রাত্রীপ্রিয়া #পর্বঃ৫ লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

0
110

#রাত্রীপ্রিয়া
#পর্বঃ৫
লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

“আমি দুই মাসের প্রেগন্যান্ট, রাহি। আমার প্রেগন্যান্সির রেজাল্ট পজিটিভ আসছে’রে। এই সিচুয়েশনে আমি এখন আমি কি করবো, রাহি?”

নিজের অবিহিত ছোট ননদ পরশ “প্রেগন্যান্ট” কথাখানা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেলো, রাত্রীপ্রিয়া’র! তার মাথা ঝিনঝিন করছে। নিজের সুখের সংসারে এ কোন, পা’প! এ কোন নতুন অশান্তি’র উৎপত্তি হলো!

বিকেলে নিজের বেডরুমে বিশ্রাম করছিলো, রাত্রীপ্রিয়া। কিছুদিন পরই তার ইন্টার প্রথম বর্ষে’র এক্সাম। পরশ ও রাত্রীপ্রিয়া দু’জনই প্রায় সমবয়সী। তারা একই ক্লাসে, একই কলেজে পড়াশোনা করছে। মেয়েলী সমস্যা’র জন্য গত দুই দিন কলেজে যায়’নি সে। পরশ গিয়েছিল। শুনেছে, ক্লাসে’র টিচাররা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নোটস দিয়েছে গতকাল। হঠাৎ সেকথা মনে পড়তেই, সেগুলো নেওয়ার জন্যই পরশে’র রুমে আসছিলো রাত্রীপ্রিয়া। দরজার কাছাকাছি আসতেই ভিতর থেকে ভয়ংকর কিছু বাক্য শুনতে পেয়ে তার বাড়ন্ত পা থেমে যায়। তাদের পরশ এমন কাজ করছে, বিশ্বাস করতে পারছে না সে। সত্যিই কি পরশ প্রেগন্যান্ট? এ কি করে সম্ভব? সে কি ভুল শুনছে? নাহ! নিজের কানকে কি করে অবিশ্বাস করবে। সে স্পষ্ট শুনেছে,পরশ ফোনে কাউকে এটা বলছে। রাহি, রাহি হচ্ছে পরশের ঘনিষ্ঠ বান্ধুবী। তার মানে, রাহি’র সাথে কথা বলেছে পরশ।

সংশয়ে পড়লো, রাত্রীপ্রিয়া। ততক্ষণাৎ কান খাড়া করলো, ভিতর থেকে এখন আর কোনো আওয়াজ আসছে না। হয়তো তার উপস্থিতি টের পেয়েছে,পরশ। ভিতরে যাওয়া ঠিক হবে, নাকি হবে না? কিছুক্ষণ নিজের সাথে দ্বিধা-দ্বন্ধ করে অবশেষে দরজায় টোকা দিলো। বললো,

“পরশ, আসবো?”

ভিতর থেকে পরশ খুব আস্তে করে বললো, “আয়।”

নিজেকে এমন ভাবে ধাতস্থ করলো রাত্রীপ্রিয়া যেন কিছুই শুনতে পায়নি সে। ধীরপায়ে রুমে প্রবেশ করে আড় চোখে একবার তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো, পরশকে। মেয়েটার চোখ দু’টো ফুলে আছে, কেমন বি’প’র্য’স্ত লাগছে তাকে!
মায়া হলো রাত্রীপ্রিয়া’র! পরশ নিজের বেডে নিচু হয়ে, হাঁটু ভাজ করে বসে আছে। রাত্রীপ্রিয়া বসলো তার পাশে। কাঁধে হাত রেখে মৃদু কণ্ঠে শুধালো,

“কেঁদেছিস? কি হয়েছে তোর, পরশ? আমাকে বল।”

চমকে উঠলো, রাত্রীপ্রিয়া। মুখে ভ’য়া’র্তে’র ছাপ। তবুও নিজেকে সামলে আমতা আমতা করে বললো,

“কই, কই কেঁদেছি। কিছু হয়নি আমার, কিছু হয়নি।”

“মিথ্যে বলছিস কেন, পরশ? তোর চোখে জল স্পষ্ট। ”
যা শুনে পরশ মলিন মুখে একটুখানি হাসি টেনে বললো,

“ভীষণ মাথা ব্যথা করছে’রে। তাই চোখ দিয়ে জল পড়ছে। তুই কিছু বলবি?”

রাত্রী বুঝে গিয়েছে, পরশ মিথ্যে বলছে। তাকে বলতে চাইছে না যখন সে-ও জোর করলো না আর। ততক্ষণাৎ উঠে বসলো, রাত্রী। নিজের আসার কারণ খানা আড়াল করে পরশকে বললো,

“ভালো লাগছিলো না। তাই ভাবলাম তোর সাথে একটু আড্ডা দিবো। চল ছাদে যাই।”

“না’রে ভালো লাগছে না। তুই যা, আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। আমি একটু ঘুমবো। তুই বের হওয়ার সময়, রুমের লাইটটা অফ করে যাস।”

বলতে বলতে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো, পরশ। মেয়েটার ভাবসাবে বলে দিচ্ছে, মেয়েটা কিছু একটা লুকাতে চাইছে। ভয়ংকর সে সত্য কেমন খোলসা হয়ে আসছে। রাত্রীপ্রিয়াও আর দাঁড়ালো না। পরশে’র কথা অনুযায়ী রুমের লাইট অফ করে বেরিয়ে পড়লো। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ, চোখেমুখে আ’ত’ঙ্ক! যদি সেসব সত্যিই হয় থাকে, তারা কি করে মুখ দেখাবে সমাজে? তার নেতা সাহেব, তার মামা’রা কি ভাবে ব্যাপারটা নিবে? এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের রুমের দিকে অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটছি, রাত্রীপ্রিয়া। এরিমধ্য, তানিয়া চৌধুরী ডাকলো তাকে। বললো,

“বউ মা!”

আচমকা ডাকে খানিকটা চমকালো, মেয়েটা। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বললো,

“জ্বি, মামনী!”

চৌধুরী বাড়ির ছোট-বড় সবার মধ্যে চাপা উওেজনা কাজ করছে। কেননা, দু’দিন বাদে সালাম চৌধুরী’র একমাত্র বোন, সানজিদা’র মেয়ে’র বিয়ে। তার দুই মেয়ে, শেফা ও সেতু। বড় মেয়ে শেফার বিয়ে হচ্ছে ব্যাপক ধুমধাম করে। ভাই-ভাবীদে’র নিকট সানজিদা’র আবদার, তারা যেন দু’দিন আগেই তাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়।
সায়মন, সানাম, রাত্রীপ্রিয়া বাদে চৌধুরী বাড়ি’র সকালেই এক্ষুণি সেখানে যাবে। সানাম চৌধুরী দুপুরে ফোন করে বাবা’কে জানিয়েছে,

“আমার ও সায়মনে’র ইমারজেন্সী কিছু কাজ রয়েছে, আমরা আজ যেতে পারছি না।
তুমি বিকেলে সবাইকে নিয়ে ফুপির বাড়িতে চলে যেও বাবা। আমি রাত্রী, সায়মন সময় মতো বিয়ের অনুষ্ঠানে’র দিন উপস্থিত হবো।”

ছেলের কথা অনুযায়ী দু’দিন আগেই বড় ভাগ্নী’র বিয়েতে যাচ্ছে, তারা। সবার মাঝে কত আনন্দ কাজ করছে! ছোট বড় সবাই নিজেদের মতো, গোছগাছ করছে। কোনদিন কে কি পড়বে, কিভাবে সাজবে! কোন ড্রেসে বেশি মানাবে। এসব নিয়ে বাচ্চারা, বড়রা মাতামাতি করছে।

তানিয়া চৌধুরী তার ছোট মেয়ে পরশে’র রুমেই যাচ্ছিলো। সবার মধ্যে থেকে ছোট মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই তার। এরিমধ্যে এখানে রাত্রী’কে দেখে ব্যস্ত কণ্ঠে উনি বললো,

“সবাই গোছগাছ করছে, আমরা এক্ষুণি বের হবো বাসা থেকে। হাতে একদম সময় নেই। তুমি একটু পরশকে ডেকে দেও তো, মা। ও এখনো আসছে না, যে।”

যা শুনে রাত্রীপ্রিয়া’র মুখটা শুকিয়ে গেলো। বিয়ে নিয়ে সবাই কত এক্সাইটেড!
সবার এই আনন্দ দেখে, রাত্রীপ্রিয়া নিজের শোনা কথা চেপে গেলো খুব গোপনে। তার এসবে বলতে ইচ্ছে করছে না আজ। থাক না সবাই একটু আনন্দই করুক। এরকম দুঃসংবাদটা না হয় পরেই শুনলো। রাত্রীপ্রিয়া ততক্ষণাৎ শ্বাশুড়িকে মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে বললো,

“আচ্ছা মামনী, আমি দেখছি।”

পুনরায় শ্বাশুড়ি’র কথা অনুযায়ী মেয়েটা ডাকলো, পরশকে। সবটা শুনে,পরশ সাথেসাথে নাকোচ করে দিলো। সে এখন যাবে না, তার মাথা ব্যথা করছে। পরশ যাবে না শুনে, তানিয়া চৌধুরী, রোকসানা চৌধুরী, পায়েল ও তানহা আসলো তার রুমে। সবাই সাধাসাধি করছে। জোর করছে তাকে। পায়েল অভিমান নিয়ে বললো,

“তুই না গেলে আমিও যাবো না, পরশ।”

তানহা বললো, ছোট আপু তোমাকে এক্ষুণি আমাদের সাথে যেতেই হবে। আমাদের কত কত প্ল্যান। তুমি না গেলে জমবে না। প্লিজ, চলো না!”

হুট করে রেগে গেলো, পরশ। চিৎকার দিয়ে বললো,

“আশ্চর্য! তোরা এমন করছিস কেন? কতবার বলছি আমার শরীর খারাপ লাগছে, আমি যাবো না। তোরা যাবি যা, আমাকে বিরক্ত করছিস কেন?”

হঠাৎ মেয়েটার এমন আচরণে বিস্মিত হলো, সবাই। যে মেয়ে কোনো অনুষ্ঠানে হলে, সবার আগে রেডি হয়ে সবাই’কে তাড়া করতো। আজ তার চোখে মুখে বিরক্ত। তানিয়া চৌধুরী’র চিন্তিতে হলো। কি হলো হঠাৎ মেয়েটার? ইদানীং তার আগের সেই চঞ্চলতা হারিয়ে গিয়েছে। সবসময় নিজের রুমে চুপচাপ থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যায়। পরিস্থিতি সামলাতে রাত্রীপ্রিয়া বললো,

“তোমরা সবাই যাও। পরশ আমাদের সাথেই না হয়, গেলো। তাছাড়া, তোমারা সবাই চলে যাচ্ছো। বাসায় আমার একা একা ভালো লাগবে না, পরশ না হয় আমার সাথেই থাকুক।”

তানিয়া চৌধুরী আপওি করে বললো, “আমার মেয়েটা অসুস্থ। আর আমি তাকে রেখে বিয়েতে যাবো? না! আমিও যাবো না, আজ।”

শ্বাশুড়ি’কে আশ্বাস দিয়ে রাত্রীপ্রিয়া বললো, আমি আছি তো। আমি দেখে রাখবো, ওকে। কোনো অসুবিধা হবে না, মামনী। উনি আসলেই ডক্টরে’র কাছে নিয়ে যাবো, পরশকে। আপনি চিন্তা করবেন না। ”

এরপরও একে একে সবাই আপওি করলেও তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিলো, রাত্রীপ্রিয়া।
_________

রাতে দশটায়, বাসায় সানাম চৌধুরী ও সায়মন চৌধুরী ফিরলো। দুই ভাই, ফ্রেশ হয়ে টুকটাক কথা বললো। এরিমধ্যে রাত্রীপ্রিয়া রাতের ডিনার রেডি করলো। ডাকলো, সবাইকে। সবাই আসলেও, পরশ খাবে না বললো।
মেয়েটা বিকেল থেকে একবারও বের হয়নি রুম থেকে। ডক্টরে কাছেও যাবে না। তার মাথা ব্যথা এখম কমে গিয়েছে। শুধু একটু শরীর দুর্বল লাগছে। ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে। তাই আর কেউ তাকে জোর করলো, না।

উঠে দাঁড়ালো, সানাম চৌধুরী। খাবার প্লেট হাতে নিয়ে বোনের রুমে গেলো। ভাইকে দেখেই শোয়া থেকে উঠে বসলো, পরশ। সানাম চৌধুরী বসলো বোনের কাছে। নিজ হাতে ভাত মাখিয়ে মুখের সামনে ধরলো। আদুরে কণ্ঠে শুধালো,

“খেয়ে নে, পরশমণি। এতো বড় রাতে না খেয়ে, থাকতে নেই, সোনা। অল্প করে খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমি পড়।”

সাথে-সাথে অপরাধী ন্যায় মাথা নিচু করে, ফেললো পরশ। তার কান্না দলাপাকিয়ে আসছে। তবুও নিজেকে সামলাতে চাইছে। ছলছল চোখে, দ্রুত ভাইয়ের হাতে খেয়ে নিলো। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেও কিচ্ছুটি বললো না,সানাম চৌধুরী। বোনকে খাইয়ে দিয়ে শুয়ে দিলো। মাথার পাশে বসে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

“চোখ বন্ধ কর, বুড়ী। ঘুমানোর ট্রাই করো। আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ভাই হাত বুলিয়ে দিলে ব্যথা সেরে যাবে।”

“আমি ঠিক আছি ভাই। তুমি যাও, খেয়ে নেও। আমি এমনিতেই ঘুমিয়ে পড়বো এখন।”

বোনকে থামিয়ে দিলো, সানাম। পরশ আর কথা বাড়ালো না। মাথায় ভাইয়ের আদুরে ছোঁয়া অনুভব করতেই, কিছুক্ষণ পরই ঘুমিয়ে পড়লো সে। সানাম চৌধুরী আরো কিছুক্ষণ বোনের মাথা হাত বুলিয়ে দিলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে বোনকে, কত মায়া তার বোনের মুখে। হঠাৎ করেই, দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। বোনের কপালে আলতো চুমু খেয়ে তবেই রুমের লাইট অফ করে বেরিয়ে পড়লো।

চলবে……

[রেসপন্স করবেন সবাই। কেমন লাগছে গল্প? ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here