#আশার_হাত_বাড়ায় |১৮|
#ইশরাত_জাহান
🦋
রাতের পরিবেশটা এখন ঠান্ডা ও নিস্তব্ধ।ব্যালকনিতে দাড়িয়ে এই পরিবেশ উপভোগ করছে ফারাজ।একাকীত্বের জীবনে লড়াই করছে পুরো দুনিয়ার সাথে।মেয়েকে নিয়ে পুরুষ হয়েও তাকে লড়াই করতে হয়।এটাই দুনিয়া।নারী পুরুষ বলে কথা নেই।লোকের আঙুল সবসময় একে অপরের দিকে তুলবেই।এটাও যে লোকের কাজ।মিমিকে নিয়ে আজ ফেস করলো।হয়তো ভবিষ্যতেও ফেস করতে হবে।কিন্তু মিমির তো দোষ নেই। ফারাজের নিজেরও দোষ নেই।তারপরও মিমির মায়ের করা কৃতকর্মের ফল পাচ্ছে মিমি।পুরোনো কিছু সাংসারিক জীবনের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে আসে।ফারাজ যেনো ওগুলো দেখতে পাচ্ছে এখনও।এই তো কয়েকমাস আগেও অহনা তার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,”আমার একটা ব্ল্যাক কালারের গাড়ি পছন্দ হয়েছে।ভাবছি ওটা কিনে আমি আর মিমি ঘুরবো।একান্তই আমার আর মিমির জন্য হবে গাড়িটি।”
মুচকি হেসে অহনার কথায় রাজি হয় ফারাজ।বলে,আচ্ছা দিবো।আমার দুনিয়া আমার পরিবার।এদের জন্য আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে দিবো।”
অহনার এই ভালোবাসাটা যে শুধু লোক দেখানো ছিলো এটা বুঝতে পারেনি ফারাজ।কিভাবে বুঝবে?অহনা সবসময় বলে মিমি আর সে এটা ওটা নিয়ে থাকবে।বিদেশে থাকা ফারাজ যেনো দূরে থেকে ভেবে নিতো তার মেয়ে বউ মিলে সুখে আছে।বাসায় আসলে অহনা তাকে কোনোকিছু বুঝতেই দিতো না।এখন বুঝতে পারছে তার টাকা দিয়ে তার বউ অন্য পুরুষের কাছে যেতো।অতীত মনে পড়তেই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এলো ফারাজের।ব্যালকনিতে থাকা সাজানো দেওয়ালে ইচ্ছামত বল প্রয়োগ করে ঘুষি দিতে থাকে।হাত ফেটে রক্ত পড়ছে কিন্তু ফারাজের রাগ কন্ট্রোল হচ্ছে না।অহনাকে ভালোবেসে বিচক্ষণ ফারাজ পুরোটাই অন্ধ হয়ে যায়।অহনার দেওয়া ধোকাকে ভালোবাসা ভেবে জীবনকে উপভোগ না করে বরং নষ্ট করে দিলো।আজ সেই অহনাকে শাস্তি দিলেও শান্তি নেই তার জীবনে।
ফুটো টিনের মধ্য দিয়ে পানি পড়তে থাকে।নিচে বালতি পেতে আছে শ্রেয়া ও রিমলি। খাট ভিজে গেছে কিছুটা।খাটের এক কোনায় শুকনো জায়গায় ঘুমোচ্ছে সৃষ্টি বেগম।শ্রেয়া আর রিমলি নিচে বিছানা পেতে গল্প করছে।ফ্যান বন্ধ করে রেখেছেন সৃষ্টি বেগম।তার ভাষ্যমতে,”এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় ফ্যান চালিয়ে কারেন্ট বিল বাড়ানোর কোনো মানে নেই।”
মায়ের কথার দ্বিমত করলো না দুই বোন। রিমলি ছোট করে বলছিলো,”কিপ্টে মা।”
সৃষ্টি বেগম চোখ গরম দেখিয়ে শুয়ে পড়েন।শ্রেয়া শুতে যাবে রিমলি বলে ওঠে,”এখনই ঘুমাবে?”
উঠে বসে শ্রেয়া।বলে,”কত রাত হয়েছে দেখেছিস?সকালে অফিসে যেতে হবে।কিছু মডেল আসবে।ওদেরকে নিয়ে আবার ড্রেস সিলেক্ট করতে হবে।অনেক কাজ।এখন ঘুমাই।”
“ধুর!তোমার কাজের জন্য একটু গল্পও করতে পারি না।সন্ধার পর বাসায় এসে তো সেই ঘর গোছাতে থাকো।তারপর খেয়েদেয়ে ঘুম।আবার সকালে চলে যাও অফিসে। একটুও সময় দেও না আমাকে।”
মিষ্টি হেসে রিমলির সামনে এসে বাবুদের মত আসন করে বসলো শ্রেয়া।বলে,”আচ্ছা দুই বোন মিলে এখন গল্প করব। বল কি বলবি?”
রিমলি কিছুক্ষণ শ্রেয়ার মুখের দিকে তাকালো।দেখলো ফুরফুরে মেজাজের শ্রেয়াকে।শ্রেয়ার মুখটা আগের থেকে উজ্জ্বল হয়েছে।গালের হাসিটা এখন লেগেই থাকে।বাবা বেঁচে থাকতে যে শ্রেয়াকে রিমলি দেখেছিলো সেই শ্রেয়াকে পুণরায় দেখতে পেলো রিমলি।খাটের কোনায় হাত রেখে একটু হেলান দিয়ে রিমলি বলে,”জীবনটা কেমন যেনো বদলাতে থাকে তাই না আপু।সুখ দুঃখ কোনোটাই যেনো স্থায়ী না।”
চোখমুখ ছোট ছোট করে শ্রেয়া বলে,”এমনটা কেনো মনে হলো তোর?”
“এই যে বাবা বেচে থাকতে কত হাসিখুশি ছিলে তুমি।বাবা মারা যাওয়ার পর মনটা আস্তে আস্তে বিষন্নতায় ছেয়ে গেল।তারপর বিয়ে করলে।সেখানে সুখ তোমার সাথে দেখা দেয়নি।কিন্ত যেই তুমি জীবনে নতুন ভাবে চলার চেষ্টা করেছো সুখেরা যেনো তোমাকে নতুন রূপে দেখা দিচ্ছে।এই সুখ এই দুঃখ আবারও সুখ এভাবেই বদলাতে থাকে জীবন।”
ছোট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শ্রেয়া।হাসির কারণে শ্রেয়ার মুখে টোল দেখা যায়।কিন্তু এই হাসিটা কিছুক্ষণ আগের থাকা ফুরফুরে থাকে না।এই হাসিটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে মন খারাপের দিকে।মনে পড়ে গেলো শ্রেয়ার আজ দুপুরের কথা।ফারাজ যখন মিমির স্কুলে শ্রেয়াকে নিয়ে যায়।শ্রেয়া কৌতূহল নিয়ে চেয়েছিলো স্কুলের ভিতরের ঘটনা দেখার জন্য।ড্রাইভার দ্বারা জানতে পারে মিমির ঘটনা।দারোয়ানের কাছে প্রশ্ন করে ড্রাইভার।তখন সব জেনে মিমির উপর মায়া হয় তার।মিমির চেহারা ভেসে আসতেই শ্রেয়া বলে,”আমাদের জীবনে আসা কিছু কিছু সুখ আবার অন্য মানুষের জীবনে দুঃখ নিয়ে আসে।সে যেমন ভাবেই হোক।আমার সুখে কেউ দুঃখী তো কারো সুখে আমি দুঃখী।”
কৌতূহল নিয়ে রিমলি বলে,”কিছু হয়েছে আপু?”
শ্রেয়া সব ঘটনা খুলে বলে রিমলিকে।সব শুনে আফসোসের সুরে রিমলি বলে,”এমন মাও হয়!কিভাবে পারে মেয়ের এমন অন্ধকার জীবন গড়ে দিতে?কিছু করার আগে অন্তত সন্তানের কথা ভাবা উচিৎ ছিল।তোমার বস অনেক ভালো মানুষ।দেখো তাদের জীবনটাও একদিন আলোকিত হবে।”
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শ্রেয়া বলে,”মিমির জীবনটা আলোকিত হোক এটাই চাই।ছোট মেয়েটার জীবনে আর কোনো অন্ধকার না আসুক।বাবা মা থাকা একটা সন্তানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ এটা আমি বাবা হারানোর পর বুঝেছি।আজ মিমিকে দেখে বুঝলাম।জানিস আমার কোলে যখন ও মাথা রাখে ওর হার্টবিট আমি কেমন জানি বুঝতে পারছিলাম।মিমির গায়ের গরম উষ্ণতা তো অহনার মাতৃত্বে ভালোবাসা উপলব্ধি করার কথা।আমি যেটা দূরের কেউ হয়ে পেলাম অহনা মেয়েটা কেনো পেলো না?বিয়ের পর মা যখন বলতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা নে দেখবি ভালো লাগবে আমি তখন লজ্জা পেতাম।আবার ভাবতাম আমার একটি বাচ্চা হবে।আমি তাকে এভাবে বড় করবো এভাবে ওকে নিয়ে ঘুরবো।আমাকে আদুরে কণ্ঠে মা বলবে।সেখানে অহনা মেয়েটা মা হওয়ার পরও কিভাবে মেয়ে থুয়ে এসব করে?আমি না মিমি মেয়েটার কষ্টটা দেখে নিজেকে সত্যি লাকি মনে করি।অর্থ সম্পদ কম থাকুক কিন্তু আমি আমার বাবা মায়ের ভালোবাসা পেয়েছি।তাদের দেওয়া শিক্ষা তাদের দেওয়া ভালোবাসা অন্তত আমার জীবনের এক অংশকে আলোকিত করেছে।কিন্তু মিমি মেয়েটা তো ছোট থেকেই অন্ধকারে ডুবে গেলো।”
বলেই চোখের পানি ফেলতে থাকে শ্রেয়া। রিমলি শ্রেয়ার চোখের পানি মুছে বলে,”মিমি মেয়েটা অনেক স্ট্রং আপু।তুমি চিন্তা করোনা।দেখবে ওর জীবনটা আলোকিত হবে।শুধু সময়ের অপেক্ষা।তুমি একটু ওকে ভালোবেসো আদর যত্ন করো।ও যখন তোমার কাছে আসে ওকে ভালোবেসে আঁকড়ে নিও।মেয়েটার অন্য সময় যেমন কাটুক তোমার সাথে থাকার সময়টাতে যেনো মেয়েটা হাসিখুশি ভালো থাকে।দেখবে তুমিও শান্তি পাবে।”
মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝিয়ে দিলো শ্রেয়া।দুই বোনের কথাগুলো খাট থেকে শুনছিলো সৃষ্টি বেগম।তিনি ঘুমাননি।শুয়ে ছিলেন।কিন্তু শ্রেয়া ও রিমলিকে বুঝাতে থাকেন তিনি ঘুমিয়ে গেছেন।মেয়েদের এখন আলাদা রুম নেই।তাই তো মেয়ে দুজন আলাদা গল্প করতে পারে না।কখনও কখনও মা বাবার সামনে গল্প করা যায় না।কিছু কথা মা বাবার সামনে বলতে সন্তানদের লজ্জা করে। বন্ধু বা বোন থাকলে মানুষ মন খুলে কথা বলতে পারে।এটা সৃষ্টি বেগম বোঝেন।তাই তিনি এখন ওদের কিছু না বলে চুপ করে আছে।অন্যদিকে ফিরে কথাগুলো শুনে তার নিজের চোখটাও ভিজে গেছে। আস্তে আস্তে পানীগুলো গড়িয়ে পড়ে বালিশে।ভিজতে থাকে বালিশ।তার স্বামী বেচে থাকলে মেয়েটার এমন অবস্থা হতো না।তিনি সমাজ চিনতে পারে না।ঘরকুনো সৃষ্টি বেগম জীবনে যে শিক্ষা পেয়েছেন সন্তানদের জন্য তাই করছেন।কাজ কর্ম করা বরের মার খাওয়া এছাড়া শ্বশুরবাড়ির খোচা শোনা তার একটা অভ্যাস ছিলো।গ্রাম্য পরিবেশে থাকায় তিনি এত আধুনিক মন মানসিকতার ছিলেন না।যার কারণে রনির মত ছেলের সাথে বিয়েটা হয়ে যায়।
খাটের এক প্রান্তে শুয়ে এ কাথ ও কাথ করছে অহনা।বিরক্ত লাগছে তার। ফোনটাও সেদিন এক্সিডেন্টে ভেঙ্গে যায়। রাগে নিজের মাথা ফাটাতে ইচ্ছা করছে এখন।অহনার পাশেই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে মিসেস নাজমা।গাল হা করে নাক ডাকছেন তিনি।লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে আছেন।রাতের অন্ধকারে ভয় করে তার।জ্বলন্ত সাদা লাইটে চোখ বন্ধ রাখলেও লাল আভাস দেখে তার শান্তি লাগে।বুঝতে পারে চারিদিকে আলো ছড়িয়ে আছে।কিন্তু অন্ধকার দেখলে তার ঘুম ভেংগে যায়।স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি লাইট অফ করে ঘুমাতে পারেনা।মিসেস নাজমা অহনাকে বলেছিলেন,”আজ থেকে আমার সাথে ঘুমাবে তুমি।ফজরের নামাজ পড়তে উঠবে।আমি এলার্ম দিয়ে রেখেছি।নামাজ পড়ে তারপর আমি কুরআন শরীফ পড়বো আর তুমি শুনবে।দেখবে মনটা পবিত্র লাগছে।এই খিটমিটে ভাব থাকবে না।”
মিসেস নাজমার কথা শুনে অহনার মেজাজ আরো বেশি গরম হয়ে গেলো।কিন্তু না পেরে সে চুপ আছে।মিসেস নাজমা এই রাগকে পাত্তা না দিয়ে ঘুমোতে থাকেন।হঠাৎ ফোনের আওয়াজ পেয়ে স্থির হয়ে চেয়ে থাকে অহনা।মিসেস নাজমার ফোন বেজে উঠেছে।অহনা একটু উচু হয়ে ফোনটা হাতে নেয়।স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম ‘ কবীর ‘।রিসিভ না করার কারণে প্রথম কল কেটে যায়।দ্বিতীয়বার কল আসতেই অহনা নিজে কেটে দেয়। আবারও কল আসে মিসেস নাজমার ফোনে।এবার ফোন রিসিভ করে অহনা বিরক্তি নিয়ে বলে,”এভাবে রাতের বেলা একজন বুড়িকে কল দিতে বিবেকে বাঁধে না?”
আমেরিকার একটি বিলাস বহুল ঘরে বসে দাদীকে কল দিতে থাকে কবীর।এখন তার সময় হয়েছে কল দেওয়ার।ওখানে এখন দিন।সারাদিনের ব্যাস্ততায় দাদীর সাথে কথা বলতে পারে না।দাদীকে ভালোবাসে খুব।তাই কল দিলো।কিন্তু দাদীর কণ্ঠ না পেয়ে অন্য কারো কণ্ঠ পেয়ে কবীর বলে,”তুমি কে?”
অহনা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,”তুমি কে যে এত রাতে কল দেও?”
“তুমি যার ফোন নিয়েছো আমি তার ছেলের ছেলে।এখন দাদীকে ফোন দেও।”
“তোমার দাদী ঘুমাচ্ছে। কাল কথা বলো।”
বলেই কল কেটে দিলো অহনা।অবাক হলো কবীর।তারপর মনে পড়ল এখন তো বাংলাদেশে রাত।তাও আবার গভীর ঘুমের সময়।তাই আর সে ফোন দিলো না।অহনা ফোনটি পাশে রাখবে ওমনি মনে পড়লো মিসেস নাজমা বলেছিলো ওনার এলার্ম দেওয়া আছে।অহনা এলার্ম বন্ধ করে দিলো।তারপর শয়তানি হেসে বিড়বিড় করে বলে,”বুড়ি তুমি নিজেও আরামে ঘুমাবে আর আমিও আরামে ঘুমাবো।”
কথাগুলো বলেই শান্তিতে শুয়ে পড়ে অহনা।
******
ফজরের আজান কানে ভেসে আসে অহনার।সাথে ভেসে আসে মিসেস নাজমার ডাক।অহনাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে তিনি বলেন,”এই মেয়ে ওঠো ঘুম থেকে।আজান দিচ্ছে এখন।”
অহনার কোনো সাড়া শব্দ নেই।সে ভাবছে সে স্বপ্ন দেখছে।স্বপ্ন ভেবেই ঘুমের ঘোরে মিটমিট হাসতে থাকে অহনা।কিন্তু এই শান্তির ঘুম স্থায়ী হলো না।মুখের উপর পানি পড়তেই ঘুমের রেশ কাটিয়ে উঠতে হলো তাকে।এক লাফে উঠে বসলো।পাশে তাকিয়ে দেখলো মিসেস নাজমার হাতে জগ।রেগে গিয়ে অহনা বলে,”সমস্যা কি আপনার?ঘুমের মধ্যে মুখে পানি দেন কেন?”
“ফজরের আজান দিয়ে দিছে।এখন ওঠো।আমি যা যা বলব তাই করবে। আর হ্যাঁ মুখের উপর না বলবে না।তুমি আমার কেয়ার টেকার।”
চোখ মুখ ফুলিয়ে অহনা মা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।মিসেস নাজমা আবার বলেন,”আমার এলার্ম শুধু ফোনে দেওয়া থাকে না।আমার কাছে ঘড়ি আছে।তাও একটা না দুইটা।এই সবগুলোতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাই আমি।”
অহনা হা হয়ে গেলো।কিন্তু কিছু বললো না।মিসেস নাজমা তাড়াহুড়া দিয়ে বলেন,”এখন যাও তাড়াতাড়ি আমার হুইল চেয়ার নিয়ে আসো।আমাকে নিয়ে বাথরুমে চলো।অযু করতে হবে।”
মন না চাইলেও বাধ্য হয়ে চলে গেলো অহনা।এটা দেখে মিসেস নাজমা বিড়বিড় করে বলেন,”খারাপ কে কিভাবে ভালো পথে আনতে হয় এটা এই নাজমা খুব ভালো করে জানে।তুমি তো সোজা পথে আসবেই।”
পুরোনো কিছু কাপড় নিয়ে ঘর মুছতে থাকে শ্রেয়া আর রিমলি।ঘরের নিচ থেকে পানি উঠতে থাকে।পুরোনো টিনের বাড়িতে এই একটাই কষ্ট।ঝড় বৃষ্টি হলে পানি উঠবে।শ্রেয়া জেনে বুঝেই ভাড়া নেয় এই ঘর।সৃষ্টি বেগম রান্না চাপিয়েছেন।সব পরিষ্কার হওয়ার পর শ্রেয়া ওর মা আর বোনের দিকে তাকায়।খারাপ লাগে ওর।এখানে ওর মা আর বোন কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।ভালো কোনো ঘর দেখতে হবে তাকে।কথাগুলো ভেবে অফিসের জন্য তৈরি হয় শ্রেয়া। রিমলি মন খারাপ করে আছে।শ্রেয়া আয়নার মধ্যে রিমলির প্রতিবিম্ব দেখে বলে,”তোর আবার কি হলো?”
মন খারাপ করে রিমলি বলে,”আমার ছাত্র ছাত্রীদের মা কল করেছিলো।বলেছে ওদের নাকি পরীক্ষা।এমন সময় এত গ্যাপ দিলে হয় না।ওরা মনে হয় নতুন টিচার দেখবে।”
হিজাব বাঁধতে বাঁধতে শ্রেয়া বলে,”তাহলে দেখুক নতুন টিচার।”
মুখ ভেংচে রিমলি বলে,”হ্যাঁ তাই তো! যা একটু হাত খরচ ওই ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ায় পাই ওগুলো উঠে যাক।ওরা হাত থেকে ফসকে গেলে আমি যশোরে গিয়ে কাদের পড়াবো?”
“যশোরে যাবি কেনো?”
“ওমা তোমার এই বাড়িতে কয়দিন থাকবো?মা তো বলেছে আর তিন চারদিন থেকেই চলে যাবে।”
রান্নাঘরে কাজ করছিলেন সৃষ্টি বেগম।গলা উঁচিয়ে শ্রেয়া বলে,”তোমরা কি যশোরে যাবে মা?”
সৃষ্টি বেগম বলেন,”হ্যাঁ রে।অনেকদিন তো হলো থেকেছি।এবার যশোরে যাওয়া লাগবে।”
“কিন্তু যাওয়ার দরকার কি?এখানে থাকো তোমরা।আমরা সবাই তো এখানেই ভালো আছি।”
ফোড়ন কাটল রিমলি।বলে,”আমার এখন কলেজে ভর্তি হতে হবে।পড়াশোনা তো করতে হবে তাই না?”
শ্রেয়া কোমড়ে হাত রেখে রিমলিকে খোচা মেরে বলে,”কত বই পড় তুমি?যশোরের কলেজে পড়তে হবে না।ঢাকায় কোনো সরকারি কলেজে ভর্তি করায় দিবো তোকে।”
কিছুক্ষণ খুশি হলেও মন খারাপ করে রিমলি বলে,”এখানকার দ্রব্যমূল্য যে হারে বৃদ্ধি পায় আমি এখানে থাকবো না।সবকিছুর কেমন চওড়া দাম।আবার আমার টিউশনির ব্যাবস্থা নেই।নিজে তো তাও যশোরে থাকলে কিছু করতে পারি।অন্তত প্লে নার্সারি কেজি এদের পড়ালেও আমার হাত খরচ আমি উঠাতে পারি।”
শ্রেয়া জানে রিমলি একটু সেল্ফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট টাইপের।ও কারো কাছে কিছুই চাইতে পারে না।শুধু নিজের যোগ্যতায় চলে।কিছুক্ষণ চুপ থেকে শ্রেয়া বলে,”ড্রাইভার আংকেলের বউয়ের সাথে তো ঘুরঘুর করিস সারাদিন।ওনার কাছে একটু বল যে তুই ছোট ছোট ছাত্র ছাত্রী খুজতেছিস।কলেজ করে এসে এখানে বাচ্চাদের পড়াবি।”
রিমলি কিছু বলার আগে সৃষ্টি বেগম বলেন,”সে নাহয় হলো।কিন্তু আমি যে কিছু কাঁথা বুনে দু এক টাকা আয় করি।তার কি হবে?এখানে তো আর ওসব চলবে না।কে নিবে আমার বানানো কাঁথা?আমার যা একটু আয় হয় তাও চলে যাবে।তোর এত খরচ করতে হবে না।”
“আরে মা তুমি জানো না।যশোরের থেকে ঢাকায় কাঁথার প্রতি মানুষের ঝোক বেশি।যশোরে তো যেখানে সেখানে নকশী কাঁথা বুনে দেয়।কিন্তু এখানে এতকিছু হয় না।যে যার মতো ব্যাস্ত।আমার কাছে তাই দু একজন আন্টি এসে বলতেন,ভালো কাঁথা পেলে ভালো হয়।বাজারে যে দাম কিনতে কষ্ট।তুমি যে সুন্দর কাঁথা বুনো ওগুলো ঢাকায় চার হাজারের নিচে নেই।তুমি তো এখানেই কাঁথা বুনতে পারবে।আর আশেপাশে লোকজন দেখলে এমনি এগিয়ে আসবে।”
খুশিতে লাফ দিয়ে ওঠে রিমলি।হাত তালি দিয়ে বলে,”তাহলে তো হয়েই গেলো।আমরা এখানে থাকবো।আমি ঢাকায় পড়াশোনা করবো।অনেক ভালো লাগছে।”
সৃষ্টি বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,”যেটা ভালো হয়।তাহলে তো যশোর থেকে কিছু ফার্নিচার আনতে হবে।এখানে তো এভাবে থাকা সম্ভব না।”
শ্রেয়া ব্যাগে টাকা রাখতে রাখতে বলে,”নতুন ঘর দেখতে হবে মা।এখানে এমনিতেও থাকা সম্ভব না।আমি ড্রাইভার আংকেলকে বলেছি।উনি আমাকে কিছু বাড়ির অ্যাড্রেস দিয়েছিলো।ওগুলো নিয়ে ঘর খুঁজতে হবে।যেটা ভালো লাগে একটু সাধ্যের মধ্যে পাবো ওটাই নাহয় ভাড়া নিবো।”
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন সৃষ্টি বেগম।শাড়ির আচল তার মাথায় ছিলো।মুখে গুজে কান্না করে দেন।শ্রেয়া আর রিমলি অবাক হয়ে বলে,”কান্না করছো কেনো?”
সৃষ্টি বেগম বলেন,”বাবা মায়েদের দায়িত্ব সন্তানদের আগলে রাখা।আর আমি কিনা তোদের উপর নির্ভর।তোদের জীবনে সুখ তো এনে দিতে পারলাম না।উল্টো তোর ঘাড়ে চেপে আছি।এমন অভাগা মা হওয়ার চেয়ে না হওয়া ভালো।”
কষ্ট পেলো শ্রেয়া। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”এভাবে একদম ভাববে না।মা বাবা কেনো শুধু সন্তানকে দেখবে।সন্তানও তো মা বাবাকে দেখবে।এতে কি এমন ক্ষতি?সন্তানের টাকায় মা বাবা চলাটা কি অন্যায়?”
সৃষ্টি বেগম মাথা নাড়ালেন।তিনি যতই বলুক শ্রেয়া বুঝবে না।সৃষ্টি বেগম কোনো কিছু সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন না।কিন্তু শ্রেয়াকে এইভাবে কষ্ট করতে দেখে মা হিসেবে তার বুক চিড়ে আসে।কোনো বাবা মা চায় না তার সন্তান তাদের জন্য কষ্ট করুক।কিন্তু এটা একদিকে আলাদা এক ভালোলাগাও কাজ করে।সৃষ্টি বেগমের ভালো লাগলেও আবার তিনি মেয়ের কষ্ট দেখলে নিজেই কষ্ট পান।
চলবে…?
ঈদের সময় বাসায় মেহমান আসে।রোজা রেখে সবার জন্য ব্যাবস্থা করা আবার তাদের সাথে গল্প করা এদিকে কেনাকাটা তো থাকেই।রোজার শেষের দশদিনের বেজোড় রাতগুলো অনেক ব্যাস্ত ছিলাম।ঘুম তাই ঠিকমত হয়নি।আবার আমার পরীক্ষা তেইশ তারিখে।রোজার ব্যস্ততা শেষে একাডেমিক নিয়ে বসতে হয়।তাই গল্প দিতে দেরি হয়েছে।আসলে আমার একটু ভুল হয়েছে।পঁচিশ রোজার পর যে ব্যাস্ত হয়ে যাবো এটা মাথায় আসেনি।তাই তো গল্প দিয়ে দেই।দেরি হওয়ার জন্য আমি দুঃখিত।