অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ১২.

0
606

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

১২.

ভার্সিটির পেছনের নির্জন রাস্তা দিয়ে বের হলো অন্তূ। হঠাৎ-ই আজ ইচ্ছে করল চাঁদনীর সাথে দেখা করতে যেতে। আর একবারও ওদের বাড়িতে যাবার অবকাশ পায়নি, ভাবলেই একটা চাপা হতাশা ভর করতো দেহে। কিন্তু আজ যেতে ইচ্ছে করছে। বেশ কয়েকবার দোয়া-কালাম পড়ল। শয়তানের সাথে দেখা যেন না হয়ে যায়। অথচ শয়তান পিছু পিছু এসেছে, ওকে না জ্বালিয়ে ফিরে যাবে কেন?

“আরমিণ!ʼʼ

জয়ের ডাক! অন্তূর পা থমকাল! পেছন ফিরে তাকাল। জয় হাসল তার নিজস্ব ভঙ্গিতে, “তোমায় একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে খুব।ʼʼ ঠোঁটে ঠোঁট গুজলো জয় কথাটা বলেই।

অন্তূ চোখ বুজে গাঢ় শ্বাস ফেলল।

ঘাঁড়ে হাত দিলো জয়, “চ্যাহ! রাগছো কেন? মামা একটা বিয়ে করায়ে দেয় না। তার কোনো মেয়েই পছন্দ হয় না। কিন্তু আমার তো বয়স হয়েছে!ʼʼ চট করে হেসে ফেলল কথার মাঝেই, “আচ্ছা! যাও এখন চুমু-টুমু বাদ! বিয়ের পর মন ভরে চুমু খাব, ঠিক আছে?ʼʼ

অন্তূ ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। জয়ের ভয়ে পেছনের ছেলেরা জোরে হাসতে না পেরে সবগুলো মুখে রুমাল চেপে ধরেছে। জয় ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকাল, “হাসতেছিস ক্যান? আমার প্রেমিকাকে আমি চুমু খাই অথবা এখানেই… উপভোগ কর শালা, উপভোগ কর। হাসবি না। নো হাসাহাসি।ʼʼ

অন্তূ চলে গেল। জয় হাতের তালু উঁচিয়ে ধরল, “আরে.. কথা তো শুনে যাও..ʼʼ কথা অসম্পূর্ণ রেখে জোরে শব্দ করে গা কাঁপিয়ে হেসে লুটিয়ে পড়ল জয়। প্রানখোলা হাসি হাসছে সে। পা বাঁকিয়ে কুঁজো হয়ে দুই হাঁটুতে হাত রাখল। হাসি থামছে না ওর। ছেলেরা দেখল জয়ের মনখোলা অট্টহাসি। ওরাও হেসে ফেলল। কোনো মানুষই একক রূপী হয়না, সবারই ক্ষেত্রবিশেষ একাধিক রূপ থাকে। জয়েরও আছে, একের অধিক ভিন্ন ভিনন্ন রূপ। অন্তূকে জ্বালাতে পেরে যে সে পরিতৃপ্ত, অন্তূর বিরক্তি তাকে আনন্দ দিচ্ছে, এই হাসি তারই বহিঃপ্রকাশ। অন্তূর কানে অবধি পৌঁছালো সেই হাসির আওয়াজ।

জয় থামল। অন্তূর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়াল, কবীর এগিয়ে এসে সিগারেট দিলো হাতে, এরপর লাইটার। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আবার হাসল জয় আকাশের দিকে তাকিয়ে। কবীর প্রশ্ন করে, “ভাই! আপনে কি মেয়েটারে সত্যিই..ʼʼ

গম্ভীর মুখে চোখ নামিয়ে তাকাল জয়, “নিজের কাজে কাজ রাখ, যাহ!ʼʼ

আলিম ঠোঙা ভরে গাছের পেয়ারা এনেছে জয়ের জন্য। জয়ের বেশ পছন্দ পেয়ারা। পথে হাঁটতে হাঁটতে জয় ঠোঙা থেকে পেয়ারা বের করে সবাইকে দিতে লাগল একটা একটা কোরে। পথে যেসব জুনিয়রদের সাথে দেখা হলো, ওরা সালাম দিয়ে হাত মেলাতে এলো, সকলকে দিলো একটা একটা কোরে। পথে একটা মেয়ের সাথে দেখা হলো। তার ওড়না গলার সাথে ফাঁসির দড়ির মতো পেঁচানো। জয় একবার আপাদমস্তক দেখল, এরপর বলল, “গলার দড়িটা হয় খুলে ফেলো, অথবা গায়ে রাখো। ফাঁস-টাস লেগে মরে গেলে সেই দোষও আমার হবে। অবশ্য দোষ আমার এমনি এমনি হয়না, আমার আবার মুখ ভালো না, সাথে চোখ তো আরও খারাপ! আজুবাজু কিছু বললেই নেতাগিরির নাম বদনাম হবে। ধরো, পেয়ারা খাও।ʼʼ

সিগারেট টানতে টানতে এগিয়ে গিয়ে শহীদ মিনার চত্বরের সিঁড়িতে বসল জয়। আশপাশে মেয়ে-ছেলেরা বসে হাসাহাসি করছিল। জয়ের পাশেই বসে আছে একদল মেয়ে। শব্দ করে হাসছিল সবগুলো, একে অপরের গায়ে ঢলে পড়া হাসি। জয় ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে চোখ উঠিয়ে তাকাল একবার সেদিকে। জয়ের দিকে চোখ পড়তেই নীরব হলো পরিবেশ, থমথমে হয়ে উঠল আশপাশ। মাথা নিঁচু করে সালাম দিয়ে উঠে চলে গেল সবগুলো সেখান থেকে।

শেষ অবধি দেখা গেল জয়ের ভাগে পেয়ারা জুটল না।খালি ঠোঙাটা ফেলে দিলো জয়। সবাই একজোটে নিজেদের পেয়ারা এগিয়ে দিলো জয়ের দিকে। জয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘাঁড় নাড়ল, “খা তোরা, খাব না আমি।ʼʼ

-“ভাই!ʼʼ কতর স্বরে একযোগে ডেকে উঠল সবাই।

জয় বিরক্ত হলো, “একেকটা তো দেখতেছি সুপার ড্রামা কুইনের মেল ভার্সন! এমনভাবে পেয়ারা ধরে আছিস, যেন মনে হচ্ছে নিজেদের একেকটা করে কিডনি খুলে সঁপে দিচ্ছিস আমার নামে। খা তোরা, আমার লাগবেনা। পারলে একটা মিষ্টি স্বাদের বেশি করে জর্দা মেরে পান কিনে দে। চিবোই।ʼʼ

কবীর একটা দারুণ কাজ করল হুট করে। নিজের হাতের পেয়ারাটা জয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দৌঁড়ে ডানদিকে গেল। যে মেয়েটাকে জয় পেয়ারা দিয়েছিল সে এখনও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তার কাছে গিয়ে বলল, “পেয়ারা দাও।ʼʼ

মেয়েটা অবাক হলো। বুঝল না, বলল, “হু?ʼʼ

কবীর চট করে পেয়ারাটা মেয়েটার হাত থেকে কেঁড়ে নিলো। দৌঁড়ে এলো দলের কাছে। সকলে হাঁ করে চেয়ে আছে কবীরের দিকে। কিছুক্ষণ কেউ মুখ বন্ধ করল না, কথা বলল না। খানিক সময় যেতেই সবগুলো হু হা করে হেসে উঠল। রাহাত কাঁধ থাপড়ায় কবীরের, “মামা! কী কামডা করলি? কেঁড়ে নিয়ে চলে এলি? ভাই, তোকে আমি এ বছরের সেরা পেয়ারা ফেরত এওয়ার্ড দেব। সাথে থাকবে দুই বালতি পেয়ারা ভাজি, এবং পেয়ারার হালুয়া।ʼʼ

হেসে গলে পড়ছে সবগুলো। রাহাত ঘুরে এসে বসল জয়ের বাঁ পাশে, “ভাই! একটা ডাউট, আপনে আসলেই যদি মেয়েটাকে ভালো না বাসেন, তাইলে..ʼʼ

জয় চোখ তুলল, “আমি যা বলি, করি–তা যেকোনো মেয়ে ভয় পেয়ে হোক আর ভালো লেগে, সায় দিতো, মিঠা কথা বলতো, আড়চোখে তাকাতো, দেখতো আমায়, লজ্জা পেত–যে লজ্জায় লজ্জা না, থাকে আসলে নির্লজ্জতা। দু একদিন গেলে গা ঘেঁষতো, এরপর আমার মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করতো। এসব যেকোনো মেয়েই করতো। ভয়েই হোক অথবা ইচ্ছে করে। আর এদেরকে ডিস্টার্ব করার কিছু নেই, এরা এমনিতেই কিলবিলিয়ে বেড়ায়, সুঁতো না টানতেই গায়ে আঁছড়ে পড়ে। এদের জ্বালালে বিরক্ত হতো ওরা? বা সেটা কি জ্বালানো হতো না নিজের ব্যক্তিত্ব আর পদের নাম বিসর্জন দেয়া হতো?ʼʼ

-“ঠিক কথা, ভাই।ʼʼ

ভার্সিটি ক্যাম্পাস ফাঁকা প্রায়। জয় সিগারেটে টান দিলো আরেকটা, “আরমিন সেরকম?ʼʼ

-“না, ভাই!ʼʼ

-“এক্সাক্টলি। ওর আত্মসম্মান আর তেজ অতিরিক্তই বেশি। ওই যে আমার আচরণ, কাছে যাওয়া, কথা বলা সবেতে ওর গা চিটমিট করে ওঠে। ঠিক যেমন ধর, ফুটন্ত বালুতে মুড়ির চাউল যেরকম, সেরকম ফোটে ওর গায়ে। আর এখানেই মজাটা। তুই জানিস না, আমি ওর সামনে গেলে ও ঠিক কতটা অস্বস্তি আর ঘৃণা নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। ধরে নে একটা আজাব আমি ওর কাছে। আসলে ওকে বিরক্ত করার ইন্টারেস্টটা এখানেই।ʼʼ আরাম করে বসল জয়।

-“কিন্তু, ভাই..ʼʼ

জয় একদম অন্তর্যামীর মতো কথাটা বুঝল, যা রাহাত বলতে চায়। জবাব দিলো, “রাহাত! ছাড় দেয়া আর ছেড়ে দেয়াকে গুলিয়ে ফেলিস না। ছাড় দিয়ে রেখেছি, সুঁতো আমার হাতে। সুঁতো জড়াতে শুরু করলে হুড়মুড়িয়ে এসে আমার খপ্পরে পড়বে। ও আমাকে চ্যালেঞ্জও করেছে, জানিস?ʼʼ

আর কাউকে কিছু বলতে দিলো না। কবীরের দিকে তাকাল, “এ অমলেট! গিটার দে আমার!

ওর কোলে গিটার তুলে দিলো কবীর। তাতে টুংটাং সুর তুলে বজ্র কণ্ঠে গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে গেয়ে উঠল,

—যতই বল আমায় বোকাভোলা, আরে হবি তুই আমার কোকাকোলা..

গা দুলিয়ে হেসে ফেলল নিজেই। ছেলেদের অবস্থাও বেকায়দা। জয় গিটার নামিয়ে রেখে সিঁড়ির দিকে ঝুকে বসল। গা কাঁপিয়ে হাসছে, হাসির দমকে শরীর দুলছে তার। নিজের মনে হঠাৎ গেয়ে ওঠা গানে নিজের কাছেই এত্ত উদ্ভট লাগল। সঙ্গের ছেলেরা খুব পছন্দ করে জয়কে! কেমন যেন ছেলেটা! নেতা নেতা ভাব, সভ্যতার বড় অভাব। বেজায় বখাটে আর বেয়ারা! অথচ সেসবের মাঝেও কিছু একটা আকর্ষণ করে ওদের। সামনে দিয়ে একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছিল। জয় ডাকল, “এই! শোন! এদিকে আয়!ʼʼ

ছেলেটা এসে দাঁড়াল। জয় আগাগোড়া চোখ উপর-নিচ করে দেখল একবার। প্রশ্ন করল, “নাচতে পারিস?ʼʼ

ছেলেটা বোকার মতো চেয়ে আছে। জয় বিরক্ত হলো, “নাচতে পারিস নাকি?ʼʼ

ছেলেটা না বুঝেই বোধহয় ঘাঁড় নাড়ল। জয় জিজ্ঞেস করল, “কী কী নাচ পারিস?ʼʼ কথা শেষ করে কবীরের দিকে কাধ ঝুঁকিয়ে চিবোতে চিবোতে বলল, “আজকাল খুব সুরসুরি টের পাচ্ছি ভেতরে! আগুন বেড়ে গেছে।ʼʼ

কবীর উদ্ভট হাসল, “ভাই! কী কন না কন! দিনের বেলায় কেমনে কী? রাতে একটা ব্যবস্থা হবে না-হয়!ʼʼ

ভ্রু জড়াল জয়, “দিনের বেলা সুরসুরি ওঠা যাবে না, নাকি? এখন বুঝতেছি মানুষ বিয়ে ক্যান করে? দিন হোক বা রাত, যখন তখন.. ফুলটাইম..ʼʼ

-“ভাই, আপনিও জীবনে বিয়েশাদী করবেন? মানে আপনার হাবভাব দেখে কিন্তু কোনোদিন মনে হয়না যে আপনি বিয়ে করবেন।ʼʼ

জয় এদিক-ওদিক তাকালো, যেন খুব মনোযোগ দিয়ে হাওয়ার মাঝে অণুজীব খুঁজছে সে, “কথা খারাপ বলিস নি তুই। আমিও ভাবছি কয়দিন ধরে, তোকে একটা বিয়ে দেব, এরপর বউটাকে আমি আর তুই ভাগ করে নেব। ভাগাভাগি এক মহৎ মানসিকতার পরিচয়। সবে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। সপ্তাহে তিনদিন তোর, তিনদিন আমার। বাকি শুক্রবারটা আমার বোনাস।ʼʼ

রাহাত হেসে গড়াগড়ি খায়, “ভাই! বউ ওর, কিন্তু বোনাস আপনি কেন পাবেন?ʼʼ

-“বিয়ে কে দেবে হে? যেই ফকিরের সিরনি খাও, সেই ফকির চেনো না? তোর মনে হয় কবীরের জীবনে বিয়ে হবে আমি না সুপারিশ করলে?ʼʼ

-“ভাই কিন্তু আপনি বিয়ে করবেন না কেন?ʼʼ

জয় পেয়ারাতে কামড় দিলো, “পুরুষ দুই প্রকারের। এক–বিবাহিত, দুই–জীবিত। তবে বেশিদিন বেঁচে থাকা ঠিক না। আজকাল খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে রে! বেঁচে তো রইলাম এতগুলো বছর।ʼʼ

-“ভাই! তার মানে পুরুষ বিয়ে করলে বেঁচে থাকে না?ʼʼ

জয় মাথা নাড়ল, “চান্সই নেই।ʼʼ নজর ঘুরিয়ে সামনে দাঁড়ানো ছেলেটাকে বলল, “একটা জম্পেশ বেলী ডান্স দে তো! নাচ!ʼʼ

কবীর ফিসফিস করল, “ভাই! ও তো ব্যাটা মানুষ! ওর বেলী ডান্সে আপনার আগুন কেমনে নিভবো?ʼʼ

ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে জয় ছেলেটার দিকে অতিষ্ট নজরে তাকিয়ে, আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে তীব্র বিরক্তি নিয়ে সামনের রাস্তার দিকে আঙুল ইশারা করল, “এ যা, ভাগ এখান থেকে! যা, সামনে থেকে সর! শোন, আবার যাইয়া উপর মহলে কমপ্লেইন করবি না, যে ভিপি তোরে র‌্যাগ দিছে! আমি আছিই কিছুদিন। আর বদনাম ভাল্লাগে না আজকাল, বয়স হচ্ছে তো!ʼʼ

প্রফেসর এদিকেই এগিয়ে আসছেন! জয় উঠে দাঁড়াল, আরেকটা লম্বা টান দিলো সিগারেটে, স্যার যখন একদম সামনে এসে দাঁড়াল, তার মুখের সামনে ধোঁয়া ছেড়ে এরপর তা মাটিতে ফেলে জুতো দিয়ে চেপে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো, “সালাম, স্যার! কী অবস্থা?ʼʼ

-“তোমার কী অবস্থা? কী করছো আজকাল?ʼʼ

হাতদুটো মাথার ওপর তুলে অলস ভঙ্গিতে বলল জয়, “বিন্দাস চলছে! যা করছি, আপনি স্যার মানুষ, বলা ঠিক হবে না।ʼʼ

-“এতো রঙ-তামাশা আর ভালো থাকাথাকি আসে কোত্থেকে?ʼʼ

হাত নামাল জয়, “ভালো থাকা একটা পেশা, স্যার!ʼʼ

-“পেশা?ʼʼ প্রফেসর স্যার নাক কুঁচকালেন।

মাথা নাড়ল জয়, “জি স্যার, পেশা। আর এই পেশায় দরকার— যা ইচ্ছে তা করার ক্ষমতা, আর মন-মানসিকতা। যখন যা ভালো লাগবে, যাতে আনন্দ এবং মজা পাওয়া যাবে, ইচ্ছে করবে যা করতে, তা করার সাহস এবং পাওয়ারটুকু থাকলে অলওয়েজ ভালো থাকা যায়। সেটা খারাপ অথবা ভালো, এই চিন্তা করলে আপনি এই পেশার যোগ্য না। তাইলে আপনাকে ওই মদ গিলে ডিপ্রেশন কাটাতে হবে।ʼʼ

-“তোমার কাছে এই পেশা আছে বলে তুমি মদ গেলো না? সিগারেট টানো না? বজ্জাত ছেলে, তোমার সাথে কথা বলাই তো উচিত হয়নি আমার!ʼʼ

-“এমন ভাব করছেন যেন, আজকেই প্রথম অনুচিত কোনো কাজ এবং শব্দের সাথে পরিচয় হলো আপনার? দিনে কয়টা উচিত কাজ করেন? যেসব কাজ করেন আপনি, আমিও অত খারাপ না।ʼʼ

এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আর কথা বলছে জয়। এটা তার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। কোনো সময় চোখের চাহনি এবং ঘাঁড় স্থির থাকেনা। পাখির মতো তাকিতুকি চলতে থাকে। প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন, “কবে এসেছ ঢাকা থেকে?ʼʼ

-“আবার ঢাকা ফেরার সময় হয়ে এলো, আপনি আসার কথা বলছেন!ʼʼ

-“পরীক্ষা কবে?ʼʼ

-“পরশুদিন যাব।ʼʼ

পাখিদের মতো চোখের চাহনি এবং ঘাঁড়টা সবর্ক্ষণ ছটফটে, চঞ্চল, বেপরোয়া। প্রফেসর বললেন, “ভালো হও, বখাটে হচ্ছ দিনদিন!ʼʼ

-“একটা বিয়ে দিয়ে দেন তাইলে! ভালো হয়ে যাই!ʼʼ

-“তোমাকে মেয়ে দেবে? এমন বাপ নেই দেশে আমার জানামতে! দিনকে দিন যা হাভাতে হচ্ছ! এক নম্বরের ম্যানার্সলেস তুমি!ʼʼ

জয় সোজা হয়ে দাঁড়াল, নাক শিউরালো, “দিলেন তো মুডটার আব্বা-আম্মা করে? ম্যানার্স কী জিনিস? হোয়াট ইজ ম্যানার্স! সেতা খায় না গায়ে মাখে? ম্যানার্স আর আমি একসাথে! এই অসম্ভব বাক্যটারে উচ্চারণ করার খুব দরকার ছিল আপনার এই মুহুর্তে? যান, যান! কোথায় যাচ্ছিলেন, যান। আপনার উদ্দেশ্যে সম্মান দেখিয়ে আবার সিগারেটটা ফেলে দিলাম! আঠারো টাকা একটা সিগারেটের দাম!ʼʼ

গম্ভীর মুখে তাকালেন স্যার, “শুধরাবে না।ʼʼ

জয় আনমনেই বলল, “শুধরালে কি আপনার মেয়ে বিয়ে দেবেন আমার সাথে?ʼʼ

স্যার পেছন ফিরলেন, “কচু দেব।ʼʼ

জয় স্যান্ডেলের ফিতা লাগাতে লাগাতে মুখ না তুলেই বলল, “লাগবেনা, ওটা আপনিই জুস করে খাইয়েন, পেট কমবে। আমার এলার্জি আছে, গা চুলকায়।ʼʼ

স্যার কপালে হাত ঠুকলেন! কবীর জিজ্ঞেস করল, “কী করবেন ভাই এখন?ʼʼ

-“তুলির শ্বশুরবাড়ি যাব। কোয়েলকে আনতে যাব, সীমান্ত শালার চুলকানি বাড়ছে। ভালো একটা মলম কিনে নিয়ে গিয়ে একটু লাগিয়ে দিয়ে আসি।ʼʼ

-“ভাই, মাইরেন না ওরে। সামনে কিন্তু নির্বাচন। হামজা ভাই জানলে আমি শেষ।ʼʼ


নতুন একটা বাছাই অনুষ্ঠিত হবে আবার। কিন্তু জয় তাতে অংশগ্রহন করবেনা। হামজা জয়কে বলেছিল, “আমার পদটা তুই নে। নমিনেশন পাইয়ে দেব আমি।ʼʼ

জয় বলেছে, “শখ নেই। এই পদই ভারি পড়তেছে আমার ওপর। এইটাই কখন জানি অন্য কারও ঘাঁড়ে চাপায়ে দেব।ʼʼ

-“মাল-টাল খেয়েছিস? মাথা ঠিক আছে? পদ কি মুড়ির মোয়া তোর কাছে?ʼʼ

-“ভাই! ভালো হওয়া সহজ কাম, ঠিক ততটাই কঠিন হলো ভালো হওয়ার নাটক করাটা। যেটা আমাকে ভিপি হিসেবে প্রতিমুহূর্তে করতে হচ্ছে। কোনোরকম অসভ্যতা, অশালীনতা, উশৃঙ্খলতা চলবে না। শালা মার্কা কথা এটা। এসবের কারণ আমি লিডার, আমাকে নিখুঁত ব্যক্তিত্বের মানুষ হতে হবে। ক্যান, বাল! আমি যদি ভালো না হই আসলে, তাইলে আমি নাটক করব ক্যা? তাও আবার বিনা পয়সায়। আমায় কি যাত্রাপালার জোকার মনে হয়, আমি ভালো না, তবুও মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য নাটক করতে হবে? এসব ভারী নাম, ভালো মানুষের পদক, কর্তব্যপরায়নতা–এসবে গা চুলকানি আছে আমার। তবুও শুধু রয়ে গেছি ক্ষমতা হাতে রাখার জন্য। নয়ত এই বালের পদ আমার সাথে যায়না, তুমিও জানো।ʼʼ

হামজা গম্ভীর চোখে তাকালো। হামজার চোখের মণি আলকাতরার মতো কালো রঙা। তাতে যেন চোখের দৃষ্টি আরও সূঁচালো লাগে দেখতে। জয় বোঝানোর মতো করে বলল, “চ্যাহ! আমার কথা বোঝার চেষ্টা করো। আমি আমার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছি এই দায়িত্ব পালনে। নেতার অনেক গুণ থাকতে হয়, সেই প্রতিটা গুণ অনবদ্য সুন্দর হতে হয়। অথচ আমার ভেতরে সেসব কিছু নেই। প্রতিদিন আরমিণ আমার সাথে যা করে যাচ্ছে, তুমিই বলো আর কে সহ্য করতো এসব চুপচাপ? আমি করে যাচ্ছি, যেন আমার গায়েই লাগেনা! কেন? কারণ, আমি চাইলেও ওকে কষে চারটা থাপ্পড় মেরে কানে ঝিঝি ডাকাতে পারিনা, খোলা মাঠে দাঁড় করিয়ে বকতে পারিনা। কারণ আমি ছাত্রদলের লিডার। অথচ আমার ভেতরে সেরকম কিছু প্রকাশ পায়না কোনোদিন।ʼʼ

হামজা এ ব্যাপারে কিছু বলল না। বরং সতর্ক করল, “বাড়ি থেকে বের হবি না। এ কথার খেলাপি হলে নিজের হাতে হাঁটুর হাড় ভাঙবো আমি তোর। মাজহারের ছেলেরা তিনবেলা নজর রাখছে বাড়ির ওপর। তোর ভাবী ওই বাড়ি যাবে বলে জিদ ধরে বসে আছে। বিকেলে সম্মেলন আছে, একটা হাঙ্গামা হবেই হবে। সাবধান করলাম কিন্তু, বাইরে বের হবি না।ʼʼ

জয় ঘড়ি দেখল, দশটা বাজছে বেলা। ছাদে গিয়ে কবুতরের খাবার দিয়ে, দুটো কবুতর ধরে আনলো কচি দেখে। তরুকে ডেকে বলল, “পাতলা ঝোল রান্না করতে বলবি। মামি আর আমি খাবো। মামির শরীর ভালো?ʼʼ

-“এখন ব্যথা কম। আপনি কোথায় যাবেন? হামজা ভাই কিন্তু বের হতে নিষেধ করেছে। আমি গিয়ে বলে দেব আপনি বের হচ্ছেন।ʼʼ

জয় চোখ বুলালো তরুর ওপর, “ভাড়ায় চালিত? হামজা ভাই ভাড়া দেয় তোরে আমার পেছনে লেগে থাকতে?ʼʼ

হামজা রুমে এলো। রিমি বিছানার ওপর বসে আছে। গায়ের ওড়নাটা পরিত্যক্ত হালে বিছানায় পড়ে আছে। খেয়ালহীন, উদ্ভ্রান্তের মতো বসে আছে। হামজা গিয়ে বসল সামনে, “সকাল থেকে খাওনি কেন কিছু?ʼʼ

-“আপনার পয়সায় কেনা কিছু খাওয়ার রুচি আসছে না।ʼʼ

হামজা চরম ধৈর্য্যশীল পুরুষ। তবুও যেন ধপ করে আগুন লেগে গেল ভেতরে। তা গিলে ফেলল অবশ্য, “তাহলে কার পয়সায় খাবে? স্বামীর পয়সায়ই তো খেতে হবে তোমাকে।ʼʼ

-“আপনি স্বামী? আপনি জানোয়ার, জংলি পশু, অত্যাচারী, ক্ষমতলোভী কুকুর। আমি আব্বুর কাছে যাব যখন বলেছি, তখন যাবোই। আপনি জানেন আমার জিদকে। আপনাকে চেনাতে ভুল ছিল অনেক।ʼʼ

হামজা উঠে গিয়ে খাবারের প্লেট আনলো। তা রিমির সামনে রাখতেই প্লেট ধরে গায়ের জোর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল তা। হামজা তাকিয়ে দেখল একবার প্লেটটা। রশিদা খালা দৌঁড়ে এলেন, প্লেট উঠাতে গেলে হামজা বলল, “উহু! আপনি যান। যে হাত থেকে পড়েছে, ওই হাতেই উঠবে। সমস্যা নেই, যান।ʼʼ

রিমিকে জিজ্ঞেস করল, “কী করবে ওই বাড়ি গিয়ে?ʼʼ

-“দেখবো নিজের চোখে, আপনার মতো জানোয়ারের হাত কোনো বাড়িতে পড়লে সেই বাড়ির হাল কী হয়?ʼʼ

-“দেখে কী হবে?ʼʼ

ফুঁসে উঠল রিমি, “আপনার একটুও আফসোস নেই এসব নিয়ে?ʼʼ

-“আমি নিজের কাজে কোনোদিন আফসোস করিনা, রিমি। সেটা যতই নিকৃষ্ট কাজ হোক না কেন? আর এ তো দলের প্রয়োজনে করেছি। তোমার চাচা আমাকে মারতে চাইলে ভালোভাবে মিটিয়ে নিতাম। কিন্তু সে আমার দূর্বলতা খুঁজে বের করে সেখানে আঘাত করছে বারবার। এটা ভয়ংকর, রিমি। যে তোমাকে নয় বরং তোমার দূর্বলতাকে টার্গেট করে, সে তোমার জন্য জাহান্নামের মতো ভয়ানক। আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে গোপনে, অথচ প্রকাশ্যে আর খারাপভাবে জয়ের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। একবার ট্রাক চাপা দিয়ে পরের বার ছুরির আঘাত করে। মাজহারের প্রাপ্য ছিল যা, তা পেয়েছে ও। এ নিয়ে তুমি বেশি বেশি করছো।ʼʼ

ঝরঝর করে কেঁদে উঠল রিমি, “আপনি বন্দুক চালাতে জানেন, জানা ছিল না আমার। আপনাকে নিয়ে আমার ধারণাগুলো কাঁচের মতো খানখান হয়ে গেছে। আপনার পিস্তল এই দুই বছর বাদে সেদিন দেখলাম কাবার্ডের গোপন সিন্দুকে তোলা। কেন, হামজা! এইসব লুকোনো রূপ কেন রেখেছেন নিজের মাঝে? আমার ভাই ছিল না, মাজহার ভাইয়া আমাকে কোলে-পিঠে চড়িয়ে মানুষ করেছে। আপনি তার পেট ছিদ্র করে রেখে এসেছেন? আপনি মানুষ? রাজনীতিতে মানুষ ক্ষমতার জন্য এত নিচে নামতে পারে? আব্বু বা চাচ্চুকে তো নামতে হয়নি এমন! আপনি একটা ধোঁকা, একটা যন্ত্রণা। যা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে, আমি সইতে পারছি না। আপনার মুখ দেখেও বুক ভেঙে আসছে।ʼʼ

হামজা হাসল, “তুমি বোকা, রিমি। তোমার বাপ-চাচা কী করেছে তা তো আর তোমার সাথে আলোচনা সভা ডেকে করেনি! নিজের বাপ-চাচা তোমার কাছে খারাপ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। আর রইল কথা, মাজহারের। তো ও তোমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে বলে তোমার এত মায়া, আর আমি আমার এই হাতে জয়কে মানুষ করেছি, আমার মায়া কি ভেসে আসা? তোমার এই জিদ কোথায় গিয়ে থামবে, কোন কোন মোড় পাড়ি দেবে জানা নেই। তবে এসব ঝেরে ফেলো মাথা থেকে। ওই বাড়ি থেকে যেদিন তোমায় নিয়ে এসেছি আমার নামের কবুল পড়িয়ে, তুমি আমার হয়েছ। অতএব আমাকে ঘিরে চিন্তাধারা থাকা উচিত তোমার। বাপের বাড়ি পর হয়েছে, আমি তোমার জাত-পরিচয় এখন।ʼʼ

রিমিকে কান্নারত রেখেই বেরিয়ে পড়ল হামজা। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবীর ওপর ঘিয়ে রঙের মুজিব কোট, বেশ মানিয়েছে শ্যামবর্ণের লম্বা শরীরটাতে। গাড়িতে ওঠার আগে কবীর দ্রুত গিয়ে গাড়ির দরজা খুলতে গেল। হামজা রোদচশমা খুলে বলল, “এসব কী? আমার হাত নেই গাড়ির দরজা খোলার মতো? তোরা কি চাকর আমার? এসব করবি না আমার সাথে, পছন্দ না আমার।ʼʼ

চারদিকে পোস্টারে ছেয়ে গেছে পথঘাট। মাইকিং চলছে রাস্তায় রাস্তায়। সেসব পেরিয়ে এগিয়ে চলল হামজার গাড়ি পলাশের ডেরার দিকে। দিনাজপুর শহরের সন্ত্রাস বিস্তারের কর্মসূচি যার হাতে নিয়ন্ত্রিত। রাজন ও ওর ভাতিজা পলাশ। হামজার মোটেও ইচ্ছে ছিলনা রিমিকে কাঁদিয়ে এসব করার। কিন্তু উপায় রাখছে না চাচাশ্বশুর মশাই। আজও ক্লাবঘরের জানালার কাঁচ ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে গেছে। গোপন সূত্রে খবর পেয়েছে, জয়কে কেইসে ফাঁসানোর জন্য খুব শক্ত পরিকল্পনায় নেমেছে ঝন্টু সাহেব। সুতরাং পলাশের সাহায্য একান্তই দরকার এসময়। ভোটের আমেজে এলাকা রমরমা হয়ে উঠেছে। আজ বিকেলের সম্মেলনে কিছু লোক লাগবে হামজার। পলাশ দিতে পারবে সেই লোক।


হামজা বেরিয়ে যেতেই জয় বেরিয়ে পড়ল ভার্সিটির ক্লাবের উদ্দেশ্যে। সেখানে ঝামেলা হয়েছে ছাত্র হোস্টেলে কিছু একটা। হামজার নিষেধ মানার মতো ছেলে নয় জয়। পাঞ্জাবী গায়ে চড়িয়ে, তরুকে ডাকল। তরু এলে বলল, “তোর বড় শালটা নিয়ে আয়, এসে আবার দিয়ে দেব। নাকি সমস্যা হবে?ʼʼ

তরু কথা না বলে বেরিয়ে এলো। তার জানটা যেখানে হাজির সেখানে শালের কথা বলছে। শালটা জয়ই আগের বছর কাশ্মির থেকে কিনে এনে দিয়েছিল।

ভার্সিটিতে ঢুকতেই ছেলেরা ভিড় করে ফেলল জয়কে ঘিরে। এজন্য সাধারণত জয় ভার্সিটিতে ঢোকে মুখে রুমাল বেঁধে, ক্যাপ পরে, পেছনের ঝোপঝাড়ের রাস্তা দিয়ে। সামনে দিয়ে ঢুকলেই সালামের জবাব দিতে আর ছেলেদের ভিড়ে বিরক্তি ধরে যায়। অনেকে হ্যান্ডশেক করতে এগিয়ে এলো। ভালো আছে কিনা, জিজ্ঞেস করল। ছেলেরা পেছনে, সামনে জয় হেঁটে এগিয়ে গেল ক্লাবের পথে। পথে হিন্দু মেডাম শ্যামলী দাসের সঙ্গে দেখা হলো, জয় লম্বা করে একটা সালাম দিলো, “আসসালামুআলাইকুম, ম্যাম।ʼʼ

ম্যাম অল্প হাসলেন। এই কাজটা জয় ইচ্ছে কোরে করে। হামজা থাকলে ধমক দিতো, সালাম নিয়ে ইয়ার্কি ঠিক না। কিন্তু জয়ের কাছে যুক্তি আছে। শান্তি সবার ওপরই বর্ষন করা যায়।

কার্যালয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল। প্রথমেই এলো একদল সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষে ফাইনাল ইয়ারের বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন বিষয় নিয়ে। জয় হিসেব দেখে কাগজটা টেবিলে রেখে বলল, “এতোসব বড়োলোকি আয়োজন করার মানে নেই কোনো। জিলাপি অথবা বাতাসা ছিটিয়েও বিদায় অনুষ্ঠান করা যায়।ʼʼ

-“ভাই এই একটা কথা?ʼʼ

জয় বলল, “কথা না? কথা কাকে বলে, বলতো? মনের ভাব প্রকাশ করতে যে ধ্বনি বা আওয়াজ গলা দিয়ে বের হয়, সেটাই কথা। সেই হিসেবে আমারটা কথা ছিল না?ʼʼ

সকলে বুঝলো, জয় এ বিষয়ে কথা বলতে আপাতত আগ্রহী না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জয় নিজেই জিজ্ঞেস করল, “হোস্টেলে কী হয়েছে?ʼʼ

একজন বলল, “ভাই.. ভার্সিটিতে গতদিন বিকেলে আপনাকে নিয়ে বিতর্ক লেগেছিল। আপনি নাকি সেকেন্ড ইয়ারের একটা মেয়েকে হ্যারাস করছেন। মেয়েটা কমপ্লেইন করেছে সাধারণ সম্পাদক মুকুলের কাছে। আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, আপনি ওকে বাজেভাবে ডিস্টার্ব করেন ভার্সিটিতে আসলে। সাথে..

জয় চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজল ছাদের দিকে মুখ তুলে। বিরবির করল, “আরমিণ, আরমিণ, আরমিণ! কী যে করো তুমি? এই তো খেয়াল থেকে বের হয়ে যাচ্ছ, আবার ঠিক কোনো না কোনো বেয়াদবী করে আগুন জ্বালাচ্ছ ভেতরে। জোরে বলল, “সাথে? কী? থামলে কেন? শুনছি, বলে যাও।ʼʼ

ছেলেটার মুখ শুকনো। জয় সোজা হয়ে বসল, “বিক্ষোভ চলছে এই নিয়ে, তাই তো? তোমাদের কী মনে হয়, এতে আমার পদত্যাগ করাতে পারবে তো? এরকম এই নীরব বিক্ষোভ করছে সবগুলো মহিলা মানুষের মতো পেছনে লুকিয়ে! এদের দিয়ে আদৌ সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা হবে? এই যে গেইট দিয়ে ঢুকলাম, একটা খোয়া পর্যন্ত ছুঁড়ল না কেউ! কী সব মেয়েলি আন্দোলন শিখেছে! সামনে এসে একটা বকা পর্যন্ত দিলো না কোনো, শালা! এই নাকি এরা ছাত্রলীগ, এরা যুবসেবক! শালারা, বালের আন্দোলন শিখেছে। আমি হামজা ভাইকে মানাতে পারছি না পদত্যাগের জন্য, অজান্তে হলেও আমার পদত্যাগ করিয়ে একটা উপকার করতে পারতো, খাস মনে দোয়া দিতাম। সেজান, কাল সকালে ওদের কার্যালয়ে আনবি। আন্দোলন শেখাবো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো শেখাবো, যা।ʼʼ

সকলে হাহাকার করল, “ভাই! আপনি কি পদত্যাগ করতে চান? মানে..ʼʼ

পেপার ওয়েট হাতে তুলে উঠে দাঁড়াল জয়। রাহাতকে বলল, “আগামীকাল একটা সম্মেলন ডাক, সকলে যেন উপস্থিত থাকে। কাল না হলে পরে কিন্তু দেরি হবে। কাল রাতে গাড়ি আমার, ঢাকা থেকে ফিরতে দেরি হবে কয়েকদিন।ʼʼ

বহুদিন, বেশ বহুদিন পর জয়কে ভিপি ভিপি লাগলো। রাজনৈতিক কর্মীর মতো দেখাচ্ছেও আজকে পাঞ্জাবীতে, সাথে চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে গম্ভীর এক নেতৃত্ব। অনেকদিন পর কার্যালয়ে ঢুকে রূপ বদলে গেছে।

এলএলবি বিভাগের ছাত্রী অন্তূ। সেখানকার হেড হলেন শিক্ষিকা মনোয়ারা রেহমান। জয় অনুমতি চাইল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে, “আসবো, ম্যাম?ʼʼ

-“এসো।ʼʼ

ম্যাম কিছু লিখছেন। জয় দাঁড়িয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত, পরে বলল, “বসতে বলবেন না, ম্যাম?ʼʼ

চশমার ফাঁক দিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে ইশারা করলেন ম্যাম। বসল জয়, “কেন ডেকেছেন? নাস্তা এনেছেন ভালো কিছু? আপনার হাতের পাটিসাপটা খাই না কতদিন, ভেবেই ক্ষুধা অনুভূত হচ্ছে। পানি আছে, ম্যাম? দুটো ঘুমের ওষুধ খাবো। আমার আবার ঘুমের ওষুধ পেটে পড়ার পর কাজ শুরু হতে দেরি হয়। এখন খেলে বাড়ি গিয়েই ঘুমিয়ে পড়তে পারব।ʼʼ

মনোয়ারা ধমক দিলেন, “সাট-আপ! চুপ করে বোসো।ʼʼ

জয় আঙুল ঠেকালো, “ওকে। কিন্তু শুধু চুপ করতে বললেই হতো। বসে তো আমি আছিই।ʼʼ

মনোয়ারা কটমটিয়ে তাকালেন। জয় হাতের পেপার ওয়েটটা টেবিলে ঘুরিয়ে খেলছে।

চলবে..

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। এমন কিছু হবে সামনে, আপনারা ধাক্কা নাও সামলে নিতে পারেন। প্রস্তুত হন সকলে। সকলের অভিযোগ, আমি অনিয়মিত। অথচ যেদিন গল্প দেই, কত বড় যে দিই সেটা কেউ খেয়াল করেনা। আপনারদের তো পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে যাবার কথা, যে পাহাড় সমান বড় হয় একেকটা পর্ব।😒]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here