আশার_হাত_বাড়ায় |১৪| #ইশরাত_জাহান 🦋

0
112

#আশার_হাত_বাড়ায় |১৪|
#ইশরাত_জাহান
🦋
অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটলো শ্রেয়ার।রুবিনা ও তার দুই মেয়ে এসেছে। একটি ব্যাগ হাতে করে আনে।আজ রুবিনার চোখে মুখে স্পষ্ট ইতস্তত বোধ দেখা যাচ্ছে।রুবিনা এসে সোজা দাড়ালো শ্রেয়ার সামনে।কোনো কথা না বলে শ্রেয়ার দিকে ব্যাগটি এগিয়ে দিলো।তারপর মাথা নত করে বলে,”এখানে কাবিনের টাকা আর তোমার মায়ের থেকে নেওয়া টাকাগুলো আছে।একেবারে সব দিতে পারিনি।অনেক কষ্ট করে এই কয়দিনে গুছিয়ে আনতে হয়েছে সব।”

শ্রেয়া ব্যাগটি হাতে নেয়।রুবিনার দিকে তাকিয়ে বলে,”অবশেষে আমি আমার পাওনা টাকা তো পেলাম ওটাই যথেষ্ট।বাকিটা আমি দাবি রাখলাম না।”

কথাগুলো বলেই শ্রেয়া ঘুরে দাড়ায় মিসেস তানহার দিকে।মিসেস তানহা দুজনের কথাগুলো শুনছিলো।শ্রেয়া ঘুরে দাড়াতেই এবার তালাকের কাগজ এগিয়ে দিলো।কাগজটি পড়লো শ্রেয়া।রনির থেকে সই নিয়েছে মিসেস তানহা।এবার শুধু তার সই করার অপেক্ষা।টেবিল থেকে একটি কলম নিয়ে শ্রেয়া সই করে দেয় কাগজটিতে।মিসেস তানহা বলেন,”কয়দিন পর তুমি এটার একটা কপি পাবে।”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো শ্রেয়া।সৃষ্টি বেগমের হাত ধরে বেড় হবে তার আগে রুবিনা এসে দাঁড়ায় শ্রেয়ার সামনে।হাতজোড় করে শ্রেয়াকে বলে,”আমি আর আমার পরিবার যা কিছু করেছি তার জন্য ক্ষমা চাইছি।আমার ছেলের কৃতকর্মের জন্যও আমি ক্ষমা চাই।ক্ষমা করে দিও ওকে।”

আজ তৃপ্তি পাচ্ছে শ্রেয়া।এতদিন করা অন্যায়ের জন্য অন্তত শেষে এসেও ক্ষমা তো চেয়েছে।শ্রেয়া বলে ওঠে,”ক্ষমা সবার মুখে মুখে আদান প্রদান হয় ঠিকই কিন্তু ক্ষমা করে দেওয়াটা না মন থেকে আসে।আমি মুখে বলে দিবো আমি ক্ষমা করেছি আর আমার মন হাজার চাইতেও আপনাদের ক্ষমা করতে পারবে না তাহলে কি সম্ভব?যদি কোনোদিন আমার মন মানতে চায় তো সেদিন না বলতেই আমার তরফ থেকে ক্ষমা পাবেন।এখনও শরীরের ক্ষতগুলো মেটেনি মনের ক্ষত তো অনেক দূর।”

কথাগুলো বলেই বাইরে আসে শ্রেয়া।গাড়ির সামনে এসে কান্না করতে থাকে।চোখের সামনে ভাসতে থাকে পুরনো অতীত।যেখানে সে পায়নি এক ফালি সুখ।কত কিছু করে চেষ্টা করেছিলো সবার মন পাবার কিন্তু না এরা মন দেয়নি।তাহলে আজ কেনো শ্রেয়া এদের এত তাড়াতাড়ি ক্ষমা করবে?অর্পা এসে শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,”চল অফিসে যাবি।আণ্টিকেও একটু তোর অফিস ঘুরিয়ে দেখাবো।”

চোখের পানি মুছে শ্রেয়া উঠলো গাড়িতে।সৃষ্টি বেগম ও রিমলি উঠেছে।রিমলি অনেক খুশি।সে তার বোনের অফিসে যাচ্ছে।এই কথা ওই কথা বলে হাত নাড়াতে থাকে রিমলি।না চাইতেই মা বোন আর বান্ধবীর সঙ্গ পেয়ে মনটা খুশিতে ভরে যায় শ্রেয়ার।অফিসের সামনে এসে গাড়ি থামতেই সৃষ্টি বেগম ইতস্তত বোধ করেন।হাত গুটিয়ে শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন,”ও মা এটা অনেক বড় রাজ প্রাসাদের মতো রে।এখানে থাকতে হবে না আমাদের।চল বাড়ি ফিরে যাই।”

বলে যেই পিছনে চলে যেতে নিবে ওমনি দুইপাশে দুই হাত ধরে আটকিয়ে নেয় রিমলি আর অর্পা।পিছন থেকে মিমি বলে ওঠে,”তুমি তো দেখছি খুব ভীতু।পাপা বলে ভীতুদের ভাত নেই।দেখবে তোমারও ভাত নেই।”

হা হয়ে যায় শ্রেয়া আর সৃষ্টি বেগম।মুখ টিপে হাসতে থাকে রিমিলি।না পেরে এবার জোরেই হেসে দেয়।তারপর বলে,”আমার মা আর বোন একটু বেশি ভীতু।সবসময় এমন করে।”

চোখ রাঙিয়ে তাকালো সৃষ্টি বেগম। রিমলি চুপ হয়ে যায়।মিমি আজ একটি ফ্রগ পরে পুতুল কোলে নিয়ে এসেছে।স্কুলে যায়নি সে।অর্পার থেকে শুনেছিলো আজ শ্রেয়ার মা ও বোন আসবে তাই মিমিও এসেছে মাত্র।মিমি এসে ভরসার হাত বাড়িয়ে ভিতরে নিয়ে যায় সৃষ্টি বেগমকে।সৃষ্টি বেগম ছোট মিমির হাত ধরে চলে যায়।

******
অহনা খাবার খেয়ে এবার উঠে দাড়ায়।মিসেস নাজমাকে বলে,”আমি এবার গেলাম।”

হুইল চেয়ারে বসা অবস্থায় মিসেস নাজমা বলেন,”কোথায় যাবে তুমি?”

“যেদিকেই যাই না কেনো আপনাকে কেনো বলব?”

একটু হাসলো নাজমা।বলেন,”একা মেয়ে এদিক ওদিক খালি দৌড়াতেই হবে।কাছে যা আছে তা দিয়ে তো ওই কয়েকদিন চলে যাবে।তারপর কি করবে তুমি?”

ভেবে দেখলো অহনা।কথাগুলো সঠিক।এখন কোন কাজ পাওয়া সম্ভব না তার।মিডিয়াতে ছড়িয়ে গেছে তার করা পাপ।আশেপাশে তার জন্য শুধু ধিক্কার আসবে।অহনার নীরবতার মাঝে মিসেস নাজমা বলেন,”বাইরে একা মেয়ে কখনও চলেছো।”

মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে দিলো অহনা।মিসেস নাজমা বলেন,”তাহলে?”

“আমাকে এখন কাজ খুঁজতে হবে।নিজেকে চালানোর জন্য।কিন্তু কাজ পাওয়া তো সম্ভব না।আমি প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি।”

“আপাতত তোমাকে একটা কাজ দিতে পারি করবে?”

“কি কাজ?”

“আমার এই বাড়িতে আমি একাই থাকি।আমার ছেলে আর নাতি মিলে জার্মানে থাকে।মূলত আমার নাতির এসএসসি শেষ করে ওখানে পড়াশোনা করতে গেছে।আমি পঙ্গু মানুষ এই বাড়িতে কোনো রকমে থাকি।আমাকে দেখাশোনার জন্য লোক লাগবে।তুমি করবে আমার দেখাশোনা?”

অহনার মাথায় যেনো বজ্রপাত হল।চোখ বড় বড় করে বলে,”আমি এসব পারি না।আর কোনো কাজ নেই নাকি?”

“আমি নিজেই তো সেভাবে চলতে পারি না।তোমাকে কাজ দিবো কিভাবে?ভালো একটি উপায় দিলাম রাজি থাকলে বলো।”

চুপ করে ভাবতে থাকে অহনা।এখন যদি মিসেস নাজমাকে দেখতে হয় তাহলেও অন্তত তার মাসে কিছু আয় হবে।তাই বলে,”ঠিক আছে।আমি রাজি এই কাজ করতে।কত দেওয়া হবে মাসে?”

“আমার দেখাশোনা করতে মাসে তোমাকে পাঁচ হাজার দিবো।”

ফুষে উঠে অহনা বলে,”মাত্র পাঁচ হাজার?এই ঢাকা পাঁচ হাজার কোনো তাকে হলো?”

হুইল চেয়ার নিয়ে এগিয়ে আসে মিসেস নাজমা।বলেন,”তুমি যে আমার সেবা করবে তার জন্য তিন বেলা তো এখানেই থাকবে।এখানে খাবে এখানে পরবে তাহলে এর থেকে বেশি কেনো দিবো?”

কোনো কাজ নেই অহনার হাতে।নিজেকে চালাতে হলে এই কাজ তাকে করতেই হবে।রাজি হয়ে যায় মিসেস নাজমার প্রস্তাবে।মিসেস নাজমা এবার অহনাকে বলেন,”কিন্তু আমার একটি শর্ত আছে।”

চোখ খিটমিট করে অহনা বলে,”আবার কি শর্ত?”

“তোমাকে আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে।তুমি মেয়ে খুব বেয়াদব আছো।”

রাগ চেপে বসলো অহনার মাথায়।কিন্তু হাত পা বন্ধ তাই কিছু বলতে পারছে না সে।মিসেস তানহা বলেন,”শুধু তাই না।এবার থেকে সকাল সকাল উঠে আমার জন্য নাস্তা বানাতে হবে।আমি কি কি ঔষধ খাই ওগুলো বিষয়ে জানতে হবে।নিজেকে এভাবে উড়নচণ্ডী বানানো যাবে না।নমনীয়তা আনতে হবে নিজের মাঝে।যেহেতু বাড়িতে আরও সার্ভেন্ট আছে তাই আমার মতো হয়ে থাকতে হবে।”

অহনা দেখলো মিসেস নাজমাকে।মিসেস নাজমা পরিপাটি হয়ে আছেন।মাথায় কাপড় দেওয়া।চুলগুলো ঢেকে রাখা।অহনা বুঝলো তাকেও এভাবে থাকতে বলা হচ্ছে।শর্তগুলোর একটাও পালন করা সম্ভব না অহনার কাছে।বিরক্তির সাথে বলে,”আমি পারব না।আমি কোনোদিন এভাবে চলিনি।ঘুম থেকে উঠতেই তো আমার সকাল এগারোটা ওপার হয়ে যায়।”

“ওটাকে সকাল বলে না মেয়ে।আসল সকাল তো ভোর পাঁচটার পর।সূর্য ওঠার সুন্দর মুহূর্ত তোমরা মডার্ন মেয়েরা মিস করো।যাই হোক এটা তোমার কাজের রুলস।পালন না করলে কাজ হবে না তোমার। আর তুমি কাজ না পেলে আমার যায় আসে না।আমি আমার মতো অন্য কাউকে খুঁজে পাবো।”

হাত ফসকে টাকা বেড়িয়ে যাওয়া যাবে না।তাই বাধ্য হয়ে অহনা বলে,”আচ্ছা আমি রাজি।”

মুচকি হাসি দিয়ে মিসেস নাজমা বলেন,”ভেরি গুড।”

******
অফিসের বাইরেটা দেখ যতটা ঘাবড়ে যায় সৃষ্টি বেগম অফিসের ভিতর এসে তার থেকেও বেশি ঘাবড়ে যায়।এখানে তো সব মেয়েরাই ছোট ছোট ড্রেস পরা।বিশেষ করে এনি নিজেও।টপস আর জিন্স পরা।এটা দেখেই মাথা ঘুরছে তার।সৃষ্টি বেগম তার মাথার আচলটা আরেকটু এগিয়ে দিয়ে মুখ ঢেকে বলে,”হ্যাঁ রে এখানে বুড়িরাও রং ঢং করে?”

শ্রেয়া দেখলো এনিকে।এনি মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে সৃষ্টি বেগমের দিকে।মূলত তিনি ওয়েলকাম করতেই এখানে আছে।আর সৃষ্টি বেগম গ্রাম্য আবির্ভাব ধরে রেখে কথা বলছেন।রিমলি এবার বলে ওঠে,”উফ মা ওরা যা পারে করুক।আপু তো আর ওমন করে চলে না।এখানে কাজ দেখে ড্রেস না।”

“তুই কিভাবে জানলি?”

“পড়াশোনা করি আমি।সাথে টিভি সিরিয়াল তো দেখি তাই না!”

এনি এসে সাক্ষাৎ করে সৃষ্টি বেগমের সাথে।সৃষ্টি বেগম কি বলবেন না বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।কিন্তু এনির মিষ্টি ব্যাবহারে সৃষ্টি বেগম একটু শান্তি পেলো।তার ভাষ্যমতে বড় বড় জায়গার মানুষ অহংকারী হয়।ওদের কথার মধ্যে আলাদা পার্সোনালিটি কাজ করে।মিমি ছুটে চলে যায় ফারাজের কাছে।দুপুরে এখনও খায়নি সে।ফারাজকে নিয়ে বাইরে এসে মিমি বলে,”পাপা দেখো আন্টির মা আর বোন এসেছে।”

“আন্টির মা না বলতে হয় নানু।”
বলেই ফারাজ চলে যায় সৃষ্টি বেগমের কাছে।সৃষ্টি বেগমকে সালাম দিয়ে কিছু কথা বলে ডাক দেয় একজন কর্মীকে।সে কাছে আসলেই ফারাজ বলে,”এনাদেরকে চারপাশ ঘুরিয়ে দেখাও।”

কর্মী নিয়ে গেলো ওদের।শ্রেয়া চলে যায় কেবিনে।তার ফাইলগুলো ভালোভাবে চেক করতে হবে।শ্রেয়ার কাজের মাঝে রিমলি এসে বসে শ্রেয়ার কেবিনে।বলে ওঠে,”তোমার ভাগ্যটা অনেক ভালো আপু।কি সুন্দর জায়গায় কাজ পেয়েছো।আহ তোমার কেবিনে আবার এসি আছে।”

ফাইল দেখতে দেখতে শ্রেয়া বলে,”এসি তো পুরো কোম্পানি জুড়েই আছে।”

“হ্যাঁ তা আছে।কিন্তু অর্পা আপুর জন্য আজ তুমি এখানে।সবথেকে বড় ভাগ্য এমন বান্ধবী পাওয়া।”

মুচকি হেসে শ্রেয়া বলে,”অর্পা যেমন আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তুইও আমার বেস্ট বোন।তোরা আমাকে এগিয়ে যেতে আশার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিস।নাহলে আমি আজ এতদূর এগোতে পারতাম না।”

“হুমমম তবে আপু।আই মাস্ট সে তোমার বস ইজ ঠু মাছ হ্যান্ডসাম।এমন হাসব্যান্ড রেখে অন্য পুরুষের প্রতি আসক্ত হয় কিভাবে?”

“ওখানে তুই শুনিস নি।রনি আর অহনা কলেজ লাইফ থেকেই রিলেশনে ছিলো।বিয়ের পর এতকিছু পেয়েও যখন অহনা স্যারের প্রতি ভালোবাসা আনতে পারেনি তারমানে তো বোঝাই যায় অহনা রনির প্রতি দুর্বল।”

“ওমন নষ্ট দুর্বলতা কোনো মেয়ের না হোক।বাজে মেয়ে একটা।কারো সংসার ভাঙে তো কারও মন।আবার নিজের সন্তানের সাথে ছিঃ।”

বাইরে তাকিয়ে শ্রেয়া দেখলো ফারাজ ও মিমি আসছে।ওদের লাঞ্চ কমপ্লিট।শ্রেয়া এবার রিমলিকে বলে,”এই বিষয়ে কথা বলা বাদ দে। আর এখন চুপ থাক।স্যার আসছে আমি কাজ করি। কাল মিটিং আছে।”

“ওকে, করো তুমি কাজ।”
বলেই এদিক ওদিক খুঁটিয়ে দেখছে রিমলি।শ্রেয়ার কেবিনেও একটি ডিসপ্লে ডল রাখা আছে।তারপাশে ছোট ডেস্ক।সেখানে ফুলদানি দিয়ে সাজানো।সৃষ্টি বেগম সবকিছু দেখতে থাকে।অর্পা ও একজন কর্মী মিলে সবকিছু বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলতে থাকে তাকে।কিছু ড্রেস পরিয়ে দেখিয়ে দেয় সৃষ্টি বেগমকে।এখন মনটা একটু শান্ত হলো তার।অর্পা বলে ওঠে,”এখনও কি টেনশন হচ্ছে তোমার আণ্টি?”

সৃষ্টি বেগম মাথা নাড়িয়ে বলেন,”না এখন একটু শান্তি পাচ্ছি।মেয়ে আমার ভালো জায়গাতেই এসেছে।আমার এখন আর কোনো চিন্তা নেই।”

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here