#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ০৬
[অতীত]
মেহরাদ গম্ভীর মানুষ।সবার সাথে তেমন একটা কথা বলে না।কিন্তু মায়ের কাছে সে একদম অন্যরকম।যখন সে মায়ের সাথে কথা বলে,কেউ দেখে বুঝতে পারে না সে এতো গম্ভীর। তারা মা-ছেলে একসাথে অনেক মজা করে,হাসি-ঠাট্টা করে,ঘুরতে যায়,সিনেমা দেখতে যায়,ফুচকা খায়।মেহরাদ ফুচকা খায় না,তার মতে, এগুলো অসাস্থকর।কিন্তু বনলতা বেগমের এসব হাবিজাবি অনেক পছন্দের।কে বলবে উনি একজন বয়স্ক মহিলা?উনার আচার-আচরণ একদম কিশোরীদের মতো। মেহরাদ কত বলে সাবধান হয়ে চলেফেরা করতে,কিন্ত তিনি এক কানে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেন।মেহরাদও চায় তার মা সবসময় এমন হাস্যোজ্জবল ও প্রাণোচ্ছল থাকুক।কিন্ত শরীরের প্রতিও তো খেয়াল রাখা লাগবে।সে তো সবসময় মায়ের পাশে থাকতে পারে না। আজ সকালে খাওয়া-দাওয়া শেষে মেহরাদ প্ল্যান করলো মাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে,রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করবে।মেহরাদ জানে স্রোতের ব্যাপার নিয়ে তার মায়ের এখন একটু মন খারাপ।কিন্তু সে তো এতোদিন এটাই বুঝতে পারে নাই যে স্রোতের প্রতি তার অনুভূতি কেমন!এখন বুঝলেও নিজের চিরচেনা রূপ থেকে বেরিয়ে আসতেও কেমন লাগছে,এই বুড়ো বয়সে কিনা কিশোরদের মতো মেয়ে পটাতে হবে,ভাবতেই তার হাসি পায়।সে তো ঐদিনই বুঝে গিয়েছে,যে মেয়ে তার মাকে সরাসরি না করে দিতে পারে,তাকে পেতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়ানো লাগবে।কিন্তু সমস্যা একটাই,হাতে সময় নেই।যা করার এই কয়েকদিনেই করতে হবে।এসব ভাবতে ভাবতেই সে তার মায়ের রুমে যায়,
“মা আসবো?”
“না আসিস না,ঐখানেই দাড়িয়ে থাক। তোর শাস্তি এটা।”
মায়ের এমন কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মেহরাদ।জিজ্ঞাসা করে,
“ওমা,কি করলাম,কিসের শাস্তি?”
“গাধা কোথাকার,এতো বড় হয়ে গেছিস একটা মেয়ে পটাতে পারছিস না।”
মেহরাদ এতোক্ষণে সব বুঝতে পারে।সে হেসে “ধ্যাত মা,তুমিও না ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে” বলে রুমে ঢুকে মায়ের কোলে শুয়ে পড়ে।বনলতা বেগমও হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে শুরু করলেন।জিজ্ঞাসা করলেন,
“স্রোতকে ভালোবাসে আগলে রাখতে পারবি না?”
“পারবো মা।কিন্তু তুমিই তো বললে সে রাজি না।” সিলিং ফ্যানটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে মেহরাদ।
“এমনিই কি তোকে গাধা বলি?মেয়েটা কাকে বিয়ে করবে?তোকে না আমাকে?যাকে সে বিয়ে করবে তার সাথে কোনোদিন কথা হয়নি,তার কোনো এফোর্ট নাই?এতো সহজে রাজি হবে? তুই নাকি আমার ছেলে, আবার নাকি দেশের দায়িত্বে আছিস।”
“আমিও ভেবেছিলাম উনার সাথে যোগাযোগ করবো।কিন্তু আমার সাথে তো এসব যায় না,বলো!উনি কি ভাববেন?আর এই বয়সে আমি মেয়ে পটাবো?” কোল থেকে উঠে মায়ের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসা করে মেহরাদ।
“প্রেমে বয়স কিরে? ভালোবাসায় বয়স বলতে কিছু ম্যাটার করে না বুঝছিস।বয়স ম্যাটার করলে বুড়ো বয়সে দুটো মানুষ একসাথে থাকতে পারতো না,হাতে হাত রেখে সারাটা জীবন পার করতে পারতো না।” সুন্দর করে বুঝালেন বনলতা বেগম।
মেহরাদ মনোযোগ দিয়ে মায়ের কথা শুনলো।তার মা এখনো কত সুন্দর মানসিকতা নিয়ে চলেন।কত সুন্দর সবকিছু বুঝিয়ে দেন।ভাবলেই তার মায়ের প্রতি গর্বে বুক ফুলে উঠে।
মনে মনে ঠিক করলো আজ থেকে সে প্রেমিকপুরিষ হবে,স্রোতের পা গ লা টে প্রেমিকপুরুষ।তারপর মাকে বলে সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থাকতে,তারা ঘুরতে যাবে,শহর ঘুরবে।
মেহরাদ চলে গেলে,বনলতা বেগম বুদ্ধি বের করেন।মান্ধবীকে ফোন দিয়ে জানান সন্ধ্যায় স্রোত ফিরলে তাকে কোনোভাবে বুঝিয়ে তৈরী করতে,তবে স্রোত যেনো না জানে।বনলতা বেগমের মেহরাদের উপর বিশ্বাস নেই,যেই ছেলে এতো বছরে একটা প্রেম করতে পারে নি,সে কি করবে কে জানে?
সন্ধ্যার একটু আগে স্রোত বাড়ি ফিরলো।কলেজ,হসপিটাল,কোচিং সবকিছু শেষ করে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।স্রোত বাড়ি ফিরতেই মান্ধবী এসে করুণ স্বরে বলে,
“আপু একটা আবদার করলে রাখবি?”
“কি আবদার?”রুমে যেতে যেতে বলে স্রোত।
” রাখবি কিনা বল আগে?”বোনের পেছন পেছন মান্ধবীও যায়।
“হুম রাখবো,বল।” কাঁধের ব্যাগ আর হাতের বই টেবিলে রাখতে রাখতে বলে স্রোত।
মান্ধবীর চোখে-মুখে হাসি ফুটে উঠে।বলে উঠে,
“আমরা এখন ঘুরতে যাবো।তাড়াতাড়ি রেডি হ।”
স্রোত ভেবেছিলো মান্ধবী হয়তো টাকা চাইবে,কিন্তু।ক্লান্তিতে বলে,
“আমি ক্লান্ত বোন।আজকে না অন্য কোনো দিন।”
“তুই বলেছিস রাখবি।তোর এসব ক্লান্তি অভ্যাস হয়ে গেছে আপু।না করিস না।আমরা কতদিন বাহিরে যাই না।মা থাকতে সপ্তাহে তিন-চারদিন যাওয়া হতো।আমরা রিকশায় করে শহর ঘুরতাম,ফুচকা-চটপটি-ভেলপুরি খেতাম।বাবা বকাবকি করলেও শুনতাম না।কত আনন্দ করতাম।এখন মাও নেই,আনন্দও নেই।” মন খারাপ করে বলে মান্ধবী।
“মা ছাড়া এ শহর রংহীন। মাকে ছাড়া এ শহর মানায় না।”দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে স্রোত।আরও বলে,
” আমি ফ্রেশ হতে হতে রেডি হবি,এর চেয়ে এক মিনিট বেশি সময় লাগলে আমি যাবো না বলে দিলাম।”
মান্ধবী তো খুশিতে শেষ।
“থাংকু আপু,উম্মাহ।” বলে বোনকে জড়িয়ে ধরে চলে যায় নিজের রুমে।
বোনের কান্ডে স্রোত হেসে ফেলে।তারপর চলে যায় ফ্রেশ হতে।অন্যদিকে,সিরাজ সাহেবকে বনলতা বেগম ফোন করে অনুমতি আগেই নিয়ে নিয়েছেন।মান্ধবীর সাথেও সিরাজ সাহেবের কথা হয়েছে।মান্ধবী রুমে গিয়ে মেসেজ করে,
“আন্টিইইইই প্ল্যান সাক্সেসফুল।আপনারা কোথায়?”
বনলতা বেগম যেনো এই মেসেজেরই অপেক্ষা করছিলেন।
সাথে সাথে রিপ্লাই দিলেন,
“রাস্তায় আছি,আসছি।”
মেহরাদ ড্রাইভ করাকালীন খেয়াল করেছে তার মায়ের মনোযোগ ফোনে। এক হাতে কষ্ট করে ফোন ঘাটাঘাটি করছে।কি করছে জিজ্ঞাসা করতেই মা ধমকে বলে উঠে,
“কিছু না,তুই তোর কাজ কর।যেই ঠিকানা দিয়েছি সেখানে যা।”
মায়ের এই ছটফটানো স্বভাবগুলো মেহরাদের অনেক ভালো লাগে।এগুলা উপভোগ করে সে।কে বলবে উনার এক হাতে বেন্ডেজ করা।আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা তার মা সবসময় এমন হাসি-খুশি,মনখোলা মানুষ থাকুক।বহা বাহুল্য, মা তাকে একটা ঠিকানা দিয়ে বলেছে ওখানে যেতে।কারণ জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলে নি মা।যদিও সে জানে এইটা স্রোতের বাড়ির ঠিকানা।মাকে ধরা দেয় নি সে।দেখা যাক, মা কি করতে চাচ্ছেন।গাড়ি এসে থামে একটা চারতালা ভবনের সামনে।গেইটের পাশের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে বাড়ির নেমপ্লেটটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে,যেখানে লেখা,
“স্রোতস্বিনী”
মেহরাদ ভাবছে,
“রাজপ্রাসাদের নাম স্রোতস্বিনী,রাজকন্যার নামও স্রোতস্বিনী।সো মাচ কিউট।”
স্রোত আর মান্ধবী আরো আগেই তৈরী হয়ে নিলেও মান্ধবী অনেক কষ্টে এটাসেটা বলে বোনকে বসিয়ে রেখেছিলো।বোন যদি জানে তাহলে জীবনেও যাবে না।বনলতা আন্টির সামনে অব্ধি পৌছানো হলো মান্ধবীর কাজ।কারণ সে জানে তার বোন আন্টির কথা ফেলতে পারবে না।মান্ধবী স্রোতের রুমের বারান্দা দিয়ে দেখলো একটা কালো গাড়ি গেইটের সামনে দাড়ানো।সে দৌড়ে গিয়ে বোনের হাত ধরে “চল চল” বলে বেড়িয়ে গেলো।স্রোত বিরক্তির চরম সীমানায়।তার বোন মাঝে মাঝে কি করে বুঝে উঠতে পারে না সে।এখন এমন ভাবে দৌড়ানোর কি আছে?কেউ তো আর অপেক্ষা করছে না। সিড়ি দিয়ে নামার সময় বোনকে ধমকে উঠে,
“এই ছাড়,নিজেও পড়বি,আমাকেও ফেলবি।তোর হাড্ডি ভাঙ্গার শখ হলে একা পড়ে ভেঙ্গে ফেল,আমাকে ছাড়।আর এতো তাড়াহুড়ো করছিস কেন!কেউ তো আর অপেক্ষা করছে না।”
মান্ধবী মনে মনে হেসে বলে,
“সে তুই নিচে গেলেই দেখতে পাবি।”
মেহরাদ আর বনলতা বেগম গাড়ি থেকে নেমে দাড়িয়েছে।মেহরাদের একটা ফোন আসায় সে উল্টোদিকে চলে যায়।কথা বলার সময় হঠাৎ পেছনে ঘুরতেই তার দু’চোখ জুড়িয়ে যায়।সে দেখতে পায় দুটো মেয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বের হচ্ছে। সামনের জনের পরনে ল্যাভেন্ডার কালারের টপস,জিনস্ আর গলায় স্কার্ফ ঝুলানো,চুল ঝুটি করা।পেছনের মানবী সাদা ড্রেস পড়েছে,ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া,মাথায় ঘোমটা দেওয়া।সাদা কাপড়ে মানুষকে এতো স্নিগ্ধ লাগে কেনো?এই রং শুভ্রতার প্রতিক বলে?অন্যদিকে স্রোত তো এখানে বনলতা বেগমকে দেখে যা বুঝার বুঝে নিয়েছে।মনে মনে পণ করলো বাসায় এসে মান্ধবীর অবস্থা খারাপ করে দিবে।আবার, ভাবলো ভালোই হয়েছে,আন্টি তাদের সঙ্গি হলে মন্দ হবে না।উল্লেখ্য, সে এখনো মেহরাদ কে দেখেনি।মেহরাদ উল্টোদিকে অন্ধকারে দাড়িয়ে কথা বলছিলো।ওদের দেখে গাড়ির পেছনে চলে যায়।বনলতা বেগমের সাথে কথা বলে গাড়িতে উঠে ওরা।মান্ধবী আর বনলতা বেগম পেছনে আর স্রোত সামনে বসে।স্রোত প্রথমে বসতে না চাইলেও পরে বসে যায়,ড্রাইভার আঙ্কেল-ইতো হবে।তখনই মেহরাদ ড্রাইভিং সিটে এসে বসে।স্রোত খেয়াল করে নি।তার মনোযোগ ফোনে,পাশে কেউ বসেছে বুঝেও তাকায়নি,ড্রাইভার আঙ্কেলই তো হবেন।গাড়ি চলতে শুরু করে আপনগতিতে,শহরের অলি-গলিতে,গন্তব্য অজানা।
ফোনের কাজ শেষ হতেই পাশে নজর যায় স্রোতের,
মেহরাদকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে।এই বদলোক এখানে কি করছে?সে কি না ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে?ঐ বদলোকটাকে কল্পনা করছে?কেনো করছে?এসব ভাবতে ভাবতেই ছোট ছোট চোখ করে পিটপিট করে চেয়ে আছে মেহরাদের দিকে।মেহরাদের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে যায়,বাঁকা হেসে মাকে প্রশ্ন করে,
“মা,আজকে কি আমাকে বেশি সুন্দর লাগছে?”
“কেনো বলতো!” সাথে সাথেই জবাব দেন বনলতা বেগম।
“আসলে কেউ একজন তো আমার দিক থেকে চোখ ফেরাতেই পারছে না,তাই।”
মেহরাদের কথায় বনলতা বেগম- মান্ধবী হাসতে শুরু করে।স্রোতের মনে হচ্ছে মাটিটা ফাঁক হয়ে যাক,সে ঢুকে পড়ুক।কি লজ্জা, কি লজ্জা। এই বদলোককে বুঝিয়ে দিবে সে কি জিনিস,হুহ।রাগী চোখে মেহরাদের দিকে তাকাতেই মেহরাদ চোখ মারে।স্রোত রাগে গিজগিজ করতে করতে জানালার বাহিরে রাতের শহর দেখতে থাকে,তাকাবে না ঐদিকে।মেহরাদের মুখে দুষ্ট হাসি।সে আনমনেই গেয়ে উঠে,
“বন্দে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে
দেওয়ানা বানাইছে,
কী যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে।”
মান্ধবী বলে উঠে,
“বাহ ভাইয়া, আপনি তো অনেক ভালো গান করেন।”
মেহরাদ প্রতিত্তোরে হাসি উপহার দেয়।বনলতা বেগম তখন বলে উঠেন,
“আমার দুই ছেলে-মেয়েই খুব ভালো গান করে।”
মান্ধবী বলে,
“আপুও অনেক ভালো গান গায়। আমাদের মায়ের গান শিখার আগ্রহ ছিলো।কিন্তু কনজার্ভেটিভ ফ্যামিলির মেয়ে হওয়ায় শিখতে পারেন নি।তবে আমাদের শিখিয়েছেন “।
স্রোত সবটা শুনলেও কিছু বলে না আর।মুহূর্তটা সুন্দর, ভীষণ সুন্দর।বদলোকটা তাকে উদ্দেশ্য করেই যে গান গেয়েছে,তা ভালো করেই বুঝেছে সে। তার কেনো জানি ব্যাপারটা ভাল্লাগছে,মুহুর্তটা উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে।
” এই এই গাড়ি থামা,ঐ ফুচকার দোকানটার সামনে গাড়ি থামা।” রাস্তার পাশে ফুচকার দোকান দেখে বলে উঠেন বনলতা বেগম।
“মা তুমি এখন ফুচকা খাবা?”
“হ্যা,আমি, স্রোত আর মান্ধবী খাবো।আহা কতদিন পর এতো মজা হবে।মাহিরা যাওয়ার পর তো আমি একা একাই খেয়েছি,তুই পাশে বসেছিলি।”
ফুচকার দোকানে ফুচকা খাওয়ার সময় মান্ধবী,বনলতা বেগম আর মেহরাদ অনেক মজা করেছে।সবকিছুই চুপচাপ অবলোকন করেছে স্রোত।স্রোত অবাক হওয়ার থেকে বেশি যেনো মুগ্ধ হয়েছে,মা-ছেলের এতো ভালো বন্ধন,বয়স্ক একজন মহিলা অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও এতো প্রাণোচ্ছল, মায়ের সাথে মেহরাদের ব্যবহার,আনন্দ করা,কে বলবে সে একজন মেজর?বাহিরের মানুষের কাছে গম্ভীর মানুষ?
স্রোতের ধ্যান ভাঙ্গে মান্ধবীকে করা মেহরাদের প্রশ্নে,
“মান্ধবী ক্যান্ডি ফ্লস কেমন লাগে তোমার কাছে?”
“অনেক ভাল্লাগে, কেনো?”হাসিহাসি মুখে বলে মান্ধবী।
“ওয়েট” বলে কোথায় যেনো চলে যায় মেহরাদ।
এই ফাঁকে বাকিরা গাড়িতে গিয়ে বসে অপেক্ষা করতে থাকে।বনলতা বেগম আজ মান্ধবীকে পেয়ে যেনো স্রোতের অস্তিত্ব ভুলে গিয়েছেন।এটাও ওনার প্ল্যানিং।উনি চান স্রোত এসব দেখুক,বুঝুক। এর মধ্যেই মেহরাদ হাতে নয়টা হাওয়াই মিঠাই,তিনটা কাঠগোলাপের গাজরা,তিনটা আলাদা আলাদা গোলাপের তোড়া নিয়ে আসে।হেসে বলে,
“মায়ের হাওয়াই মিঠাই আর ফুল খুব পছন্দের।” বলতে বলতে মাকে আর মান্ধবীকে হাওয়াই মিঠাই আর ফুল দেয়।কাঠগোলাপের গাজরাটা সে নিজের হাতে মায়ের হাতে পড়িয়ে দেয়।মা-ছেলের এতো সুন্দর মুহুর্ত দুই বোন যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে।স্রোত যেনো মুগ্ধতায় হারিয়ে গিয়েছে কিন্তু তার চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই,সেই শান্ত,অনুভূতিহীন চেহারা।তার মুগ্ধতার ব্যাঘাত ঘটে যখন মেহরাদ তার দিকে ফুল,গাজরা আর হাওয়াই মিঠাই বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“নিন।”
“ধন্যবাদ”। বলে নিয়ে নেয় স্রোত।আজকে কেনো জানি কোনো কিছুতে বাঁধা দিতে ইচ্ছে করছে না,মুহুর্তটা নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না।এতো সুন্দর মুহুর্ত মা মা*রা যাওয়ার পর আর এসেছে কিনা তা বলা কঠিন।
ব্যস্ত শহরের এতো এতো যানবাহনের মাঝদিয়ে সারি সারি ভবন,দালান পেরিয়ে গাড়ি শো শো করে এগিয়ে যাচ্ছে।এখন তারা রেস্টুরেন্টে যাবে,রাতের খাওয়া দাওয়া করে বাসায় ফিরবে।রেস্টুরেন্টে খাবার পরিবেশন শেষে বনলতা বেগমের এক হাতে খেতে অসুবিধা হবে বলে স্রোত তাকে সাহায্য করতে চাইলে মেহরাদ বলে উঠে,
” আপনি খান স্রোতস্বিনী, আমি মাকে খাইয়ে দিচ্ছি।”
স্রোত আর জোর করেনি,হয়তোবা আরেকটি সুন্দর মুহুর্তের সাক্ষী হতে চায় সে।কিন্তু,এই লোকের মুখে নিজের পুরো নাম এই প্রথম শুনলো সে,কেমন জানি অনুভব হলো!!!
মেহরাদ মাকে খাইয়ে দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজেও খেয়ে নিচ্ছে।দুই বোন মুগ্ধতার সহিত তা দেখছে,মায়ের সাথে এমন মুহুর্ত তাদের খুব কমই রয়েছে।মা অসুস্থ থাকাকালীন অনেক যত্ন করলেও তখন সেখানে কষ্ট বৈ অন্য কিছু ছিলো না,মাকে হারানোর কষ্ট।
খাওয়ার মাঝেই মাহিরা ভিডিও কল দিলো।মায়ের সাথে তার প্রতিদিনই এই সময় কথা হয়।মা তাকে স্রোত সম্পর্কে সব বললেও কোনো ছবি দেয় নি।বনলতা বেগম কল রিসিভ করে হেসে বলে উঠলেন,
“দেখ মাহি আমরা ঘুরতে এসেছি,কত মজা করছি।”
মায়ের মুখে এমন উপচে পড়া আনন্দ দেখে সবাই খুশি।কিন্তু একটু অভিনয় করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
“এটা কিন্তু ঠিক না মা,আমাকে ভিনদেশে পাঠিয়ে তোমরা এতো আনন্দ করছো।আমার কিন্ত হিং সে হচ্ছে।”
তখনই মেহরাদ মজা করে বলে উঠলো,
“মিথ্যুক, তুই নিজেই তো স্বামীকে চোখে হারাস বলে চলে গেলি।স্বামীকে ছাড়া তোর ভালো লাগে না।এখন আমরা পাঠালাম? হিং সুটে কোথাকার।”
এবার সত্যি সত্যি মাহিরা কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে বললো,
“মা তোমার ছেলেকে বলো আমাকে নিয়ে মজা না উড়াতে।ওয় কি বুঝে হুহ,আনরোমান্টিকের ডিব্বা একটা,মামা হয়ে গেলো অথচ এই অব্ধি একটা প্রেম করতে পারলো না।”
এই কথা শুনে মান্ধবী জোরে হেসে উঠলো।সাথে সাথেই স্রোত রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে তার হাতে চিমটি কাটলো।স্রোতের সামনে বোন এই কথা বলায় মেহরাদ যেনো লজ্জা পেলো।দাঁতে দাঁত খিচিয়ে বললো,
“বাসায় গিয়ে তোকে দেখে নিবো।তাঈফকে বলবো তুই ঘুমালে যাতে তোর মুখে পানি ফেলে দেয়।”
বনলতা বেগম ছেলে-মেয়ের খুনসুটি দেখে হাসছে,দুইজন দুই দেশে তাও এদের ঝগড়া শেষ হয় না।ফোনেও দুইজনের খুনসুটি দেখে ভালো লাগলো স্রোতের।সারা পৃথিবীর সামনে গম্ভীর মানুষটা মা-বোনের সাথে একদম মাটির মানুষ।
এর মাঝেই মাহিরা মাকে বলে উঠে,
“স্রোতকে দাও,কথা বলি ওর সাথে।”
বনলতা বেগম সবাইকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালে মাহিরা স্রোতকে দেখতে পায়,তার স্রোতকে চেনা চেনা লাগে।স্রোত অস্বস্তি নিয়ে ফোনে তাকালে মাহিরা বলে উঠে,
“স্রোতস্বিনী, তোমাকে আমি চিনি।”
“আমারও চেনা চেনা লাগছে আপু।” স্রোতও বলে।
“ধ্যাত আপু বলো না,আমরা সেইম এইজ।কলেজ থেকে একবার তিনদিনের জন্য ক্যাম্পেইনে গিয়েছিলো।সেখানে তোমাদের কলেজ আর আমাদের কলেজের স্টুডেন্টদের একটা রুম দেওয়া হয়। তুমি ছিলা আমার পাশের বেডে।মনে পড়েছে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে।” হাসিহাসি মুখ করে বলে স্রোত।
বাকিরা খাওয়ার পাশাপাশি দুইজনের কথা শুনছে।টুকটাক কথা বলে কল কেটে দেয় মাহিরা।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ,এবার বাড়ি ফেরার পালা।গাড়ি চলছে স্রোতস্বিনীর উদ্দেশ্যে। একপর্যায়ে মেহরাদ মান্ধবীকে জিজ্ঞাসা করে,
“আচ্ছা মান্ধবী তোমাদের দু’বোনের নাম এমন ইউনিক কেনো?আসার সময় খেয়াল করলাম তোমাদের বাড়ির নামও স্রোতস্বিনী। ব্যাপার কি বলো তো?”
মান্ধবী হেসে বললো,
“আসলে ভাইয়া,আমাদের মা গল্প-উপন্যাস পড়তে অনেক ভালোবাসতেন,সেখান থেকেই আমাদের নাম রাখা।মায়ের মুখে শুনেছি যে বছর আমাদের বাড়িটা করে,সেই বছরই আপু পৃথিবী স্পর্শ করে।একই বছরে পরিবারে দু’টো খুশির স্বাদ আশায় দু’টোর নামই রাখা হয় “স্রোতস্বিনী”।”
“ইন্টারেস্টিং তো।” অবাক হয়ে বলে মেহরাদ।
“হ্যাঁ অনেকটাই।আর আমার নাম নিয়ে প্রচুর বিড়ম্বনায় পড়েছি।কেউ কখনো এমন নাম শুনেই নি।তবে এক হিসেবে ভালোই লাগে এই নামে আমি ছাড়া আর দুটো কেউ নেই।” হেসে বলে মান্ধবী। বিপরীতে মেহরাদও হাসে।কথার ফাঁকে ফাঁকে মেহরাদ স্রোতের দিকে তাকায়,কিন্তু স্রোতের এদিকে খেয়াল নেই।সে বাহিরে তাকিয়ে আছে।অন্যদিকে,স্রোত এসবকিছুই শুনছে,উপভোগ করছে।কিন্তু মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই।একপর্যায়ে গাড়ি এসে স্রোতস্বিনীর সামনে থামলে ওরা দুই বোন বনলতা বেগম এবং মেহরাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।স্রোত মেহরাদের সাথে কথা বলে নি,বনলতা বেগমকে বাসায় যেতে বললে তিনি জানান আজকে যাবেন না,কয়েকদিন পরে তো আবার আসতেই হচ্ছে।
মান্ধবী আর স্রোত বাড়ির ভেতরে চলে গেলে মেহরাদ খেয়াল করে স্রোত ব্যাগ ফেলে গিয়েছে।তাই সে মাকে বলে ব্যাগ দিতে যায়।স্রোতরা যখন দ্বিতীয় তালায় তখন পেছন থেকে মেহরাদ ডেকে উঠে,
“স্রোতস্বিনী”
মান্ধবী মেহরাদকে দেখে ওদের স্পেস দিয়ে বাসায় চলে যায়।স্রোত পেছন ফিরে মেহরাদকে দেখে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালে মেহরাদ ব্যাগটা দেখিয়ে বলে,
“আপনার ব্যাগ।”
স্রোত “ধন্যবাদ” বলে ব্যাগটা নিয়ে চলে যেতে নিলে মেহরাদ আবার বলে উঠে,
“আপনি আমি ছাড়া আর কারো সামনে সাদা ড্রেস পড়ে যাবেন না।”
স্রোত বুঝে উঠতে না পেরে শোধায়,
“স্যরি?”
“আপনাকে শুভ্র রঙে অনেক স্নিগ্ধ লাগে,স্রোতস্বিনী ।আমি চাই না আমার ব্যক্তিগত মানুষের এমন স্নিগ্ধরূপ আমি ব্যতীত আর কেউ দেখুক।” গাঢ় স্বরে এই কথাটা বলে মেহরাদ হেঁসে চলে যায়।
কথাটা শুনে স্রোত থমকে যায়,কি বলে গেলো লোকটা?
” আমার ব্যক্তিগত মানুষ?”
#চলবে…
[আজকে বেশি বড় পর্ব দিয়েছি,খুশি?অন্যসময়তো নায়কের প্রেমে পড়েন এবার নাহয় নায়কের মায়ের প্রেমেও পড়েন🥹🫶 ]
পর্ব ৮
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2928447507294874/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ৭
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2928237030649255/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ৬
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2927393364066955/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ৫
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2926608987478726/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ৪
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2925928897546735/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ৩
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2925756014230690/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ২
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2925365577603067/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ১
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2925296520943306/?mibextid=Nif5oz
সবাই জয়েন করুন গ্ৰুপে আর ফলো দিয়ে রাখুন
👉 Bindas Life