#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_১৪
হঠাৎ টাল সামলাতে না পেরে শুভ্রর দুহাত পেঁচিয়ে ধরলো তুলির মেদহীন কোমড়, ঠোঁট ছুয়ে গেল একদম তুলির গলার নিচের অংশে। জীবনের প্রথম এমন স্পর্শে তুলি একপ্রকার থমকে গেল। শুভ্রও সঙ্গেসঙ্গে মুখ তুলল তুলির গলা থেকে। হঠাৎ করেই সম্পূর্ণ পরিস্থিতিটা উল্টো স্রোতে ঘুরে গেল গেল এ নতুন দম্পত্তির।
শুভ্রর সমস্ত ভার তুলির উপড় পড়তেই একপ্রকার চ্যাপ্টা হয়ে গেলো তুলি। চোখ খিঁচে রেখে, শুভ্রর বুকে দুই হাত চাপতেই শুভ্র চটজলদি তুলির উপর থেকে উঠে পড়লো। তুলির বুক উঠানামা করছে। ভয় পেয়ে গেছে ও। সঙ্গে প্রথমবারের ন্যায় শুভ্রর ঠোঁটের স্পর্শ হৃদয়ে তীব্র আবেশের জন্ম দিচ্ছে। শুভ্র উঠে বসে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে পায়ে পা ঘষতে থাকল। তুলি শুয়ে আছে। এখনো যেন ঠিক হতে পারছে না। তুলির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে শুভ্র পেছনে ঘুরল। তুলি শুয়ে আছে দেখে তার ডান হাত বাড়িয়ে দিলো তুলির দিকে, কিন্তু কিছু বললো না। তুলি ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল, হাত বাড়িয়ে শুভ্রর হাত চেপে ধরে আস্তে করে উঠে বসলো। তারপর দুজনেই চুপচাপ। শুভ্র মেঝের দিকে চেয়ে। তুলিও সেরকমভাবেই বসে আছে। খানিক পর হঠাৎ দুজন একসঙ্গে বলে উঠলো,
‘সরি।’
নিজেরা বলে নিজেরাই অবাক হয়ে গেলো। একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। শুভ্র প্রথমে হেসে ফেললো। তুলিও শুভ্রর দেখাদেখি হেসে উঠলো। শুভ্র বললো,
‘সরি বলার দরকার নেই আমাদের কারোরই। ইটস প্রিটি নরমাল বিটুইন আস।’
তুলি হঠাৎ এমন কথা শুনে কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলো। কপালের ভিজে চুল কানের পেছনে গুঁজতে গুঁজতে বললো,
‘হুম।’
হঠাৎ শুভ্র বিছানার দিকে চাইল।তারপর দ্রুত উঠে দাঁড়াল,
‘তুলি তুমি তো চুলের পানিতে বিছানাও ভিজিয়ে দিয়েছ।’
শুভ্রর কথা শুনে তুলি পেছনে তাকাল। বিছানার একটা অংশ ভিজে গেছে। তুলি দাঁত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে বাঁকা চোখে শুভ্রর দিকে তাকালো। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে তুলির দিকে। তুলি মিনমিন করে বললো,
‘সরি, আসলে আমার চুল ঘন তো তাই-‘
‘এদিকে টাওয়ালটা দাও তো, আমি মুছে দিচ্ছি চুল।’
শুভ্র কথাটা বলে তুলির টাওয়াল দেওয়ার আর অপেক্ষা করলো না। তুলির হাত থেকে টাওয়াল কেড়ে নিয়ে তুলির পেছনে এসে দাঁড়াল। আলগোছে চুল মুছে দিতে থাকল আর তুলিকে শোনাতে লাগলো কিভাবে চুল মোছতে হয় তার হাজারো টিপস। তুলি এসব শুনেনি। শুনবেও না। এভাবে তুলির চুলে দুনিয়া ভেসে যাক। শুভ্র এগিয়ে আসবে, মুছে দিবে তুলির চুল। তুলি ডুবে যাবে তখন আকণ্ঠ!
শুভ্র বেশ যত্নে তুলির চুল মুছে দিল। তারপর টাওয়াল বারান্দায় মেলে এসে দ্রুত নিজের গায়ে জ্যাকেট জড়াতে জড়াতে বললো,
‘দ্রুত চলো, নাহলে রাতে আর কারোরই খাবার জুটবে না কপালে, হোটেল বন্ধ হয়ে যাবে।’
তুলি এত তাড়া পেয়ে দৌড়ে দৌড়ে ভিজে চুলই আলগা করে খোঁপা করে মাথায় ওড়না তুলে নিলো। শুভ্র তুলিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম লক করে। বাহিরে বাকিরা অপেক্ষা করছিলো শুভ্রদের জন্যে। ওরা যেতেই তারা সবাই চলল রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে।
খাবার খেয়ে রুমে আসল দুজন তখন প্রায় ১১টা। খাবার খাওয়া অনেক আগেই শেষ হয়েছিল, তবে সবাই মিলে প্রায় এক ঘণ্টার মতো রাতের সাজেকের রাস্তায় হাঁটছিল, তাই এত দেরি হওয়া। সারাদিন জার্নি করে রাতে বিছানায় এসেই দুজন ক্লান্ত দেহে কয়েক মিনিটেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
_____________________
ভোর হয়নি এখনো। সূর্য উদিত হবে আর অল্পক্ষণের মধ্যেই। সাজেকের সকল সৌন্দর্যের মধ্যে প্রধান হচ্ছে, ভোরের সূর্যোদয় দেখা। সূর্য মেঘের উপরে ভেসে বেড়ায় অনেকটা তেমন মনে হয়। শুভ্র অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল। ৪টা বাজতেই অ্যালার্ম এর শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। বুকের উপর কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করে, ঘুমে ডুবে থাকা চোখ ঘুরিয়ে পাশে চায়। তুলি ডান হাত দিয়ে শুভ্রকে জড়িয়ে রেখেছে। ঘুমে কাহিল তুলি হয়তো বুঝেও নি, সে কী করছে। শুভ্র মৃদু হাসলো। হাতটা আলগোছে সরিয়ে দিয়ে বিছানায় রাখলো খুব যত্ন নিয়ে।
শোয়া থেকে উঠবে তখন চোখ গেল তুলির ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখের দিকে। ঘুমন্ত অবস্থায় তুলিকে খুব বেশি মায়াবি দেখায়, কথাটা সত্য। এইজে শুভ্র এখন চোখ ফেরাতে পারছে না, ওঠে ব্রাশ করতে যাবে: সেটাও করতে পারছে না। সেই কখন থেকে তুলির দিকে চেয়েই আছে। এইজন্যে বোধহয় বিয়ের আগে ছেলেমেয়ের একসঙ্গে থাকা নিষেধ। তখন এসব খুঁটিনাটি সোন্দর্য বিয়ের আগে একে অপরের নিকট প্রকাশ পেয়ে যায়, বিয়ের আর তখন আগ্রহ থাকে না।
তুলির এলোমেলো চুল কপালের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শুভ্রর কী হলো কে জানে। এগিয়ে আসলো সে। তুলির উপর শুয়ে ঝুঁকে এলো তুলির ঘুমন্ত মুখের দিকে। কপালের চুল চার আঙুলে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে মুখের দিকে চাইল তীব্র দৃষ্টিতে। তুলির নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছে শুভ্র।
আল্লাহ বোধহয় এজন্যে বিয়েকে হালাল করেছেন। দুজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ কিভাবে একটু একটু করে বিয়ের দোহাই দিয়ে কাছে আসছে, শুভ্র তুলি তারই নমুনা। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ চেয়ে থাকার পর কী মনে করে আচমকাই শুভ্র ঠোঁট বসালো তুলির কপালের ত্বকে। তুলির নিঃশ্বাসের শব্দ আরও নিবিড় হলো যেন। শুভ্র কপালে ঠোঁট বসিয়েই বিড়বিড় করলো,
-‘আলহামদুলিল্লাহ! আমার জীবনে তোমার আসার দরকার ছিলো, এভাবে নাহলে অন্যভাবে।’-
তুলির ঘুম পাতলা হচ্ছে দেখে শুভ্র নিজেকে ঠিক করে চট করে উঠে গেল বিছানা থেকে। শুভ্র বাথরুমে যেতেই চোখ খুলে তাকাল তুলি। চোখ তার টলমল করছে। শুভ্র তাকে ভালোবেসে স্পর্শ করেছে, উফ! তুলি আলগোছে বা হাত তুলে শুভ্রর স্পর্শ করা কপালের সেই অংশ ছুলো তুলি। মনেহচ্ছে, এখনো শুভ্রর ঠোঁট ছুয়ে আছে তুলির কপাল। কোথাও শুনেছিলো, যে পুরুষ তোমাকে মন থেকে চাইবে- তার ঠোঁটের স্পর্শ তোমার কপাল ছুবে সবার প্রথমে। তার চুমুতে তুমি শান্তি পাবে, আরাম বোধ করবে। এইজন্যেই বোধহয় শুভ্রর ছোয়া এখনও তুলির মনে গেঁথেই রইলো। তুলির শ্বাস বেড়ে যাচ্ছে। শুভ্র তাকে মেনে নিচ্ছে, একটু একটু করে দুজন এগিয়ে যাচ্ছে একটি সুখী সংসারের দিকে। ব্যাপারটা ভেবেই তুলি রোমাঞ্চকর অনুভব করছে।
শুভ্র বাথরুম থেকে বেরুতেই তুলি আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান করল। নাহলে দেখা যাবে লজ্জায় শুভ্র তুলির মুখোমুখিই আর হচ্ছে না। শুভ্র ব্রাশ করে এসেছে। সূর্য উঠবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। আকাশে লালচে আভা দেখা যাচ্ছে। শুভ্র আর দেরি করলো না। এগিয়ে এসে তুলির মাথার কাছে এসে দাঁড়াল। ডাক দিলো তুলিকে,
‘তুলি, তুলি। উঠবে একটু? একটা বেস্ট জিনিস দেখাবো তোমাকে। প্লিজ উঠো। তুলি? দেরি করলে কিম্তু মিস হয়ে যাবে। আফসোস করলেও লাভ হবে না তখন। শুনছো, তুলি।’
তুলি এত ডাক শুনে আড়মোড় ভাঙার ভান করে তাকাল শুভ্রর দিকে। কিছুক্ষণ শুভ্রর দিকে ঘুমঘুম চোখে চেয়ে রইলো, তারপর হালকা করে হাসল। সঙ্গেসঙ্গে শুভ্রর মনেহলো,, সে তার হার্টবিট মিস করেছে। ঘুমন্ত মুখে এমনিতেই আজ সকালে তুলির উপর ঘায়েল হয়েছে সে। আর এখন ঘুমঘুম মুখে মুচকি হাসি। উফ, মারাত্মক! শুভ্র ড্যাবড্যাব করে তুলির দিকে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ। তুলি হাসি থামিয়ে উঠে বসলে শুভ্রর হুশ ফেরে। সঙ্গেসঙ্গে কোমরে হাত রেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। তুলি চুল খোপা করতে করতে উঠে বসল। ঘুমঘুম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কী দেখাবেন, দ্রুত দেখান। আমি ঘুমাব।’
শুভ্র স্বাভাবিক হলো এবার। এগিয়ে এসে তুলির কাঁধ ধরে জোর করে তুলিকে উঠাল। বারান্দার দিকে তুলিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
‘নো ওয়ে। ঘুমকে এখন না বলো প্লিজ। আমরা একটা বেস্ট জিনিস দেখবো একসঙ্গে। কাম উইদ মি।’
তুলিকে বারান্দায় এনে থামাল শুভ্র। তুলি ঘুম চোখ মুছে সামনে তাকালো। পুরো সাজেকের আকাশ লালচে হয়ে আছে। দু কদম এগিয়ে এসে কাঠের বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়াল তুলি। সূর্য উঠছে একটি একটু করে। তুলি হা হয়ে চেয়ে আছে সামনে। শুভ্রও মৃদু হেসে তুলির পাশে গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়াল। সূর্য উদয় হচ্ছে যেন মেঘের উপর থেকে। সাদা মেঘ ভাসছে, তার উপর লাল টকটকে এক সূর্য। ভয়াবহ সুম্দর দৃশ্য। তুলি খুশিতে নেচে উঠল যেন,
‘ওয়াও! কি সুন্দর সূর্য।’
শুভ্র তুলির মতো সামনে চেয়ে আছে। শুভ্র মন্ত্রমগ্ধের মতো বললো,
‘ইয়াহ! সাজেকের অন্যতম সুন্দর দৃশ্যের মধ্যে এটা একটা।’
‘সত্যিই সুন্দর।’
সূর্য উঠে গেছে অনেকক্ষণ। তুলি শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে এখনো বারান্দার গ্রিল ঘেষে। দুজনেই চুপ। ভোরের শীতল বাতাস বইছে। তুলির গায়ের শাল সে বাতাসে মৃদুমন্দ উড়ছে। তুলি শালটা নিজের গায়ের সঙ্গে চেপে রাখলো। ওর হাত রেলিংয়ের উপর রাখা। শুভ্রও হাত উঠিয়ে তুলির পাশে রেলিংয়ে রাখলো। একটাসময় শুভ্র সূর্য থেকে মনোযোগ সরিয়ে মুগ্ধ তুলির দিকে একবার তাকাল। তারপর তাকাল তুলির হাতের দিকে। ঢোক গিলে শুভ্র। কী করবে, হাতটা কী ছুবে? ছুলে কী তুলি অস্বস্তি বোধ করবে? শুভ্র সাতপাচ চিন্তা করেও নিজেকে এটুকু দমাতে পারল না। হাত একটু একটু করে এগুলো তুলির হাতের দিকে। প্রথমে আঙুলে আঙুল ছুয়ে গেলো। তুলির ধ্যান ভাঙল। কিম্তু তাকাল না শুভ্রর দিকে। অপেক্ষা করলো যেনো আরো একটুখানি স্পর্শের। শুভ্রও সামনে তাকিয়ে একটু একটু করে পুরো হাতটাই নিজের হাতের মধ্যে পুড়ে নিলো।
হাতটা সম্পূর্ণ শুভ্রর দখলে চলে গেলো, তখন তুলি তাকাল শুভ্রর দিকে। শুভ্রও কেমন সম্মোহিত দৃষ্টিতে তাকাল। তুলি তাকিয়ে আছে দেখে শুভ্র তুলির সম্মতি নেই সেটা ভেবে সঙ্গেসঙ্গে হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলে- তুলি ছাড়ল না। বরং ধীরে ধীরে হাতের বাঁধন শক্ত করে শুভ্রর হাত চেপে ধরলো। দুজন দুজনের দিকে চেয়ে সামান্য হাসলো। তারপর আবার দুজন সামনে তাকাল আবার। একে অপরের হাতে হাত রেখে দুজন অনুভব করল তাদের জীবনের এক নতুন সূর্যোদয়!
#চলবে
শুভ্র সম্পর্কে দু লাইন বলে যান একটু, শুনি❤️