যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_১০ জাওয়াদ জামী জামী

0
123

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_১০
জাওয়াদ জামী জামী

” মম, আমি আর জীবনেও ভার্সিটি যাবোনা। ওই মাস্টারের কতবড় সাহস আমাকে পুরো ক্লাস কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে! আমার মানসম্মান ধুলোয় মিশে গেল। ঐ মাস্টারকে আমি ছাড়বনা। ওকে আমি ম্যানহোলে না চুবালে আমার নাম মাশিয়া নয়। ” রাগে মাশিয়া কেঁদে ফেলল। ও বাসায় এসেই নিজের ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে নিজের রাগ ঝাড়তে লাগল ড্রয়িংরুমের ফার্নিচারের ওপর।

” শান্ত হও, মাশিয়া। আমাকে বল কি হয়েছে? এভাবে ফার্নিচার নষ্ট করছ কেন? এসব কিনতে টাকা লাগে। কেউ এমনিতে দেয়না। ” কল্পনা মোর্তাজাও রেগে উঠলেন। তিনি আর কিছুতেই মাশিয়ার অন্যায়গুলোকে প্রশ্রয় দিতে চাননা।

” আমার থেকে এই ফার্নিচারগুলো তোমার কাছে বেশি প্রিয়! আমি থাকবনা এখানে। তোমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাব। ”

” তা কবে যাচ্ছ? এর আগেও বেশ কয়েকবার যেতে চেয়েছিলে, কিন্তু প্রতিবারই সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করেছ। এবার আশা করছি সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করবেনা? ”

মাশিয়া কল্পনা মোর্তাজার কথার উত্তর না দিয়ে তার দিকে অগ্নি দৃষ্টি হেনে দুপদাপ পা ফেলে নিজের রুমের দিকে যায়।

” নিলু, তুমি টেবিলে খাবার দাও। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাহিনের বাবা এসে যাবে। আমি বউমাকে ডাকছি। আর শিল্পি তুমি মাশিয়াকে জুস দিয়ে এস। আজকে অনেক পরিশ্রম করেছে আমার মেয়েটা। পরিশ্রমের ফলে মাথার টেম্পারেচারও বেড়েছে। এখন ঠান্ডা ঠান্ডা জুসে যদি ওর মাথা একটু ঠান্ডা হয়। ” কল্পনা মোর্তাজা দুইজন মেইডকে ডেকে নির্দেশ দিলেন। তার নির্দেশ পাওয়া মাত্রই দুইজন মেইড তাদের কাজে লেগে যায়।

” আমি মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছি, শফিক। মেয়েকে কোন কয়েদখানা কিংবা ক্যাসিনোতে পাঠাতে চাইনি। তুমি আজ পর্যন্ত যতগুলো পাত্রের খোঁজ এনেছ তাদের কাউকেই আমি যোগ্য বলে মনে করছিনা। এই যে, এটা দেখ, এই ছেলের সঙ্গে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেব? এি ছেলের বাবা, ভাই এমনকি ছেলেও মদ আর জুয়ায় মেতে থাকে। এরা পরিবারের সবাই মিলে ড্রয়িংরুমে বসেই স্যাম্পেন খায়। আর তুমি কিনা এই ছেলের বায়োডাটা এনেছ! আমি মাশিয়ার বিয়ে দিতে চাই, তারমানে এই নয় যে, আমা আমার মেয়ের হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দেব। তুমি যদি পার একজন সং পাত্রের সন্ধান এনো। হোক সে মধ্যবিত্ত কিংবা গরীব। আমি শুধু আমার মেয়ের জন্য একজন উত্তম জীবনসঙ্গী চাই। ” মিরাজ মোর্তাজা রাগে হাতে থাকা ছবি এবং বায়োডাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। যেটা দোতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখল মাশিয়া। ওর ধারনাই ছিলনা বাবা ওর বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। নিচে নামার বদলে ও দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়।

” পাপা সত্যিই আমার বিয়ে দেবে! আমাকে এই বাড়ি ছেড়ে, পাপা-মম, ভাইয়া-ভাবীকে ছেড়ে যেতে হবে! আমি কিভাবে থাকব ওদের ছাড়া? ” মাশিয়া রুমে এসে নিজের সাথে নিজেই কথা বলতে থাকে। ও আর কিছুই ভাবতে পারছেনা। ও তাড়াহুড়া করে ড্রেস চেঞ্জ করে ভার্সিটির দিকে রওনা দেয়। অধিক উত্তেজনায় ও ভুলেই গেছে গতকাল ভার্সিটি থেকে আসার পর ঘোষণা দিয়েছিল, আর কখনোই ও ভার্সিটিতে যাবেনা।

ভার্সিটিতে এসে মনযোগ দিয়ে সব ক্লাস করল মাশিয়া। আরমানের ক্লাসেও কোন গোলযোগ করলনা। আরমান তার অবাধ্য ছাত্রীটিকে মনোযোগী হতে দেখে হাসল। কিন্তু সে জানতেও পারলনা, তার এই অবাধ্য ছাত্রীটির বিয়ের চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

রাত দশটা বিশ। আরমান একটা কফিশপের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। আজ ওরা কয়েকজন বন্ধু মিলে জম্পেশ আড্ডা দিয়েছে। দশটা বাজতেই সবাই যে যার বাসার পথে রওনা দিয়েছে। ওদের প্রত্যেকেরই নিজেদের বাইক, কার আছে। শুধু আরমানই রিক্সায় যাবে। অবশ্য ওকে বন্ধুরা সবাই লিফ্ট দিতে চেয়েছিল।, কিন্তু ওদের বাড়ি আরমানের ফ্ল্যাটের ঠিক উল্টো রাস্তায়। তাই আরমান ওদের ঝামেলা বাড়াতে চায়নি। সবাই বিদায় নিতেই আরমানও রিক্সার জন্য দাঁড়ায় কফিশপের বাহিরে।

” হেই ইয়াং ম্যান, তুমি এখানে? কোন প্রবলেম? ” হঠাৎ একটা গাড়ি আরমানের সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন মিরাজ মোর্তাজা।

আরমান মিরাজ মোর্তাজাকে দেখে একটু অবাকই হয়।

” আসসালামু আলাইকুম, স্যার। রিক্সা পাচ্ছিনা, তাই দাঁড়িয়ে আছি। ”

” গাড়িতে উঠ। তোমাকে বাসা পর্যন্ত ছেড়ে দেই। শুনেছি তুমি ভার্সিটির আশেপাশেই থাক। আমিও সেদিকেই যাচ্ছি। ” মিরাজ মোর্তাজা আন্তরিকতার সাথেই বললেন। আরমান মিরাজ মোর্তাজার এরূপ প্রস্তাবে বেশ বিব্রত হয়। ভার্সিটির চেয়ারম্যান একজন শিক্ষককে এভাবে লিফ্ট দিতে চাইছে, এখানে আরমান যদি না করে দেয় তবে সেটা খারাপ দেখায়। আবার এভাবে তাদের সাথে যেতে আরমানের ইচ্ছে করছেনা। তাই সে ইতস্তত করে বলল,

” স্যার, আমার জন্য অযথাই ঝামেলা করার কোন প্রয়োজন নেই। আমি রিক্সা নিয়ে চলে যাব। ”

” আরে এখানে এত কথার কিছু নেই। তুমি চল আমাদের সাথে। তোমার ম্যামও আছে গাড়িতে। এই সুযোগে তার সাথে পরিচিত হয়ে নিবে। তারও তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগবে। চল, ইয়াং ম্যান। ” মিরাজ মোর্তাজার আন্তরিকতা দেখে আরমান অবাক হয়ে যায়। এত উঁচু সমাজের মানুষ হয়ে এভাবে তার অধিনস্ত কারও সাথে কথা বলতে এই প্রথমবার কাউকে দেখছে আরমান। সেই সাথে মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাতা নত হয়ে যায়। সে আর না করতে পারেনা।

” ম্যামও আছে! আপনাদের দেরি হয়ে যাবেনা? ”

” নোহ্। তুমি এসো। ” ততক্ষণে মিরাজ মোর্তাজা গাড়ির দরজা খুলে ফেলেছেন।

” কল্পনা বেরিয়ে এসো। তোমাকে আরমানের কথা বলেছিলাম না? এই যে সেই ইয়াং ম্যান। ” মিরাজ মোর্তাজার কথা শুনে বেরিয়ে আসলেন কল্পনা মোর্তাজা। তাকে দেখে আরমান সালাম দেয়।

কল্পনা মোর্তাজা কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন তার সামনে দাঁড়ানো এই সুর্দশন যুবকটির দিকে। ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের যুবকটিকে দেখে তার চোখ জুড়িয়ে যায়। বয়সে আরমান তার ছেলে মাহিনের থেকে ছোটই হবে। তাই তিনি আরমানকে তুমি বলেই সম্ভাষণ করলেন। তিনি সালামের উত্তর নিলেন। এরপর কয়েকটা কথা বলেই আরমানকে গাড়িতে উঠতে বললেন।

” ইয়াং ম্যান, আমার ছেলের রিসিপশনে তোমাকে আশা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। ” মিরাজ মোর্তাজা পেছন থেকে বললেন। ড্রাইভারের পাশে বসা আরমান মিরাজ মোর্তাজার কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়।

” আসলে স্যার, আমার আম্মা সেদিন হঠাৎই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। আম্মাকে নিয়ে সারাদিন ছুটাছুটি করতে হয়েছে। ” আর কিছু বললনা আরমান।

আরমানের কথায় যা বোঝার বুঝে গেছেন মিরাজ মোর্তাজা। একজন আদর্শ ছেলের দ্বায়িত্ব পালন সম্পর্কে তার কোন ভুল ধারনা হতে পারেনা।

” কি হয়েছিল তোমার আম্মার? তিনি এখন কেমন আছেন? ” মিরাজ মোর্তাজার গলায় খাঁটি উদ্বেগ।

” আম্মার হার্টের প্রবলেম দেখা দিয়েছে। সেকারনেই তাকে ঢাকায় এনেছি। চিকিৎসা করাচ্ছি। গত কয়েকদিন সে একটু সুস্থ ছিল। কিন্তু সেদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যায়। ”

” সেক্ষেত্রে বলব, তুমি একজন আদর্শ ছেলের দ্বায়িত্ব পালন করেছ। কোন দাওয়াতের চাইতে মা’য়ের চিকিৎসা করা বেশি দরকার। তার পাশে থাকা দরকার। ”

” তোমার বাবা কি করেন? কয় ভাইবোন তোমরা? ” পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলেন কল্পনা মোর্তাজা।

” বাবা বেঁচে নেই। আমার ছোট দুইটা বোন আছে। ” ছোট্ট করে বলল আরমান।

আরমানের কথা শুনে কল্পনা মোর্তাজার মন খারাপ হয়ে যায়। বাবা না থাকার যন্ত্রণা তিনি ভালো করেই জানেন। মুহূর্তেই তার মনে পরে যায় বাবার মৃ’ত্যু’র পর তাদের সেই দুর্বিষহ দিনের কথা। ছোট ছোট ভাইবোনকে নিয়ে তার মধ্যবয়সী মায়ের জীবনযুদ্ধে লড়াইয়ের কথা। বাবা হীন যেকোন সন্তানের জীবনই যে কণ্টকাকীর্ণ পথের ন্যায় তা তিনি ভালো করেই জানেন। বাবা নামক বটবৃক্ষ না থাকলে একজন মা’য়ের পক্ষে সন্তানদের মানুষ করা কত কঠিন তা তিনি জানেন। খুব কম সন্তানই বাবা ছাড়া জীবনের কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে সফলতার মুখ দেখতে পায়। গাড়ির সামনে বসা যুবকটিকে দেখে তার বুকের ভেতর ছলকে উঠল। চোখের কোনে জমা হয় বেদনার নোনা জল। তিনি সংগোপন চোখের জল মুছলেন।

গল্পে গল্পে আরমান বুঝতেই পারেনি গাড়ি ওর বিল্ডিংয়ের সামনে এসে গেছে। ড্রাইভার বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়ি থামালে আরমান মিরাজ মোর্তাজা ও কল্পনা মোর্তাজার কাছ থেকে বিদায় নেয়। অবশ্য যাওয়ার আগে মিরাজ মোর্তাজা আর কল্পনা মোর্তাজাকে বাসায় নিয়ে যেতে চাইলে তারা জানায় অন্য একদিন তারা বেড়াতে আসবেন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here