#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৯.
দুপুর দুটোর মতো বাজে। শীতের রোদ বাইরে। মেয়েটা কার্যালয়ের ভেতরে এসে দাঁড়াল মুস্তাকিনের সামনে। অথচ দেখা গেল তার চোখে কোনো ইতস্তত ভাব নেই। দৃঢ় চোখের চাহনি, আত্মবিশ্বাস ভরপুর তাতে। মাহমুদ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “মেডাম, কোনো প্রয়োজনে এসেছেন? কিছু বলতে চান?ʼʼ
মেয়েটা মাথা নাড়ল। মাহমুদ বলল, “জি, কার সঙ্গে কথা বলতে চান!ʼʼ
মেয়েটা মুস্তাকিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কি কিছুটা সময় দিতে পারবেন?ʼʼ দ্বিধাহীন দাবী।
মুস্তাকিন ভ্রু জড়িয়ে একবার পরখ করল মেয়েটাকে। হাতঘড়িতে সময় দেখল। ঘড়ির দিকে তাকিয়েই কিঞ্চিৎ মাথা নাড়ল। বিনয়ের সাথে হাত ইশারা করে নিজের কেবিনের দিকেটা দেখিয়ে দিলো। মেয়েটা এগিয়ে গেল সেদিকে। চেয়ারে বসে টিবিলের ওপর হাত রেখে দু’হাত একত্র করে কয়েক সেকেন্ড দেখল মেয়েটাকে মুস্তাকিন। এরপর বলল, “জি বলুন, কী বলতে চান?ʼʼ কণ্ঠস্বর ভারী, কৌতূহলি।
মেয়েটা বলতে শুরু করল, “আমি মাহেজাবিন আরমিণ অন্তূ। দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।ʼʼ
মুস্তাকিন সৌজন্যে অল্প হাসল, “জি, চিনতে পেরেছি। কিন্তু আপনাকে কোন নামে সম্বোধন করা যায়?ʼʼ
-“লোকে আরমিণ অথবা অন্তূ ডাকে।ʼʼ
-“আমি কোন নামটা বেছে নেব?ʼʼ
-“আপনার ইচ্ছেমতো!ʼʼ
মুস্তাকিন এবার সোজা হয়ে বসল, “তো মিস অর মিসেস অন্তূ! কী বলতে চান?ʼʼ
অন্তূ ইতস্তত না করে সরাসরি বলল, “মিস।ʼʼ
মুস্তাকিন ঘাঁড় কাত করল। অন্তূ আবার বলল, “আপনাদের টিম রিসেন্ট যে কেইসে কাজ করছে, সে ব্যাপারে কথা বলার ছিল!ʼʼ
মুস্তাকিন সন্তর্পণে কপাল জড়াল, “আপনি কিছু জানেন? আই মিন, কী বলতে চান এ ব্যাপারে?ʼʼ
-“আপনারা কতদূর পৌঁছেছেন?ʼʼ
মুস্তাকিন মাথা নাড়ল, “সরি, অন্তূ। আম জনতাকে আমাদের তদন্তের ব্যাপারে এভাবে তথ্য দিতে পারি না।ʼʼ
-“হু, তা দিতে পারেন না। তবে তা না জানলে আমি গতিবিধি বুঝব কী করে?ʼʼ
জহুরী চোখে তাকাল মুস্তাকিন, “আপনি কীসের গতিবিধির কথা বলছেন? কী জানেন, খোলাশা করুন। বুঝতে পারছি না।ʼʼ
-“লাশ আসার পর আঁখিদের বাড়িতে গিয়েছিলেন?ʼʼ
-“না, যাইনি।ʼʼ
অন্তূ বলল, “আমি ওখান থেকেই আসছি। আবারও নতুন করে ঘা জেগে উঠেছে বাড়ির। আপনারা কাউকে সন্দেহ করছেন না? রিপোর্ট কী বলছে?ʼʼ
সরাসরি এভাবে একটা মেয়েকে এত দ্বিধাহীন এসব কথা বলতে শুনে একটু অপ্রস্তুত বোধ করল মুস্তাকিন। কথাগুলো খুব পেশাগতভাবে বলছে। মুস্তাকিন চোখ নামিয়ে ভাবুক হয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর বলল, “আপনি ঠিক কী বুঝাতে বা বলতে চাচ্ছেন, অন্তূ!ʼʼ
অন্তূ শ্বাস ফেলল একটা। খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, “রিপোর্ট দিয়ে নিশ্চয়ই তেমন কিছু বের হয়নি, তাই না অফিসার!ʼʼ
মুস্তাকিন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। খুব সহজ সাবলীল সম্বোধন আর কথা বলছে মেয়েটা। কিছু বলল না। অন্তূ বলল, “আমার প্রথমে জয় এবং হামজার ওপর সন্দেহ হয়েছিল।ʼʼ
মুস্তাকিন জিজ্ঞেস করল, “আর এখন? এখন হচ্ছে না? হলে কেন হয়েছিল, আর না হলে কেন হচ্ছে না?ʼʼ
অন্তূ হাসল, “ব্যাপারটা অতটাও সরল-সহজ নয়, তা আপনিও জানেন, অফিসার! এভাবে ধারণার ওপর ভিত্তি করে কেইস মিলে যাবার মতো কেইস নয় এটা। আপনি কি এটা জানেন, কিছুদিন আগে আঁখির মেজো ভাই সোহান মারা গিয়েছে?ʼʼ
মুস্তাকিন জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রয় অন্তূর দিকে। অন্তূ নিজেই বলল, “এই ব্যাপারটা নিয়ে ঘাপলা কাজ করছিল আমার ভেতরে। আজ তো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার মতো অবস্থায় নেই ও বাড়ির লোক। তবে আমার মনেহয় সোহানের মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না। এখানেও কোনো ব্যাপার আছে।ʼʼ
মুস্তাকিন হাত দুটো একত্র করে গুটিয়ে থুতনির কাছে নিয়ে এলো। শার্টের ওপর দিয়ে তার বাহুর পেশি ফুলে উঠেছে। কব্জিতে ঘড়ি। গলার কাছে শার্টের বোতাম খোলা, হাতা গোটানো কনুই অবধি। বিন্যস্ত পোশাক ও চেহারা। সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এসবে এত ইন্টারেস্ট নিচ্ছেন কেন?ʼʼ
অন্তূ চুপ রইল ক্ষণকাল। হঠাৎ-ই বলল, “আজ আমি চুপ থাকব, তামাশা দেখব। আঁখির পরের শিকারটা আমি হব না, এমন গ্যারান্টি কার্ড তো পাইনি! আর তাছাড়াও..ʼʼ
মুস্তাকিন সপ্রতিভ হয়ে চাইল, ভ্রু উচালো, “তাছাড়াও?ʼʼ
-“তাছাড়াও আঁখির পরিবার ভয়ে বারবার বলছে, বিচার চাইনা। ধরুন ওদের হয়ে সেই সকল জানোয়ারদের বিচার আমি চাই।ʼʼ চাপা তেজ বহির্ভূত হলো অন্তূর কণ্ঠস্বর ভেদ করে।
মুস্তাকিন মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তো আপনি কী চাইছেন? আমাদেরকে সাহায্য করতে
চান এই কেইসে?ʼʼ
-“উহু! সাধারণ মেয়ে আমি। এতখানি সক্ষমতা নেই, এরকম একটা ভয়ানক কেইসে মাথা ঢুকিয়ে এক্টিভিটির সাথে আপনাদের সহায়তা করব। তবে এটুকু দাবী জানাতে এসেছি, যেকোনো মূল্যে এই কেইসের শেষ দেখবেন আপনারা। আঁখির মৃত্যুর জন্য না হোক, মেনে নিলাম কোনো না কোনো একদিন মানুষের হায়াত ফুরোয়। সকলের কপালে স্বাভাবিক মৃত্যু লেখা থাকে না। কিন্থু ওর সম্মানহানি এবং ওর সাথে হওয়া অত্যাচার যেন চাপা না পড়ে যায় আপনাদের গাফলতির নিচে। এই অনুরোধটুকু করতে এসেছিলাম।ʼʼ
মুস্তাকিন সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো না। কিছুক্ষণ চুপ রইল। পিবিআই এর কার্যালয়ে এসে পিবিআই অফিসারের কার্য গতিবিধিতে আঙুল তোলার সাথে সাথে বিচার দাবী করছে নারীটি। ইন্টারেস্টিং লাগল মুস্তাকিনের কাছে ব্যাপারটা। খানিক পরে বলল, “তবে প্রমাণ এবং ক্লুর খুব অভাব কেইসটাতে। এমন কোনো সূত্র এখন অবধি আমাদের টিম পায়নি, যা দ্বারা এই কেইস এগোতে পারে। এরকম আর কিছুদিন না পেলে কেইস এমনিতেই চাপা পড়ে যাবে। তবে আমাদের চেষ্টা জারি আছে।ʼʼ
অন্তূ আপাতত আর কিছু না বলে বের হয়ে এলো কার্যালয় থেকে। পেছন থেকে কিছুক্ষণ চেয়ে দেখল মুস্তাকিন অদ্ভুত মেয়েটিকে। অদ্ভুত কেন মনে হচ্ছে, জানা নেই। তবে কেন যেন সবার থেকে আলাদা লাগল অল্পক্ষণের জন্য হলেও!
অন্তূ যখন রাস্তা পার হওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তখনই সামনে দিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল হামজার গাড়িটা। অন্তূ টের পেল না। জয় ততক্ষণ অবধি ক্ষেপা চোখে দেখল অন্তূকে, যতক্ষণ গাড়ির কাঁচ ভেদ করে লক্ষ্য করা যায় ওকে। ঘাঁড় ফিরিয়ে হামজাকে বলল, “অন্তূ পিবিআই ডিপার্টমেন্টের সামনে?ʼʼ ঘাঁড় ঝাঁকালো পরপর দুবার, “কাহিনিই বুঝতে পারছি না মেয়েটার!ʼʼ
হামজা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “এমনিতেই বোঝা যায়, প্রতিবাদী চিন্তাধারার মেয়েটা। হয়ত ওই মেয়েটার বিচারের জন্য লড়তে চাচ্ছে! তুই নজরদারী করছিস কেন ওর ওপর?ʼʼ
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল জয়, “তোমার সৎ নেতাগিরি আর নীতি নিজের পকেটে রাখো! ওর সন্দেহ আমার আর তোমার ওপর! এবারেও কি তোমার নীতিকথা শোনাবে, নেতাজি!ʼʼ
হামজার হাতের পিঠে গাঢ় জখম। জয় যতদ্রুত সম্ভব গাড়ি চালাচ্ছে। চেপে রাখা টিস্যু রক্তে ভরে উঠেছে। অথচ হামজা নির্বিকার ভঙ্গিতে ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “আমার-তোর ওপর কেন? আমি-তুই ওর কী করেছি?ʼʼ
জয় স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে জবাব দিলো, “চলো, জিজ্ঞেস করে আসি।ʼʼ
নাক শিউরে উঠল হামজার, “হারামি!ʼʼ
গাড়ি এসে থামলো এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে। ভেতরে ভর্তি রয়েছে দলের কয়েকটা ছেলে। গতকাল মারামারি হয়েছে ভার্সটির মোড়ে ঝন্টু সাহেবের ছেলে মাজহারের লোকেদের সাথে। অবশেষে জয় যখন গিয়েছিল, শেষ পর্যায়ে তার হাত কেটেছে, কপাল ফেটেছে, পিঠে আস্ত একটা লাঠি ভেঙেছে। জয়ের টুকটাক ব্যান্ডেজ লাগলেও মাজহারের ছেলেদের অবস্থা খারাপ। কিন্তু সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়েছে হামজার সেক্রেটারী লতিফ।
দলের লোকেদের হামজা সর্বদা কেবিনেই এডমিট করায়। আম জনতার ভিড়ে রিস্ক থাকে এসব মামলায়। দুজন গিয়ে বেডের পাশে দাঁড়াতেই লতিফের বউ কাঁদতে কাঁদতে উঠে এলো। এখনও বেহুশ লতিফ। লতিফের কোমড়ের ওপর পেটের বাঁ পাশে ছু রি কা ঘা ত করা হয়েছে মারামারির কোনো একসময়ে। রাস্তার পাশে পড়ে ছিল সে। হামজা অবশ্য নির্বাচনের আগে প্রস্তুত ছিল এসবের জন্য একবার।
মারামারির সূত্রপাত ঘটেছে সকালের দিকে। মাজহারের ছেলেরা ক্লাবঘরে ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ির মাধ্যমে ঘটনার শুরু। জয়ের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা ক’দিন বাদে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে দু’দিনের জন্য ঢাকা যাবে সে। ক্লাবে সে ছিল না তখন, হামজা পড়তে বসার জন্য চাপে রেখেছে, কিছুদিন কারবার থেকে দূরে থাকতে বলেছিল। কিন্তু ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মাজহারের ছেলেরা থামেনি। নোংরা ভাষায় হামজাকে গালি দিয়েছে। তখন হামজার ছেলেরা বেরিয়েছিল। দুপুর বেলা লতিফের সাথে এই অঘটন ঘটে যাবার পর জয় বিকেলে পড়ালেখা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যার পর ভার্সিটি মোড়ে তুমুল মারামারি শুরু হলো দুই দলের। লাঠিসোটা, ককটেল, সাথে ছুরি ছিল ছেলেদের হাতে। জয় দুটো ছেলেকে বেদম পিটিয়েছে, সেসময় প্রতিরোধ করার জ্ঞান থাকেনা জয়ের। এটা তার অপারগতা। যখন কাউকে মারতে শুরু করে, তাকে বৃষ্টির মতো মারা যায়, সে একনিষ্ঠ চিত্তে শুধু ছেলে দুটোকে মেরেছে। তার মাঝে নিজে জখম হয়েছে বেশ ভালোমতোই।
মাজহার নিজে উপস্থিত ছিল না। সকালে জয়কে না ডেকেই হামজা পৌঁছে গেছিল পলাশের ডেরায়। দিনাজপুরের নামকরা সন্ত্রাস পলাশ আকবর আর রাজন। দুজনের সাথে ভালো মিল মাজহারের। সাথে দুটোকে মহাজনও বলা চলে। কড়া সুদে টাকা ধার দেয় মানুষকে, পরে তার বদলে জমি, ঘরের জিনিস অথবা ব্যবসা কেঁড়ে নেয়ার বহু নজির আছে। সেখানে গিয়ে মেরে এসেছে হামজা মাজহারকে। জয় সেখান থেকে নিয়ে আসছে হামজাকে। এখন অবধি জিজ্ঞেস করেনি, মাজহারের কী অবস্থা। কীভাবে মেরেছে, কী হাল করেছে! হামজা খুব শান্ত-শীতল মেজাজের পুরুষ। যতক্ষণ না জয়কে আঘাত করা হয়, তাকে ক্ষেপতে দেখেনি ছেলেরা। কিন্তু লতিফের স্ত্রীর কান্নাকাটি দেখেছে সে রাতে, লতিফের বাচ্চাদুটোর শুকনো মুখ দেখেছে। লতিফের রক্তাক্ত শার্টখানা দেখেছে।
হামজাকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে জয় দ্রুত গেল নার্সকে ডাকতে। এই অসময়ে হাসপাতালে নার্সের সংখ্যা কম চারদিকে। ব্যস্ত নার্স দাঁড়াতে বলল জয়কে। হুট করে জয়ের মেজাজ চটলো, অমানুষের মতো হয়ে উঠল মুহুর্তে, দাঁত খিঁচে উঠল, “ওঠ, তাড়াতাড়ি ওঠ! তোর পাশে যে মগা দাঁড়ায়ে আছে ওরে বল, ক্যানোলা ঢুকায়ে দিক এই লোকের! তুই আমার সাথ চল। ভাইয়ের হাতে রক্ত পড়তেছে, শুনতেছিস না কথা!ʼʼ চেঁচিয়ে উঠল শেষের দিকে।
নার্স কেঁপে উঠল। দ্রুত উঠে দাঁড়াল। রাগে শরীর কাঁপছে জয়ের। এখানে হামজা থাকলে নির্ঘাত একটা থাপ্পড় মারত কোনো মেয়ের সাথে এমন দূর্ব্যবহারের ফলে। নার্সকে নিয়ে এসে দাঁড় করালো হামজার পাশে। আসলে অনেকটা রক্ত বেরিয়ে সাদা পাঞ্জাবী রঙিন হয়ে উঠেছে হামজার। গালের পাশে কালশিটে দাগ দেখা যাচ্ছে। এটা অস্বাভাবিক নয়, নির্বাচনের আগে এমন অঘটন ঘটারই ছিল। ঝন্টু সাহেব ও তার ছেলে যে চুপচাপ বসবে না, এটা জানা কথা। নার্স ভয়ার্ত গলায় বলল, “কিছু ওষুধ আনতে হবে।ʼʼ
জয় তাড়া দিলো, “হ্যাঁ, বলেন সিস্টার কী কী ওষুধ লাগবে? আমি এনে দিচ্ছি, দ্রুত বলেন!ʼʼ
নার্স অপ্রস্তুত হলো, কিছুক্ষণ আগে কী ব্যবহার ছিল, এখনই আবার সিস্টার বলছে! একটা কাগজে নাম লিখে দিলো। জয় কারও হাতে দিলো না কাগজখানা। নিজে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল ওষুধ আনতে। হামজা চেয়ে রইল জয়ের যাবার পথে। নিজের হাতের তালুতে ব্যান্ডেজ জড়ানো, কপালে ব্যান্ডেজ, কোমড়ে ঘা। সে ছুটছে ভাইয়ের ওষুধ আনতে। হামজা এটাই সবাইকে বোঝাতে পারেনা, পুরো পৃথিবীর জন্য জয় আমির জঘন্য এক নাম, সেও মানে। কিন্তু বিশেষভাবে তার জন্য ওই ছেলেটা বিশেষ!
লতিফের চিকিৎসার সমস্ত খরচা হামজা বহন করল। কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল সকলে। শেষ রাতের দিকে সার্জারি করা হয়েছে লতিফের। এখনও সেন্স ফেরেনি।
চিন্তিত মুখে নিজের ব্যথা ভুলে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে পায়চারী করে চলল হামজা। সে কোনো সময় চায় না তার জন্য দলের ছেলেরা মূল্য দিক। সেদিন নিষেধ করে আসার পর হামজা নির্বাচন অফিসে গিয়ে ঝন্টু সাহেবের আপিল বাতিল করে এসেছে। তাতে যে ঝন্টু সাহেব ক্ষেপবেন তা জানা কথা। তবে আঘাতটা লতিফকে করে ওর পরিবারকে বিদ্ধস্ত করে তোলাটা ঠিক হয়নি ঝন্টু সাহেবের। মাজহার ভালো ঘা খেয়েছে। যতদিন নির্বাচন শেষ না হচ্ছে, ঝামেলা যে টুকটাক লেগেই থাকবে, এ-ও জানা কথা। নির্বাচনের পরেও কোনো বিশেষ ঝামেলা হওয়ার চান্স রয়েছে।
রাত করে বাড়ি ফিরল হামজা। জয় ঢুকে পড়ল নিজের ঘরে। তার পড়ালেখায় গাফলতি চলবে না এখন। ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে ডাকল মামিকে। দ্রুত পায়ে তরু এগিয়ে গেল, “কী হয়েছে, জয় ভাইয়া? খালামণি অসুস্থ, ব্যথা বেড়েছে। কিছু দরকার?ʼʼ
জয় জ্যাকেটের চেইন খুলে ইশারা করল জ্যাকেটটা খুলে নিতে। তরু জ্যাকেট খুলে নিয়ে সেটা হ্যাঙ্গারে বাঁধিয়ে রাখল। জয় বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “এককাপ গরম কফি বানিয়ে দে তো। আমি মামির কাছ থেকে ঘুরে এসে খাবো। আর ঘরটা ঝাড়ু দে, পায়ে নোংরা বাঁধছে!ʼʼ
তরু ঝাড়ু দিতে দিতে দেয়ালের দিকে তাকায়। চারদিকে বড়-ছোট ফ্রেমে বাঁধানো জয়ের ছবি, ওয়ালমেটে ভর্তি ঘরের দেয়াল।
জয় যখন মামির রুমে এলো, দেখল, হামজা মায়ের মাথার কাছে বসে আছে। মামা বারান্দার পাশে চেয়ারে বসা। মুখ বাঁকাল জয়, “ওখানে বসে কি নিজেকে বীরপুরুষ প্রমাণ করতে চাইতেছ? বারান্দা দিয়ে ঠান্ডা আসছে না? পরে তো খেঁক খেঁক করে কাশবে। তোমার কাশির আওয়াজ শুনতে একটুও ভাল্লাগে না, মামা! দরজা আঁটকে বসো!ʼʼ
শাহানা ব্যথায় কুঁকড়ে গেছেন। হামজা মাথা নিচু করে বসে আছে মায়ের শিওরে। জয় বকে উঠল, “শালার ডাক্তাররা যদি কষ্টের সময়ে চিকিৎসা না করতে পারবে, তাইলে ডাক্তার ট্যাগ লাগানোর মানে কী? ব্যথা এখন, সার্জারি করবে মাস কয়েক পরে, এইটা কোনো চিকিৎসার মধ্যে পড়ে?ʼʼ
তুলি জবাব দিলো, “তুই চুপ থাক! না বুঝে চেঁচাবি না। সবকিছুই তো আর তোর মুখের বকার মতো সহজ না! আগে ওষুধ খাইয়ে, ভেতরে একটা সার্জারির মতো পরিবেশ তৈরী করে এরপর সঠিক সময়ে সার্জারি করবেন ডাক্তারেরা। তোর মতো পদার্থবিজ্ঞান পড়ে অপদার্থ হয়নি তারা। ডাক্তার ওরা ভালো বোঝে।ʼʼ
জয় দাঁত খিঁচে বকতে গিয়ে আবার চুপ করল। এখানে সবার মন খারাপ, এখন চুপ থাকা ভালো মানুষের কাজ। জয়ের ধারণা, সে খারাপ হলেও মাঝেমধ্যে একটু ভালো মানুষের মতো আচরণ দেখিয়ে লোককে চমকে দেয়া ভালো।
বাইরে বেরিয়ে এলো। বাড়িটা খুব বিষণ্ন লাগছে। জয়ের ভালো লাগছে না বিষয়টা। কালই গিয়ে কোয়েলকে আনতে হবে। ও থাকলে এখন দৌঁড়ে এসে কোলে উঠে আবদার করতো, “মামা! আমিও ব্যান্ডেজ লাগাবো। এরপর দুজন চক্কেত কিনতে যাব। ম্যাচিং ম্যাচিং হবে তোমার আমার ব্যান্ডেজ।ʼʼ
শরীরের ব্যথা রাত বাড়ার সাথে সাথে প্রকট হচ্ছে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো। কোমড়ের ক্ষততে টান ধরেছে, পুরো গা-হাত-পা বিষব্যথা হয়েছে, এখন বোঝা যাচ্ছে। জয়ের রুমটা বাড়ির পেছন দিকে। এখান থেকে বাড়ির পেছনের জঙ্গল চলে গেছে। বিশাল ফাঁকা পতিত জমি পড়ে আছে, সেখানে জঙলি গাছ-পালা জন্মেছে। তরু কফি রেখে চলে যাবার সময় জয় ডাকল, “খাবারটা রুমে দিয়ে যা তো!ʼʼ
জয় জানে, ও না বললেও মেয়েটা ঠিক নিয়ে আসতো। কেন এত যত্ন করে জানার বা বোঝার চেষ্টা করেনি কখনও জয়। তবে এই নিঃসঙ্গ পাপে ভরা জীবনে এই মেয়েটার বেশ মনোযোগ পায় সে। তরু খাবার আনল, জয় তখন বিছানায় বসা। তরু খাবার রেখে চলে গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। জয় জিজ্ঞেস করল, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন?ʼʼ
চিকন, মিষ্টি কণ্ঠস্বর তরুর, “আপনি নিজে খেতে পারবেন? আমি খাইয়ে দেব?ʼʼ
অবাক হলো না জয়, সে জানতো এমন কিছুই বলবে তরু। চেয়ে রইল তরুর মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড। এরপর মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। যত্ন করে খাওয়াতে বসল তরু। খাবার চিবোতে চিবোতে একবার তরুকে দেখে নিয়ে নিঃশব্দে হাসল জয়, “আমি খারাপ, লোকে নাম শুনলেই নাক ছিটকায়। তুই বিশেষ এই যত্ন কেন করিস?ʼʼ
তরুর চোখের ঘন পাপড়ি নড়ে উঠল। একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। আস্তে করে বলল, “হাঁ করুন!ʼʼ
জয় লোকমাটা গালে না নিয়ে আবার হাসল, “ভালোবাসির আমায়?ʼʼ
হাত থেমে গেল তরুর। চোখের কোণে জলের ছিটা জমেছে। জয় হালকা ব্যস্ত হলো, “এই পাগলি, এই! কাঁদছিস কেন? আমি স্বয়ং পাপ, আমাকে ভালোবাসতে নেই। এজন্য আমিও পাপকেই ভালোবাসি অবশেষে। জীবনে এমন সব নিকৃষ্ট পাপ করে রেখেছি, কেউ যদি তার শাস্তি কোনোদিন দেয় আমায়, তাহলে তা হবে আমার জঘন্য মৃত্যু! আবার আমার পাপের পেছনে এমন কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, যা শোনার পর মানুষ ইমোশনাল হবে, বা বলবে এই জন্য আমি বাধ্য হয়েছি বা এমন হয়েছি। সবই করেছি ক্ষমতার জোরে। তুই যে আমায় ভালোবাসিস, তুইও সমান পাপী। কারণ আমার মতো পাপীষ্ঠকে কোনো সুন্দর মনের মানুষ ভালোবাসতে পারেনা, তা জানি আমি। যে কোনোদিন আমায় ভালোবাসবে, বা বেসেছে, আমি জেনে নিই, তার ভেতরেও আমার মতোই পাপ আছে। নয়ত কেউ আমার পক্ষপাতিত্ব করতে পারেনা।ʼʼ
তরু চুপচাপ খাবার খাওয়ায় জয়কে। সযত্নে মলম লাগিয়ে দিলো পিঠের ক্ষততে। ওষুধগুলো খাইয়ে দিয়ে, জয়ের হাতের ঘড়ি, শার্টটা খুলে দিলো। শুইয়ে দিয়ে কম্বলটা গলা অবধি তুলে দিয়ে মাথার কাছে বসল। গভীর মনোযোগের সাথে জয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো, চুল টেনে দিলো, কপাল টিপে দিলো। জয় চোখ বুজে চুপচাপ নেয় সেই সেবাগুলো। একদৃষ্টে চেয়ে রয় তরু জয়ের মুখের দিকে। খোঁচা দাড়ির গালটা হাত দিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করছে। জয়ের নিঃশ্বাস ভারী ভারী পড়তে শুরু করে। বহুদিন এভাবে পাশেই শুয়ে পড়েছে সে জয়ের। অথচ সকালে উঠে নিজেকে অক্ষত অবস্থায় দেখে জয়ের প্রতি ভালোবাসা বেড়েছে। একটা তাগড়া পুরুষের পাশে রাত কাটিয়ে যখন বোঝা যায়, পুরুষটি হাতও লাগায়নি নারী শরীরে, সেখানে প্রেম জাগার নয়? তরু মানে, জয় খারাপ। কিন্তু তার আপেক্ষিকতায় জয়ের খারাপের শিকার হয়নি সে, সুতরাং তার ভালোবাসা জায়েজ।
হঠাৎ-ই তরু একটা অকাজ করে বসল। গাঢ় একটা চুমু খেলো জয়ের কপালে। ফিসফিস করে বলল, “আপনাকে ভালোবাসা যদি পাপ হয়, আপনাকে ভালোবেসে আমায় যদি পাপী হতে হয়! তো পাপই ঠিক, আমি সেই পাপই করেছি। প্রেমিকা না হয়ে বরং আপনার পাপীষ্ঠা নারীই হয়েছি। তবুও আমি আপনাকে ভালোবেসেছি, জয় আমির! একথা অনস্বীকার্য, একথা চিরধার্য!ʼʼ
জয়ের ঠোঁটের এক কোণ প্রসারিত হয়ে উঠল। অবচেতন কানেই কথাগুলো শুনে ফেলল জয়? তরু আর বসল না, দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল জয়ের রুম থেকে।
চলবে..