প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [১৩] প্রভা আফরিন

0
536

প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [১৩]
প্রভা আফরিন

একটি শান্ত, স্নিগ্ধ সকালের আবেশে মন যখন ফুরফুরে তখন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি চিত্ত নাড়িয়ে দিল। ব্যাচের সবচেয়ে তুখোর ক্যাপ্টেনও ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। কপালে পড়ল উদ্বেগের ভাজ। সেই উদ্বেগের কারণ শুধু গাড়িতে থাকা র’ক্ত নাকি বাহুতে মিশে থাকা তরুণী তা ঠাহর করা মুশকিল। তার ঘর্মাক্ত দেহের উত্তাপে লেপ্টে আছে যাবীনের নিরুত্তাপ, নিস্তেজ, ফ্যাকাশে গাল। ঘন পাপড়িতে ঢেকে আছে বোজা চোখ। বেকায়দায় পড়েছে বলে লিপবামে ভেজা পাতলা, পেলব অধরযুগল কিঞ্চিৎ বেঁকে আছে। একটা চুল আটকে আছে ঠোঁটে কোণে। সম্মুখের সাদা গাড়ির রক্তাভ দৃশ্যের বদলে কখন যেন নিশান্তের চোখ গিয়ে ঠেকল সেই ঠোঁটে আটকানো চুলের মাঝেই। তর্জনী ও বৃদ্ধার আলতো স্পর্শে টেনে বের করে অবমুক্ত করল চুলটিকে। ওর ভারী দেহের বিপরীতে যাবীনের দেহভার নিতান্তই পলকা। যেন বাহুতে একটি পাতা উড়ে এসে পড়েছে। সংজ্ঞাহীনাকে সে চাইলেই কোলে তুলে ভেতরে নিয়ে যেতে পারত। বিবেকে বাধা পড়ল। কেননা মেয়েটির ভাই ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে। বলাবাহুল্য, গাড়ির অবস্থা ও বোনের অসাড়তা জাওয়াদকে যুগপৎ বিস্মিত ও বিহ্বল করে তুলেছে।
নিশান্ত চোখের পলক ঝাপটে ওকে শান্ত হতে বলল। জাওয়াদ বুঝল সে ইশারা। এগিয়ে এসে বোনকে পাজাকোলে তুলে নিল দেরি না করেই। বাড়ির সকলের মাঝে তখন সকালের কাজ গুছিয়ে নেওয়ার তাড়া৷ এমন সময় জাওয়াদের কোলে যাবীনকে জ্ঞানহীন দেখে একটা হুলুস্থুল বয়ে গেল স্বাভাবিকভাবেই। জাওয়াদ নিচতলার বসার ঘরের লম্বা সোফায় বোনকে শুয়িয়ে দিল। আফিয়া রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে বললেন,

“কী হলো? মাত্রই তো সুস্থ সবল মেয়েটা বাড়ির বাইরে গেল।”

শাওন তখন স্বামীর ফেলে যাওয়া ব্লেজারটা নিয়ে দোতলা থেকে নামছিল। সিড়িতে নামাবস্থায় প্রিয় বান্ধবীর নির্জীবতা দেখতে পেয়ে ওর মাঝে হড়বড়তা সৃষ্টি হলো। জাওয়াদের চোখ এড়াল না সেটা। নিচে থেকেই সতর্ক করল,
“সাবধানে নামো, শাওন।”

শাওন দৌড়াতে গিয়েও থমকে গেল। সামলে নিল অধীরতা। শাড়ির কুচি আগলে নেমে এসে যাবীনের সামনে নিচু হয়ে বসল। গালে চাপড় দিয়ে বলল,
“কী হয়েছে ওর?”

আফিয়া পানি ছিঁটালেন চোখেমুখে। জাওয়াদ মুঠোফোনে দৃষ্টি রেখে ডাক্তারের নম্বর খুঁজতে খুঁজতে বলল,
“প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে।”

চাঁদনি বেগম আসতে আসতে শুনলেন সব। চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “হঠাৎ কী নিয়ে প্যানিক হলো?”

“হিমোফোবিয়া!” ভরাট স্বরে জবাব দিল নিশান্ত।

চমকে উঠল সকলে। ঘটনার কিছুই বুঝতে পারল না। চাঁদনি বেগম উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“হায় আল্লাহ! সাত সকালে র’ক্ত কই দেখল ও?”

জবাব দিল না নিশান্ত। কথাটা বলা ঠিক হয়নি। নিশ্চিত না হয়ে বাড়ির মানুষকে চিন্তায় ফেলাটা ঠিক হবে না। তার জন্য জাওয়াদের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। তারও আগে প্রয়োজন যাবীনের জ্ঞান ফেরানো। ওর এই রোগ ছোটোবেলাকার। প্রথমবার প্রকাশ পেয়েছিল নিশান্তের সামনেই। ছোটোবেলা থেকেই খেলাধুলায় ভীষণ ঝোঁক নিশান্তের। একবার সাইক্লিং কম্পিটিশনের জন্য টানা প্র‍্যাকটিস করতে হচ্ছিল। দুরন্ত গতিতে ছুটতে ছুটতে আচমকা গতি হারালো। পড়ে গিয়ে হাটুতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হলো। গলগল করে ঝরা র’ক্তে ভিজে গেছিল পা। স্কুল থেকে ফেরার পথে সেই দৃশ্য চোখে পড়ে গেছিল সদ্য কৈশোরের স্পর্শ পাওয়া যাবীনের৷ নিশান্তের বয়স তখন আঠারো। ওদের সম্পর্ক তখন তিক্ত ছিল না। যাবীন ওর অবস্থা দেখে জ্ঞান হারাল সঙ্গে সঙ্গে। নিশান্ত নিজের পায়ের চিন্তা ফেলে আগলে ধরেছিল কোমলমতিকে। সেই প্রথমই জানা গেছিল যাবীনের হিমোফোবিয়া আছে। র’ক্ত দেখলে প্যানিক অ্যাটাক হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷ অবশ্য তখন নিশান্তের মন এই ফুলের মতো পেলব, মসৃণ মেয়েটির প্রতি বিশেষ প্রগলভ ছিল। নারী-পুরুষের আকর্ষণের আদিম যে অনুভূতি তা দ্বারা অনায়াসে আক্রান্ত হয়ে গেছিল বিনা শ্রমেই। কৈশোরের প্রথম আবেগের সতেজ, শুভ্র মনবাগিচায় মেহযাবীন নামের ফুল ফুটেছিল সন্তর্পণে। কিন্তু সেই ফুল এতই কোমল ছিল যে নিশান্ত চেয়েও মনের কথা প্রকাশ করতে পারেনি। সময়ের সাথে যাবীনও একসময় আবেগের স্পর্শ পেল। তবে সেই আবেগ বন্ধুদের প্ররোচনায় বয়ে গেছিল ভিন্নখাতে। সেখান থেকেই সম্পর্কের অবনতি, দূরত্ব, তিক্ততা৷ আজ এতগুলো বছর পর আবারো নিশান্তের বাহুতেই জ্ঞান হারালো মেয়েটি। একটু সময়ের জন্যও কি প্রথম আবেগ তখন উঁকি দিয়েছিল! নাকি পরবর্তী জীবনের প্রবাহিত তিক্ততা এতটাই মোটা পর্দা ফেলেছে যে তা ভেদ করে সেই কৈশোরের আবেগ আর তারুণ্যে পৌঁছাতে পারে না!

আফিয়া ও শাওনের ঐকান্তিক চেষ্টায় মিনিট পাঁচেক বাদেই হুশ ফিরল যাবীনের। ঘোলা চোখ মেলে প্রথমেই নিজের অবস্থান নিয়ে বিভ্রম হলো ওর। চেনা মানুষদের নিকটে পেয়ে ভরসা পেল দিশাহারা মন। জাওয়াদ বোনের গালে হাত রেখে স্নেহসিক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“মিহা, ঠিক আছিস?”

যাবীন ঠিক নেই। গাড়ির দৃশ্যটার কথা মনে হতেই পুনরায় দুচোখে উৎকণ্ঠা খেলে গেল ওর। ওটা কী সত্যি ছিল! নাকি দৃষ্টির ভ্রম। চঞ্চল দৃষ্টি মেলে জড়ানো স্বরে উচ্চারণ করল,
“ভাইয়া, গাড়িতে…”

জাওয়াদ বুঝতে পেরে মিথ্যা আশ্বাস দিল,
“রিল্যাক্স। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। বি ইজি।”

বললেই তা হলো না। সকলেই জেনে গেল গাড়ির কথা। দ্বীপশিখার প্রফুল্ল শিখাটি অজানা ভয়ে, আশঙ্কায় কেঁপে উঠল তিরতির করে। ঝরো হাওয়ায় কম্পিত পল্লবের মতোই টলতে লাগল সকলের হৃদয়।

নিশান্ত ভালোমতো গাড়িটা পরখ করেছে। রক্ত তাজা। অর্থাৎ ঘটনা বেশিক্ষণের নয়। গাড়ির পেছনের কাচ নামানো ছিল বলে অনায়াসে কেউ কাণ্ডটা করে গেছে। কিন্তু দ্বীপশিখায় ঢুকে এতবড়ো কাজটা করে যাওয়ার সাহস কার হলো? প্রথমেই যেটা মাথায় এলো তা হলো সিসিটিভি ফুটেজ। নিশান্ত লম্বা লম্বা পা ফেলে নিজরুমে ঢুকে ল্যাপটপ নিয়ে বসল। সিসিটিভি ফোকাস মূলত সদর দরজা ও রাস্তা সংলগ্ন মূল গেইটের দিকে। ফলে ভবনের একপাশে ছাউনিঘেরা বানানো গ্যারেজটা ক্যামেরার দৃষ্টিসীমার বাইরে পড়েছে। আধঘণ্টার মাঝে পত্রিকা বিলি করা লোক ছাড়া আর কেউ সদর দরজা মাড়ায়নি। আর এখানেই একটা জিনিস চোখে লাগল। পত্রিকা দিতে এসে লোকটা কিছুক্ষণের জন্য ফুটেজের বাইরে চলে গেছিল। অর্থাৎ গ্যারেজের দিকে! নিশান্ত ভিডিও জুম করল। কিন্তু লোকটার মাথায় ক্যাপ। মুখটা বিশেষ বোঝা গেল না। সন্দেহের কটূ গন্ধ রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে গেল ওর। নিচে নেমে প্রথমে খোঁজ নিল কোন লোক পত্রিকা বিলি করে৷ তার ফোন নম্বর টুকে নিল সঙ্গে সঙ্গে। লাইসেন্স করা রিভলভারটা শার্টের তলায় প্যান্টের পকেটে গুজে বাড়ি থেকে বের হলো। গ্যারেজের কাছে গেল পুনরায়। গাড়ির চারপাশ পরখ করে একবার চৌকস দৃষ্টিতে চারিদিক নিরীক্ষণ করে নিতে ভুলল না। উঁচু ও কাচ গাঁথা প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢোকা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। অর্থাৎ সকল সন্দেহ এখন তীরবেগে ধেয়ে যাচ্ছে পত্রিকা দিতে আসা লোকটার দিকেই।
_______________

শোভার এক্সিডেন্টের রেশ কাটতে না কাটতেই এই নতুন উপদ্রব আজাদ ও শেখ দুই বাড়িকেই নাড়া দিয়েছে। কারণ কাণ্ডটা জাওয়াদের গাড়িতে ও আজাদদের বাড়ির সীমানায় ঘটেছে। বিরূপ প্রভাব পড়েছে শেখ বাড়ির আদরের কন্যা যাবীনের ওপর। শিরীন বেগম দুর্বল যাবীনকে গরম দুধ খাইয়ে দিচ্ছিলেন। শোভা পাশে বসে আছে। এমন সময় কোথা হতে ছুটে এলো টফি। শোভা ও যাবীনের সামনে এসে সে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। শোভা চোখ কটমট করে বলে,
“এই তুই আমার বাড়িতে কেন ঢুকেছিস? আবার আমার ওপর গলাবাজি করিস!”

টফির মাঝে কিছুটা উত্তেজিত ও ছটফটে ভাব। যেটা ওর বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যায় না। টফি বেশ শান্তশিষ্ট এক কুকুর। শোভা অবাক হলো এই আচরণ দেখে। টফি ওর জামা কামড়ে ধরে বারবার টানছে। শোভা ওর মনের ভাব বুঝল অনায়াসে। পিছু নিতেই টফি ছুটতে লাগল বাড়ির বাইরের রাস্তা ধরে। কিছুদূর এগোতেই দুটো বাড়ির মধ্যবর্তী স্থানে এসে থামল টফি। একটা বিড়ালের মৃ’তদেহ পড়ে আছে সেখানে। শোভা থমকে যায়, বিড়ালটা ওর চেনা। গতকালও না গেইটের সামনে বসে এটাকে মাছ খাইয়েছিল! আর আজ সে ম’রে পড়ে আছে? শোভার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ল। কে করল এই নিষ্ঠুর কাজ? হাতে তুলে নিয়ে দেখল বিড়ালের দেহে ক্ষত আছে কিন্তু র’ক্ত নেই। যেখানে ফেলা হয়েছে সেখানেও না। যেন সব র’ক্ত চিপে বের করে নেওয়া হয়েছে।
শোভার মাথায় বিদ্যুতের গতিতে একটা ভাবনা খেলে গেল। কেউ কী ইচ্ছে করে বিড়ালের র’ক্ত ছিটিয়ে দিয়েছে জাওয়াদের গাড়িতে! তার উদ্দেশ্যটা কী!

চলবে…
এইটুকুই পারলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here