প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২০] প্রভা আফরিন

0
342

প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২০]
প্রভা আফরিন

নিশান্তকে সকাল সকাল বেরোতে হয়েছিল একটা মেডিকেল চেকআপের জন্য। গত শান্তিরক্ষী মিশনে তার পিঠের শিরদাঁড়ার নিচের দিকে আঘাত লাগায় গুরুতর আহত হয়েছিল সে। ডাক্তার নির্দেশ দিয়েছিল পুরোপুরি না সাড়া অবধি মেজর কোনো অপারেশনে যুক্ত না হতে। মূলত এবারের লম্বা ছুটির পেছনে এই কারণটাও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বিশ্রাম আর হচ্ছে কই! একের পর এক ঘটনায় শরীর-মন উভয়ই ছুটে চলেছে। এরই মাঝে প্রতিরক্ষা অধিদপ্তরের সিক্রেট টিমে জয়েন হবার প্রস্তাব ওর কাছে বিরাট এক সম্ভাবনা। কিন্তু সেখানে যুক্ত হবার আগে ফিটনেস এনশিওর করা মাস্ট। তাই সবকিছুর মাঝেও নিজের শরীরের দিকে বিশেষ নজর দিতে হচ্ছে ওকে।
নিশান্ত সিএমএইচ হসপিটালের উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল। পথিমধ্যে শেখ বাড়িতে তাকে থামতে হলো। চাঁদনি বেগম শাওনের রিসেপশনের জন্য দাওয়াতের কার্ডের কিছু কালেকশন পাঠিয়েছেন। শেখ বাড়ি থেকে অনুমোদন পেলেই ছাপাতে অনুমোদন দেবেন। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমেই নিশান্তের চোখের মণিতে আটকা পড়ল মেহযাবীন। একহাতে ফুলের তোড়া এবং অপর হাতে চিঠি আগলে যে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশান্ত কালো রোদ চশমা চোখ থেকে নামিয়ে নেভি শার্টের বুকের কাছটায় ঝুলিয়ে রাখল। যাবীনকে আপাদমস্তক জরীপ করে বলল,
“ফুল বেচতে দাঁড়িয়ে আছো নাকি?”

সুন্দরী বলে পরিচিতমহলে মেহযাবীন বরাবরই নন্দিত এক নারী। এ নিয়ে তার যে কিঞ্চিৎ দম্ভ হয় না, তা বললে বোধহয় ভুল হবে। মানুষের সহজাত স্বভাবই হলো প্রশংসা পেতে ভালোবাসা। আর নারী তার রূপ ও গুণের প্রশংসা পেতে বরাবরই একটু বেশি ভালোবাসে। ভার্চুয়াল ভাষায় ফ্যান ফলোয়ার কিংবা প্রেমের ভাষায় অনুরাগী নেহাত অভাব হয়নি জীবনে। কিন্তু একটি বড়ো ভাই থাকার দরুন বাড়ি বয়ে কেউ কোনো গিফট, ফুল কিংবা প্রেম নিবেদন পাঠানোর সাহস পায়নি। আবার কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনন্তের মতো হাঙ্গামাপ্রিয় বন্ধু ছিল বলে কেউ উত্যক্ত করার সাহস পেত না।
এতগুলো বছরেও যা ঘটেনি তা আজ এই আশ্বিনের ফুরফুরে সকালে হঠাৎ বয়ে যাওয়া চৈত্রের দমকা হাওয়ার মতো ঘটে যাওয়ায় যাবীনের চিন্তার দ্বারে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। কেন জানি মনে হলো, যে এই ফুল ও চিঠি প্রেরণ করেছে সে এমন কেউ যাকে যাবীন চেনেই না। অথবা চেনে, কিন্তু সেই ব্যক্তিটা আড়ালে থাকতে চাইছে।

আকস্মিক ঘটনার বেগ সামলে ওঠার মাঝেই পুরুষালি গুরুগম্ভীর স্বর যাবীনের কর্ণকুহরকে আন্দোলিত করল। চমকে উঠে ভারসাম্য হারিয়ে হাতের চিঠিটা পড়ে গেল মেঝেতে। নিশান্ত এতক্ষণে খেয়াল করল একটা চিঠিও আছে। সেটা তুলতে গিয়ে এক পলকের জন্য চোখ বুলিয়েই ভেতরের কয়েক শব্দের লেখাটা পড়ে ফেলল। যাবীন অপ্রস্তুত হয়ে নিশান্তের হাত থেকে ছো মেরে কাগজটা নিয়ে নিল। আমতাআমতা করে বলল,
“কিছু বলছিলেন? আপনি এখানে? হঠাৎ?”

নিশান্ত প্রথমে ঘটনা না জেনে কথাটা বলেছিল। এখন চিঠি ও তার বাক্য দেখেই ঘটনা আন্দাজ করতে সক্ষম হলো। এক ভ্রু উঁচিয়ে, বিষাক্ত তীরের ন্যায় চোখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন করল,
“কেন? অসুবিধা হলো নাকি?”

“আপনিই তো আস্ত অসুবিধা।” খুব করে বলতে ইচ্ছে হয় যাবীনের। কণ্ঠটা কেন যে শব্দশূন্য হয়ে যায়! ঠিক কোন ভাগ্যদোষে ওর জীবনের বিব্রতকর কিংবা একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তে এসে এই লোক হাজির হয় এই সমীকরণ সদা ভালো ফলাফল করা ছাত্রীর আজও অজানা। মনোভাব লুকিয়ে বলল,
“অসুবিধা কেন হবে? বাড়ির ভেতরে যান। আমি ক্যাম্পাসের জন্য বেরিয়েছি।”

“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। সকাল সকাল রোজ ডে পালিত হচ্ছে!”

নিশান্তের কথাটা অনুধাবন করে যাবীন ভড়কে যাওয়ার পাশাপাশি কিঞ্চিৎ বিরক্তও হলো। একটা মানুষের কণ্ঠ এমন ব’ন্দুকের মতো কেন হবে? মুখ খুললেই কেন বুলেটের মতো ছুঁচালো কথা বের হবে? জবাব দিলো,
“ফুলের জন্য ডে লাগে নাকি! ফুল সবসময়ই স্পেশাল।”

“আর ফুলদাতা?”

“আরো বেশি স্পেশাল।” সগৌরবে উত্তর দিলো মেহযাবীন।

নিশান্ত নীরবে কিছুক্ষণ দৃষ্টিপাত করে ওর সামনে থেকে চলে গেল। যাবীনের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হলো। এই ফুল কে দিয়েছে ও জানে না, কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে দেওয়া তা সহজেই অনুমেয়। এই ডাকাবুকো মিলিটারি যদি মায়ের কাছে ফুলের কথা বলে বসে! পাস্ট রেকর্ড অনুযায়ী বিচার দিতে তার জুড়ি নেই। যাবীন ব্যাপারটা অনুধাবন করে তাকে থামাতে ফুলের ডালাটা নিশান্তের গাড়ির ওপর রেখে উলটো হাঁটা ধরল। নিশান্ত ততক্ষণে লম্বা লম্বা পা ফেলে সদর দরজায় পৌঁছে গেছে। যাবীন ধাওয়া করে যেই না নিকটে পৌঁছে গেল, অমনি সুমা এসে দাঁড়িয়েছেন ওদের সামনে। অসময়ে নিশান্তের আগমন আর মেয়েকে পুনরায় ফিরতে দেখে উনার কপালে ভাজ সৃষ্টি হয়।
নিশান্ত সালাম দিলো উনাকে। সুমা সালাম নিয়ে বললেন,
“কেমন আছো, নিশান্ত?”

নিশান্ত বিনীত স্বরে বলল,
“ভালো আছি, আন্টি। দাদি ইনভাইটেশনের কার্ড পাঠিয়েছিল। আপনাকে সিলেক্ট করতে বলেছে। সেগুলোই দিতে এসেছিলাম।”

“ভেতরে এসে বসো।”

নিশান্ত মাথা দুলিয়ে একবার অবজ্ঞায় পাশের ভীত রমনীকে দেখে সম্মুখের সোফায় গিয়ে বসল। সুমা মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমার ভার্সিটি যাওয়ার কথা ছিল না?”

যাবীন কানের পিঠে চুল গুজে ইতস্তত করে বলল,
“বেরোচ্ছিলাম কিন্তু কার্ডের কালেকশন দেখতে ফিরলাম।”

সুমা আর কিছু বললেন না। বেছে চারটে কার্ড পাঠানো হয়েছে। সেগুলো দেখে যাবীনের পছন্দ হলো না। মুখ কুচকে বলল,
“ডিজাইন কমন। তারচেয়ে কাস্টমাইজড করে নিলে বেটার হয়। দাওয়াতের ঐতিহ্য অনুযায়ী পানপাতা আঁকা একটি ঐতিহ্যবাহী কার্ড করা যায়।”

সুমা বললেন, “দায়িত্বটা তুমি নিলেই পারো।”

“আমি?”

“যেরকমটা ভাবছো তার একটা স্যাম্পল তৈরি করে আমাদের দেখাও।”

যাবীন মাথা নেড়ে বলল, “চেষ্টা করব।”

সুমা রান্নাঘরে গেলেন নিশান্তের জন্য নাশতা তৈরি নির্দেশ দিতে৷ সেই ফাঁকে যাবীন চাপা স্বরে বলতে লাগল,
“শুনুন, যে ফুলগুলো আমার হাতে দেখলেন ওগুলো কে দিয়েছে আমিই জানি না। হুট করে পেয়েছি। আপনি কিন্তু মাকে উলটোপালটা কিছু বলে নালিশ করবেন না। আমি নির্দোষ।”

নিশান্ত ভরাট দৃষ্টিতে নিকটে বসা মেয়েটির চোখপানে চাইল। ঘন পল্লবঘেরা দুই চোখের কোটরে লেপ্টে আছে আশঙ্কা। পেলব গালের রক্তিম ছটা জানান দেয় বিব্রতভাব। কিন্তু একটা কথা কানে গিয়ে লাগল,
“আমি নালিশ করি? নাকি তোমার কথা-কাজে গোলমাল আছে? বলার আগে তো সামান্যতম ভাবো না কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কী বলছো।”
মেহযাবীন নিরুত্তর রইল।

শেখ বাড়ির বাঁধা কাজের লোক জরি ও তানি। তানি রান্নাঘরে নাশতা তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিল। জরিকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ বাদে জরি ফুলের ডালা দুইহাতে আগলে ধরে বসার ঘরে উপস্থিত হলো। নিশান্তকে দেখে বিগলিত হেসে বলল,
“ফুল বাইরে রাইখ্যা আইছো ক্যান? কেউ নিয়া গেলে!”

সুমা ফিরে এসে ভ্রুকুটি করে বললেন, “ফুল কীসের?”

“যাবীন মামণির লইগ্যা আনছে নিশান্ত বাবায়। যাবীন বাইরে থুইয়াই আইয়া পড়ছে। তাই আমিই নিয়া আইলাম।”

যাবীন ও নিশান্ত হতভম্ব হতে একে অপরের মুখ চেয়ে পুনরায় জরি খালার মুখপানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। যাবীন প্রতিবাদ করে বলল,
“আন্দাজে কথা বলো কেন, জরি খালা? ফুল উনি কেন আনবে?”

“তুমি বাইর হওনের পরেই তো নিশান্ত আইলো। আর তো কাউরে দেখলাম না ফুল নিয়া আইতে। উপরতলায় ঝাড়ু দেওনের সময় দেখলাম ফুল লইয়া খাঁড়াইয়া দুইজনে কথা কইতাছো।”

“ফুল ডেলিভারি বয় দিয়ে গেছে। কে পাঠিয়েছে জানি না। না জেনে অহেতুক কথা বলবে না। দেরি হয়ে যাচ্ছে। গেলাম আমি।”
রেগেমেগে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল যাবীন। তাকে ও নিশান্তকে ঘিরে একের পর এক বিব্রতকর পরিস্থিতি এবার সত্যিই আর মেনে নেওয়া যাচ্ছিল না।

যাবীন গাড়িতে উঠে বসতেই নিশান্তকে বেরোতে দেখা গেল। তার কোনো বিকার নেই দেখে যাবীনের রাগটা কেন জানি আরেকদফা বেড়ে গেল। নিশান্ত গাড়ির কাছাকাছি আসতেই ও ক্ষোভের সঙ্গে বলল,
“আপনি একটা কুফা। আশেপাশে এলেই ঝামেলা হয়।”
_____________

শেখ টেক্সটাইলের অফিসে আজ বিশাল ব্যস্ততা। সুলতান শেখ ও জাওয়াদ শেখ বিদেশি মেহমানের সঙ্গে কনফারেন্স করছেন। আগামী মাসের শুরুতেই জাওয়াদকে জার্মানি যেতে হবে। সেখানকার স্বনামধন্য বায়ার ব্র‍্যান্ডগুলোর সঙ্গে কনফারেন্স এটেন্ড করতে হবে। কনফারেন্সে নিজের পরিকল্পনা ও কাজের নমুনা উপস্থাপন করে তাদের ইমপ্রেস করতে সক্ষম হলে ডিল কনফার্ম করে জাওয়াদ জার্মানি থেকে চায়না যাবে মেশিন কেনার জন্য। সব মিলিয়ে সামনে একটা বিরাট কাজের চাপের পাশাপাশি নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে চলেছে। তাতে করে শেখ টেক্সের প্রসার ও সুনাম বেড়ে যাবে অনেকটা। সুলতান শেখ কিছুতেই তা হাতছাড়া হতে দিতে নারাজ। প্রতিপক্ষরাও চেষ্টা করবে ডিলটা ভেস্তে দিয়ে তাদের অনুকূলে নিতে৷ তাই বাড়তি যত্ন দিচ্ছে পিতা-পুত্র।

কনফারেন্স থেকে বেরিয়ে জাওয়াদ তার সফরের ডেট দেখল পুনরায়। রিসেপশনের পর হানিমুনের সময় হবে না নবদম্পতির। আগে যাওয়াও সম্ভব নয়। অফিসের কাজ গুছিয়ে নিতে হবে এ কয়দিনে। শাওন কী রাগ করবে? পরক্ষণেই মাথায় এলো কিছুদিন বাড়িয়ে বিজনেস ট্যুরকেই হানিমুন ট্যুর বানিয়ে ফেলা যায়। শাওনের ভিসার খোঁজ নিতে হবে। জাওয়াদ ফোন বের করল। লকস্ক্রিনে ভেসে ওঠা প্রাইভেট নম্বরটি দেখে তার জোছনারাঙা মনে অমাবস্যা নেমে এলো। জাওয়াদ তার অফিসকক্ষে ঢুকে ডোর লক করে সেই প্রাইভেট নম্বরে ফোন দিল। শক্ত গলায় বলল,
“আপনার উদ্দেশ্যটা কী?”

“আমি তো জানতাম আপনি ভীষণ চতুর, মি. শেখ। চতুর না হলে এভাবে গোপন পাপ ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে এখন আমার উদ্দেশ্য ধরতে না পারার মতো বোকা হলেন কীভাবে?” ওপাশ থেকে ব্যাঙ্গাত্মক হাসির শব্দ এসে ধাক্কা দিলো স্পিকারে।

জাওয়াদ ঠান্ডা মাথায় সরাসরি জানতে চাইল,
“আমার থেকে কী চান?”

“এবার বুদ্ধিমানের মতো আচরণ করছেন। আর বুদ্ধিমানেরা অহেতুক কথা বলে সময় নষ্ট করে না। লেটস মেইক আ ভেরি সিক্রেট ডিল…”
_____________

শোভার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ইভেন্টের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ওরা ক্যাট, ডগলাভার রিলেটেড গ্রুপগুলোতে প্রচারণা করে অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ইভেন্টের অংশগ্রহণকারীদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সাড়াও মিলছে প্রচুর। শোভা এখনো ইভেন্ট প্রস্তুতির কাজে যোগ দিতে পারেনি নিজের এক্সিডেন্টের জন্য। ইংলিশ আন্টিকে পটিয়ে ডোনেশন বের করা বাকি। ওদিকে নিশান্ত ওদের ওপর পাহারা বসিয়েছে। সব মিলিয়ে মেয়েটার দিন-কাল পানসে হয়ে গেছে। পানসে সময়ে একটু চিনি মেশাতে শোভার প্রিয় জ্যন্ত মতিচুর অর্থাৎ হোয়াইট হাউজের ইংলিশ বয়কেও পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে মা তার দেখভালের জন্য অফিস ছেড়ে ছুটি নিয়েছেন। অতি যত্নে বিরক্তি ধরে গেছে যেন।

দুপুরের পর বাড়িটা নিস্তেজ হয়ে যায়। সকলেই নিজঘরে বিশ্রাম নেয়। শোভা সেই সময়টায় বিড়ালপায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সদর দরজা খুলতেই আকস্মিক চিকন স্বরের কুকুরের ডাক ওকে চমকে দিলো। শোভা লাফিয়ে উঠে বুকে থুতু দিয়ে দেখে টফি জিভ বের করে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে বসে আছে। শোভা ঝুঁকে এসে ওর মুখ চেপে ধরে। বাড়ির ভেতর চোখ বুলিয়ে চাপা গলায় গজগজ করে বলল,
“হোয়াইট হাউজের হট ডগ, তুই আমার বাড়ির দরজায় কী করতে এসেছিস?”

শোভার হাতের ভেতর বন্দি হয়ে টফি হুটোপুটি শুরু করেছে। দরজা খোলা পেলেই পালিয়ে যাওয়া টফির অতি প্রিয় কাজ। শোভারও তাই। তাই ওকে বকতে পারল না। তবে হোয়াইট হাউজে আবারো আলোড়ন সৃষ্টি করার একটা কারণ পেয়ে গেল। দিলশানকে এখন বাড়িতে পাওয়া যাবে না শোভা জানত। দুষ্টু ফন্দি ভর করল মাথায়। তাই টফির জন্য একটা চিকেন ফ্রাই কিনল বাড়ির পাশের মিনি ফুডকোর্ট থেকে। সেটার লোভ দেখিয়ে টফিকে নিয়ে সোজা হোয়াইট হাউজের উলটো দিকে হাঁটা দিল সে।

প্রায় আধঘন্টা পর সুলেখার চিৎকার চ্যাঁচামেচি শোনা গেল বাড়ির সামনে। টফিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্বামী-সন্তান সারাদিন বাড়িতে থাকে না, তাই একটা অবলা প্রাণ নিয়েই উনার অবসর কেটে যায়। দুপুরে মতিন মিয়াঁর বউকে দিয়ে মাথায় হেয়ারপ্যাক লাগিয়ে ঘণ্টাধরে গোসল করেছেন তিনি। ফেরার পর টফিকে খেতে দিতে গিয়ে দেখেন ছানাটা বাসায় নেই। দরজা আলগা পেয়ে কোনফাঁকে বেরিয়ে গেছে মতিন মিয়াঁ ও তার বউ বলতে পারে না। সুলেখা সেই থেকে চ্যাঁচামেচি জুড়েছেন। মতিন মিয়াঁ হন্তদন্ত হয়ে চারিদিকে খোঁজ চালিয়েছে। আরো বিশ মিনিট পর শোভা হাঁপাতে হাঁপাতে এলো হোয়াইট হাউজে। ইংলিশ আন্টির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কাঁদবেন না আন্টি, আমি ধরে এনেছি তার কানটি।”

ইংলিশ আন্টির প্রেশার বেড়ে গেছিল। তিনি টফিকে পেয়ে শান্ত হলেন। দেখলেন টফির হাতে-পায়ে মাটি, শোভারও তাই। তবে এতক্ষণ বাড়ির বাইরে থেকে টফির চিন্তা নেই। আয়েশে জিভ দিয়ে নিজের শরীর চাটছে। ইংলিশ আন্টি বললেন,
“এটাকে কোথায় পেলে শোভা?”

শোভা রহস্য করে বলল,
“সে এক দুর্গম অভিযানের গল্প। আপনার চোখের জল সইতে না পেরে পাহাড় বেয়ে, খাদ ডিঙিয়ে, ঘন অরণ্যের মাঝে খুঁজে বেরিয়েছি টফিকে।”

মতিন পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে গল্প শুনে বোকা হয়ে বলল, “এই শহরে এইরকম বনঝোপ আছে?”

“অবশ্যই। গাছাপালার জঙ্গল হলো প্রাকৃতিক বন। আর শহর হলো মানুষের তৈরি বন। অট্টালিকা হলো এর পাহাড়, ভাঙা রাস্তা হলো উঁচু-নিচু খাদ এবং জীবজন্তু হলো আমরা মানুষরা। আমাদের মাঝেই হিংস্র, কোমল উভয় প্রাণীর বাস। আমি এই বিপদজনক বনে অভিযান চালিয়ে টফিকে খুঁজে বের করেছি। কিছুদিন আগে এক্সিডেন্ট করে আমি ভেঙেচুড়ে গেছি। শরীরের ব্যথা ভুলে আমি টফির জন্য দৌড়েছি।”

ইংলিশ আন্টির মন তরলে রূপান্তরিত হলো যেন। তিনি শোভাকে বসতে দিয়ে বললেন,
“তোমাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব শোভা…”

শোতা আহত স্বরে বলল,
“আহ আন্টি! ভালোবাসায় সৌজন্যতা একদম নিষিদ্ধ। আমরা কুকুর-বিড়াল ভালোবাসি বলেই জীবনের ঝুঁকি নিতে পরোয়া করি না।”

“তুমি খুব ভালো মেয়ে, শোভা।”

“আপনিও খুব ভালো, আন্টি। আমি জানি আপনার একটি পশু প্রেমী মন আছে। তাইতো টফিকে এত ভালোবাসেন। এরকম শত শত টফিকে ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে আপনি ডোনেশন দেবেন জানি। আপনার এই সুন্দর মানসিকতার জন্যই আমাদের নেক্সট ইভেন্টের একজন সম্মানিত গেস্ট হতে যাচ্ছেন আপনি। সভাপতি বানিয়ে দেব আপনাকে।”

শোভা শুধু মিষ্টি কথায় ভুলালোই না, এক ঘণ্টার মাঝে ব্যাংক ট্রান্সফারও করে নিল। এরপর তার নিস্তার পাওয়ার কথা থাকলেও সুলেখা দিলেন না। নিজের হাতে স্যুপ তৈরি করলেন অসুস্থ মেয়েটির জন্য। সেদ্ধ করা চিকেনসহ হাড়-গোড় গেল টফির পাতে, আর চিকেন স্টক দিয়ে বানানো পুদিনা ফ্লেভারের স্যুপ গিলতে হলো শোভাকে। দিলশান ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফিরে দেখল তার মা যত্ন করে শোভাকে খাইয়ে দিচ্ছে। ও অবাক হয়ে বলল,
“কী হয়েছে?”

শোভা ইংলিশ আন্টির আড়ালে চোখ টিপে বলল, “শেয়াল এসে মুরগী খেয়ে ফেলেছে। শেষপাতে মিষ্টিটাও জুটে যাবে ভাবিনি!”

চলবে…
ভুল পেলে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here