#শ্রাবনে_প্রেমের_হাওয়া।
#লেখনীতে_ফাতিমা_তুয_যোহরা।
#পর্বঃ২
সো-সো শব্দে বাস চলতে শুরু করলে হাতে থাকা জামাকাপড়ের ট্রলিটা বাসের উপরে বক্সে রাখতে যেতে ভা’ঙা রাস্তার ধা’ক্কানিতে জানালার পাশের সিটে বসে থাকা মেয়েটার উপর হু’মরি খেয়ে পরতে নিতে সিটের দুইপাশে হাত রেখে নিজেকে সামলে নিল ওমর। জানালার কাঁচ খোলা থাকার কারনে বৃষ্টির রেশের মৃদু ঝ’লসানি ওমরের ঘন কালো চুলগুলো কেমন দুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যেন। বিভ্রা’ন্তানিতে পরে গিয়ে উঠতে যেতে সামনে থাকা ঘুমন্ত মেয়েটার দিকে দৃষ্টিস্থির হয়ে পরলো যেন ওমরের।
দক্ষিণা হিমেল হাওয়ায় মেয়েটার কালোরাঙা নেকআপটা আপন মনে উড়ে বেড়াতে ব্যাস্ত হয়ে পরেছে যেন। ভ্রুযুগল নিন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবে কুঁ’চকে আছে যেন তাঁর। কালো রাঙা বন্ধ চোখদুটি নিরন্তর ভাবে ফুলে লাল হয়ে আছে যেন মেয়েটার। কপালের ভাঁ’জে-ভাঁ’জে তাঁর দুশ্চি’ন্তার ছাপ স্পষ্ট।
শহরে রাস্তার লাল হলুদ রাঙা ল্যাম্পপোস্ট গুলো বাসের সঙ্গে-সঙ্গে পিছিয়ে যেতে থাকলে তার প্রখর আলোয় মেয়েটাকে কেমন মা’য়াবী লাগছে ওমরের কাছে। হুট করেই তি’ব্র বাতাসে নেকআপটা খানিকটা সরে যাওয়াতে নাজের গোলাপিরাঙা ঠোঁটদ্বয়ে চোখ আঁ’টকে গেল যেন ওমরের।
হৃদয় মাঝারে কেমন হাতু’ড়ি পেটা শুরু হয়েছে ওমরের। এ যেন এক অদ্ভুত অচেনা অনুভূতি ঝেঁ’কে বসেছে ওমরকে। মেয়েটার জন্য আলাদা একটা টা’ন অনুভব করতে পারছে সে।
—আপনের টিকিটটা সাহেব?
কনট্রাকটরের কথায় হুঁ’শে ফিরলো যেন ওমর৷ নিজেকে সংযত রেখে দ্রতগতিতে মেয়েটার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ধীর চাহনিতে পিছুফিরে কনট্রাকটরের দিকে তাকিয়ে আরেক পলক মেয়েটার দিকে তাকিয়ে নেকআপটা ঠিক করে দিয়ে নিজের সিটে এসে বসে পরলো ওমর।
পকেট থেকে টিকিটটা বের করে কনট্রাকটরের দিকে এগিয়ে দিলে টিকিটটাতে এক পলক চোখ বু’লিয়ে নিয়ে পাশে থাকা নাজের উদ্দেশ্যে বললেন।
—এইযে ম্যাডাম, আপনের টিকিটটা দিতে হইবো তো।
ওমর মেয়েটার দিকে তাকালে মেয়েটা কেমন নিস্তে’জ হয়ে ঘুমিয়ে আছে যেন। বেশ অবাকও হলো মেয়েটাকে দেখে। আবারও কনট্রাকটর নাজকে ডাকতে নিতে চটজলদি ওমর বলে উঠলো।
— ঘুমোচ্ছেন তিনি। ক্লা’ন্ত দেখাচ্ছে তাঁকে। আপনি ওনার টিকিটের দামটা আমার থেকে নিয়ে নিন। কথাটা বলেই পকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করে হাজার টাকা দিয়ে দিলে কনট্রাকটরও আর কিছু বললেন না নাজকে। বাকিদের টিকিট চেক করতে গেলেন তিনি।
সময় পাইলে টাংকি মা’রতে আইয়ো ও বন্ধুগো
সময় পাইলে টাংকি মারতে আইয়ো..
হুট করেই অদ্ভুত গানে ফোনটা বেজে উঠলে ভ’রকে গেল ওমর। চারপাশে তাকালে আশপাশের কয়েকজন মিটমিট করে হাসছে তাঁর দিকে তাকিয়ে। ল’জ্জা পেয়ে গেল সে। এ নির্ঘাত ছুটকির কাজ। তাঁকে সাথে করে না আনার জন্য যে, সে এ রকমটা করেছে তা বুঝতে আর বাকি নেই ওমরের। হলোও তাই। ম্যাসেজে বড়বড় করে লেখা আছে।
— আমাকে না নিয়ে যাওয়ার শা’স্তি এটা ভাইয়া। হেসে উঠলো ওমর। তাঁর বোনটা সত্যিই একটা পা’গল।
দ্রুত রিংটন পাল্টে কলব্যাগ করলে ওপাশ থেকে রায়ানুল সাহেবের কন্ঠ শোনা গেল।
— কি ব্যাপার ওমর। ফোন ধরতে এত দেরি করলে যে?
নিজের বাবার কন্ঠ শুনে বিরক্ত হলো যেন ওমর। ধীর কন্ঠে বললো।
— তেমন কিছু না ড্যাড। আমি ঠিকঠাক ভাবে পৌঁছে যাব, সময় মতো খেয়ে নেব, আর নিজের খেয়াল রাখব। এবার রাখছি।
ছেলের কথায় হাসলেন রায়ানুল সাহেব। বললেন।
— বাহ, আমার সবকথা গুলো দেখছি খুব ভালো করে নিজের আয়ত্তে করে নিয়েছো তুমি।
— ছোট বেলা থেকে তো এই একটা কথা শুনেই বড় হয়েছি তাইনা। যাইহোক, ফোন রাখছি এখন। কথাটা বলেই চটজলদি ফোনটা কেঁ’টে দিল ওমর। চোখের কোনে পানি এসে জমা হলো যেন তাঁর।
— টাকা পয়সাই কি সবকিছু ড্যাড? এই ভালোবাসাহীন টাকা পয়সাই আমাকে কেমন কোনঠাসা করে দিয়েছে জানো? এসব তুমি বুঝবে না। নয়তো ভাইয়া আমাদের ছেড়ে ভাবিকে নিয়ে আলাদা থাকতেন না। কথাগুলো মনের মাঝে ঝড় তুলতে থাকলো যেন ওমরের।
.
রাত এখন গভীরে গিয়ে। বৃষ্টির রেশটাও অনেকটা প্রবল বেগে ঝড়ে পরছে যেন শহরে। অন্ধকার বাসে সবাই যেন গভীর ঘুমে বিভোর।
বুকের উপর ভাড়ি কিছু অনুভব করতে পেরে ঘুমটা কেমন নড়বড়ে হয়ে পরলো ওমরের। কালোরাঙা শার্টটা কারো কান্নার রেশে ভিজে উঠেছে যেন তাঁর। চোখের উপর হাত রেখে ঘুমের ঘোরটা মৃদুভাবে কাঁ’টিয়ে নিয়ে পিটপিট করে তাকালো ওমর সেদিকে৷ ঘুমের ঘোরে মেয়েটা কেমন আ’ষ্টেপৃ’ষ্টে ভাবে জড়িয়ে ধরে আছে ওমরকে। চ’মকে উঠলো যেন ওমর। মেয়েটা সমানে কেঁ’দে চলেছে। সঙ্গে তাঁর অস্পষ্ট স্বরে আওরে চলা কিছু প্রলেপন। সমস্ত শরীর যেন কাঁ’পছে নাজের। ওমরের বুকের উপর এলোপাতাড়ি কি’ল ঘু’ষি দিতে থাকলো সে হাত দিয়ে। ওমরের মাঝেই যেন সে রাদিফকে দেখতে পাচ্ছে ঘুমের ঘোরে।
— কিভাবে পারলেন আপনি রাদিফ? আমিতো আপনার সবকথা মেনে চলতাম। আপনি যা বলতেন তাই সয়ে যেতাম মুখ বুঁজে। একটিবারও হৃদয়ে আ’ঘাত হানলো না আপনার? আপনি এতটা পা’ষান। আমি এবার আম্মাকে কি জবাব দেব বলুন? আমার জীবনের এই সাদাকালো রঙহীন আবরনেও যে কল’ঙ্ক লাগিয়ে দিলেন আপনি। আপনার দেওয়া আঘা’তে ঝ’লসে গেছে নাজ। আপনি তাঁর মূল্য বুঝলেন না রাদিফ।
নাজের আনমনে আওরে চলা কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো ওমর। কিন্তু বাড়িরের তুমুল বর্ষনপাতে কথাগুলো যেন স্পষ্ট শোনা গেল না। তবে ওমর এটা বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে যে, মেয়েটা অন্য একজনকে তাঁর মাঝে খোঁজার চেষ্টা করছে।
আর তাই এই পা’গলামো করছে সে।
মা’য়া হলো তাঁর মেয়েটার জন্য। শীতল হাতের স্পর্শে নেকআপের উপর দিয়ে নাজের মাথায় হাত ছোঁয়াতে চ’মকে গেল যেন ওমর। শরীর কাঁ’পিয়ে জ্বর চে’পেছে যেন নাজের।ঘন-ঘন নিশ্বাস টে’নে চলেছে নাজ। ক্লা’ন্ত শরীরে মি’য়িয়ে পরে আছে যেন সে। সারাটাদিন একফোঁটা পানি অব্দি পেটে পরেনি নাজের। শাশুড়ী মা’রা যাওয়ার শোকে বিব্ভ’ল হয়ে পরেছিল সে। তারপর রাতেই রাদিফের এরুপ আচারনের কারনে নিজেকে শান্ত রাখা ক’ষ্টদায়ক হয়ে পরেছিল যেন নাজের কাছে।
খানিকবাদে একেবারে থেমে গিয়ে ওমরের বুকের উপরই ঘুমিয়ে পরলো নাজ।
ওমরের ঘুম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল এমন পরিস্থিতি দেখে। মেয়েটার মুখটাও দেখা যাচ্ছে না নেকআপের কারনে। উঠে যে ব্যাগ থেকে পানি বের করে মেয়েটার চোখেমুখে ছিটিয়ে দিবে, তাঁরও কোনো উপায় নেই। নাজ তাঁর বুকের উপর রয়েছে যে। ওমর অবশ্য একবার ভাবলো যে, মেয়েটার নেকআপটা সরিয়ে দিলে হয়তো মন খুলে নিশ্বাস নিতে পারবে সে। কিন্তু বিবেকের দাঁড় গড়ায় বাঁ’ধ সাধলো যেন তাঁকে।
—মেয়েটা হয়তো তাঁর চেহারা কাউকে দেখাতে চায়না৷
তাই আর নেকআপটা সরালো না ওমর। দীর্ঘশ্বা’স ছেড়ে নেকআপের উপর দিয়ে নাজের মাথায় হাত বু’লিয়ে দিতে থাকলো সে।
.
তিব্রভাবে সূর্যালোকের তীর্যক রশ্মি চোখেমুখে এসে ছেঁয়ে পরাতে কাঁ’চা ঘুমটা কেমন ভে’ঙে গেল ওমরের। হাই তুলে বাসের কাঁচ ভেদ করে তাকালে বৃষ্টি শেষে এক স্নিগ্ধময় দিনের শুরু হলো যেন। সকালের ফুরফুরে হিমশীতল হাওয়া এসে সমস্ত শরীর কাঁ’পিয়ে গেলে ভ্রুদ্বয় কি’ঞ্চিৎ পরিমান ভা’জ করে পাশের সিটে চোখ পরতে সেই মা’য়াবী মেয়েটার কথা মনে পরে গেল ওমরের। ভাবনায় ছেদ কেঁ’টে গেল মেয়েটাকে না দেখতে পেয়ে। চারপাশে চোখ বু’লিয়ে তাকালে সবাই ঘুম ছাড়িয়ে জলদি পায়ে বাস থেকে নেমে পরাতে ব্যাস্ত। বেশ অবাক হলো ওমর।
—গেল কোথায় মেয়েটা? এত জ্বর নিয়ে অসু’স্থ শরীরে কোথায় গেল সে? কথাটা ভাবতে নিতে কনট্রাকটরের দিকে এগিয়ে গেল ওমর। হুট করেই ওমরকে এভাবে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে কনট্রাকটর ভর’কে গেলেন যেন। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললো।
— কিছু কইবেননি সাহেব?
ওমর যেন হা’সপা’স করতে থাকলো তাঁর প্রশ্নে। সত্যিই তো, কি বলবে সে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
—আমার পাশে যে মেয়েটি বসেছিল,ওইযে কালোরাঙা বোরকাওয়ালি। ওনাকে দেখেছেন?
কনট্রাকটর পান চিবুতে-চিবুতে কিছুটা ভেবে নিয়ে বললেন।
— তিনিতো অনেকক্ষণ আগেই বাস দিয়া নাইমা পরছেন সাহেব।
—চলে গেছেন?
—হ গেলেন তো।
কনট্রাকটরের কথাটা কানের কাছে এসে পৌঁছাতে বুকটা কেমন ভারি পরে গেল ওমরের। আর দাঁড়াল না সেখানে।
—চলে গেলেন। একটাবার কৃতজ্ঞ’তা জানানোরও প্রয়োজন অনুভব করলেন না? কথাটা নিজ মনে ভেবে আবার নিজেই বললো।
— আমাকে বলতেও বা যাবেন কেন? আমি কি হই তাঁর। কথাটা বলেই হেসে উড়িয়ে দিয়ে নিজের জামাকাপড়ের ট্রলিটা নিয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়াল ওমর….
চলবে….