারও মুখের ভাষায় স্লাট হয়ে যাচ্ছে তবুও জবাব দেবার প্রয়োজনীয়তা দেখছ না। আমাকে তো দিতেই হবে জবাব, তাই না? আমার তো গায়ে সইবে না অপবাদ!ʼʼ

অন্তিক অন্তূর দিকে তাকাল, অন্তূর চোখের দৃষ্টি নির্লিপ্ত। ওই চোখে তাকিয়ে কেউ ওই নজরকে এড়িয়ে যাওয়া বা ভুল বোঝার ক্ষমতা বোধহয় রাখে না। জলন্ত, চিরন্তন সত্য দৃষ্টি! অন্তূ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নিম্ন অথচ দৃঢ়, সবল গলায় বলল, “ভাই, তুই আমার কথা বিশ্বাস কর বা না কর সেটা তোর ব্যাপার। তাসিন বীথিকে ডিভোর্স দিতে চায়, আর তা নাকি আমি আর আম্মা প্রতিদিন কবিরাজের কাছে ঘুরে কুফরী কালাম করে করাচ্ছি। এতখানি আত্মমর্যাদাহীন এবং কুসংস্কারচ্ছন্ন না আমি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটুকু অহংকার আছে আমার। তোর বউকে বোঝা, শিক্ষিত মেয়ে হয়ে মূর্খর মতো আচরণ এবং কাজকর্ম করলে আমিও কিন্তু অন্তূ! মিথ্যাচার সহ্য করার মতো চামড়া অন্তূর দেহে নেই?ʼʼ

মার্জিয়া আর্তনাদ করল, “কী করবা তুমি আমার সাথে? মারবা? যেমন কেবল তোমার আম্মা মারল?ʼʼ

-“আম্মা মারেনি আপনাকে। বরং কাজকর্ম অনুসারে প্রতি মুহুর্তে প্রতিটা মানুষের কিছু ন্যায্য প্রাপ্য থাকে, সেটাই মিটিয়ে দিয়েছে আম্মা আপনাকে।ʼʼ

অন্তিকের দিকে তাকিয়ে আবার বলল অন্তূ, “আব্বুর জণ্ডিস তা তো অন্তত জানিস! তাই বড়ো খালা বলেছিল গাছ-গাছরার ওষুধ খেলে জণ্ডিস রোগে বেশি কাজ করে। তাই আম্মা আর আমি কয়েকদিন ইউনানী না কী বলে, গাছ-গাছরার ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতে একজন গাছ-গাছরার চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলাম। সেই ওষুধ আব্বু এখনও খাচ্ছেই। তোর বউ এ বাড়িতে তামাশা না করলেই কি বেশি ভালো থাকবে না বাড়ির পরিবেশ? কী দরকার প্রায় দিন অহেতুক বিতর্কে নামার।ʼʼ

অন্তিক কোনো কথা বলল না। চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেল। অন্তূ আহত চোখে চেয়ে রইল বড়ো ভাইয়ের চলে যাওয়ার পানে। একরাশ ভাঙাচোরা যন্ত্রণা আর ঘেন্না বোধহয় জড়িয়ে এলো বুকটায়। সে বহুদিন ভাইয়ের সাথে প্রয়োজনীয় ছাড়া অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না, হাসে না, একসাথে খায় না। এক অপরিকল্প অনীহা এবং বিতৃষ্ণা জেগেছে সবকিছু বুঝে নির্বিকার থাকা অন্তিকের ওপর। এই যে এখন একটাও কথা না বলে চলে গেল রুমে। অন্তূ যদি যুক্তি-প্রতিবাদ না করতে জানতো, আজ নিশ্চয়ই বউয়ের কথায় অন্তূ নষ্টা মেয়ের কাতারে পড়ে যেত ভাবীর ভাষায়!

সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি, একটু আগে যে অল্প খিদে পেয়েছিল, তা এখন আর অনুভব হচ্ছে না। আস্তে করে নিজের ঘরে চলে গেল। পেছনে রাবেয়া বেগমের ফুঁপানোর আওয়াজ পেল, ফিরে তাকাল না।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here