উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৫৮ (১ম ভাগ)||

0
82

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৮ (১ম ভাগ)||

১২০।
পদ্মের কন্ঠ শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আফিফের। এমনিতেই আহির ডায়েরীটা পড়ে মন ভালো নেই, তার উপর আহিকে হারিয়ে ফেলার মূল কারণ পদ্ম এখনো তার পিছু ছাড়ছে না। এই মুহূর্তে পদ্মকে তার উপদ্রব মনে হচ্ছে। পদ্ম ওপাশ থেকে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
“আফিফ, মা আমাকে আজ ভীষণ মেরেছে। আমাকে একটু বাঁচান। জানি, আমি আপনার অপরাধী। কিন্তু এতোটাও তো খারাপ নই যে আমাকে বিপদে বাঁচাতে আসবেন না।”

আফিফ গম্ভীর সুরে বলল,
“তুমি যদি তাজওয়ারের মতো নরপশুর মার খেয়ে আমাকে ফোন করতে তাহলে ভেবে দেখতাম। কিন্তু তুমি এখন তোমার অভিভাবকের হাতে। ওরা তোমার ভালো তোমার চেয়ে বেশি বুঝবে। মার খেয়েছো, বুঝেও না ভালোর জন্য খেয়েছো।”

কথাটা বলেই আফিফ কল কেটে দিলো। ওপাশে পদ্ম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার অপরাধে শাস্তি সে পাচ্ছে। আফিফকে হারিয়ে ফেলায় তার শাস্তি। কিন্তু কখনো যদি আফিফ সংসারী হয়ে যায়? তখন তো চাইলেও আফিফকে পাওয়া সম্ভব না৷ এখন যেহেতু তালাক হয়ে গেছে, আফিফকে দ্বিতীয় বার পাওয়ার সুযোগ অন্য কাউকে বিয়ে করে তার কাছ থেকে তালাক নেওয়া। পদ্ম মনে মনে ভাবছে,
“বাবা যে প্রস্তাবটা এনেছে আমি কি তাহলে সেই লোকটাকে বিয়ে করে নেবো? তারপর না হয়, তাকে ছেড়ে দিলাম। এরপর আফিফের সাথে আবার বিয়ে হবে।”

এমন ভাবনা আসতেই পদ্মের মন ভালো হয়ে গেলো। পদ্ম ভুলেই গেলো আবেগের তাড়নায় অবাস্তব চিন্তা করছে সে।

(***)

“ভাবতেই পারি নি সেদিন আমার জীবনের এতোটা ভয়ংকর অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে হবে। বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গেছে অনেক দিন। আমি একা থাকি। বাবা দেরী করে বাসায় আসে। আমার জীবনে কোনো সার ছিলো। কোনো আনন্দ ছিল না। লিনাশা ছিল হাসির কারণ। সেও নেই এখন। কেউ নেই। সবাই চলে গেছে আমাকে ফেলে। এই মুহূর্তে আমার শরীরে জ্বর প্রায় ১০২ ডিগ্রী। আমি ডায়েরী লিখছি এমন অবস্থায়৷ গত কয়েক সপ্তাহে আমার জীবনে অদ্ভুত ঝড় চলে গেছে। আর এতো ঝড়-ঝাপটার কাছে ১০২ ডিগ্রী জ্বর খুবই হাস্যকর। বাবা-মায়ের আলাদা হয়ে যাওয়াটা আমার ভাবনার মধ্যে ছিল। বরং তাদের বিচ্ছেদ না হওয়াটাই আমাকে ভাবাতো। ভাবতাম মা কিভাবে এতো কম্প্রোমাইজ করছে? কিভাবে সহ্য করছে? এখন তো বুঝতে পারছি, বাধ্য হয়েই করেছে। যেমন আমাকে কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে, সত্যটা বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে। বর্ষার রাত। পদ্মের বিয়েতে আমি একাই গিয়েছি। দেখলাম পদ্মকে নিতে তার বর এসেছে। পদ্মের দিকে হাত এগিয়ে দিলো মানুষটা। আমি থমকে গেলাম তাকে দেখে। আমার ভালোবাসার মানুষ, পদ্মের বর। আক্দ আরো অনেক মাস আগেই হয়ে গিয়েছিল। এখন তো পদ্মকে নিয়ে যাবে। সরি, পদ্ম না। পদ্মফুল। এখন তো পদ্ম আমার কাছে পদ্মফুল। যেই সম্বোধন তার, সেই সম্বোধন আমারও হওয়া উচিত। তার ভালো লাগার সবকিছুকেই নিজের ভালো লাগা ভেবে নিয়েছিলাম। পদ্মকে যদি ফুলের মতো না দেখি, তাহলে হিংসে হবে। ঘৃণা জন্মাবে। কেন শুধু শুধু তার প্রিয় মানুষকে নিজের অপ্রিয় করবো? তার প্রিয় রং, তার প্রিয় ফুল, তার প্রিয় সবটাই যেহেতু আমার প্রিয়, তবে তার প্রিয় মানুষটা কেন আমার প্রিয় হবে না? সেদিন বর্ষার রাতে আমি তার আর পদ্মফুলের বিয়েতে গেলাম। যেই কন্ঠ শুনে আমার ফ্রেমে তুলে রাখতে ইচ্ছে হতো, সেই কন্ঠে শুনলাম, পদ্মফুল। যার স্পর্শ পাওয়ার লোভে ভাস্কর্য বানিয়েছিলাম, সেই মানুষটা ধরলো অন্য কারো হাত। তাদের বিয়ের খাবার গলা দিয়ে নামছিলো না। জোর করে খেয়েছি। কেঁদেছিও ভীষণ। পদ্মের বড় আপুকে বললাম, আমার ঝাল লেগেছে। আসলেই তো। ভীষণ ঝাল লেগেছে। আমার ভালোবাসা যাকে আমি মিষ্টি অনুভূতি ভাবতাম, সে আমাকে মরিচ লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছে। হা হা হা। হাসি পাচ্ছে খুব। হাসিটা শুনলে ভয়ংকর লাগবে। পাগলের হাসি। বিশ্রী হাসি। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি একটু আগে। মোটেও কম সুন্দরী নয় আমি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাকে দেখলে মনে হবে মানসিক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসা পাগল। আচ্ছা, তারপর বলি। কিভাবে যেন সেদিন আফিফ জেনে গেলো আমি সেই মেয়েটা। আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম, ওতো কিছু মনে পড়ছে না। হয়তো পদ্ম আমার পরিচয় দিয়েছিল। আমি তো এতোকিছু খেয়াল করি নি। আমার শুধু মনে আছে, তার হাসি হাসি চেহারায় আমার নাম শুনে গ্রহণ লেগেছিল। সে ভেবেছিল, আমি তার পদ্মফুলকে বলে দেবো, আমার ভালোবাসার কথা। তার সংসার ভেঙে দেবো। আমি তাকে সত্যটা সামনা-সামনি জানিয়েছিলাম। যা বুঝলাম, সে আমাকে চায় না। আমি তার জীবনে এক্সিস্টও করি না। চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো নিজের গালে। চলে এলাম বৃষ্টির মধ্যে। ভিজতে ভিজতে দামী লেহেঙ্গা কাঁদায় মাখামাখি। লেহেঙ্গাটা আমি ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি। ব্যাড লাক সিম্বল রেখে কি লাভ। কাউকে দেবো না। কারণ আমি চাই না, আমার শত্রুও এমন ব্যাড লাকের মুখোমুখি হোক। বিভীষিকাময় রাত ছিল সেদিন। এরপর যখন জ্ঞান ফিরলো। একের পর এক ধাক্কা। জানলাম ব্রেইন স্ট্রোক করেছি। এরপর বাবা বিয়ে করলো লিনাশার বড় আপুকে। লিনাশার বাবা মারা গেলো। আমাদের বন্ধুত্বও ভাঙলো। সব হারালাম। আর এখন আমি বড়লোক ভিখারিনী। যার সব আছে, অথচ কিছুই নেই। কেউ আমাকে ঠকায় নি। আমার ভাগ্য আমাকে ঠকিয়েছে। তাহলে আমি কাকে অপরাধী বলবো? তবে আমার জীবনের এক অংশের জন্য আমি একজনকে অপরাধী ভাবতে পারি। লাবণি মেহেরা। সারাজীবন ঘৃণা করতে থাকবো তাকে৷ অন্য অংশের জন্য কাকে দায়ী করবো? আফিফকে হারিয়ে ফেলার জন্য কাকে দায়ী করবো?”

এতোটুকু পড়েই আফিফ নিজের আলমারিতে যত্নের সাথে ডায়েরীটা রেখে দিলো। এরপর ওজু করে নিলো। নামাজে দাঁড়ালো। সেজদায় কাঁদলো অনেকক্ষণ। মোনাজাত ধরলো। চাইলো, যেটা সঠিক, যেটা সবার জন্য ভালো, সেটাই যাতে হয়। দিনশেষে আহি যাতে সুখী হয়। আর সেই সুখ আহি যার মাঝে খুঁজে পায়, তাকেই যাতে আহি জীবনসঙ্গী করে নেয়।

১২১।

ভোর ৬টা। আহি সবে মাত্র একটা ছবি এঁকে শেষ করলো। ছবি আঁকা শেষ করেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ছবিটির দিকে। ভাবতে লাগলো কি নামকরণ করা যায় ছবিটির। অদ্ভুত এক ছবি। প্রথম দেখায় মনে হবে শুধু রং ছড়িয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে খুঁজে পাওয়া যাবে একটা স্যাঁতসেঁতে ডোবায় একটি মেয়ে চিত হয়ে ভাসছে। তার চুলগুলোও ভাসছে। চুলের ফাঁকে ফাঁকে সাদা রঙের ফুল। আহি কালো কালি দিয়ে পাশে নিজের স্বাক্ষর করলো। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো কাচের আলমারির তাকে। খটকা লাগলো তার। তড়িৎ গতিতে আলমারি খুলে আশেপাশে ঘাঁটতে লাগলো। বিড়বিড় করে বলল,
“ডায়েরীটা তো এখানেই রেখেছি।”

আহির স্পষ্ট মনে আছে, কাল ওয়াসিফের কাছ থেকে নিয়ে ডায়েরীটা সে এখানেই রেখেছিল। আহি এবার পাশ ফিরে খেয়াল করলো তার ড্রেসিংয়ের টুলটা বাঁকানো। কাল আর আজ একবারো সে এই টুলে বসে নি। তাহলে কি ওয়াসিফ নিজের সাথে তার ডায়েরীটাও নিয়ে গেছে? এমন সাংঘাতিক কাজ করবে ছেলেটা? আহি বিশ্বাস করতে পারছে না। সে পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো তার ডায়েরী। রুমের বাইরে এসেও খুঁজলো। আহির নিজের নিরাপত্তার পুরো ঘরে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিলো। সাথে নিজের রুমেও লাগিয়েছিল। আহি ল্যাপটপ চালু করে গতদিনের ফুটেজ দেখলো। সত্যিই গতকাল আহি রুম থেকে বেরুতেই ড্রেসিংয়ের সেই টুল টেনে কাচের আলমারি খুলে সেই ডায়েরীটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেছিল ওয়াসিফ। আহি ল্যাপটপ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অবশ্য এখানে বাচ্চাটারও দোষ নেই। হয়তো আহির ডায়েরী খুলে স্কেচগুলো দেখে তার আগ্রহ জন্মেছিল, তাই নিয়ে গেছে। আহির অস্থির লাগছে। এই ডায়েরীটা দেখেই সে অনুভব করে আফিফ তার আশেপাশে আছে। আহি দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। সাড়ে ছয়টা বাজছে। এতো সকাল সকাল কাউকে ফোন দেওয়াটা অভদ্রতা। আহি অপেক্ষা করলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। সময়টা যাচ্ছেই না। ঘড়িতে সকাল সাতটা মাত্র। এই মুহূর্তে কান্না পাচ্ছে তার। ওয়াসিফের মায়ের নম্বর ফোনের ডায়াল লিস্টে আছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুণি ফোন করতে। কিন্তু আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায়ছে সে।

(***)

আহির ডায়েরীর অনেকাংশ জুড়ে লেখা আফিফের ভাস্কর্য আর আহির নিরব কথোপকথন। আহি প্রায়ই ভাস্কর্যটির সামনে বসে ডায়েরী লিখতো। এটাই শেষ সম্বল ছিল তার। কিন্তু একদিন সেটাও ভেঙে ফেললো আহির বাবা। পাগল প্রায় আহি ডায়েরীর পাতা উলটে আফিফকে বের করে আনতে চাচ্ছিলো। কিন্তু সে নিরুপায়। ভাস্কর্যের ভাঙা অংশগুলো হাতড়ে হাতড়ে কেঁদেছিল বেশ কয়েক ঘন্টা। লিনাশা এসে শান্ত করেছিল তাকে বলেছিল, সে না-কি বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। আফিফ এখন আর তার নয়। আহি সেদিনই চোখ মুছলো। দৃঢ় সংকল্প করল, কাঁদবে তবে নিরবে। মানুষ যেহেতু তার ভালোবাসা, তার পাগলামো, এতোদিনের অপেক্ষাকে বেহায়াপনা বলছে, তাহলে কি দরকার তাদের এসব দেখানোর। আহি কাঁদলো না। বেশ মানসিক চাপ পড়লো। ফলাফলস্বরূপ আহির হ্যালুসিনেশন। ইউকে গিয়েও প্রায়ই আফিফের সাথে কথাবার্তা বলা। তাকে অনুভব করা। একা একা হাসা। সবটাই ডায়েরীতে লিখেছে। আফিফ শক্ত হয়ে বসে শুধু পড়েছে।

(***)

আহির দৃষ্টি ঘড়ির দিকে। ভদ্রতার মানদণ্ডে অপরিচিত কাউকে ফোন করার সময় সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা হওয়া উচিত। কিন্তু আহির জন্য দুই ঘন্টা অপেক্ষা করেই অনেক কষ্টকর ছিল। ঘড়িতে আটটা ছুঁইছুঁই হতেই সে ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করলো নাওফা রেনুকার নম্বরে। প্রথম বার কল করলো, দ্বিতীয় বার করলো, তৃতীয় বার করলো, কিন্তু রিসিভ হলো না। পাগল পাগল লাগছে আহির। এবার তো সহ্যই হচ্ছে না। হাত কাঁপছে তার৷ ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। সালমা ফাওজিয়া আহিকে সকাল সকাল বের হতে দেখে বললেন,
“কোথায় যাচ্ছো আহি?”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আমার ডায়েরী! আমি তোমাকে এসে বলছি, মা।”

আহি বেরুতে বেরুতে আবার কল করলো সেই নম্বরে। এবার কলটা রিসিভ হলো। আহি কথা বলতে বলতেই গাড়িতে উঠলো।

(***)

“প্রিয়, বৃষ্টিস্নাত ফুল দেখেছো কখনো? ভীষণ স্নিগ্ধ লাগে দেখতে, তাই না? আজ না হয় আমার দিকেই তাকিয়ে দেখো। তোমার জন্য হলুদ শাড়ি পরে অলকানন্দা সেজে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার মোড়ে। বৃষ্টিতে ভেজা আমাকে দেখে তোমার নিশ্চয় অলকানন্দার কথায় মনে পড়বে। আর তুমি নিশ্চিত আমার প্রেমে পড়বে। যেদিন তুমি আমার প্রেমে পড়বে, সেদিন থেকে আমিই হবো তোমার অলকানন্দা। আর এরপর যখন বৃষ্টি নামবে তুমি আমার হাত ধরে বৃষ্টি বিলাস করবে। করবে না বলো?”

আফিফ ডায়েরী বন্ধ করে ফোনটা হাতে নিলো। বসকে কল দিয়ে জানালো, আজ তার শরীর খারাপ আসতে পারবে না। অফিসে যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা নেই তার। আফিফা বেগম নাস্তা খাওয়ার জন্য দরজায় ঠোকা দিচ্ছেন। আফিফ এক বাক্যেই বলল,
“মা, এখন খেতে পারবো না।”

আফিফ ডায়েরী খুললো ইউকে থেকে ফিরে আহির চার বছর পর আফিফকে দেখা, বার-বার আফিফের মুখোমুখিতে আহির মানসিক অবনতি, মানসিক অস্থিরতা কাটানোর জন্য নায়ীবকে দেখানো, এরপর কক্সবাজারের পরিকল্পনা, আর আফিফ আর পদ্মকে একসাথে দেখে আরো বেশি আঘাত পাওয়া আর তাদের নিয়ে মধুচন্দ্রিমার আয়োজন করাটাও ডায়েরীতে লিখেছে আহি।

“এআর, তুমি হয়তো কখনোই আমার কল্পনায় আসবে না। তারা হয়ে গেলে যে। আজ থেকে আবার আমার অনুভূতিগুলো এই ডায়েরীতে স্থান পাবে। শোনো এআর, তোমার জায়গাটা আমি কাউকে দিতে পারবো না। হয়তো এজন্য আমার তোমাকে নিয়ে দেখা অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে যাবে। কিন্তু আমি তো আহি। স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করবো না, তা তো হয় না। তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো পূরণ হবে, এআর। আমি সেই স্বপ্ন পূরণ করবো আজই। একটা স্বপ্ন ছিল আমার। সাগর পাড়ে তোমার সাথে সমুদ্র বিলাস করবো। এক রাতের জন্য একটা ছোট্ট সাজানো ঘর বাঁধবো সমুদ্র পাড়ে। আজ এই স্বপ্ন পূরণ হবে। আমার কল্পনায় দেখা তুমিটা এবার বাস্তবে হাসবে। তোমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে তুমি সমুদ্র দেখবে। শুনবে সাগরের আর্তনাদ। তোমার চোখে আটকে থাকবে তোমার ভালোবাসার মানুষটির মিষ্টি হাসি। তোমার বুকে ঝাপটে পড়বে সে। সেই মানুষটা আসবে আজ। তোমার মনের মানুষ আজ তোমার মনের মতো করে সাজবে।”

এরপর চারটা পৃষ্ঠায় শুধু কলমের দাগ পড়েছে। চারটা পৃষ্ঠার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা,
“আমার গায়ের গন্ধ লেগেছে বলে ফেলে দেবে তোমার টি-শার্টটা? আমি তো পরতে চাই নি। পদ্ম দিয়েছিল, তাই পরেছি। জানি কোনো অধিকার নেই। কিন্তু যতোক্ষণ তোমার টি-শার্ট গায়ে ছিল, মনে হয়েছিল তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছো। তোমার আর পদ্মের সংসার দেখেছি আজ। ভীষণ সুন্দর সংসার। আমি এই সংসারে নজর দেবো না। চিন্তা করো না।”

দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখা,
“তোমার স্পর্শ পাওয়ার অনুভূতিটা আমাকে আজীবনের জন্য তোমার করে দিয়েছে, আফিফ। কাপ্তাইয়ে ঘটা আজকের প্রতিটি মুহূর্ত আমি মনে রাখবো। কারণ সেই মুহূর্তে তুমি আমার পাশে ছিলে।”

তৃতীয় পৃষ্ঠায় লেখা,
“সত্যিই কি তুমিও আমায় ভালোবাসতে, এআর? তাজওয়ার কেন বললো এ কথা?”

চতুর্থ পৃষ্ঠায় লেখা,
“এতোটা ঘৃণিত আমি? আমার চেহারাটাও দেখতে চাও না? আর তোমার চেহারা না দেখে যে আমি অস্থির হয়ে যায়? বেশ তো। আসবো না তোমার সামনে। আর কখনো লিখবোও না তোমাকে নিয়ে। তুমি তো চলে যাচ্ছো অন্য জায়গায়। এই শহরটা রেখে যাচ্ছো আমার জন্য। যেই শহরে তোমার সাথে প্রথম দেখা। আমার এক তরফা ভালোবাসার গল্প লেখা। আমার স্বপ্ন ভাঙা। আমার তোমাকে বার-বার হারিয়ে ফেলা।”

এরপরের সব পৃষ্ঠা খালি। অর্থাৎ আহি গত পাঁচ বছরে ডায়েরিতে আফিফকে নিয়ে কিছুই লিখে নি। আফিফ ডায়েরী বন্ধ করলো। আয়নার সামনে দাঁড়ালো। লাল হয়ে আছে তার চোখ দু’টি। তখনই বেল বেজে উঠলো। দু’বার বেল পড়তেই আফিফ মুখ ধুয়ে রুম থেকে বের হলো। এদিক-ওদিক তাকালো। বাসায় কি কেউ না-কি? আফিফা বেগমও তখন বেরিয়েছেন। ছেলেকে দেখে বললেন,
“খুলছিস না কেন? আদ্য এখনো ঘুম। রেনু নাস্তা করে আবার শুয়েছে। আমিও শুয়ে ছিলাম।”

আফিফ বলল,
“আচ্ছা, আমি দেখছি কে এসেছে!”

আফিফ দরজা খুললো। সামনে তাকাতেই থমকে গেলো সে। আফিফের মুখোমুখি এলোমেলো দৃষ্টি জোড়াও যেন থমকে গেলো সামনের মানুষটিকে দেখে। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলো উভয়েই। আফিফ অস্ফুটস্বরে বলল, “আহি!’

আহি কিছু বলতে পারলো। অশ্রু ভীড় করলো তার চোখে। আবার কেন দেখা হলো মানুষটার সাথে? এখন কি আবার হারিয়ে ফেলবে তাকে?

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here