#রাত্রীপ্রিয়া
#পর্বঃ১৪(শেষ অংশ)
লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
চিন্তিত ভঙ্গিতে খাবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, সালাম চৌধুরী। বাবা’কে উঠতে দেখে সানাম চৌধুরী বললো,
“কি হলো আব্বু, উঠলে কেনো? বসো, খাবারটা শেষ করো।”
“তোমরা খেয়ে নেও। আমি পরশমণির সাথে খাবো।”
বলতে বলতে নিজের খাবার প্লেট হাতে নিলো, সালাম চৌধুরী। পা বাড়ালো ছোট মেয়ের রুমের দিকে। উনার পিছনে পিছনে রাত্রীপ্রিয়াও সেদিকে গেলো। উপস্থিত সবাইকে একবার বলে গেলো,
“আমিও একটু যাই। পরশকে দেখে আসি।”
কেউ আর প্রত্যুত্তরে কিচ্ছুটি বললো না। সবাই চুপচাপ খাচ্ছে, শুধু খাবার প্লেটে হাত রেখে খাবার নাড়াচাড়া করছে, সানাম চৌধুরী। বাসায় আসার পর থেকে তার চোখ-মুখ অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর। ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো সায়মন। খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর কি কিছু হয়েছে, সানাম? এতো চিন্তিত লাগছে কেন তোকে?
“কিছু হয়নি।”
ছোট্ট করে জবাব দিয়ে ততক্ষণাৎ খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, সানাম চৌধুরী। সায়মন আবার বললো,
“উঠলি কেন? কিছুই তো খেলি না।”
“খেতে ইচ্ছে করছে না।”
বলে চটজলদি নিজের রুমে চলে গেলো, ছেলেটা। ছেলে কিছু খেলো না দেখে, মা হা-হুতাশ শুরু করলো। সে-ও বারকয়েক ডাক দিয়ে বললো,
“খাবারটা শেষ করে যা,বাবা। কতবড় রাত, না খেলে শরীর খারাপ করবে।”
সানাম চৌধুরী সেসব সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।
বিচক্ষণ পুলিশ অফিসার সায়মন চটজলদি বুঝলো, সানাম চৌধুরীর খুব বড় রকমের কিছু একটা হয়েছে। ছেলেটা, কারণটা সবার থেকে লুকাতে চাচ্ছে। সায়মনের চিন্তা হলো, কি হলো ভাইয়ের? যাই হোক, এখন জিজ্ঞেস করে লাভ হবে না। পরে একসময় জেনে নিবে বলে ভাবলো, সায়মন।
.
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে আছে, পরশ।
ফোন হাতে প্রিয় পুরুষটির ছবির দিকে ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মেয়েটা। ছবিটায় বারবার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে। মানুষটাকে দেখতে কতোটা মায়াবী লাগে। চোখে মুখে কতো মায়া ঝড়ে তার! এই মায়ায় মুগ্ধ হয়েই তো তার প্রেমে পড়েছিলো, পরশ। বোকা মেয়েটা দেহ-মন উজাড় কইরা ভালোবাসলো, মানুষটাকে। এরপর, এরপর ছেড়ে যাবো না বলেও মানুষটা তাকে মাঝ পথে ছেড়ে দিচ্ছে। পুরোনো কথা ভাবতেই অশ্রুতে টলমল করে উঠলো, আঁখি। দু’ফোটা জল গড়িয়েও পড়লো ফোনের স্ক্রিনে। তবুও মেয়েটার দৃষ্টি অনড় শখর পুরুষের প্রতিচ্ছবিতে। সেদিকে তাকিয়েই হঠাৎ করেই সে আক্ষেপ করে বলে উঠলো,
“তুমি দেখতে মায়ারাজ, তবে পাষাণ!”
একটু বলে থামলো মেয়েটা। পুনরায় ভারী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বললো,
“আমার অভিমান কখনো জিততে পারেনি তোমার ভালোবাসার কাছে।আজ ভাবতেই, অবাক লাগে! এতো তীব্র ভালোবাসার ও রঙ পাল্টে গেলো, কতটাই সহজে।”
এরিমধ্যে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই কল্পনা থেকে বের হলো, পরশ। বাবা অনবরত ডাকছে,
“পরশমণি? মা, ঘুমিয়েছিস? দরজাটা খোল।”
বাবা’র কণ্ঠ শুনতেই ফোনটা চটজলদি লুকিয়ে ফেলে, পরশ। নিজেকে স্বাভাবিক করতে, ওয়াশরুম থেকে দ্রুত চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে এলো পরশ। এরপর বিষন্ন মনে দরজা খুলে দিলো। সালাম চৌধুরী খাবার হাতে ভেতরে প্রবেশ করলো,সাথে রাত্রীপ্রিয়া ও। বাবা খাটে গিয়ে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো,
“দরজা খুলতে এতো দেরি করলি কেন, মা?”
পরশ মাথা নিচু করে বললো, “ঘুমিয়ে পড়ছিলাম বাবা।”
মেয়ের কথা যেন তার বিশ্বাস হলো না। উনি বিজ্ঞদের মতো তাকালো মেয়ের মুখোপানে। মুহূর্তেই আ’ত’ঙ্কে উঠলো, বাবার কোমল হৃদয়। মেয়েটার চোখ দু’টো লাল,ফুলে গিয়েছে অস্বাভাবিক রকমের। ততক্ষণাৎ উনি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
“পরশমণি? সোনা মা! তোর কি হয়েছে? এমন লাগছে কেন তোকে, চোখ-মুখ এতো লাল কেনো?বাবা’কে বল।”
কত মায়া শুনালো বাবা’র মুখে, পরশমণি নামটা। ততক্ষণাৎ বাবা’র দিকে তাকালো, পরশ।
বাবা তাকে সবসময় আদর করে “পরশমণি” বলে ডাকে। এই মানুষটাকে সে ঠকিয়েছে। একজনকে ভালোবেসে বিভোর হয়ে, ঠকিয়েছে তার পরিবারকে। ভাবতেই, অপরাধবোধ অনুভব হলো মেয়েটার বক্ষে। অনুশোচনায় বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। আবারো কান্না দলা পাকিয়ে আসছে। সারাদিন কাঁদার ফলে এই অবস্থা হয়েছে। বাসায় এসে একাকী খুব কেঁদেছে। আজকাল যেন কান্না তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই যে এখনো গলা ফা’টি’য়ে কান্নারা ভেতর থেকে উতলে আসছে।
তবে সে কাঁদল না। বরং মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হাসলো। বোকা বোকা হেসে বললো,
“ঘুমিয়ে গেছিলাম তো, তুমি ডাকলে তাই কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলো। এজন্যই এমন লাগছে বাবা। তুমি খামোখা চিন্তা করো না তো।”
মেয়ের কথায় যেন স্বস্তি পেলো, বাবা। বোকা বাবাটা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারলো না, মেয়ের মনের অবস্থা। আসলে তাকে বুঝতে দেওয়া হলো না। তবে এসব বুঝলো রাত্রীপ্রিয়া। সবটা বুঝেও নিরব দর্শকের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে, মেয়েটা। এরিমধ্যে সালাম চৌধুরী নিজ মেয়ে’কে বললো,
“তোর জন্য খাবার নিয়ে এসেছি,মা। আয় খাইয়ে দি।”
বিনাবাক্যে বাবা’র পাশে বসে পড়লো, পরশ। তার খেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও শত যন্ত্রণার মাঝে বাবা’র আদরটুকু হাতছাড়া করলো না সে। কে জানে, হয়তো বাকি জীবনটায় এ আদর নাও জুটতে পারে তার কপালে।
সালাম চৌধুরী আনন্দ সহকারে নিজ হাতে মেয়ে’কে এক লোকমা ভাত মুখে তুলে দিলো। এরপর রাত্রীপ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুই দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো, মা? আয় এদিকে আয়। বোস আমার কাছে। নে, হা কর। তোকেও খাওয়িয়ে দিচ্ছি আমি।”
রাত্রীপ্রিয়া খানিকটা মুচকি হাসলো। বসলো মামার পাশে। দুই মেয়ে’কে দুই পাশে বসিয়ে, পুরোটা ভাত তাদের খায়িয়ে দিলো, সালাম চৌধুরী। এদের সাথে ফাঁকে ফাঁকে নিজেও কিছুটা খেলো। পেটে ভাত পড়তেই, পেট মোচড় দিয়ে উঠলো পরশের। বমি পাচ্ছে খুব। এতোদিন মাথা ঘুরতো শুধু। কিছুদিন ধরে বমি বমি ভাবটা এর সাথে যোগ হয়েছে। কি যে অসহ্য! মা হচ্ছে বলেই এই লক্ষণ। এদের সামনে বমি করলে, কি ভাববে? পরশ প্রাণপণ আটকাতে চাইছে বমিটা। রাত্রীপ্রিয়া খেয়াল করলো পরশের মুখের ভঙ্গিমা। তাই কায়দা করে সে মামা’কে রুম থেকে বের করতে চাইছে৷ বললো,
“মামা, আপনাকে বোধহয় আপনার ছেলে ডাকছে। এমনটা শুনলাম যেনো। আপনি এখন যান, গিয়ে এঁটো হাতটাও ধুয়ে নিন।”
উনি আর কথা বাড়ালো না। এঁটো থালা হাতে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
“আচ্ছা, যাচ্ছি আমি। মা, পরশমণি। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাস।”
পরশ কোনো রকম মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। বাবা বের হতেই, গলগল করে বমি করে ভাসিয়ে দিলো রুম। আর আটকানো গেলো না। রাত্রীর সম্মুখে এ কাজে ভীষণ লজ্জিত হলো, পরশ। রাত্রী তাকে দ্রুত ধরলো। বিছনায় বসিয়ে দিয়ে, খাবার পানি এগিয়ে দিলো। মিনিট দশেক যেতেই পরশ স্বাভাবিক হলো। এতক্ষণ একদম চুপচাপ ছিলো, রাত্রীপ্রিয়া। পরশকে স্বাভাবিক হওয়ার সময় দিয়ে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো,
“বলতো, তোর কি হয়েছে পরশ?”
এতোদিন এই কথাটা বলতে গিয়েও সেভাবে বলার সুযোগ হয়নি। আজ যখন সুযোগ হলো, বিষয়টা ক্লিয়ার হওয়া দরকার। কিন্তু পরশ মেয়েটা ভয়,লজ্জায় সবকিছু অস্বীকার করলো। আমতা আমতা করে জবাব দিলো,
“কি হবে আমার, কিচ্ছুটি হয়নি।”
“কথা লুকাচ্ছিস পরশ? লুকাস না, আমায় শেয়ার কর। সবকিছু বল। এতে মন হালকা হবে, সমস্যার সমাধান হবে।”
“আশ্চর্য! তুই এমন করছিস কেন, রাত্রী? বললাম তো আমার কিছু হয়নি।”
“তাহলে, তুই বমি করলি কেন?”
পরশ চুপ হয়ে গেলো। কথা শুনেও জবাব দেওয়া আগ্রহ দেখালো না। বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নিলো। রাত্রীপ্রিয়া অহেতুক আর প্রশ্ন করলো না, কথা বাড়ালো না। চটজলদি পরশের পাশ থেকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, সে । পরশের দিকে এক নজর তাকিয়ে বললো,
“তুই শুয়ে পড়। কাজের খালাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, উনি এসে রুম পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে।”
ব্যাস্ত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো, রাত্রীপ্রিয়া। তার চিন্তা হচ্ছে, বড় চিন্তা হচ্ছে। বিষয়টি গোপন রাখার মতো সাধারণ নয়। মান-ইজ্জত, সম্মানের ব্যাপার। খুব দ্রুত এর একটা সমাধান বের করা উচিৎ। বিষয়টা আর কোনোভাবে চেপে রাখা যাবে নয়। কঠিন এক সত্য, মামনীকে বলা উচিৎ।
রাত্রীপ্রিয়া সবদিক বিবেচনা করে ততক্ষণাৎ চলে গেলো, তানিয়া চৌধুরীর কাছে। উনি ও রোকসানা চৌধুরী দুই জা মিলে টিভিতে সিরিয়াল দেখছিলেন। রাত্রীপ্রিয়া কাছে গিয়ে তাকে নিচু কণ্ঠে বললো,
“মামনী?”
“হ্যাঁ, কিছু বলবে তুমি?”
“আমার সাথে একটু আসবেন? দরকারী একটা কথা বলতে যাচ্ছি।”
“এক্ষুনি? সিরিয়ালটা শেষ হোক।”
“খুব আর্জেন্ট।”
অগত্যা তানিয়া চৌধুরী উঠলো। জা কে বলে গেলো,
“এই ছোটো? এরপর কি কাহিনী হয় আমায় বলিস। আমি একটু আসছি।”
“আচ্ছা আপা যাও। তবে, তাড়াতাড়ি এসো।”
তানিয়া চৌধুরী’কে নিয়ে নির্জন ছাঁদে আসলো, রাত্রীপ্রিয়া। যা দেখে তানিয়া চৌধুরী অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি ব্যাপার, রাত্রী? আমাকে এখানে নিয়ে আসলে কেনো? কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে, তুমি? যে এতো রাতে আমায় ছাঁদে নিয়ে আসলে।”
মেয়েটা আলগোছে আরো একবার নিজের ভেতরে কথাগুলো সাজিয়ে নিলো। এরপর কোনো বণিতা ছাড়াই বললো,
“আমি কিছু বলতে চাই, মামনী। কথাটা আপনি কিভাবে নিবেন আমি জানি না।”
“আচ্ছা, বাবা এবার বলো। আমার এতো তড় সইছে না।”
“মামনী? আপনার ছোট মেয়ে পরশ, প্রেগন্যান্ট।”
চলবে……
[গল্প কেমন লাগছে জানাবেন?এই পর্বে রাত ১০ টায় ১ হাজার রিয়েক্ট হলে, বোনাস পর্ব দিবো।]