প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৮] প্রভা আফরিন

0
559

প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৮]
প্রভা আফরিন

শরতের সুনীল আকাশ। সূর্যটা ক্রমশই তেতে উঠছে। বাড়ছে রোদের উত্তাপ। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দিলশানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তার উজ্জ্বল গায়ের রংটা রোদের স্পর্শেই যেন কিছুটা লালচে রূপ ধারণ করেছে। শান্ত ভঙ্গিতে পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে অপরহাতে টফির গলার বেল্টটা ধরে রেখেছে। অবাক দৃষ্টি শোভার মুখপানে। মেয়েটির কথাটা সে ঠিকঠাক অনুধাবন করতে পারেনি। উচ্চারণ করল,
“তুমি কী বললে?”

শোভার ওষ্ঠাধরে ওপর জমে থাকা জলের বিন্দুগুলো মুছে নিল শৈল্পিক ভঙ্গিতে। ঠোঁট টিপে দুষ্টু হেসে বলল,
“বলছিলাম আপনার নামটা দারুণ। দিলশান…দিল…হৃদয়। নামটা উচ্চারণ করলেই হৃদয়ের কথা বেরিয়ে আসে।”

দিলশান চোখ ছোটো ছোটো করে চায়। মেয়েটি অতি মাত্রায় পাঁজি। বখাটে গোছের চলাফেরা, ঠোঁটকাটা, লাগামছাড়া স্বভাব। দিলশান ছোটো থেকেই দেখে আসছে একে। প্রয়োজন না পড়লে খুব একটা কথাবার্তা না বলারই চেষ্টা করে। তার এড়িয়ে যাওয়ার কারণেই কিনা মেয়েটা বিরক্ত করার সুযোগ পেলে ছাড়ে না। দিলশান কপাল কুচকে শক্তমুখে বলল,
“তোমার হৃদয়ের কথাটা কী?”

চতুর শোভা একপেশে হাসে। হেয়ালি করে বলে, “সেই কথা শুনতে হলে কথার ভার নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। আপনার কী সেই কথার ভার নেওয়ার ক্ষমতা আছে?”

“একদমই না।” দিলশান জবাব দিতে দেরি করল না। সঙ্গে নির্দয়ের মতো যোগ করল, “তোমার আরেকটু সহবত শেখা দরকার। আমাদের কালচারে সিনিয়রদের নাম ধরে ডাকতে নেই এটুকু জ্ঞান রেখে চলাফেরা করবে। আর হ্যাঁ, টফিকে উলটোপালটা কিছু খেতে দেবে না। ওর হেলথ এন্ড হাইজিন মেইনটেইন করতে মান্থলি একটা উল্লেখযোগ্য এমাউন্টও খরচ করতে হয়।”

কথা শেষ করে দিলশান হাঁটা দিল। গলায় টান পড়ায় টফিকেও যেতে হচ্ছে। শোভা ক্রুর চোখে চেয়ে থাকে। পরক্ষণেই শিশ বাজিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠল, “মেরেছো কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না! শোভা কিন্তু এতটাও নির্দয় না।”

সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে দিলশানের। পেশায় চক্ষু বিশেষজ্ঞ সে। একজন ব্যক্তিত্ববান, সম্মানিত মানুষ। অথচ সেদিনের দুই আঙুলে মেয়ে তার সঙ্গে মজা নেয়! হেয়ালি করে! মেয়েটাকে তার একদমই সুবিধের মনে হয় না। দিলশান হোয়াইট হাউজে ফিরে টফির পায়ের নখ কেটে, কান পরিষ্কার করে এরপর ভালোমতো গোসল করাল। নিজেও গোসল সেড়ে নিট এন্ড ক্লিন হয়ে নিল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে তার একটু বাতিক আছে। যাকে বলে শুচিবায়ু। কোথাও নোংরা কিংবা অগোছালো ভাব দেখতে একদমই পছন্দ করে না। তার এই বাতিকের ফলেই কাজের লোকেরা বেশিদিন টিকতে চায় না। কে চাইবে সারাক্ষণ ময়লা পরিষ্কারে লেগে থাকতে! সবচেয়ে বড়ো কথা বাড়িকে অগোছালো করে তারই মা ও টফি, দিলশানের সবচেয়ে প্রিয় দুজন। তাই রেগে গেলেও সহ্য করতেই হয়। সহ্য করতে করতেই এখন তার ধৈর্য শক্তি বেড়ে গেছে।

দিলশানের আজ অফ ডে। তবে চেম্বার আছে দুপুরের পর। একদম রওনা হওয়ার আগে তৈরি হয়েই নিচে নামল। টফির পশমী ফোলা দেহ গোসলের পরে চিমসে গেছে। ড্রায়ার দিয়ে আধশুকনো করে দিয়েছে দিলশান৷ বাকিটা রোদে গা এলিয়ে শুকিয়ে নিচ্ছে সে। ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে দিলশান ড্রইংরুমে ঢুকল। একটা গন্ধ এসে ধাক্কা দিল নাকে। কৌতুহলী পায়ে ডাইনিংয়ের দিকে গেল সে। একটি গ্লাসডোরের সাহায্যে কিচেন ও ডাইনিং পৃথক করা। দিলশান ডোরের মুখে দাঁড়িয়ে দেখল তার মা কিছু রান্না করছে। বলল,
“কী বানাচ্ছো, মা?”

সুলেখা বাহুতে ঘাম মোছেন। সানস্ক্রিন মেখে রান্নাঘরে ঢুকেছেন তিনি। চেহারায় হোয়াইট কেস্ট ভেসে আছে। ছেলের দিকে ফিরে উত্তেজিত, উচ্ছ্বসিত স্বরে বললেন,
“নতুন এক্সপেরিমেন্ট করছি। শাপলা ফুলের ডেজার্ট বানাচ্ছি।”

দিলশান অবাক গলায় বলল, “শাপলা কোথায় পেলে?”

“মতিনকে দিয়ে কিনিয়েছি। একশ বিশ টাকায়। ফুল দিয়ে ডেজার্ট বানাব আর ডাটাগুলো মতিনকে ছোটো মাছ দিয়ে রাঁধতে বলেছি। তুই কিন্তু আমার ডেজার্ট খেয়ে যাবি।”

সুলেখার এক্সপেরিমেন্ট যে সব সময় খারাপ হয় তেমন নয়। মাঝেমধ্যে আহামরি ভালোও হয়ে যায়। কিন্তু একটু ইউনিক হতে গিয়ে সুলেখা বরাবরই এমন কিছুর কম্বিনেশন করতে চায় যে উপাদানের স্বাদে মিসম্যাচ হয়ে যায়। আজকেরটা কেমন হবে যদিও বোঝা যাচ্ছে না। দিলশান বিরক্ত গলায় ডাকল,
“মতিন চাচা?”

হাড় জিরজিরে, লম্বাটে মধ্যবয়সী এক লোক এগিয়ে এলো। হাজার লোক এসে গেলেও মতিন মিয়া এ সংসারের সূচনা থেকেই এ বাড়িতে রাঁধুনির কাজ করে। বাড়ির পেছনে তাকে একটা কোয়ার্টারও দেওয়া হয়েছে পরিবার নিয়ে থাকতে। মালিকের সহযোগিতায় মেয়ে দুটোর বিয়ে দিয়ে বউকে নিয়ে এখানেই থাকছেন তিনি। মতিন ডাক শুনে এগিয়ে এসে বিনীত স্বরে বলল,
“কও, রিয়াদ আব্বা।”

“মাকে শাপলার আইডিয়া কে দিয়েছে?”

“আমিই গল্পে গল্পে কইতাছিলাম গেরামে আমরা শাপলা ফুলের বড়া খাই। ভাবিসাব হুইন্যা কইল তারও লাগব। তাই আইন্যা দিছি। কিন্তু ভাবিসাবে বড়া না বানাইয়া মিষ্টান্ন করতাছে। কি জানি কও তোমরা? ডেজার্ট!”

“ডেজার্ট না ডেঞ্জার। আমি আজ বাইরে খেয়ে নেব। চললাম।”
___________

শান্তশিষ্ট শেখ বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে আজ কোলাহল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দ্বীপশিখার সদস্যরা ঘর আলো করে এসেছে মেয়ের নাইওর নিতে। ছেলে-মেয়েদের হুড়োহুড়িতে পুরো বাড়ি চঞ্চল। বসার ঘরে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। বড়োরা রয়েছে ভেতরে। শোভা সোফায় দুই পা তুলে আসন গেড়ে বসে আছে। পাশেই বসেছে অনন্ত। শাওন ফিস কাটলেট এনে পরিবেশন করছে ভাইবোনদের। শোভা গরম কাটলেটে কামড় দিয়ে আফসোস করে বলল,
“আহারে! কতগুলো মাছের কাটলেট বানালে। আমার ভাগেরগুলো আস্ত রেখে দিতে। বিড়ালের জন্য নিয়ে যেতাম।”

শাওন চোখ গরম করে চাইল। অনন্ত আয়েশ করে চিবোতে চিবোতে বলল, “তোকে মাছুয়ার সঙ্গে বিয়ে দেব। তোর বর মাছ ধরবে আর তুই বিড়ালকে খাওয়াবি।”

শোভা রেগেমেগে ভাইয়ের বাহুতে এলোপাতাড়ি কিল দেয়। দুজনে লেগে যায় ঝগড়া। একটু দূরেই জাওয়াদ ও নিশান্ত নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। নিশান্তের বাবা রিটায়ারমেন্টের পর লেদারের বিজনেস শুরু করেছে । আশরাফুল আজাদের ইচ্ছে ছিল ছেলেরাই ব্যবসাটা দেখবে। কিন্তু দুটো ছেলের মাঝেই সে ইচ্ছে ম্রিয়মাণ। জাওয়াদের আবার বিজনেসের দিকে অঢেল ঝোঁক। বিশ্ব অর্থনীতির মোটা মোটা বই তার প্রিয়। বাবার সঙ্গে সমানতালে ব্যবসা সামলায়।

অনন্ত জাওয়াদ ও শাওনকে পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞের মতো বলল,
“এমনিতেই ঠাণ্ডামার্কা বাড়ি, তারওপর বউ এনেছে আরেক ঠাণ্ডামার্কা। তোদের বাচ্চাকাচ্চা বোবা হবে কিনা আমার চিন্তা হচ্ছে।”

জাওয়াদ হেসে জবাব দিল,
“ব্যাপার না। বাচ্চাকাচ্চা হলে তোদের দিয়ে দেব। কথাবার্তা শিখিয়ে দিস।”

শাওন বিমূঢ় হয়। চোখাচোখি হলো জাওয়াদের সঙ্গে। জাওয়াদ সুক্ষ্ম হেসে সকলের আড়ালে চোখ টিপল। ভাইবোনদের সামনে লজ্জায় শাওন দ্রুতই স্থান ত্যাগ করে।

আড্ডায় একটা শূন্যস্থান আছে। যাবীন অনুপস্থিত। শূন্যতাটা অনন্তের চোখে লাগল। যাবীনকে ছাড়া আড্ডা পানসে লাগছে। কাটলেটের প্লেট হাতে নিয়ে ও উঠে দাঁড়াল। বলল,
“আমার সখী কই? তার এত দেরি হচ্ছে কেন? মনে তো হচ্ছে ওরই নাইওর নিতে এসেছি আজ।”

“তাইতো! যাবীন আপু কই?” গলা মেলাল শোভা।

জাওয়াদ বলল, “মেয়েটা যা ঘরকুনো হয়েছে! সকাল থেকে নাকি কিসব আঁকাআঁকি করেছে। এখন তৈরি হতে দেরি হচ্ছে।”

যাবীনের ঘরে ঢুকে অনন্ত থমকে গেল। বারান্দার দিক থেকে আসা দুপুরের তেজোদীপ্ত আলোয় ক্যানভাসের ওপর চিত্রিত ছবিটা দেখে চোয়াল ঝুলে যাওয়ার জোগাড়। চমকে গেল শোভাও। ওরা দুজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে৷ যাবীন তখন মন দিয়ে আইলাইনারের টান দিচ্ছিল চোখে। হুড়মুড় করে কেউ ঢোকায় লাইন গেল ছড়ে৷ ঠাণ্ডা চোখে চাইল পেছনে। বলল,
“মানে তোরা এমন কেন? একটু ধীরেসুস্থে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিলে কোন ক্ষতিটা হতো?”

অনন্ত তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল, “তার আগে তুই বল, পদাতিকেরা তো তোর ভীষণ অপছন্দের। তবে এটার মানে কী?”

অনন্তের দৃষ্টি খেয়াল করে ক্যানভাসের দিকে তাকাল যাবীন। সাদা ক্যানভাসে সবুজ রঙের ইউনিফর্মে রা’ইফে’লধারী এক পদাতিকের দুর্নিবার ভঙ্গির ছবি জ্বলজ্বল করছে। যার মুখটা অবশ্য আঁকা হয়নি। সারা বেলা এরই পেছনে সময় গেছে যাবীনের৷ ও স্বাভাবিক গলায় বলল,
“ও এটা! সকাল থেকে তো এটাই আঁকতে গিয়ে লেট হলো।”

শোভা কাছে গিয়ে ছবিটা খেয়াল করল। নিচে কালো অক্ষরে লেখা, ‘প্রেম নগরের প্রণয়কুমার’। ও চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“সর্বনাশ! যাবীন আপুর প্রণয়কুমার সেনাসদস্য! কবে থেকে রিলেশন?”

যাবীন কপাল চাপড়ায়। এটা ওর অর্ডারের ফটো। একজন পরিচিতের অনুরোধে কাজটা নিতে রাজি হয়েছে। মেয়েটি তার বয়ফ্রেন্ডকে সারপ্রাইজ করবে ছবিটা দিয়ে। তবে ‘প্রেম নগরের প্রণয়কুমার’ ক্যাপশনটা যাবীনের দেওয়া। এই ক্যাপশনে যাবীন তার অদেখা স্বপ্ন পুরুষের চেহারাহীন অবয়ব আঁকে, যেটা বেশিরভাগ সময়ই অস্পষ্ট ধাঁচের কিংবা রাজকুমার বেশে। তাই শোভা এই স্পষ্ট ও পোশাকি ছবিটা দেখে মনে করল হয়তো যাবীন গোপনে কাউকে পছন্দ করে। যাবীন সত্যিটা বলতে যাচ্ছিল ওদের। হঠাৎ ওর সতর্ক দৃষ্টি চলে গেল দরজার বাইরে। মনে হলো কেউ শুনছে তাদের কথা। গলা খাকারি টেনে যাবীন সুর পালটে ফেলল,
“ঠিক রিলেশন নয় তবে…”

“তবে কী?” অনন্ত আহত চোখে চেয়ে আছে। যাবীন ওকে বলল না! এতবড়ো কথা চেপে গেল। যাবীন আর উত্তর না দিয়ে হাসল। তাতে ওদের ধারণা আরো গাঢ় হলো নিশ্চয়ই গোপন কিছু আছে। অনন্ত তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল,
“কিন্তু তুই তো এই পেশাকে পছন্দ করিস না।”

যাবীন পর্যাপ্ত উত্তর হাতড়ায়। জবাব দেয়,
“করি না সত্যিই। তবুও দুই একজন এক্সেপশনাল হয়ে যায় যার প্রতি টান আসে। তাদের বেলায় অত যুক্তিতর্ক খাটে না।”

শোভা উত্তেজিত হয়ে বলল,
“তুমি মুখটা আঁকোনি কেন? আমরাও দেখতাম তাকে।”

“আসলে তার মুখটা এত সুন্দর যে ফুটিয়ে তুলতে সাহস পাচ্ছি না। পাছে নষ্ট করে ফেলি।”

“নাকি আমাদের দেখাতে চাও না?”

“তেমন কিছু না।” যাবীন মনে মনে মজা পাচ্ছে।

“তার মুখটা কেমন? পটল চেরা চোখ, গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট, বাঁশির মতো নাক, আপেলের মতো গাল?”

যাবীন হাওয়ার সঙ্গে উড়িয়ে দিল কথাটা, “আরেহ! এটা তো কবী বা লেখকের সৃষ্ট চরিত্র নয়। বাস্তবের মানুষ। তারওপর সেনাসদস্য। তার চোখের তুলনা দিয়ে বলা যায় বু’লেট চেরা চোখ, দৃষ্টিদ্বয় বো’মার মতো বি’স্ফো’রক ঠাসা, দুইনলা ব’ন্দুকের মতো নাক, কণ্ঠস্বর যেন মে’শিনগা’নের ব্রা’শফা’য়ারের সমান।”

অনন্ত ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, “দোস্ত, তুই প্রেমিকের বর্ণনা দিচ্ছিস নাকি অ’স্ত্র সমৃদ্ধ স’ন্ত্রা’সীর?”

যাবীন দরজার বাইরে আড়দৃষ্টি ফেলে শ্লেষের সুরে বলল, “ধরে নে তাই।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here