#আশার_হাত_বাড়ায় |১৩|
#ইশরাত_জাহান
🦋
সকাল সকাল ব্যাগ ঘুছিয়ে বাড়ি থেকে বেড় হতে নেয় অহি।টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছিলো ফারাজ সহ বাকি সদস্য।অহিকে এভাবে বেড় হতে দেখে ফারাজ উঠে দাড়ায়।এগিয়ে এসে অহিকে প্রশ্ন করে,”এত সকাল সকাল তুমি কোথায় যাচ্ছো কাকি?”
অহির চোখে পানি।পানিগুলো মুছে মাথা নত করে বলে,”পাপ করেছি আমি।এক পাপী মেয়েকে জন্ম দিয়ে।কোনো শিক্ষা দিতে পারিনি।আমি তোর জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি।আমার মেয়েটার সাথে তোর বিয়েটা না দিলেই ভালো হতো।আমার মেয়েটা তোকে ঠকালো।যেখানে আমার মেয়ে তোদের এত বড় ক্ষতি করেছে মা হয়ে কোন মুখে থাকি তোদের সামনে?তাই চলে যাচ্ছি আমি।”
অহির হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ফারাজ বলে,”এভাবে পালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই।যে অন্যায় করেছে সে শাস্তি পাচ্ছে।তুমি কোনো অন্যায় করোনি।”
“কে বলেছে আমি অন্যায় করিনি?আমার তো প্রতিটি করা কাজই অন্যায়।প্রথম অন্যায় করেছি বামন হয়ে চাঁদে পা দেওয়া।মানে তোর কাকার মত বড়লোক কাউকে বিয়ে করা।”
কথাগুলো ফারাজের কাকা তিহানের দিকে তাকিয়ে বলেন।ফারাজের কাকাতো ভাই তুর্যর বয়স যখন ছয় তখন তার মা মারা যায়।ছেলেকে দেখাশোনা করার জন্য ফারাজের তিহান বিয়ে করে অহিকে।বিয়ের বছর কয়েক পর অহি হঠাৎ করেই মা হওয়ার অনুভূতি পায়।কিন্তু বাচ্চাটা নিয়ে আগ্রহী ছিলো না কেউ। তিহানের মতে তার ছেলের ভালোবাসা কমে যাবে।তূর্য নিজেও ক্ষিপ্ত হয়ে থাকতো।কিন্তু অহি অনুরোধ করে বাচ্চাটি নেয়।অহনার জন্মের পর ভালোভাবে যত্ন করতে পারেনা অহনাকে।তূর্য এসে এসে অহিকে নিজের সাথে ব্যাস্ত রাখতো। অহি যদি একটু বলত,”এখন অহনাকে খাওয়াতে হবে।”
ঠিক তখনই তিহান বাসায় আসলে নালিশ করে দিতো তূর্য।ছেলের প্রতি হওয়া অযত্ন উপলব্ধি করে অহিকে করেন নির্যাতন।আস্তে আস্তে অহনাকে ছেড়ে দিয়ে তুর্যর মন মতো হয়ে চলত অহি।অহনাকে না করেছে কখনও আদর না করেছে ঠিক মত শাসন।হুট হাট মাথা গরম থাকলে অহনাকে ধরে মারতো অহি।কখনও অহনাকে সামলাতে আসেনি কেউ।মেয়েটা যে রাগে দুঃখে নষ্ট পথে নিজের স্বাধীনতা বেচে নিয়েছিলো এটা শুধু অহি একাই বুঝতে পারছে।ফারাজ বা অন্য কাউকে বোঝালে কেউ বুঝতে চাইবে না অহনার এই নষ্ট পথে আসার সূচনা।তাই আজও মুখ বুজে চলে যেতে চান তিনি।অহনার পথচলাটা নাহয় তার জন্য ছিলো কিন্তু বিয়ের পর তো নিজেকে বদলাতে পারতো।ফারাজ তো তার সর্বস্ব দিয়ে অহনাকে ভালোবেসেছে।অহনার চাওয়া পাওয়া পূরণ করেছে।অহনা তখন তো নিজেকে সংযত করেনি।নিজের মর্জিতে চলা অহনার এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারবে না অহি নিজেও।ফারাজ অহির ব্যাগ নিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলে,”তুমি কোথাও যাবে না।তুমি এই বাড়িতেই থাকবে।তুমি এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছো নিজ যোগ্যতায়।তোমার মেয়ের দোষ আমরা তোমাকে দিবো না।আর কেউ তোমাকে এই নিয়ে কিছু বলবে না।যদি বলে আমি তাকে দেখে নিবো।”
সকাল সকাল অফিসে এসে শ্রেয়া অবাক হয়ে দেখতে থাকে চারপাশ।ফুল দিয়ে সাজানো বিল্ডিংটা।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে সবকিছু।অনেক সুন্দর দেখা যাচ্ছে।এনি এসে শ্রেয়াকে বলে,”কেমন আছো শেহনাজ?”
শ্রেয়া মৃদু হাসলো।এই নামটা তো শুধু সার্টিফিকেট অব্দি থাকে।এখন এনি তাকে এই নামে ডাকছে।শ্রেয়া উত্তরে জানিয়ে দেয়,”ভালো,আপনি?”
“আমি অনেক ভালো।”
“আজ অফিসে কিছু আছে?”
“একচুয়ালি হ্যান্ডসাম তার লাইফের কঠিন এক সময় পার করেছে।এই সময়টার জন্য তাকে ব্রেভ জানানো উচিত।তাই আমরা ছোটখাটো অনুষ্ঠান করছি।জীবনের কঠিন কঠিন মুহূর্ত কতজন পারে সফলভাবে কাটিয়ে দিতে!”
“আসলেই তাই।স্যার অনেক সাহসী।”
“তুমিও কিন্তু কম না।তোমার ভিতরেও সাহস আছে।কিন্তু ওটাকে জাগ্রত করতে পারো না।”
“এবার থেকে করব।”
আলতো হাসে এনি।সবাই হাততালি দিতে থাকে।শব্দ পেয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলো ফারাজ এসেছে।এনি এসে একটি ফুলের তোড়া দিয়ে ফারাজকে বলে,”হ্যাপি নিউ লাইফ হ্যান্ডসাম।”
ফারাজ ফুলগুলো নিয়ে বলে,”থ্যাংক ইউ এনি।”
বলেই নিজের কেবিনের দিকে যেতে নিবে এনি পথ আটকিয়ে বলে,”আরো একটি সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।”
ভ্রু কুঁচকে ফারাজ বলে,”কি?”
“চলো আমাদের সাথে।”
বলেই ফারাজকে নিয়ে যায় ক্যান্টিনে।শ্রেয়াকে ইশারা করে বুঝিয়ে দেয় সেদিকে যেতে।শ্রেয়া এনির ইশারা পেয়ে ওদের পিছনে যেতে থাকে।ফারাজের সামনে একটি টেবিলে কেক রাখা আছে।এনি কেক কাটা ছুরি দিয়ে বলে,”তোমার নতুন জীবন আমরা নতুনভাবে পালন করছি।সব অশুভ দিনগুলো শেষ করে বাকি দিনগুলো শুভ করার জন্য এই মিষ্টি মুখ।ইউ নো দ্যাট।আমরা সবাই সবার আনন্দে শামিল থাকি।তাই তোমার এই দিনটিও আমরা একসাথে উদযাপন করব।না করবে না।”
ফারাজ হালকা হেসে ছুরিটি নিয়ে কেক কাটে।এনিকে খাইয়ে দেয়।তারপর এনি সবাইকে খাইয়ে দিতে থাকে।সবাই সবার মত আনন্দ করতে থাকে।এনি এসে শ্রেয়ার কাছে দাড়ায়।শ্রেয়াকে নিজের হাতে কেক খাইয়ে দিয়ে বলে,”শুভ হোক তোমার বাকি দিনগুলো মাই লেডি।”
এনির মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রেয়া বলে ওঠে,”আপনি জানেন?”
“হ্যান্ডসাম আমার থেকে কিছুই লুকায় না। হ্যান্ডসামের অবর্তমানে আমি তো এই কোম্পানি দেখে রাখতাম।বলা যায় আমি সবার বেস্ট ফ্রেন্ড।জীবনের ভালো মন্দ অনেকের বিষয়ে আমি অবগত।তেমন হ্যান্ডসামের বিষয়ে আমি অবগত।সেখান থেকেই কাল তোমার ব্যাপারে জেনেছি।”
বলেই শ্রেয়ার মুখের কাছে কেক এগিয়ে দেয় এনি।শ্রেয়া নিলো কেক।টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে ফারাজ এগিয়ে আসে শ্রেয়া ও এনির দিকে।শ্রেয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,”এখানের কাজ শেষ করে আমার কেবিনে আসবেন।”
“ওকে স্যার।”
ফারাজ চলে যেতেই কিছুক্ষণ নাচ গান করতে থাকে অফিস কলিগরা মিলে।তারপর যে যার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।শ্রেয়া এসে ফারাজের কেবিনে নক করে।ফারাজ বলে,”কাম ইন।”
থাই গ্লাসের দরজা খুলে শ্রেয়া ভিতরে আসে।চেয়ারে বসতেই ফারাজ কিছু ফাইল দিয়ে বলে,”আমরা কাল বাইরে মিটিং করব।মিটিংটি লাঞ্চ টাইমের আগে হবে।ওখানে বাইরের থেকে লোকজন আসবে।আপনাকে এই ফাইল দেখে সবকিছু বুঝে নিতে হবে।আমি যখন যেই ফাইল চাইবো তখন সেই ফাইল দিবেন।ওদের সামনে আমি সবকিছু প্রেজেন্ট করব।আপনি শুধু বিষয়গুলো ফলো করবেন।নেক্সট থেকে আপনাকে এগুলো প্রেজেন্ট করতে হবে।”
শ্রেয়া ফাইলগুলো নিয়ে বলে,”ওকে স্যার আমি সবকিছু ফলো করব।”
“ওকে তাহলে আপনি এগুলো চেক করতে থাকুন।প্রয়োজন হলে ডেকে নিবো।”
“শিওর স্যার।”
বলেই উঠে দাড়ায় শ্রেয়া।নিজের কেবিনে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে ফারাজ পিছন থেকে বলে,”শুনুন।”
শ্রেয়া ঘুরে দাড়ালো।ফারাজ বলে,”ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে কাউকে কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই।এনি শুধু জানে।কিন্তু আপাতত এই বিষয়ে আর কেউ জানলে অনেক কিছু ফেস করতে হবে।আপনাকে সহ আমি আমার মেয়েকে নিয়ে এই বিষয় নিয়ে আলোচনায় আসতে চাই না।”
শ্রেয়া মাথা নাড়ালো।যদিও সে কাউকে কিছু বলত না।কিন্তু মেয়ে মানুষ তো কথা চেপে রাখতে পারে না।তাই শ্রেয়াকে এলার্ট করে দিলো ফারাজ।শ্রেয়াকে ইশারা করতেই চলে যায় শ্রেয়া।ল্যাপটপ ওপেন করে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে ফারাজ।শ্রেয়া এসে তার কেবিনে বসে ফাইলগুলো চেক করে।
চোখ পিটপিট করে চারপাশে তাকিয়ে অচেনা জায়গা পেয়ে সাথে সাথে বিছানা থেকে উঠে পড়ে অহনা।ভালোভাবে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে থাকে।নিজের হাতে থাকা ব্যাগটি খুঁজতে থাকে।ঠিক তখনই হুইল চেয়ারে করে একজন মহিলা এসে বলে,”কিছু খুজছো মা?”
অহনা দেখলো মহিলাটিকে।বিরক্ত লাগছে তার সবকিছু।চোখমুখ কুঁচকে বলে,”আমার ব্যাগ।”
“ওটা আমি আলমারিতে রেখেছি।”
“ওহ।”
“তোমার নাম কি?এত রাতে বাড়ির বাইরে কি করছিলে?”
অহনা রাগ দেখিয়ে বলে,”আমি যাই করি না কেনো আপনাকে কেনো বলব?”
মহিলাটি একটু ক্ষিপ্ত হলো।প্রশ্ন করলো,”বাবা মা কিছু শেখায় নি তোমাকে?এগুলো কেমন ব্যাবহার?”
অহনা কোনো উত্তর করলো না।মনে মনে বলতে থাকে,”বাবা মা আমাকে কিছু শেখানোর সময় পেলে তো শিখবো।”
মহিলাটি অহনার কাছে এগিয়ে এসে বলে,”হাত মুখ ধুয়ে এসো।মুখে কালি লেগে আছে।ওই রাতে আমার ড্রাইভার তোমাকে নিয়ে এসেছিলো এখানে।তুমি নাকি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলে।হঠাৎ ধাক্কা লাগে আমার গাড়ির সাথে।”
মুখে কালি লেগে আছে শুনতেই অহনার মনে পড়ে গেলো কালকের কথা।মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আসে তার।মহিলাটি বলেন,”এভাবে মন খারাপ করে কিছু ভাবতে হবে না। যাও ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিবে।তারপর নাহয় নিজের বাড়িতে যাবে।”
নিজের বাড়ির কথা শুনতেই অহনা বলে ওঠে,”আমার কোনো বাড়ি নেই।”
মহিলাটি অহনার জামা কাপড় দেখে বলে,”এত দামী জামা পরা মেয়েটি বলছে তার কোনো বাড়ি নেই।হাতে তো ছিলো দামী একটি ব্যাগ।”
অহনা কথা না বাড়িয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে।কথা বাড়াতে চায় না সে।নিজের ইচ্ছার বাইরে এখন কারো পরোয়া করে না অহনা।অহনা ভিতরে যেতেই মহিলাটির ফোনে কল আসে।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ওনার ছেলে বলে,”আমি পৌঁছে গেছি মা।শুনলাম আমাদের গাড়ির সাথে কেউ অ্যাকসিডেন্ট করেছে।”
মহিলাটির নাম নাজমা আর তার ছেলে নিবিড়।মিসেস নাজমা বলেন,”হ্যাঁ বাবু। কাল রাতে তোকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসার পথে নাকি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।টেনশন নেই মেয়েটি এখন ভালো আছে।সিরিয়াস কিছু হয়নি।”
মায়ের কথায় স্বস্তি পায় নিবিড়।বলে ওঠে,”আচ্ছা মা।নিজের খেয়াল রেখো।সময়মত ঔষধ খেয়ে নিও।আমি এখন কাজে যাবো।”
“আচ্ছা বাবু তুইও নিজের খেয়াল রাখবি।”
বলেই কথা শেষ করে দুজনে।
শ্রেয়া এসেছে মিসেস তানহার কাছে।সাথে এসেছে সৃষ্টি বেগম, রিমলি ও অর্পা।মিসেস তানহাকে উদ্দেশ্য করে শ্রেয়া বলে,”রনির মা কোথায়?”
মুচকি হাসলেন মিসেস তানহা।শাশুড়িকে আজ মা না ডেকে স্বামীর মা সম্মোধন করছে।অবশ্য ওরা যেটা করেছে তাতে মন বিষিয়ে যাওয়ার কথা।শ্রেয়া তো সেখানে কিছু না করেই ছার দিয়েছে।কিছু কাগজ বেড় করে সামনে রেখে মিসেস তানহা বলেন,”আসবেন উনি একটু পর।তোমার পাওনা টাকা নিয়েই আসবে।নাহলে যে তার বিরুদ্ধে তুমি অ্যাকশন নিবে।”
কথাগুলো বলে হেসে দেয় মিসেস তানহা।শ্রেয়া নিজেও এবার মুখ বুজে মিষ্টি হাসি উপহার দেয়।অপেক্ষা করছে রুবিনার আসার। এখান থেকে কাজ শেষ করে আবার অফিসে যেতে হবে তাকে। লাঞ্চ টাইমে এসেছে ডিভোর্সের কাজ শেষ করতে।
হাতমুখ ধুয়ে বাইরে বেড় হয় অহনা। অহনার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকেন নাজমা।অহনা নিজের মতো মুখ মুছতে ব্যাস্ত।হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে নাজমা বলেন,”নিচে চলো কিছু খেয়ে নিবে।”
অহনা কিছু বলে না।আসলেই তার এখন খুদা লেগেছে।দুপুর হয়ে এসেছে এখন। কাল রাত থেকেই না খাওয়া সে।নাজমা এখন সার্জেন্টকে ডাকতেই সে এসে নাজমাকে নিয়ে নিচে যায়।পিছু পিছু হটতে থাকে অহনা।
চলবে…?