স্রোতস্বিনী #মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা পর্ব ০৫

0
145

#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ০৫

[অতীত]
গভীর রাত,দু’টো কি তিনটে বাজবে হয়তো।সেসবে খেয়াল নেই স্রোতের।সে পড়াশোনায় ব্যস্ত।মধ্যে দু’দিন পার হয়েছে।স্রোত বিয়ের বিষয় নিয়ে আর মাথা ঘামায় নি।তার মতে,এসব আজাইরা জিনিস নিয়ে ভেবে মাথার মেমোরি জ্যাম করার কোনো মানেই হয় না,যখনের ব্যাপার তখন দেখা যাবে।সবসময় এমন মনোভাব নিয়ে চলেছে সে।আসলেই তো এগুলা সময় নষ্ট করা ছাড়া কিছুই নয়।কিন্তু সবাই তা বুঝে না,নিজের গুরুত্বপূর্ণ সময় গুলো এসব নিয়ে ভেবেই হারিয়ে ফেলে।সময় অনেক মূল্যবান।কিন্তু বনলতা বেগম যে দুইদিন অভিমান করে ফোন দেননি,তা ঠিকই বুঝেছে সে,কিন্তু তার কি-ই বা করার আছে?তখনই মান্ধবী রুমে এসে বিছানায় বসে পড়লো।সে উশখুশ করছে,মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়।

“কিরে ঘুমাস নি কেনো এখনো?” বইয়ের দিকে মুখ রেখেই জিজ্ঞাসা করলো স্রোত।
“মাত্রই পড়া শেষ করলাম।এই ফিজিক্স আমার জীবন ত্যানাত্যানা করে দিচ্ছে।কে আবিষ্কার করছিলো এই জিনিস,তারে পাইলে তাল গাছের নিচে বেঁধে বসায়ে উপর থেকে তাল ফেলতাম,হুহ।” বিরক্তি নিয়ে বললো মান্ধবী।

স্রোত হাসলো কিন্তু কিছু বলে নি।মনোযোগ তার বইয়ের দিকেই।মান্ধবী সাহস জুগিয়ে বললো,
“আপু আমি আজকে তোমার সাথে ঘুমোই?”

স্রোত বুঝলো বোন তাকে কিছু বলতে এসেছে,কিন্তু কোনো কারণে বলতে পারছে না।সাধারণত এমন আবদার মান্ধবী তখনই করে যখন কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করতে চায়।তাই সে বললো,
“কি বলতে চাস সোজাসুজি বল!”
মান্ধবী বুঝলো বোন বুঝে ফেলেছে।তাই ঢোক গিলে বললো,
“তুই বিয়েটা করে নে আপু।”
এতোক্ষণে স্রোত মান্ধবীর দিকে তাকালো।বোনের শান্ত দৃষ্টি দেখে মান্ধবী নিজেই বলা শুরু করলো,
“বনলতা আন্টি ফোন দিয়েছিলো তোর খবর জানতে।বাবার সাথেও কথা বলেছে।আমি বাবার সাথে কথা বলেছি,বাবাও চায় বিয়েটা হোক।কিন্তু তোকে কিছু বলতে পারছে না।বাবার মতে,যেই ছেলের মা এতো ভালো,ছেলেটা না জানি কতো ভালো।”এক নিঃশ্বাসে বলা শেষ করলো।

” অসম্ভব, বিয়ে আমার দ্বারা হবে না।তুই ভালো করেই জানিস আমি বিয়ে ভয় পাই।”
“সেটার কারণ হচ্ছে মায়ের সংসার আর বাবা।বাবা-মায়ের মধ্যে মিল ছিলো না বলে ওদের মধ্যে ঝামেলা লেগেই থাকতো।হ্যা,মানছি বাবা বেশি বেশি করতেন।তাই বলে সবাই এমন করবে তার কি গ্যারান্টি?”সাহস নিয়ে বললো মান্ধবী।

সে পণ করেছে বোনকে রাজি করিয়েই ছাড়বে।মা মা রা যাওয়ার পর থেকে বোন অন্যরকম হয়ে গেছে।আগে কত হাসি-খুশি ছিলো।তার চঞ্চলা বোনটা সময়ের ব্যবধানে গম্ভীর হয়ে গিয়েছে।কিন্তু আর না।এভাবে মানুষ বাঁচে নাকি?তাছাড়া সে ফেসবুক থেকে মেহরাদকে দেখেছে, তার অনেক ভালো লেগেছে।ওদেরকে একসাথে খুব মানাবে।স্রোতকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলা শুরু করলো,

” আপু তুই নিজেই তো বলিস যে তোর ফ্রেন্ডদের বাবারা কত ভালো।তাদের মুখে যখন তাদের বাবার গল্প শুনিস তোর রূপকথার গল্পের মতো লাগে,তুই বলিস নি আমায়?আমারও এমন লাগে।আমার ফ্রেন্ডদের বাবারা কত হাসিখুশি, ওদের সাথে কত মজা করে,ফ্রেন্ডলি। সবাই এক না আপু।আর বাবাও চেঞ্জ হয়ে গেছে,এখন আমার সাথে ফ্রেন্ডলি ব্যবহার করে।কিন্তু তুই দূরে দূরে থাকিস বলে তোকে তোর মতো থাকতে দেয়,নিজে অপরাধবোধে ভোগে।”
“লাভ কি? আমার মা তো দেখে যেতে পারে নি।আমার মা কে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছে।” তাচ্ছিল্যের সাথে বললো স্রোত।
“আপু ভুলে যাস না,মায়ের ক্যান্সার হয়েছিলো।ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকেই বাবা চেঞ্জ হয়ে যায়।মায়ের পাশে ছিলো।কিন্তু আমাদের মায়ের হায়াত ছিলো না।যাই হোক,তুই বিয়েটা করবি আপু।জীবন সবাইকে সুযোগ দেয় না তোকে দিয়েছে, আগের মতো হওয়ার।আর বনলতা আন্টি সে ওতো কতো ভালো,ঐদিন আমাকে কত আদর করলেন,কত কথা বললেন আমার সাথে।মনেই হয়নি ঐদিন উনি আমাকে প্রথম দেখেছেন।আবার,তুই নিজেও ঐদিন বললি,উনার সাথে থাকতে তোর ভালো লাগে,তোর মন ভালো হয়ে যায়,তুই উনার শরীরে মা মা গন্ধ পাস।বলিস নি বল?আগে কখনো এমন হয়েছে?”

স্রোত প্রায় অনেক কথাই মান্ধবীর সাথে শেয়ার করে।বনলতা বেগমের সাথে পরিচয়,তাকে নিয়ে মনে হওয়া অনুভূতি সবই মান্ধবীকে বলেছিলো সে।সে এবার ভাবনায় পরে গেলো।মান্ধবী যা যা বললো সবই তো সত্যি, তাহলে কি করা উচিত?সে কথা ঘুরানোর জন্যে বললো,
“আমার সামনে পরীক্ষা, মাথা খারাপ করিস না যা এখান থেকে।”
“এই একদম কথা ঘুরাবি না,পরীক্ষার ২ মাস আগে কে পড়ে?সবাই রিভাইস দেয়।আর তোকে আমি চিনি,পরীক্ষা যদি কালকেও হয় তাহলেও তুই টপ টেনের একজন হবি।তুই বিয়ে নিয়ে ভাব।আমি ঘুমাই।”বলে স্রোতের বিছানাতেই শুয়ে পড়লো মান্ধবী।
স্রোত টেবিলের দিকে মুখ করে বসলো।কিছু একটা ভাবতেই মান্ধবীর ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে,
” এই আপু শোন”
“আবার কি হয়েছে?”
“তুই বিয়ে না করলে আমি বিয়ে করে নিবো মেহরাদ সাদাফকে।হায়য়য়য়য়য়,ছবিতেই কত সুন্দর না জানি বাস্তবে কত সুন্দর,ওনার হাসি,ওনার চোখ।ইশশশশশশশশ আমি শেষ।” রসিয়ে বললো মান্ধবী।
স্রোত যেনো এমন কথা আশা করে নি।রাগী চোখে তাকাতেই মান্ধবী “ঘুমাচ্ছি ডিস্টার্ব করিস না” বলে মুখের উপর চাদর টেনে নিলো।
বোনের কান্ডে হেসে ফেললো স্রোত।আসলেই তো লোকটা তো এতো খারাপ না,মায়ের সাথে কি সুন্দর সাবলীল ভাবে কথা বলে,কেয়ার করে মনেই হয় না সে এতো উচ্চপদস্থ একজন ব্যক্তি।ঐ ধূসর বর্ণের চোখগুলো,লোকটার হাসি,নিজে নিজে আওড়ালো,
“মেহরাদ সাদাফ”
চোখের সামনে যে মেহরাদের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো।নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পেলো স্রোত।নিজেকেই গা লা গা ল দিলো।

ঐদিকে বনলতা বেগম বাসায় ফিরে মেহরাদকে সব জানায় এটাও বলে স্রোত বিয়ে করতে চাচ্ছে না।মেহরাদ অবাক হয়নি একটুও, ভাবলো স্রোতের হয়তো রিলেশন আছে,এটা স্বাভাবিক।ফিফথ ইয়ারের একটা স্টুডেন্টে রিলেশনে জড়িয়ে থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।সে মা কে বোঝানোর চেষ্টা করলে তিনি বললেন,
“স্রোতের এমন কিছু নেই।তুই খোঁজখবর নিবি ভালো করে।স্রোতকে এই বাড়িতে আমি বউ হিসেবে দেখতে চাই।”

মেহরাদও ২ দিনে স্রোতের সব ইনফরমেশন কালেক্ট করেছে,মায়ের কথায় করেছে নাকি নিজের জন্য?হয়তোবা নিজের জন্যই।প্রকৃতিতে বসন্তকালের রাজ্য,হয়তোবা বসন্ত কাল দখিনা বাতাসের সাথে তার জীবনেও স্রোত এনেছে।প্রথম রাতে সে ঘুমোতে পারে নি,বারান্দায় খোলা আকাশের নিচে কাটিয়েছে আর সিগারেটের ধোয়া উড়িয়েছে।সিগারেটর নে শা তার কখনোই ছিলো না,কিন্তু স্রোতের রিজেকশন কোথাও না কোথাও সে মেনে নিতে পারে নি।জীবনের প্রথম সিগারেট টেস্ট করেছে,তাও তার নেশা হয় নি।বিরক্তি নিয়ে পুরো প্যাকেটটাই রাস্তায় ফেলে দিয়েছে।পরেরদিন তার খুশির দিন,সে শান্তিতে ঘুমিয়েছে আপন মনে।সে স্রোতের সম্পর্কে জেনেছে,আদৌতে রিলেশনে কোনোদিনও সে জড়ায়নি।তাহলে সমস্যা অন্যকোথাও বুঝে নিয়ে স্রোতের সাথে কথা বলার ডিসিশন নেয় সে।

পড়ন্ত বিকেল। দীপ্তিময় সূর্যের সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে এই ব্যস্ত শহরের বুকে।মাথার উপর দিয়ে একঝাঁক নাম না জানা পাখি উড়ে যাচ্ছে,হয়তো বা নিজের নীড়ে ফিরছে।মুঠো মুঠো শুভ্র মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছে।আজ অনেকদিন পর স্রোত ছাদে আসছে।এই স্নিগ্ধ বিকেল স্রোতের খুব পছন্দের।এই বিকেল যেনো কোনো এক সুন্দর দিনের সমাপ্তি ঘোষণা করে,আধারিয়া রাতের সূচনার ইঙ্গিত দেয়।স্থির, অটল-অনঢ় সূর্যের প্রতিবিম্ব প্রতিভাত হয় স্রোতের চোখে।কতদিন পর এমন একটা মুহুর্তের দর্শন সে পেলো।প্রতিদিনই সেই সকালে বের হয় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।আজ সে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছে, তাই তো এমন একটা মুহুর্ত উপভোগ করতে পারলো। এই ছাদে তার, তার মায়ের আর মান্ধবীর কত স্মৃতি রয়েছে,,কত হাসি_ঠাট্টা করতো ওরা তিনজন,আজ সবই অতীত।পুরনো মিষ্টি স্মৃতিতে ডুবে থাকা যেনো মোবাইলটার সহ্য হলো না,সে সর্বোচ্চ চেষ্টায় বেজে যাচ্ছে।কে ফোন করেছে দেখতেই স্রোতের মুখে হাসি ফুটে উঠে।এই মহিলার প্রতি এক অদ্ভুত টান অনুভব করে,এই কয়দিনেই কত ভালোবেসে ফেললো তাকে।ফোন রিসিভ করেই সালাম দিলো স্রোত।বনলতা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“কেমন আছো?বাসার সবাই কেমম আছে?
” জ্বী আন্টি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনি কেমন আছেন?আপনার হাতের কি অবস্থা?”
“ভালো।হাতও ঠিকঠাক।বিয়ের ব্যাপারে কি ডিসিশন নিলে?”
“আসলে আন্টি…
স্রোতকে শেষ করতে না দিয়েই উনি আবার বললেন,
“আমার বিশ্বাস তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিবে না।আমার এত্তো বড় বাড়ি তোমার অপেক্ষা করছে স্রোত।তুমি তোমার আরেক মায়ের কাছে আসবে না স্রোত?”
“আমি মানাই নিতে পারবো না আন্টি,বোঝার চেষ্টা করুন প্লিজ।”
“আমার কোনো সমস্যা নেই,শুধু বিয়ে হবে।মেহরাদ বিয়ের পরদিনই চলে যাবে।ওর ছুটি কয়েকদিনের। আবার কবে আসবে ঠিক নেই।ছয়মাসে তার আর দেখা পাওয়া যাবে কিনা,আমি জানি না।এই শূন্য বাড়িতে আমার একটা মেয়ে চাই,একটা বন্ধু চাই,যেটা তুমি হবা।আমি সবকিছুতেই চুজি অনেক,মানুষ চিনতেও ভুল করি না।তাছাড়া,এই প্রথম মেহরাদ কোনো বিয়েতে রাজি হয়েছে।আমি ওর চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি,স্রোত।” বুঝিয়ে বললেন বনলতা।
“আমার সময় লাগবে আন্টি।” কিছুক্ষণ চুপ থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো।
বনলতা এবার খুশী হয়ে বললেন,
“ঠিক আছে সময় নাও।তোমার হাতে দু’দিন সময়।উত্তরটা যেনো ‘হ্যাঁ” হয় স্রোত।আমি আর আমার বাড়ি আমার দ্বিতীয় মেয়ের অপেক্ষায় স্রোত।”
স্রোত সবটাই শুনলো।কিসব অজানা অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরেছে।এই অনুভূতিগুলো একদম নতুন।সে কিছু বলতে পারলো না,চুপ করে রইলো।তাকে কিছু বলতে না দেখে বনলতা বেগম বললেন,
“ভালো থেকো স্রোত মা।আমি দু’দিন পর কল দিবো।”

স্রোত বনলতা বেগম আর মান্ধবীর বলা কথাগুলো ভাবছে।সে কি সাহস করবে?একটু লো ভী হবে?একটা মা পওয়ার লো ভ?সে তো অস্বীকার করতে পারবে না বনলতা বেগম তাকে ভালোবাসেন না বা সেও উনাকে ভালোবাসে না।সে বরং একটু সাহস করবে।

#চলবে……

পর্ব ৮
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2928447507294874/?mibextid=Nif5oz

পর্ব ৭
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2928237030649255/?mibextid=Nif5oz

পর্ব ৬

https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2927393364066955/?mibextid=Nif5oz

পর্ব ৫
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2926608987478726/?mibextid=Nif5oz

পর্ব ৪
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2925928897546735/?mibextid=Nif5oz

পর্ব ৩
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2925756014230690/?mibextid=Nif5oz

পর্ব ২
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2925365577603067/?mibextid=Nif5oz

পর্ব ১

https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2925296520943306/?mibextid=Nif5oz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here