উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৫৫||

0
89

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৫||

১১৪।
এ আর টি গ্যালারির সামনে ভীড় জমিয়েছে নন্দনকানন কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা। নার্সারির ড্রয়িং ক্লাস হচ্ছে এ আর টি গ্যালারির সামনের ছোট বাগানে। স্কুলটি এ আর টি গ্যালারির পাশেই। প্রশান্তিময় একটা জায়গা। এ আর টি গ্যালারির পেছনে খোলা অরণ্য। বিভিন্ন গাছগাছালির ভীড়ে তৈরী হয়েছে বাচ্চাদের জন্য পার্ক। অশ্বত্থ গাছের সাথে ঝুলন্ত কাঠের দোলনা। একপাশে বাচ্চাদের খেলার সামগ্রী৷ অন্যপাশে সারি সারি নারকেল গাছ। শান বাঁধানো ঘাট। আর পুকুরে শাপলাপাতা ছড়িয়ে আছে। একটা দু’টো শাপলাও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এ আর টি গ্যালারির বাম পাশেই নন্দন কানন স্কুল। আর ডানপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা বাগান। বাগানে নানা পদের ফুলের মধ্যে বিরাট অংশ জুড়ে আছে, সূর্যমুখী আর অলকানন্দা ফুলের বাগান। একপাশে কাঠগোলাপ আর বেলীফুলের বাগান। বাগানের সামনের অংশটা খালি। সেখানেই ছাউনি দিয়ে বেঞ্চ বসানো। এই জায়গায় নন্দন কাননের ছোট ছোট বাচ্চাদের অংকন শেখানো হয়।

দপ্তরি ঘন্টা বাজাতেই স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো এ আর টি গ্যালারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেতরে প্রদর্শনী হচ্ছে। কাচের দেয়াল ধরে যতোটুকু প্রদর্শনী দেখা যায়, তা দেখার চেষ্টা করছে বাচ্চারা। ভেতরে উপস্থিত চারুকলা অনুষদের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী। আজ এ আর টি গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসবেন। ছয়মাসে একবার এই আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী হয়। আর মাসে একবার চড়া দামে ছবি বিক্রি হয়। বাকি দিনে সাধারণ মানুষের জন্য এই গ্যালারি খোলা থাকে। তারা এসে ঘুরে যায়। পছন্দ হলে আগে থেকেই ছবি বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। মাসের কাঙ্ক্ষিত সেই দিনটিতেই ছবিটা বিক্রি হয়।

গাড়ির হর্ণ শোনা গেলো। সাদা রঙের দামী গাড়ি এসে থামলো এ আর টি গ্যালারির সামনে। প্রহরীরা ব্যস্ত বাচ্চাদের সরানোর জন্য। মোটামুটি জটলা বেঁধে গেছে প্রবেশমুখে। গাড়ির দরজা খুলে দিলো ড্রাইভার। গাড়ির বাইরে নেমে এলো সাদা স্নিকার্স পরিহিত দু’টি পা। এ আর টি গ্যালারির প্রবেশপথ থেকে বাচ্চাদের সরালো স্কুলের ড্রয়িং শিক্ষিকা রেহেনা পারভিন। শিক্ষিকার রাগী দৃষ্টি দেখে বাচ্চারা দৌঁড়ে স্কুলের দিকে চলে গেলো। শুধু গেলো না একজন। তার দৃষ্টি আটকে আছে সাদা গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা স্নিকার্স জোড়ার দিকে। সে কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। গাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো একটি মেয়ে। বয়স ত্রিশ, অথচ বেশভূষায় মনে হবে তার বয়স একুশ কি বাইশ। পরণে সাদা টি-শার্ট আর জিন্স। গলায় ঝুলছে লাল উড়না। গাড়ি থেকে নেমেই সে চোখে পরলো ধূসর বর্ণের সানগ্লাস। মেয়েটি এগিয়ে আসতে লাগলো এ আর টি গ্যালারির দিকে। এদিকে রেহানা পারভীন দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাটির হাত ধরে টান দিয়ে বললেন,
“ওয়াসিফ, ক্লাসে চলো।”

তখনই মেয়েটি ওয়াসিফের সামনে এসে দাঁড়ালো। ওয়াসিফকে দেখে সানগ্লাস খুললো সে। হাত এগিয়ে দিলো ওয়াসিফের থুতনিতে। আলতো আদর দিয়ে বলল,
“বাবু, কেমন আছো?”

ওয়াসিফ এক গাল হাসলো। বলল,
“আন্টি এই শু’স আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি মাকে বলেছি এমন হোয়াইট হোয়াইট শু’স কিনে দিতে। মা তো আমাকে নিয়েই যায় না।”

মেয়েটি ওয়াসিফের সামনে হালকা ঝুঁকে বলল,
“তোমার মায়ের নম্বর দিও, আমি বলে দেবো কিউট বাবুকে হোয়াইট হোয়াইট শু’স কিনে দিতে।”

ওয়াসিফ মাথা নাড়লো। মেয়েটি ওয়াসিফের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি নাম কিউট বাবুটার?”

“মাই নেইম ইজ নাওফাত ওয়াসিফ আদ্য।”

“ওয়াও, কি সুন্দর নাম!”

“আমার নামটা খুব বড় তাই না?”

মেয়েটি গালে হাত দিয়ে অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল, “হ্যাঁ, তাই তো।”

“সবাই বলে আমার নাম অনে-ক বড়। আমার মতো বড় নাম কারো নেই।”

রেহানা পারভীনকে দেখিয়ে দিয়ে ওয়াসিফ বলল,
“মিসরাও বলে।”

মেয়েটি তা শুনে মুচকি হেসে বলল,
“তাই না-কি? আমার নামটাও তো অনে-ক বড়। তোমার মতো।”

“তাই? তোমার নাম কি?”

“আমার নাম ওয়াসিকা কবির আহি।”

“তোমার নামটাও তো অনেক সুন্দর। আচ্ছা, তোমার নামটাও কি তোমার মামা রেখেছে?”

ওয়াসিফের প্রশ্নে আহির মুখে বিষণ্নতা ছেয়ে গেলে। পরক্ষণেই সে মুচকি হেসে বলল,
“না, আমার নামটা আমার বাবা রেখেছে।”

“তোমার বাবা আছে?”

“হ্যাঁ আছে।”

“কোথায়?”

“ওই দূর আকাশে তারাদের ভীড়ে লুকিয়ে আছে।”

ওয়াসিফ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন তো তারা দেখা যাচ্ছে না। তুমি কি রাতেই তোমার বাবাকে দেখতে পাও?”

“না। রাতে-দিনে কখনো দেখতে পাই না। সে তো লুকিয়ে আছে। আর তারা তো দিনেও থাকে। কিন্তু সূর্য্যি মামার জন্য দেখা যায় না।”

“ওহ, আমার বাবা নেই। কিন্তু আমার মামা আছে। আমার মামা অনেক ভালো। হি ইজ দা বেস্ট।”

ওয়াসিফের আদুরে কথাবার্তা আহির বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু তার হাতে সময় কম। আজ তার আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী হচ্ছে। তার জন্য বসে আছে সবাই। আর কাল তার ছবি বিক্রি হবে। প্রতি মাসে সব কাজ ফেলে সে কক্সবাজার চলে আসে তার আর্ট গ্যালারিতে সময় দিতে। নিজের আঁকা ছবিগুলো সাথে নিয়ে আসে। বিক্রি হয় চড়া দামে। দেশে-বিদেশে আহির আঁকা ছবির বেশ সুনাম। ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ডও পেয়েছে সে গত বছর। তিন বছর আগেই সে কক্সবাজারে এই আর্ট গ্যালারিটি স্থাপন করেছিল। আর সে বছরই নন্দনকানন স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য মোটা অংকের টাকা দিয়েছে সে। যদিও এই স্কুলে আরো দু’জনের ভাগ আছে। স্কুলের চেয়ারম্যান আহির বড় মামা। আহি শুধু চেয়েছে স্কুলের ড্রয়িং ক্লাসটা যাতে তার বাগানে হয়। তার ধারণা বাচ্চারা বাগানে বসে ছবি আঁকলে, তাদের শিল্পীমন গভীর হবে।

কিছুক্ষণ পর এ আর টি গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এলো আহির এসিস্ট্যান্ট রুবি। সে আহির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“ম্যাম, আপনাকে ভেতরে আসতে হবে। সবাই অপেক্ষা করছে।”

এসিস্ট্যান্টটির কথা শুনে রেহানা পারভীন ওয়াসিফের হাত ধরে বলল,
“এবার ক্লাসে যাও, ওয়াসিফ। ম্যামকে যেতে হবে।”

আহি ইশারায় রেহানা পারভীনকে বলল ওয়াসিফের হাতটা ছেড়ে দিতে। রেহানা পারভীন হাত ছেড়ে দিতেই আহি বলল,
“বাবু, আমি যাই। পরে কথা হবে।”

ওয়াসিফ গ্যালারির প্রবেশমুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আন্টি, আন্টি।”

“হ্যাঁ, বলো।”

“আমাকে ভেতরে যেতে দেবে?”

রেহানা পারভীন গলা উঁচু করে বললেন,
“ওয়াসিফ, বললাম না বাচ্চারা ভেতরে যায় না।”

আহি তাকে ইশারায় আবার থামিয়ে দিয়ে ওয়াসিফের হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে নিয়ে যাবো, কিন্তু আমাকে প্রমিজ করতে হবে তুমি ভেতরে গিয়ে কোথাও হাত দেবে না।”

ওয়াসিফ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“হাত দিলে কি হবে?”

“হাত দিল ছবি নষ্ট হয়ে যাবে, অথবা নিচে পড়ে ভেঙে যাবে। তখন আন্টি খুব কষ্ট পাবো। তুমি কি আন্টিকে কষ্ট দেবে?”

“না, একদম না। আমি লক্ষী বাচ্চাদের মতো তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবো। আমাকে শুধু ভেতরে যেতে দিলেই হবে। আমার খুব ইচ্ছে ওখানে কি আছে দেখার। ওই যে টিভিতে ছবি দেখাচ্ছে, ওগুলো চুপচাপ বসে বসে দেখবো।”

আহি ওয়াসিফের চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে তার হাত ধরে ভেতরে চলে গেলো।

(***)

আহি চারুকলা অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললো। অংকন নিয়ে চললো গুরুত্বপূর্ণ আলাপ। কথাবার্তা শেষে আহি বেরিয়ে প্রদর্শনী রুমে এলো। দেখলো চেয়ারে বসে প্রজেক্টের পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে ওয়াসিফ। ওয়াসিফকে পাহারা দিচ্ছে রুবি। আহিকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো। আহি ওয়াসিফের পাশে বসে বলল,
“বাবু, তোমার স্কুল তো অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে। তোমাকে কেউ নিতে আসবে না?”

ওয়াসিফ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“মামা বলেছে, লম্বা কাঁটাটা সিক্সে এসে দাঁড়ালে আসবে।”

আহি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“আচ্ছা। এখনো তো লম্বা কাঁটাটা থ্রিতে বসে আছে। মামার আসতে তো অনেক সময় লাগবে। তুমি একা একা কি করবে?”

“আমি খেলবো পার্কে গিয়ে।”

“আচ্ছা। তোমার মামা এতো দেরী করে আসে?”

“না। কিন্তু আজ দেরীতে আসবে বললো। মামার অফিসে অনেক কাজ থাকে। আমাকে বাসায় দিয়ে আবার অফিসে চলে যায়।”

“আচ্ছা। চলো তোমাকে পার্কে দিয়ে আসি। তোমার সাথে কিছুক্ষণ খেলবো।”

আহি ওয়াসিফকে নিয়ে পেছনের পার্কে গেলো। দু’জনেই বেশ কিছুক্ষণ মজা করলো। হঠাৎ আহির ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো পুষ্পের নাম। আহি কল ধরতেই পুষ্প বলল,
“আহি, লাঞ্চ এখানে এসে করবি কিন্তু।”

আহি বলল, “আজকে আমার কাজ বেশি।”

“কোনো এক্সকিউজ দিবি না। ফাজিল মেয়ে একটা। লাবীব আমাকে বলে গেছে। আর তোকে এখানেই থাকতে হবে যতোদিন থাকবি।”

“মাত্র দু’দিন।”

“তো দু’দিন তুই ওই ভূতের বাড়িতে থাকবি?”

“পুষ্প!”

“তোর ওই বাংলো বাড়িটা ভূতের বাড়ির মতো দেখতে। রাতে একা কীভাবে থাকিস? লাবীবের অফিসে যাওয়ার পথেই তোর বাংলো বাড়িটা পরে। আমাকে তো প্রায়ই বলে এভাবে সুনসান রাস্তার উপর জঙ্গলের মাঝখানে কেউ বাড়ি করে? বসতিস্থল থেকে কতো দূর তোর বাংলো বাড়িটা।”

“আরেহ, রিল্যাক্স। গার্ডস আছে, মেইডরা আছে। আমি তো একা থাকি না। আর যখনই কক্সবাজার আসি, মা তো সাথেই আসেন। এবার বাড়িতে গেছে মা। নানার বার্ষিকী করছে। নানু খুব অসুস্থ। জানিস তো ডাক্তার বলেছে হাতে বেশিদিন সময় নেই। শেষ মুহূর্তগুলো বাড়িতে থাকতে চাচ্ছেন। মাও তাই ওখানেই থাকবে।”

“তার মানে তুই চট্টগ্রাম একা থাকবি?”

“হ্যাঁ। আপতত।”

“পাগল তুই? এখানেই থাক। আমাদের সাথে থাকবি। ব্যাগপত্র নিয়ে চলে আয় আমার বাসায়।”

“কি যে বলিস তোর শ্বশুড়-শাশুড়ি আছে। দেবর আছে। এভাবে থাকলে সুন্দর দেখাবে না।”

“লাবীবকে বলবো?”

“আরেহ না। এসব বাদ দে, তোর টুনি কেমন আছে রে?”

“পিয়ালী? খুব অসুস্থ রে আমার মেয়েটা। ঠান্ডা লেগেছে। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি ওর জন্য।”

“ডাক্তার দেখাস নি?”

“দেখালাম তো। সিজনাল প্রবলেম। ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা, বাসায় আয় তো। অনেক কথা হবে।”

“আচ্ছা, আসবো। কিন্তু আজকে পারবো না। কাল আসবো।”

“আজ কি সমস্যা?”

“আমার মিটিং আছে একটা। ওখানেই লাঞ্চ করবো। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়েই বেরুতে হবে।”

“বুঝলাম, খুব ব্যস্ত মানুষ তুই। কিন্তু নিজেকে একটু সময় দে। বিয়ে-টিয়েও করছিস না। কখন করবি বিয়ে? উজ্জ্বল ভাইয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে আসবে আগামী সপ্তাহে। চাচা-চাচী এবার ভাইয়াকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন। তোর জন্য অনেক অপেক্ষা করেছে বেচারা। তোকে বলার সাহস পায় নি। আমি সিউর এবারও পাবে না। চাচী তো আন্টিকে বলেছিল। আন্টি কোনো সাড়া দেয় নি দেখে তারাও চুপ হয়ে গেছে।”

আহি হেসে বলল,
“তোর ভাইয়া তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। আমার জন্য বসে থাকার কোনো দরকার ছিল?”

“বিয়ে যখন করতেই হবে করে ফেল না।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মায়ের হতাশ চেহারাটা ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে। এখন আর কোনো কিছুর অভাব নেই আহির। অনেক টাকার মালিক সে। দাদা ও বাবার সম্পত্তির পাশাপাশি নিজেও অনেক কিছু করেছে। বাংলাদেশের ধনী নারীদের তালিকায় এখন আহির নামও যুক্ত। যেই প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য কয়েক বছর আগেও তাকে কোনঠাসা হয়ে থাকতে হয়েছিল, আজ আহির হাতে সেই ক্ষমতা আছে। সে এখন রানী। তার রাজ্যের একমাত্র রানী আহি একাই। এতো কিছুর ভীড়ে যদি কোনো কমতি থাকে, তাহলে তা একজন ভালোবাসার মানুষের। গত পাঁচ বছরে অহরহ বিয়ের প্রস্তাব এসেছে আহির জন্য। সালমা ফাওজিয়া সেসব আহির সামনে রাখার সাহস পান নি। অনেক প্রস্তাব এতোটা যোগ্যতা সম্পন্ন ছিল যে সালমা ফাওজিয়া নাকচ কর‍তে চান নি। কিন্তু আহির জন্য বাধ্য হয়েছিলেন।

(***)

পুষ্পের সাথে কথা বলা শেষ হতেই আহি পেছন ফিরে দেখলো পার্কে বাচ্চাটি নেই। আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দারোয়ানের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“বাচ্চাটা কোথায় গেলো?”

দারোয়ান বলল,
“ম্যাম, এই মাত্র ওর মামা এসে নিয়ে গেছে।”

“ওহ আচ্ছা।”

আহি বেরিয়ে এলো পার্ক থেকে। সামনে হেঁটে তার গাড়ির কাছে আসতেই দেখলো ওয়াসিফ একটা মোটর সাইকেলের পেছনে বসা। মাথায় ছোট হেলমেট। ঝাঁকড়ে ধরে আছে সামনের মানুষটিকে। মুহূর্তেই আহির শিরদাঁড়া বেয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। হাত-পা অসার লাগছে যেন। বুকটাও কাঁপছে বেশ। পেছন দিক থেকে কি মানুষ চিনতে ভুল হয়? তাহলে কেন চেনা চেনা লাগছে এই মানুষটাকে? আহির ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে একবার মানুষটির চেহারা দেখতে। যদি সে হয়? না, সে হলে আহির কোনো অধিকার নেই সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। শেষবার তো খুব কড়া ভাবেই মানুষটা বলেছিল, তার সামনে না যেতে। তাহলে কেন যাবে আহি?

মোটর সাইকেলটি চলে গেলো। আহিও গাড়িতে উঠে গেলো। এখন আর অশ্রুসিক্ত হয় না চোখ জোড়া। বেশ শক্ত হয়েছে সে। কিন্তু অস্থিরতা এখনো কাটে নি। মানুষটা ভাবনায় এলেই তার হৃদ স্পন্দন বেড়ে যায়। এজন্যই বিয়ে করছে না সে। কাউকে ঠকানোর ইচ্ছে নেই তার। মনে একজনকে রেখে, অন্য একজনকে জীবনে এনে সে অন্যায় করতে চায় না। তার চেয়ে একাই ভালো আছে। সুখে আছে।

(***)

ওয়াসিফ তার মামার পিঠে হেলান দিয়ে বসে আছে। দশ মিনিট পর মোটর সাইকেলটি ঢুকলো একটি ছ’তলা ভবনে। নিচ তলায় গ্যারেজ। গ্যারেজে মোটর সাইকেল থামিয়ে ওয়াসিফকে নামালো সে। ওয়াসিফ মামার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“মামা, আমি আজকে অনেক অনেক ছবি দেখেছি। আমাকে ওই সুন্দর জায়গাটায় নিয়ে গিয়েছিল আন্টিটা। আন্টিটা একদম হোয়াইট হোয়াইট ছিল।”

ওয়াসিফের মামা তার হেলমেট খুলে দিতে দিতে বলল,
“এ নিয়ে দশ বার বলেছো এই একটা কথা।”

ওয়াসিফ আঙ্গুলে গুণতে লাগলো, আর বলল,
“দশ বার বলেছি?”

ওয়াসিফের মামা তাকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। চার তলায় ভাড়া থাকে তারা। চার তলার দরজার সামনে এসেই মামার কোলে বসে বেল বাজালো ওয়াসিফ। দরজা খুলে দিলো তার নানী। ওয়াসিফকে দেখেই তিনি বললেন,
“আমার নানু ভাই এসে গেছে।”

ওয়াসিফ কোল থেকে নেমে দৌঁড়ে ঢুকে গেলো বাসায়। ছুটে গেলো তার মায়ের কাছে। এসেই মাকে জড়িয়ে ধরলো সে। ওয়াসিফ মায়ের গালে চুমু খেতেই, তার মা এগিয়ে এসে ছেলের কপালে চুমু খেলো। তা দেখে ওয়াসিফের নানু, আফিফা বেগম আফসোসের সুরে তার ছেলেকে বললেন,
“আজ আমার রেনুর এই অবস্থা হয়েছে শুধু ওই ডাইনির জন্য। যতোবার রেনুকে দেখি ততোবারই মনে পড়ে ওই ডাইনি রাক্ষসীটা কিভাবে আমার সংসারটা এলোমেলো করে দিয়ে গেছে।”

পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেনুর ভাই। বলল,
“শুধু শুধু তার কথা কেন তুলছো, মা? সে তো আর আমাদের জীবনে নেই।”

“আফিফ! সে নেই। কিন্তু এখনো পিছু তো ছাড়ছে না। তালাক হওয়ার পরও তোকে ফোন দিচ্ছে। বিয়ে করে ফেল, বাবা। ওই ডাইনির আর সাহস হবে না ফোন দেওয়ার।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হতাশ দৃষ্টিতে রেনুর দিকে তাকালো। পাঁচ বছর আগের এক দুর্ঘটনায় রেনুর এই অবস্থা। গরম তেল ছিটকে পড়েছিল রেনুর শরীরে। জ্বলে গেছে শরীরের অনেকাংশ। গলা থেকে পেট পর্যন্ত চামড়া কুঁচকে গেছে তার। মুখেও ছিঁটেফোঁটা পড়েছিল। এখন প্রায়ই অসুস্থ থাকে রেনু। বাসার বাইরে যেতে চায় না। বোনের এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করছে সে। যদি পদ্মকে বিয়ে না করতো, তাহলে আজ তার বোনের এই পরিণতি হতো না।

পাঁচ বছর আগে, রেনু যখন জানতে পারলো তার জীবন ধ্বংসের মূলে আছে তার ভাবী পদ্ম। সে চুপ থাকে নি। সে প্রতিবাদ করেছে। সেদিন পদ্মের সাথে খুব বাগবিতণ্ডা হচ্ছিলো রেনুর। রাগের মাথায় পদ্ম চুলায় থাকা গরম তেলের কড়াইটি রেনুর দিকে ছুঁড়ে দিলো। আর সাথে সাথেই চামড়া গলে গেলো তার। পদ্ম কড়াই ছুঁড়ে দিয়েই দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। সে ভেবেছে, রেনু আর বাঁচবে না। ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা তার। রাজশাহী মেডিকেলে অনেক যুদ্ধের পর বেঁচে ফিরলো রেনু। জ্ঞান ফিরতেই তার এই অবস্থার জন্য দায়ী পদ্মকে দেখিয়ে দিলো। আফিফ মামলা করলো নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে। পুলিশ এসে পদ্মকে ধরে নিয়ে গেলো। আফিফ তালাকের সিদ্ধান্ত নিলো। পদ্ম কারাগারে থাকা অবস্থায় আফিফ আর তার তালাক হয়ে গিয়েছিল। পদ্ম ছাড়া পাওয়ার পর তার বাবা তাকে নিয়ে গেছেন গ্রামে। পড়াশুনা শেষ করে নি, তাই চাকরি পাচ্ছে না সে। বাবার সংসারেও বোঝা। তার কুকর্মের ব্যাপারে জেনে তার পরিবারের সবাই ক্ষিপ্ত। শেষমেশ সে গার্মেন্টসে কাজ নিয়েছে। প্রায়ই আফিফকে ফোন দেয়। এরই মধ্যে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে তার জন্য। পাত্র দুই সন্তানের বাবা। স্ত্রীর মৃত্যুতে সন্তান লালন-পালনের জন্য বিয়ে কর‍তে চাইছে। পাত্র কাঠের ব্যবসা করে। অবস্থা ওতো ভালো না। কিন্তু পদ্মের বাবা-মা মেয়েকে রাখতেই চাচ্ছেন না। পদ্ম তাই আফিফকে ফোন দিয়ে তাকে সাহায্য কর‍তে বলছে। এ নিয়ে ছয়টা নম্বর ব্লক করেছে আফিফ। এবার হয়তো সিমটা পরিবর্তন করতে হবে তার। নম্বরটা খোলা রাখার কারণ একটাই, একটা কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকে ফোন আসা। প্রতিবারই অপরিচিত নম্বর দেখলে তার মনে হয়, সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি কল করেছে। কিন্তু না। কল আসে না তার। তবে আফিফ প্রায়ই তাকে দেখে। দূর থেকে দেখে। বেশ নাম-ডাক তার। আফিফের যোগ্যতা নেই তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। দূর থেকে দেখেই চলে আসে। আগের চেয়ে বেশ সুন্দর হয়েছে সে। মলিন ভাবটা আর নেই। শুধু এখনো বিয়ে করে নি। কেন বিয়ে করে নি জানে না আফিফ। কিন্তু সে চায়, মেয়েটা সুখী হোক। নতুন সংসার হোক তার। জীবনে যেই কষ্ট পেয়েছে সে কষ্টটা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য যাতে কেউ আসে তার জীবনে।

রুমে এসে গা এলিয়ে দিলো আফিফ। আজ আর অফিসের কাজ নেই। হালকা ঘুমিয়ে নেবে সে। উঠেই আবার বেরুতে হবে বাজারের জন্য। আফিফ বিছানায় শুয়ে চলন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো, আজকে বেশ সুন্দর লাগছিলো তাকে। প্রতি মাসে সে কাঙ্ক্ষিত এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে। কবে আহি কক্সবাজারে এসে এ আর টি গ্যালারিতে আসবে। আর সে দূর থেকে আহিকে দেখবে।

সময়টা ঘুরে গেছে। পনেরো বছর আগে আহি যেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল, আজ আফিফ সেখানে এসে দাঁড়ানো। পার্থক্য শুধু এতোটুকুই, আহি সেই সময় ধরে নিয়েছে আফিফ তার হবেই। কিন্তু এখন আফিফ জানে, আহি তার কখনোই হবে না। কারণ তার সেই যোগ্যতা নেই।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here