প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২২-বর্ধিতাংশ] প্রভা আফরিন

0
167

প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২২-বর্ধিতাংশ]
প্রভা আফরিন

ঘড়ির কাটা টিকটিক করে সকাল দশটার ঘরে এসে পদার্পণ করতেই এলার্ম বেজে উঠল। ঘণ্টা দুই ঘুমিয়ে মেহযাবীনের মন-মস্তিষ্ক ঠান্ডা হবার বদলে ভয়ংকর মাথা ব্যথা সৃষ্টি হলো। বিছানা ছেড়েই আগে তানি খালাকে ডেকে বলল, “করা করে ব্ল্যাক কফি করে দাও, খালা।”

জানালায় সকালের কড়া রোদ এসে উঁকিঝুকি দিচ্ছে। রোদের আভায় সারাঘর আলোকিত। যাবীনের হলদেটে ত্বক সেই রোদের আভায় আরেকটু উজ্জ্বল দেখায়। তানি খালা ঘুম ভাঙা সুন্দরীর অম্লান রূপে মুগ্ধ হয়ে বিজ্ঞের ন্যায় মাথা দুলিয়ে বললেন, “তিতা কপি খাইয়ো না। চামড়ার রং কালা হইয়া যাইব।”

যাবীন খোলা চুলে আঙুল চালিয়ে ঝুটি বাঁধতে বাঁধতে বলল, “কালো হলে কী হবে?”

“পুরুষ মানুষ ফরসা চামড়া ম্যালা পছন্দ করে। ফরসা বউরে ম্যালা সোহাগ করে৷ কালা হইলে দাম দেয় না। বাইরে ছুঁকছুঁক করে।”

যাবীন হতাশ চোখে চাইল। ইতিমধ্যে তানি খালার চোখের কোলে জল জমেছে। মানুষটা দেখতে বেটে, রোগা ও শ্যামলা৷ অল্প বয়সে বাপের ভিটে-মাটি বিক্রি করে যৌতুক দিয়ে উনার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল আরেক গাঁয়ের কামারের সঙ্গে। স্বামী বাসর রাতেই প্রথম বউয়ের মুখ দেখেছিল। আর দেখেই যে কথাটা বলে উঠেছিল, “এ কোন পিশাচিনী গলায় ঝুলাইয়া দিছে!”
তানি তাঁর স্বামীর কাছে অবহেলিত হয়েছিল শুধু গায়ের রঙের জন্য। তাঁর স্বভাব চরিত্র বিশেষ সুবিধার ছিল না। পাড়ার মেয়ে-বউদের আশেপাশে ছুঁকছুঁক করত। তানি এ নিয়ে সামান্য কিছু বলতে গেলেই বেধড়ক মার জুটত কপালে। বিয়ের মাস কয়েক পর একবার কালাজ্বর হয়ে তানির গায়ের রং আরো বেশি কালচে হয়, ওজন কমে পঁয়ত্রিশ কেজি হয়ে যায়৷ শরীরের এমনই বেহাল দশা হয় যে ভারী কর্ম তার দ্বারা আর হয়ে ওঠে না। স্বামী সে অবস্থায় তাঁর থেকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নেয়। তানিকে তাঁর বাপের ঘরে পাঠিয়ে দেয়। শোনা যায় এক সপ্তাহের মাথাতেই নাকি সেই পুরুষ সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করে এনেছিল। এরপর অভাবের সংসারে পেট বাঁচাতে তানিকে তাঁর বাপ শহরে মানুষের বাড়িতে কাজ করতে পাঠায়। কয়েক বাড়ি ঘুরে এই শেখ বাড়িতে উনার আশ্রয় হয়। যাবীনের শৈশবকাল থেকেই তিনি এ বাড়িতে আছেন।

তানির নোনা জলস্রোত বাঁধ ভাঙার আগেই যাবীন এগিয়ে আসে। নিচু হয়ে পেছন থেকে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল, “পুরুষ অনেক প্রকারের হয়। কেউ সুপুরুষ, কেউ বীরপুরুষ, কেউ মহাপুরুষ, আবার কেউ কাপুরুষ। তোমার কপালে একটা কাপুরুষ জুটে গেছিল, খালা। আমাকে কী তোমরা এমন পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেবে যে আমাকে আমার গায়ের রং দিয়ে বিচার করবে?”

জরি খালা ঝাড়ু সমেত ঘরে ঢুকে বললেন, “এমন কাপুরুষ তোমারে বিয়া করব তো দূরে থাক, দুয়ারে পাড়া দিলেও পি’ছা দিয়া দুইডা বারি দিয়া দিমু। তানি আছিল একটা বেক্কল। হেরলইগ্যা জামাইর মা’ইর খাইয়া আইছে। আমি হইলে ওই লুই’চ্চা ব্যাডারে দুইবেলা পি’ছার মুহে রাখতাম।”

তানি খোঁচা দিয়ে বললেন, “এল্লেইগা-ই তো তোর কপালে জামাইর ঘর জুটল না।”

জরি চুপ করে গেলেন। খুবই অল্পবয়সে এক যুবকের প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। ঠিক-বেঠিক না বুঝে সেই যুবকের আশকারায় তার সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। জরিকে বস্তিতে এনে ফেলে রেখে যুবক ওর কানের দুল ও গলার চেইন নিয়ে পালিয়েছিল। এরপর জরি এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে, লোকের বাড়ি কাজ করে টাকা পেয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। উনাকে কেউ গ্রহণ করেনি। ফিরে এসে এখানেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। প্রথম প্রেমের বিশ্বাসঘাতকতার বেদনায় আর কখনো কোনো পুরুষকে ভরসা করতে পারেননি। বিয়েও করেননি। দুই অভাগিনী শেখ বাড়িতেই মিলেমিশে কাজ করে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। এ বাড়িই তাদের একমাত্র আশ্রয়।

যাবীন দুজনের আড়ষ্টতা ভাঙতে বলল, “আমি গোসলে যাচ্ছি। তানি খালা আমার তিতা কফি বানিয়ে দাও। আর জরি খালা আজ আমার চুল শুকিয়ে দেবে। জলদি ঝাড়ু দেওয়া শেষ করো তো।”

গোসল সেরে বেগুনি রঙের মসলিন শাড়ি পরে নিল মেহযাবীন। সঙ্গে সাদা ব্লাউজ। জরি খালা ওর চুল শুকিয়ে দিতে দিতে সে দ্রুত হাতে হালকা মেক-আপ করে নিল। মাঝে হসপিটালে একবার ফোন করে জানল বাবা ভালো আছেন। দুপুরের মাঝেই বাড়িতে ফিরছেন।
যাবীনকে নিতে এলো অনন্ত। ওর সজ্জা দেখে বুকের বা পাশে হাত রেখে বলল, “তুমি রূপের তরী। আমি প্রহরী। বলো সখী, এই প্রহরীকে মজুরি দেবে কীসে?”

মেহযাবীন ভ্রুকুটি করে বলল, “বলো সখা, কী চাও তুমি?”

“গোপন কিছু।” বলে অনন্ত এগিয়ে এলো। কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, “সাইড এফেক্ট ছাড়া ফরসা হওয়ার কোনো মেডিসিনের নাম বলে দে।”

মেহযাবীন ফিক করে হেসে দিলো। বোধহয় গতকালের ঝড়ের পর এই প্রথম সে একটু স্বস্তির হাসি হাসল যেন। বলল, “আজ সবার হয়েছেটা কী! ফরসা-কালো নিয়ে পড়েছে! ফরসা হয়ে কী করবি?”

অনন্ত ঠোঁট উলটে দুঃখী মুখ করে বলল, “আজ শ্যামলা বলে মেয়েরা পাত্তা দেয় না।”

যাবীন সরু চোখে চেয়ে ত্যারচা স্বরে বলল,
“ও আচ্ছা! তুই কারো পাত্তা পাবার আশায় বসে থাকিস যেন?”

অনন্ত কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল, “চল দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। আজ আমার ফুটবল ম্যাচ আছে আবার।”
_____________

যাবীনের প্রেজেন্টেশন মিটে গেল বেশ ভালোমতোই। পেটে খুদার আন্দোলন শুরু হতেই ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায় এসে বসল। ফাইজা ও অনন্ত এলো কিছুটা দেরি করে। ফাইজা ও অনন্ত একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে। অনন্তের সুবাদেই মেহযাবীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। এখন ওরা ভালো বন্ধু। ফাইজা এসেই যাবীনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সমবেদনা জানাল তার বাবার অসুস্থতা শুনে। অনন্ত খাবার কিনে এনে বসেই বলল, “দুই বান্ধবী এক হয়েছেন ভালো কথা। কোনো মেয়েলি আলাপ করতে শুরু করা যাবে না। নয়তো উঠে চলে যাব।”

ফাইজা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “তুই কোন সম্মানিত ব্যক্তি যে তোর জন্য এখন কথাবার্তায় রেস্ট্রিকশন মেনে চলতে হবে?”

অনন্ত তার ড্রিংকের স্ট্রতে ঠোঁট ঠেকিয়ে বলল, “তোর চেয়ে বয়সে দেড় বছরের বড়ো আমি। বয়সের দিক থেকে সিনিয়র। সিনিয়র অবশ্যই সম্মানিত ব্যক্তি।”

“সিনিয়র হয়েও জুনিয়রদের সঙ্গে পড়ছিস। নিশ্চয়ই ফেইল মেরেছিলি কোনো ক্লাসে।”

অনন্ত ক্ষেপে গিয়ে বলল, “আমি আর ফেইল! ও হ্যালো! অনন্ত এতটাও বাজে ছাত্র না। জীবনভর পড়তে পড়তে একবার হাঁপিয়ে গেছিলাম। তাই এক বছর গ্যাপ দিয়ে রেস্ট নিয়েছি৷”

ফাইজা ভেঙচি কেটে বলল, “এক বছর গ্যাপ দিয়ে কিনা রেস্ট নিয়েছে! তুই তো আধুনিক কালের কুম্ভকর্ণ।”

“শাট আপ! এসব রাজ-রাজাদের কারবার। তুই বুঝবি না।”

“আসছে রাজার বংশধর। হুহ!”

“কোনো ঝামেলায় পড়লে তো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে এই রাফিউন আজাদ অনন্তকেই ডাকিস। আমি ছাড়া আর কে আছে তোদের মতো দুই অবলাকে সেইভ করার।”

কথাটা যাবীনের গায়ে লাগল। অনন্তের সাহস নেহাৎ কম নয়, তবে বিচক্ষণতায় ঘাটতি আছে। যাবীন ভ্রুকুটি করে বলল, “মানসিকভাবে উইক হয়ে পড়েছিলাম বলে ভাইয়া তোকে একটু দেখে রাখতে বলেছে কি বলেনি, সেই থেকে শুরু হয়েছে তোর খবরদারি। মনে হচ্ছে এতদিন পথে-ঘাটে চলতে জানতাম না। আজ তুই শেখাচ্ছিস!”

“তুমি আলালের দুলালি। আর দুলালিরা যতই বড়ো হয়ে যাক তারা কেয়ার ছাড়া চলতেই পারে না। তোমাকে কেয়ার না করলে আমার গর্দান যাবে।”

“তোকে আর আমার পেছনে সময় দিতে হবে না। ফুটবল ম্যাচ না কী আছে! সেটাই কর গিয়ে। দেখিস আবার খেলার মাঝে হাঁপিয়ে গিয়ে বলে বসিস না যে একটু রেস্ট করে নিবি। রাজ-রাজাদের খেলা নয় কিনা!”

ফাইজা ও যাবীন হাই ফাইভ দিয়ে শব্দ করে হেসে ফেলল।
_____________

দুপুরেই সুলতান শেখ হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি ফিরে এলেন। জাওয়াদ বাবাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে নিজ কক্ষে এসে শরীর ছেড়ে দিলো। পোশাক না বদলেই শুয়ে পড়ল খাটে। শাওন ওদের সঙ্গেই এসেছে৷ ও খাটে বসে আলতো হাতে স্বামীর কপাল স্পর্শ করল। মৃদু চাপে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “মাথা ব্যথা করছে ভীষণ?”

জাওয়াদ শোয়া অবস্থাতেই শাওনের দিকে নিবিড় হয়ে এসে বলল, “এমন যত্ন পেলে একটু-আকটু মাথা ব্যথাও সই।”

শাওন রক্তাভ হয়ে উঠল। মৃদু কণ্ঠে বলল, “একটা লম্বা ঘুম দাও। সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।”

“ক্লান্তি দূর করার উপায় বললেই ছুটি পেয়ে যাবে ভেবেছো?” জাওয়াদ স্ত্রীর উরুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল, “এসেছো নিজের ইচ্ছেয়, ছুটি পাবে আমার ইচ্ছেয়।”

“বাবা-মা কী ভাববে? আমার উচিত একটু তাদের সময় দেওয়া। বাড়ির সবাই দুর্বল হয়ে গেছে।”

“আমার দুর্বলতা চোখে পড়ে না না?” অনু্যোগ করল জাওয়াদ। আজ তার কথাবার্তা একটু বেশিই এলোমেলো লাগছে যেন। শাওন বুঝে গেল তার নিস্তার নেই। কোনো জবাব না দিয়ে জাওয়াদের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। জাওয়াদ কাত হয়ে শুয়ে একহাতে শাওনের কোমড় জড়িয়ে ধরে। আচ্ছন্ন স্বরে বিড়বিড় করে বলে, “গায়ে কী নে’শাদ্রব্য মাখো? কাছে এলেই এমন ঘোর লাগে কেন?”

“ধুর!” শাওন লজ্জায় মুখ লুকাল। কিছুটা সময় বাদে জাওয়াদ মৃদু কণ্ঠে ডাকল, “শাওন?”
“শুনছি।”
“ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি তোমায়। আমাকে কোনোদিন ভুল বুঝো না। তোমার প্রতি, পরিবারের প্রতি, আমার ব্যবসার প্রতি, তিলে তিলে গড়া সম্মানের প্রতি আমার ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। তা রক্ষায় আমি যা কিছু করতে রাজি।”

কিছুক্ষণ বাদে শাওনের কোলেই জাওয়াদের ভারী নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেল।
____________

দুপুর দুটোয় অনন্তের ফোনে কল এলো। রিসিভ করতেই নিশান্তের জেরা, “কোথায় তুই?”

‘ফুটবল খেলতে এসেছি ভাইয়া। মাকে একটু বলে দিয়ো ফিরতে লেইট হবে।”

নিশান্ত ভ্রুকুটি করে জানতে চাইল, “মেহযাবীনকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছিলি?”

“যাবীন তো অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে। আমার খেলা আছে তাই নিষেধ করল সঙ্গে যেতে। তাই আমিও গেলাম না আর। হয়তো এতক্ষণে পৌঁছে গেছে।”

নিশান্ত বিনাবাক্য ফোন কেটে শাওনকে কল দিলো। সরাসরি জিজ্ঞেস করল, “মেহযাবীন বাড়ি ফিরেছে?”

“এখনো ফেরেনি। কেন ভাইয়া?”

“কিছু না। পরে কথা বলছি।”

নিশান্ত শান্ত ভঙ্গিতে কথা বলে ফোন কেটে দিলো৷ ওর সচেতন, বিচক্ষণ মন কেন জানি সুস্থির থাকতে পারল না। বিয়ের দিন হতে একের পর এক বিপদ ও ঝামেলা যাচ্ছে দুই বাড়ির ওপর দিয়ে। এর মাঝে জাওয়াদের আকস্মিক বোনকে নিয়ে কনসার্ন হয়ে পড়াটাও চোখে লেগেছে ওর। জাওয়াদের বোন, শাওনের শ্বশুর বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং বিয়ের দিন রাতে আমিনকে অত্যাচার করার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে আমিনের ক্ষোভের একটা কারণ মেহযাবীনও হতে পারে কি! নিশান্ত তৎক্ষনাৎ মেহযাবীনের ফোনে কল করতে করতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

চলবে…
নিয়মিত হয়েছি বলে কি ‘রিচ’ বাবাজি লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here