— বিয়ের দুই বছর পর আপনি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইছেন রাদিফ?
নাজের কান্নাভেজা কন্ঠস্বর শুনে রাদিফ নাজের উপর আরও রেগে উঠলো যেন। ভ্রুদ্বয় কি’ঞ্চিৎ পরিমান ভা’জ করে মৃদু নিশ্বাস টেনে নিয়ে দাঁতে দাঁত চে’পে ধরে বললো।
— দেখো নাজ। এই বিয়েতে না তুমি খুশি আছো, না আমি। তাই এই সম্পর্কের মোর আর না আগানোই ভালো আমাদের দুজনের জন্য। বাড়িতে সবাই ঘুমোচ্ছে, এখন তুমি সাইনটা করে বিদায় হও। বাড়ির সবাইকে পরে আমি সবটা বুঝিয়ে বলব।
রাদিফের গম্ভীর কণ্ঠের রেশ শুনে অন্তর স্পর্শ করে গেল যেন নাজের। কান্নারত কন্ঠে বললো।
— আমিতো আপনাকে ভালোবাসি রাদিফ। আমার ভালোবাসার কি কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে? আমিকি এতোটাই মূল্যহীন ছিলাম গত দু বছর। আপনি কিভাবে আমাকে বিয়ের এতদিন পর ডিভোর্স দিচ্ছেন। একটিবারও হৃদয় কাঁ’পলো না আপনার কথাটা ভাবতে? নাজের কথাগুলো যেন অতিরিক্ত প্রেশার মনে হচ্ছে এখন রাদিফের। আশপাশ কিছু না ভেবে ডিভোর্সের ফাইলটা থেকে ডিভোর্স পেপারটা বের করে কালোরাঙা শার্টের পকেট থেকে কলমটা বের করে সাইনটা করে দিয়ে নাজের সামনে থাকা টি টেবিলের উপর রেখে ধীর কন্ঠে বললো রাদিফ।
— অনেক হয়েছে তোমার ন্যা’কা কান্না। অনেক আগেই তোমাকে ডিভোর্স দেওয়া উচিত ছিল আমার। শুধুমাএ আম্মার কথায় বাধ্য হয়ে তোমার মতো মেডেলক্লাস মেয়ের সাথে এতদিন সংসার করেছি। আজ আম্মা যখন গ’ত হয়েছেন। তো, তোমার মতো মেয়ের সাথে আর একটাদিনও আমি কাঁ’টাতে চাইছি না নাজ। কি দিয়েছে তোমার পরিবার আমাকে? আমার অফিসের প্রত্যেকে আমাকে নিয়ে ঠা’ট্টা করে তোমার জন্য। এইবারতো আমাকে একটু রেহাই দেও তুমি। গেটের দরজা খোলা আছে। সাবিনা খালাকে দিয়ে তোমার ব্যাগ-ট্যাক সব গুছিয়ে রেখেছি। বিদায় হও এখন। রাদিফের গম্ভীর কণ্ঠের রেশ কান ঘেঁষে পৌঁছাতে নিস্তে’জ হয়ে পরলো যেন নাজ৷ চোখের কোন বেয়ে ঝরে পরছে তাঁর মোটা>মোটা জলরাশি। ছোটবেলায় নাজের আম্মা মেহরুম বেগম নাজকে খুব করে বলতেন যে,
— শোন আম্মা, একটা কথা সবসময় মাথায় রাখবি। অপ’মানের স্থানে দ্বিতীয়বার যেতে নেই। মেহরুম বেগমের কথাটা যেন এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো নাজের।
নাজেরও আত্মসম্মানবোধ প্রখর ছিল। তবে এই দুই বছর রাদিফের সব অন্যা’য় মুখ বুঁজে স’য্য করেছে সে। মানসিক ভাবে নির্যা’তনের পরও শশুরবাড়ির মাটি কাঁ’ম’রে পরে ছিল নাজ। কারন সে জানে, বাড়িতে ফিরে গেলে তাঁর আম্মা ওখানেই স্ট্রো’ক করে বসবেন। মেহরুম বেগম এমনিতেই হার্টের রো’গী। অনেক শখ করে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড সুলেখা বেগমের ছেলে রাদিফের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন নাজের। তাই ভয় হত নাজের। কিন্তু আজ তাঁর সবকিছু এক মুহুর্তেই শেষ করে দিল রাদিফ।
আলমারির পাশে রাখা কালোরাঙা জামাকাপড়ের ট্রলিটা নাজের দিকে একপ্রকার ভাবে ছুঁ’ড়ে মার’লো সে। নাজের আজ বড্ড বেশি কষ্ট হচ্ছে। তাঁর নিজ হাতে সাজানো-গোছানো সোনার সংসারটা কেমন এক নিমিষেই পাল্টে দিল রাদিফ। বিয়ের পর থেকে তাঁদের মধ্যকার সম্পর্ক শুধু ওই বিছানা অব্দি সীমাবদ্ধ ছিল৷ সারাটাদিন রান্নাঘরে পরে থাকত নাজ। রাদিফের আম্মা সুলেখা বেগমের হাঁটুর ব্যা’থার কারনে খুব একটা সাহায্য করতে পারতেন না কাজে। রাদিফরা তিন ভাইবোনের মধ্যে রাদিফের বড় বোনের ডিভোর্স হওয়ার কারনে এবাড়িতেই থাকেন সে। তবুও কথা শোনাতে বিন্দুমাএ ছাড় দেননা তিনি নাজকে। সারাদিন খাঁটি’য়ে মা’রেন তিনি নাজকে দিয়ে। নাজের শশুর গ’ত হয়েছেন এক বছর হতে চললো। এ বাড়িতে একমাএ আয়ের উৎস বলতে সুলেখা বেগমের দুই ছেলে, রাদিফ আর রাফি। নিজের আব্বা আফজাল সাহেবের গড়ে তোলা মসলার ভেক্টরি সামলায় রাফি। আর রাদিফ একটা কোম্পানিতে পার্মানেন্ট জব করে। সারাদিনের কাজ শেষে রাত অব্দি না খেয়ে বসে থাকত রাদিফের জন্য নাজ। কিন্তু রাদিফ রাত করে বাড়ি ফিরে বলতো খেয়ে এসেছি। মাঝেমধ্যে রাদিফের শরীর থেকে মেয়েলি পারফিউমের স্মেল পেত নাজ। সেদিকে তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ না দিলেও লুকিয়ে-লুকিয়ে কেঁদেছে কত তাঁর হিসাব নেই নাজের কাছে। রাদিফ কখনো একটিবার জানতেও চায়নি নাজ খেয়েছে কিনা? নাজের কিছু লাগবে কিনা? এই সম্পর্কটা যেন একপ্রকার টা>না হেঁ’চড়া করে আগানো। যার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন নাজের শাশুড়ী সুলেখা বেগম। আর আজকে তাঁর চলে যাওয়াতে তাঁদের সম্পর্কের বাঁ’ধটা এবার ভে’ঙেই দিল রাদিফ।
—দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমার চেহারা না দেখে বিদায় হও এখন এ বাড়ি থেকে।
রাদিফের কথায় অন্তরা’ত্মা কেঁ’পে উঠলো যেন নাজের। হুঁ’শে ফিরলো সে। বুক চি’রে বেড়িয়ে আসতে চাইছে শুধু একরাশ দীর্ঘশ্বাস। এত-এত অভিযো’গের পেয়ালা থাকা সর্তেও আজ যেন রাদিফের দিকে আঙুল তুলতে পারছে না নাজ। পা ঢ’লে টি টেবিলের সামনে বসে পরলে ডিভোর্সের কাগজের উপর রাদিফের নামটা বড়-বড় অক্ষরে চোখে ভাসতে চোখ বেয়ে টুপ করে পানি গড়িয়ে পরলো কাগজটার উপর।
— এই ছিল আপনার মনে রাদিফ? তবে আপনিও একটা কথা শুনে রাখুন রাদিফ। সময় থাকতে আমার ভালোবাসার মূল্য আপনি দিলেন না। কিন্তু একদিন এমন দিন আসবে। যেদিন আপনি আমাকে পাওয়ার তৃষ্ণায় ম’রে যাবেন। কিন্তু তবুও আমিহীনা জীবন কাঁ’টাতে হবে আপনাকে। আফসোস শুধু একটাই, ভু’ল মানুষের জন্য এতগুলো দিন নিজের হৃদয় মাঝে জায়গা করে ফেলেছি। মাটি কাঁ’ম’রে পরে রয়েছি ভালোবাসাহীন বাড়িটাতে। এখন সেই জায়গাটাতে চা’কু দিয়ে ক্ষ’ত করতে হবে।
কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে আঁচলে চোখের পানি মুছে সাইনটা করে দিয়ে এক কাপরে ট্রলিটা নিয়েই বেড়িয়ে পরলো নাজ। বুকটা কেমন হাহাকার করে যাচ্ছে তাঁর। এই কি ছিল তাঁর ভাগ্যে? নিয়তির কাছে যেন হেঁড়ে গেল সে। পা যেন সামনে আগাতে চাইছে না তাঁর। এতদিনের সংসার এক নিমেষেই কেমন ভে’ঙে গু’ড়িয়ে গেল নাজের। এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না নাজ। যে, রাদিফের সাথে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে তাঁর। সত্যিই, একটা কলমের কালিই কি এতদিতের সম্পর্ক ভে’ঙে দিতে যথেষ্ট? সত্যিই কি তাই?
নিজের করা প্রশ্নের কাছে নিজেই হেঁড়ে যাচ্ছে যেন নাজ। ভিতর থেকে শুধু একটাই সারা পাচ্ছে সে।
— আম্মাকে কি জবাব দেবে সে? কোন মুখে যাবে সে আম্মার সামনে।
.
শহরজুড়ে আজ ঝুম বৃষ্টিতে আচ্ছন্ন পরিবেশ। আষাঢ় মাসের বৃষ্টিটাও খুব তি’ব্র। ক্ষনে-ক্ষনে বি’দ্যুৎ’তের চমকানোটাও যেন হৃদয়ে ক্ষ’তে’র সৃষ্টি করছে নাজের। রাত এখন আটটা কি সারে আটটা নাগাত। সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার বাসে উঠে পরেছে নাজ। নয়টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে গাড়ি রহনা দিয়ে দিবে। চোখদুটি ভিষনভাবে জ্বলছে যেন নাজের। একটা পাবলিক টয়লেটে গিয়ে কালোরাঙা বোরকা পরে নিয়েছে বাসে ওঠার আগে। বিতৃ’ষ্ণায় আশপাশ কিছু খেয়াল না করেই রাদিফের উপর ঘে’ন্নায় দৃষ্টিশক্তি মিয়িয়ে পরাতে বোরকা ছারাই বাড়ি থেকে নেমে পরেছিল নাজ।
বাসের কাঁচ ঘেঁ’ষে বৃষ্টির রেশ ছেয়ে পরতে থাকলে জানালার কাঁচটা ঠেলে পিছনে করে দিলে হিমশীতল হাওয়ায় নাজের নেকআপটা কেমন উড়ে-উড়ে বেড়াচ্ছে। বাসের সিটের সাথে মাথাটা এলিয়ে দিতে নিজের আম্মা মেহরুম বেগমের কথা মনে পরে গেল তাঁর। বিয়ের দুই বছর পর আজই এই প্রথম নিজের বাড়িতে পা দিতে চলেছে নাজ। রাদিফের পরিবারের কেউই চাইতো না যে, নাজ তাঁর বাড়িতে বেড়াতে যাক বা কিছু। রাদিফের আম্মা সুলেখা বেগমেরও এ ব্যাপারে কিছু করার ছিল না। কিন্তু আশ্চর্য! আজ নিজের আম্মার কথা ভেবে কষ্ট হলেও একদিক থেকে নিজেকে কেমন স্বাধীন মনে হচ্ছে নাজের। বিয়ের পর ও বাড়ি থেকে কোথাও গিয়েছে কিনা এই দুই বছরে তা তাঁর সন্দেহ। বুকটা ভাড়ি পরে গেলে চোখদুটি লেগে এলো যেন নাজের। ক্লান্তিতে নিজের অজান্তেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো নাজ।
.
অন্ধকারে মুশলধারা বৃষ্টিতে কালোরাঙা গাড়িটা এসে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়ে পরলে, গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে দিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা হলুদরাঙা ল্যামপোস্টের দিকে দৃষ্টিস্থির করলো ইশতিয়াক আহমেদ ওমর।
— স্যার আপনি বাসে করে যাবেন। আপনার মাথার ঠিক আছেতো নাকি? কথাটা বলেই ড্রাইভার সিটে বসা জহিরুল সাহেব পিছু ফিরে ওমরের কপালে হাত ছোঁয়াতে নিতে ওমর হেসে বললো।
— আমি একদমই ঠিক আছি কাকা। সবসময় কি আর গাড়ি-ফা’রি ভালো লাগে বলুন? আজকে নাহয় বাসে করে যাওয়া যাক। জহিরুল সাহেব হেসে বললেন।
—যথাআজ্ঞা ছোট সাহেব।
গাড়ি থেকে ওমরের জামা কাপরের ট্রলিটা বের করে নিয়ে জহিরুল সাহেব বাসের ভিতর চলে গেলে ছাতা হাতে বেড়িয়ে পরলো ওমরও। হাতে থাকা বিদেশি ঘড়িটার দিকে তাকালে নয়টা ছুঁই-ছুঁই। আর কিছুক্ষণ পরই বাস ছেড়ে দিবে ঢাকার উদ্দেশ্যে।
“বাসে উঠে পরলে ওমর জহিরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো।”
—প্লিজ কাকা, এখানে আমি সবার মতো সাধারন মানুষের মতোই যেতে চাইছি। আপনি বাড়িতে ফিরে যান। ওমরের কথা শুনে মৃদু হাসলেন জহিরুল সাহেব। বললেন।
— বড় সাহেব বলে এক আর আপনি বলেন আরেক। এত অমিলের মাঝেও বড় সাহেবের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন ভেবে শরীর শিওরে উঠছে যেন আমার। ওমর হেসে বললো।
—আগে ঢাকাতে গিয়ে পৌঁছাই। তারপর হবে ডিসিশন। যে, আমি কাকে বিয়ে করবো। জহিরুল সাহেব ট্রলিটা ওমরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মাথায় ছাতা চেঁ’পে বাস থেকে নেমে পরলে ওমর কনট্রাকটরের কাছে সিট জানতে চাইলে কনট্রাকটর সামনে আঙুল দিয়ে দেখাতে নিতে ওমরের শীতল চাহনি কেমন আনমোনা হয়ে পরলো যেন…..
চলবে….
#শ্রাবনে_প্রেমের_হাওয়া।
#লেখনীতে_ফাতিমা_তুয_যোহরা।
#১পর্ব।
(আসসালামু আলাইকুম। নতুন মাসে আবারও নতুন কলমী নিয়ে হাজির হলাম আপনাদের মাঝে। গল্পটা ৩/৪ পর্বেই সমাপ্ত হয়ে যাবে৷ তারপর #হৃদয়_গহীনে_তুমি_আছো গল্পের সিজন ২ নিয়ে আসব ইনশাআল্লাহ। কেমন হয়েছে জানাবেন কিন্তু। 🖤)