#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৭||
১১৯।
ডায়েরীর প্রতিটি পাতায় স্কেচ। কোথাও খোলা মাঠে বসে একটা ছেলে ছবি আঁকছে, আর তার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে বোতল থেকে পানি খাচ্ছে, পাশে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মেয়েটির দৃষ্টি ছেলেটির দিকে। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। কোথাও বা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা একটি ছেলে, অন্যদিকে সেই ছেলের দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটি মেয়ে।
আহি চারুশিল্পে এমন একটা বৃহস্পতিবার, শুক্রবার যায় নি, যেদিন আফিফকে ডায়েরীতে ধারণ করে নি। তারিখসহ লেখা৷ প্রতিদিন আফিফের পিছু নেওয়া। সপ্তাহের বাকি দিনেও টুকিটাকি আফিফকে নিয়েই লেখায় পুরো ডায়েরীর অর্ধেক পাতা ভর্তি। আফিফের চোখে পড়ছে ছোট ছোট বাক্য। কোথাও লেখা,
“এআর, এই ভালোবাসার নাম কি দেওয়া যায়?”
কোথাও লেখা,
“ভালোবাসি, প্রিয় এআর। ইচ্ছে করছে তোমাকে বসিয়ে রাখি আমার সামনে।”
কোথাও বা লেখা,
“কি সুন্দর করে আকাশ দেখো তুমি! আমাকেও একটু দেখো ওভাবে।”
প্রতিটি বাক্য পড়েই আফিফের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস। অদ্ভুত ভাবে অশ্রুও ভীড় করছে চোখের কোণে। শার্টের হাতায় মুছছে সে। বেয়ে পড়ার সুযোগ দিচ্ছে না।
ডায়েরীর অনেক পাতা পড়ার পর আফিফ হঠাৎ থমকে গেলো একটি পৃষ্ঠায় এসে। আহি বিভিন্ন মাধ্যমে আফিফের ছবি এঁকেছে ক্যানভাসে। আর সেই ছবিগুলো বের করে ডায়েরীতে আঠা দিয়ে লাগিয়েছে। কিছু কিছু ছবি চারুশিল্পে পড়া অবস্থায় এঁকেছে। আর কিছু কিছু ছবি এঁকেছে পদ্ম আর আফিফের বিয়ের পর। ছবিগুলোর মধ্যে এক্রাইলিক পদ্ধতিতে আফিফের ছবি আঁকার একটি মুহূর্ত এঁকেছে। জলরঙ দিয়ে দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার একটি মুহূর্ত এঁকেছে। সবচেয়ে চমৎকার একটা ছবি ছিল অস্বচ্ছ জলরঙের মিশ্রণে আফিফের মোটর সাইকেলের উপর বসে থাকা। কক্সবাজারে আফিফের সমুদ্র দেখার একটা তৈলচিত্রও এঁকেছে আহি। প্যাস্টেল রঙের ধারণ করেছে মাস্টার্সের ক্লাসে একা একা বসে থাকা। কাঠের উপর আফিফের খোঁদাই করা ছবি, ফটোরিয়্যালিজমেও আফিফকে আঁকা বাদ যায় নি তার। এসব দেখে আফিফের বুক ভারী হয়ে এলো।
কয়েক পৃষ্ঠা পর আফিফের চোখ আটকে গেলো আহির একটি লেখায়। আহি লিখেছে,
“আজ থেকে আমার প্রিয় রঙ হয়ে গেলো সাদা। এতোদিন ধূসর বেগুনি ছিল আমার পছন্দের রঙ। কিন্তু এখন আমি শুধু সাদা জামায় পছন্দ করি। প্রতি সপ্তাহে সাদা জামা পরেই চারুশিল্পে যাচ্ছি, অন্তত এআরের দৃষ্টি আকর্ষণের লোভে। কিন্তু সে তো আমাকে দেখেই না। ইশ, রং যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে তাকে গিয়ে বলতো, দেখো আফিফ। মেয়েটা তোমার জন্য বেরঙিন হয়েছে। তুমি কি তার জীবনটা রাঙিয়ে দিতে আসবে না?”
আফিফ এতোটুকু মলিন হাসলো। চোখ মুছে মনে মনে বলল,
“সরি, তোমাকে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য আমি তোমার পাশে ছিলাম না। নিজেকে এতোদিন তোমার অযোগ্য মনে হয়েছিল। এখন তো মনে হচ্ছে তোমার মুখোমুখি দাঁড়ানোরও কোনো যোগ্যতা নেই আমার।”
আফিফ পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখলো ডায়েরীতে কয়েকটা অলকানন্দা ফুলের পাপড়ি আঠা দিয়ে লাগানো। তার মাঝখানে লেখা,
“এআর, সেদিন দেখলাম তুমি অলকানন্দা ফুলের চারা কিনছো। আমি আগে কখনো এই ফুল সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। সেদিন চিনেছি। এটাও জানলাম, অলকানন্দা তোমার প্রিয় ফুল। জানো, এখন আমার বাগানে এতো এতো অলকানন্দা গাছ। আমি তোমার মাঝে এতোটাই ডুবে গেছি যে তোমার প্রিয় ফুল স্পর্শ করেই আমার সকাল শুরু হয়। আমার খুব ইচ্ছে তোমার ফুল হওয়ার। তোমার অলকানন্দা হওয়ার। অন্তত আমাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিলেই হবে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো আফিফ। পরের পৃষ্ঠায় যেতেই আফিফ খুব বড়সড় ধাক্কা খেলো। এমন কিছু সে কখনো কল্পনা করে নি। সেখানে লেখা ছিল,
“তোমাকে তো স্পর্শ করা যায় না। আমার কল্পনায় তুমি যাওয়া আসা করো। আর এভাবে দ্বিমাত্রিক ছবি এঁকে আমি তোমাকে অনুভব করতে পারছি না। মনে হচ্ছে তুমি অনেক দূরে। আমার এবার একটু সম্রাট শাহজাহান হতে ইচ্ছে করলো। সম্রাট যেমন তার প্রেমের সাক্ষী রূপে তাজমহল বানিয়েছে। আমিও একই করে ফেলেছি। কি করেছি জানো? হুম, তোমার ভাস্কর্য বানিয়েছি। একদম তোমার প্রতিরূপ। সাদা শার্ট সেই ভাস্কর্যের গায়ে। একটা অলকানন্দা ফুল গুঁজে দিয়েছি খাঁজ রাখা পকেটে। তোমাকে স্পর্শ করার এটাই একমাত্র সুযোগ। এআর, এখন তুমি শুধু আমার। তোমাকে স্পর্শ করার অধিকার শুধুই আমার।”
আফিফ ডায়েরীটা বন্ধ করে ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত তিনটা। ইচ্ছে করছে আহির নম্বরে একবার ডায়াল করতে। এখনো কি এভাবেই আহি তাকে ভালোবাসে? তার কি আহির সাথে একবার কথা বলা উচিত?
(***)
এক্সিভিশনের আগে জায়গা খুঁজে আফিফের জন্য নিজেকে সাজিয়ে ছবি তোলার ঘটনাগুলোও ডায়েরীতে লিখেছে আহি। কিন্তু এরপর অনেকদিন আহি ডায়েরীরে হাত দেয় নি। পরের বার লিখেছে। আফিফের কার্ড রিজেকশনের ঘটনা। লেখাগুলো পড়তেই আফিফের গলা কাঁপছে। আহি লিখেছে,
“এভাবে না করে দিলে আমাকে? জানো, খুব কেঁদেছি আমি। আচ্ছা, আমি দেখতে কেমন ওটাও কি জানতে ইচ্ছে করে নি। খুব রাগ হচ্ছে আমার। তোমার ভাস্কর্যটা জড়িয়ে ধরে কতো বার করে বললাম, আমার ভালোবাসা মেনে নাও। আমি তোমাকে খুব সুখে রাখবো। কিন্তু তুমি তো শুনলেই না। মুভিতে দেখায় না, নায়িকা কিছু ভাবছে, নায়ক অনুভব করছে। আচ্ছা, বাস্তবেও এমন হয় না কেন? একটু কি বুঝবে না আমার অনুভূতি। গলায় কথা আটকে যাচ্ছে আমার। কলম চলছে না। কিন্তু এসব তো তুমি সামনে থাকলেই বুঝতে। চার দেয়ালের ফাঁকে আমার আর্তনাদ কেউ শুনছে না। কতোবার কলম হাত থেকে রেখে দিচ্ছি। লিখতে গেলেই কান্না পাই। কথা বললেই গলা কাঁপে। মা বুঝেছে আমি কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু জিজ্ঞেস করবে না। মা-বাবাও হ্যাপি না। আমিও হ্যাপি না। আমি মায়ের মতো কষ্ট পেতে চাই না। আমি তোমার ভালোবাসা চাই। আমাকে একটু ভালোবাসো, প্লিজ। কি করবো আমি?”
এতোটুকুতেই লিখেছে আহি। আফিফ বুঝতে পারলো এতোটুকু অসমাপ্ত লেখা। আহি আরো কিছু লিখতো। কিন্তু পারে নি। হয়তো সেদিন বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছে। হয়তো ভাস্কর্যটির সামনে সারারাত দাঁড়িয়ে অনুরোধ করে বলেছে, আমার ভালোবাসা মেনে নাও। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে আফিফের। পরের পৃষ্ঠায় কি থাকবে আফিফ জানতে চাচ্ছে না। এতোটুকু পড়ে তার কষ্ট হচ্ছে, বাকীগুলো কীভাবে পড়বে?
তারপরের বিশ পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল আহির আফিফকে একা একা অনুভব করার ঘটনা। আফিফের রিজেকশনের পর আড়াই বছর আহি আফিফের পিছু করেছে। কখনো আফিফের ক্যাম্পাস, কখনো ফেইসবুকের ছবিগুলো ছাপিয়ে বের করা বা স্কেচ করা, কখনো আফিফের টাইমলাইনে লেখা ছোট ছোট স্ট্যাটাসের দেয়ালিকা তৈরী করার ঘটনা। বিশ পৃষ্ঠার পরের পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, সেই ভয়ংকর রাতের মুহূর্তটি। উপরে খুব সুন্দর করে আহি লিখেছে,
“আমার এআরের বিয়ে তার পদ্মফুলের সাথে।”
আফিফ আর পড়তে পারবে না। এতোটুকু বর্ণনায় যদি তার বুক কাঁপিয়ে দেয়, তাহলে পরের গুলোতে কি হবে। ডায়েরী রেখে দিলো আফিফ। মেঝেতে শুয়ে পড়লো সে। নীরবে কাঁদলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো তার। অপরিচিত নম্বর। ঘড়ির দিকে তাকালো আফিফ। ফজরের আযান দেবে একটু পর। আফিফ কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো পদ্মের কণ্ঠ।
চলবে-
(আরেকটা আগামীকাল দেবো। আমার বিড়াল অসুস্থ। তাই টেনশনে লিখতে পারতেছি না।)