স্রোতস্বিনী #মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা পর্ব ২৬

0
303

#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ২৬

গাড়ি এসে থামে সুউচ্চ কয়েকটি ভবনের সামনে।বিশাল এলাকা নিয়ে এই হসপিটাল। সূর্য তখন মাথার উপর নিজের দাপট দেখাতে ব্যস্ত।অফিসারদের অনুসরণ করতে করতে সবাই চলে যায় আইসিইউতে।করিডোরে কয়েকজন গার্ড আর কয়েকজন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে।হাসপাতালের এই পাঁচতলার এই দিকটা সম্পূর্ণ খালি করা হয়েছে।অফিসার,গার্ড,ডক্টর এবং নার্স ছাড়া সাধারণ মানুষের আনাগোনা নিষেধ।

স্রোত গিয়ে দাঁড়ালো দরজার বাহিরের উপরের দিকের ছোট গোল গ্লাসটার সামনে।যেখান থেকে ভেতরে মেহরাদের ঘুমন্ত মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।মেহরাদের শরীরে এতো ব্যান্ডেজ দেখে স্রোতের বুকে যেনো রক্তক্ষরণ শুরু হলো।সে চোখ ফিরিয়ে নিলো।তার সহ্য হচ্ছে না।সে তার প্রেমিকপুরুষকে এই অবস্থায় দেখতে পারছে না।একবার মনে হচ্ছে মেহরাদের এমন করুণ অবস্থা দেখার আগে আমার চোখগুলো অন্ধ কেন হলো না!আবার মন চাচ্ছে এক ছুটে মেহরাদের বুকে হামলে পরতে।স্রোত সরে গেলো দরজার সামনে থেকে।একে একে পরিবারের সকল সদস্যরাই মেহরাদকে চোখের দেখাটুকু দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

স্রোত করিডোরে অবস্থিত বেঞ্চে বনলতা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।বনলতা বেগম বললেন,
“এমন পরিস্থিতিতে আমি অনেকবার পরেছি স্রোত।এইবার তোমার পালা,ধৈর্য্য ধরো।”

এসে থেকে দেখে যাচ্ছে ডাক্তার এবং নার্স ভেতরে কথা বলছে।কিন্তু কেউ বের হচ্ছে না।কারো থেকে কিছু জানতেও পারছে না।মেহরাদের অবস্থার কি অবনতি ঘটলো!
ভাবনার মাঝেই ডাক্তার বের হলে স্রোত তার দিকে এগিয়ে যায়।উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
“স্যার পেশেন্টের কি অবস্থা এখন?”
“সিচুয়েশন ক্রিটিকেল,ডেটেরিওরেট করছে।হার্টের পাশ দিয়ে গু লি যাওয়ায় অনেক কমপ্লিকেশন তৈরী হয়েছিলো।কাল বিকালে অপারেশন করা হয়েছে।অপারেশন থিয়েটারেই আমরা রোগীতে হারাতে বসেছিলাম।তবে মিরাকল হলো,অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।কিন্তু!”

এ জায়গায় এসে থেমে যায় ডক্টর।তার চেহারায় চিন্তার ছাপ।স্রোত বললো,
“কিন্তু কি স্যার?থেমে গেলেন কেনো?”
“পেশেন্টের এখনো সেনস্ ফেরে নি।”

কথাটা যেনো করিডোরে বজ্রপাত সৃষ্টি করলো।সবাই আতকে উঠলো।
“কি বলছেন স্যার?”আতকে উঠে বলে স্রোত।
” হ্যাঁ!পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ায় মাথায়ও সামান্য আঘাত লেগেছে।হার্টের কমপ্লিকেশনের জন্য ব্লাড সার্কুলেশন, অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গেছে।যেকোনো সময় হার্টের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে।এখন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ কিছু করতে পারবে না।হায়াতমত সৃষ্টিকর্তার হাতে।আপনারা প্রে করুন যাতে করে অপারেশন থিয়েটারের মতো আরেকটা মিরাকল ঘটে।”

রৌদ্রজ্জ্বল আকাশটাকে যেনো মুহুর্তের মধ্যেই কালো মেঘ ঘিরে ফেললো।এতোক্ষণ শক্ত হয়ে থাকা মায়ের মনও কেঁদে উঠলো।কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন বনলতা বেগম।তার পাশে মাহিরা বসা,মাকে আগলে ধরলো। তার চোখেও জল,তাদের ভাই-বোনের সম্পর্কটা সবসময়ই অন্যরকম ছিলো।ভাই-বোন কম,বন্ধু ছিলো বেশি।এখন সেই ভাইরূপী বন্ধু মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে।কাঁদলো না শুধু স্রোত।মেহরাদকে দেখার পর থেকেই তার ভেতর এক অদ্ভুত শক্তির উদয় হয়।কাঠিন্যতা আবার তার খোলসে রূপান্তর হয়।
সে ডক্টরকে বলে,
“স্যার পেশেন্টকে দেখা যাবে?”
“নাহ!এখন আমরা কাউকে এলাউ করতে পারবো না।”
“স্যার আমি মেডিকেল ফাইনাল ইয়ার স্টুডেন্ট,স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ।আমার ফাইনাল প্রফেশনাল এক্সাম চলছে।আমি ভেতরে গেলে আশা করি সমস্যা হবে না,বরং হেল্প হবে!”
ডাক্তার অবাক হলেও ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“এটা তো তোমার আগে বলা উচিত ছিলো।তাহলে এতোক্ষণ বাহিরে বসে থাকতে হতো না।তুমি যাও ভেতরে।তোমার উপর কিন্তু আমি সম্পূর্ণ ভরসা করলাম।”

তারপর ভেতরের নার্সকে ডেকে স্রোত সম্পর্কে সব বলে এবং জানায় যে সে আইসিইউতেই থাকবে।

বাাড়ির বাকি সবাই যারা এসেছিলো সবাই চলে যায় মেহরাদের ফ্ল্যাটে,এখানে থেকে ভীড় করে লাভ নেই।এতো মানুষ এখানে থাকা যাবে না।তারা বিকেলের দিকেই ঢাকায় রওয়ানা হবে।শুধু মাহিরা, বনলতা বেগম আর স্রোত থেকে যাবে।এখন হাসপাতালে শুধু বনলতা বেগম আর স্রোত আছে।বনলতা বেগম বসে আছেন জায়নামাজে।

ডাক্তার চলে গেলে স্রোত নার্সের পেছন পেছন আইসিইউর ভেতরে প্রবেশ করে।তার পা যেনো নড়তে চাচ্ছে না,হাত পা অবশ হয়ে আসছে,শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে এই প্রথম সে এমন একটা কেবিনে প্রবেশ করেছে।কিন্তু তার জীবনের সহস্রাধিক ঘন্টা,লক্ষাধিক মিনিট সে হাসপাতালের কেবিনে,ওয়ার্ডে,আইসিইউতে কাটিয়েছে।এই সব যন্ত্রপাতি,এই রুম সব তার অতিপরিচিত। কিন্তু আজ সব নতুন লাগছে,অচেনা লাগছে।সে কখনো ভাবতেও পারেনি ক্ষণসময়ে হয়ে যাওয়া তার অতিপ্রিয় মানুষটার জন্য তার এই রুমে প্রবেশ করতে হবে।সে ধীর পায়ে মেহরাদের বেডের সামনে দাঁড়ায়।অপলক চেয়ে থাকে তার দিকে।কত যন্ত্রপাতি ঘিরে আছে তাকে।মানুষটা মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে।

নার্স স্রোতকে থাকতে বলে চলে যায়।স্রোত একটা চেয়ার টেনে মেহরাদের পাশে বসে।ক্যানোলা লাগানো হাতটায় আলতো করে স্পর্শ করে।মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়।চোখ দিয়ে অজান্তেই অনিচ্ছায় জল গড়িয়ে পড়ছে।মানুষটার সামনে সে কাঠিন্যতা ধরে রাখতে পারে না।তার কাঠিন্যতা মেহরাদের সংস্পর্শে এলে মোমের মতো গলে যায়।কি ভেবে যেনো উঠে দাঁড়ালো স্রোত।মেহরাদের উন্মুক্ত কপালে অনেক সময় নিয়ে গাঢ় করে ঠোঁট ছোয়ালো।তারপর চোখে,নাকে,গালে,থুতনিতে,ঠোঁটে। কতদিনের তৃষ্ণা মেটালো কে জানে!মেহরাদ সজাগ থাকলে নিশ্চিত দুষ্টুমি করে বলতো,
“বউ তুমি আমার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়েছো।তুমি আমার লজ্জাহরণ করছো।ছিহ স্রোত ছিহ।দিস ইজ ভেরি বেড স্রোত।”
এমনটা করেছিলো স্রোত যখন চট্টগ্রামে এসেছিলো।কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙ্গলে নিজেকে মেহরাদের উন্মুক্ত বুকে আবিষ্কার করে।মেহরাদ তখনো ঘুমে।স্রোত মেহরাদের বুকে ভর দিয়ে তার সারা বদন উষ্ণ চুম্বনে সিক্ত করে দেয়।ঠিক ঠোঁট ছোঁয়ার মুহুর্তেই ধপ করে চোখ মেলে তাকায় মেহরাদ।আতকে উঠে স্রোত।সে ছিটকে দূরে সরতে নিলে মেহরাদ তাকে বাহুবন্ধনে আঁটকে ফেলে।দুষ্টুমি করে বলে,
“মেজর মেহরাদ সাদাফের লজ্জাহরণ করছো তুমি?তুমি তার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিচ্ছো?ছিহ স্রোতস্বিনী।”

এমনিতেই চোর চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে তার চেহারা যেমন অবস্থা হয় স্রোতেরও তেমন অবস্থা। এরউপর আবার নিজের স্বামীর লজ্জাহরণের অপবাদ শুনে চোয়াল ঝুলে গেলো। মেহরাদ বাঁকা হেঁসে বললো,
“ইউ হ্যাভ টু বি পানিশড্ স্রোত।”
“অ্যা?পানিশমেন্ট? ” করুণ চোখে চেয়ে বললো স্রোত।

মেহরাদ এবার স্রোতকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে নিজে স্রোতের উপর একটু ঝুঁকে বলে,
“ইয়েস ম্যাম।আপনি চুরি করতে গিয়ে ধরা পরেছেন।পানিমেন্ট তো আপনার প্রাপ্য,পেতেই হবে।আমি দিবো পানিশমেন্ট।আমি অনেক স্ট্রিক্ট রুলস ফলো করি।”

শেষের বাক্যটি গাঢ় স্বরে বলেছিলো মেহরাদ।তারপর ঘরময় স্রোতের হাসি ঝনঝনিয়ে শব্দ তুলছিলো।

পুরনো কথা মনে পরতেই স্রোতের ঠোঁটে হাসি ফুটে।ভিতরটা পু*ড়ছে,বড্ড পু*ড়ছে।অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মেহরাদের সারা বদনে।স্রোত আবার বসলো।মেহরাদের হাত নিজের দু’হাতের আজলে নিয়ে চোখ বন্ধ করে মাথা ঠেকিয়ে রেখে বললো,
“ফিরে আসুন মেহরাদ।আপনার স্রোতস্বিনীর কাছে ফিরে আসুন।আপনার অপেক্ষায় আমার ভিতরটা খা খা করছে।বুকটা ফেটে যাচ্ছে।আরেকবার মিরাকল হোক।”

এভাবে অনেক সময় পার হয়।সময়ের খেয়াল কে রাখে?
স্রোত তখনো হাতে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে।হঠাৎ টের পেলো তার মুঠোবন্দি মেহরাদের হাতের আঙ্গুলগুলো নড়ছে।সে চমকে উঠে।সত্যি সত্যিই নড়ছে,চোখের পাতা নড়ছে।স্রোতের চোখে-মুখে হাসির ঝলক।বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
“অনেক শুকরিয়া আল্লাহ আরেকবার মিরাকল ঘটানোর জন্যে।”

#চলবে….

[সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়েছি নিজেও জানি না।স্টিল বিছানায় শুয়ে শুয়ে লিখে পোস্ট করছি।সকালের খাবার খেতে যাচ্ছি টাটা]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here