প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৯] প্রভা আফরিন

0
168

প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৯]
প্রভা আফরিন

রুমের সামনের প্যাসেজওয়ে দিয়ে একজন মিলিটারি যাচ্ছিল আন্দাজ করেই যাবীন এতগুলো কথা বলে ফেলেছে। নিশান্তের চলনের ছন্দ ও চেনে। কতবার এই পায়ের শব্দ শুনে সে স্থান হতে পলায়ন করেছে। আজ গায়ের জ্বালা থেকেই মধুমাখা একটা অপমান যেন ঠোঁটের আগায় সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। প্রেমিক পুরুষের বর্ণনার ছলে আয়েশ করে আরেকজনের বর্ণনা দিয়ে দিল। যাকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া সে শুনেছে কিংবা বুঝেছে কিনা যাবীন ধরতে পারল না। তবে বিপত্তি ঘটল অন্য জায়গায়। নিশান্ত একা আসছিল না। তার সঙ্গে ছিল জাওয়াদ। নিঃশব্দে চলাচল করে বলেই তার পদধ্বনি যাবীনের কান স্পর্শ করেনি। অন্যদিকে বোনের উচ্চস্বরে বলা সম্পূর্ণ কথাটাই জাওয়াদ শুনে ফেলেছে। সে বোনের ঘরে ঢুকল না। দরজার বাইরে থেকেই আওয়াজ দিল,
“তোরা সব নিচে আয়। টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে।”

শব্দগুলো কানে প্রবেশ করতেই যাবীনের সর্বাঙ্গে শীতল স্রোতের ঢল নামে। চোখের কোটরে উদিত হয় বিব্রতভাব। এটা কী হয়ে গেল! জাওয়াদ কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই নিচে নেমে গেছে। যা ওর ভয়টা আরেকটু বাড়িয়ে দিল। নিশান্ত দরজা বরাবর দাঁড়িয়ে একবার দূর হতেই ক্যানভাসের ছবিটা নিবিষ্টমনে দেখে। এরপর কেমন যেন একটা থমথমে মুখ করে চলে গেল।

যাবীন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। আজ অবধি ও যতবার মিথ্যা বলেছে সবকটার ফলাফল হাতেনাতে পেয়েছে। সে জন্য পারতপক্ষে মিথ্যাটাকে ও এড়িয়েই চলে। তবুও মাঝে মাঝে মনের প্রবৃত্তিকে দমন করতে না পেরে বলে ফেলে। সংযম জিনিসটা কেন যে এত বছরেও আয়ত্তে আনতে পারল না! পর্বত ভেঙে ঝরনা তো ছুটিয়ে দিল, এবার জল কতদূর গড়াবে ভেবেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।

শোভা বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকে না। সে কখন বেরিয়ে গেছে কে জানে! অনন্তও রাগী মুখ করে বেরিয়ে যাচ্ছিল। যাবীন কাঁদো কাঁদো হয়ে ডাকে,
“অনন্ত?”

অনন্ত রাগী মুখ করে ফিরে চায়। হাত উঁচিয়ে বলে,
“কথা বলবি না আমার সঙ্গে। আমি তোর কেউ না। নয়তো এই গোপন খবরটা অন্তত জানতে পারতাম। আমি হয়তো এতটাও ভরসাযোগ্য নই। না হলাম। থাক তুই তোর বু’লেট চেরা চোখের প্রেমিককে নিয়ে।”

যাবীনের দেহ চঞ্চলা হয়। ছুটে গিয়ে ওকে আটকায়। মিনমিনে ধীর স্বরে বলে, “দোস্ত, বিলিভ মি! আমার কেউ নেই। ওটা মজা করে বলেছি।”

“হ্যাঁ, আর মজা করে ছবিটাও এঁকে ফেলেছিস! বেইমানের বেইমান। কথা বলবি না আমার সাথে।”

“ওটা অর্ডারের ছিল। নয়তো আমার কীসের ঠ্যাকা মিলিটারিদের ছবি আঁকব? অর্ডারের ডেলিভারিটা তোকে দিয়েই তো দেওয়াব। তখন নিশ্চয়ই অবিশ্বাস করবি না।”

অনন্ত ঠোঁট টিপে ভাবল খানিক। আসলে যাবীনের আগের কথাটাই বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছিল ওর। যে মেয়ে অপরিচিত কারো সঙ্গে কথাই বলতে পারে না সে হুট করে প্রেমে পড়েছে তাও গোপনে এটা মানতে কষ্ট হচ্ছিল। তবুও একটা সন্দেহ এড়ানো গেল না,
“তবে তুই ফটোটার নাম প্রেম নগরের প্রণয়কুমার কেন দিয়েছিস? এর দ্বারা কী বুঝায়?”

“যে মেয়েটি তার বয়ফ্রেন্ডের জন্য বানাতে চেয়েছে সে নিজেও একজন সেনা সদস্য। শুনেছি খুবই কাঠখোট্টা স্বভাবের। অত রোমান্টিক কথাটথা বলতে পারে না। তাই বলেছে আমিই যেন সব প্রস্তুত করে দেই৷ মানে এ টু জেড আমারই কল্পনায় হবে। মেয়েটি শুধু পেমেন্ট দিয়ে নেবে। তাই ভাবলাম আমার প্রেমনগর যেহেতু শূন্য পড়ে আছে, অন্যের প্রেম নগরের প্রণয়কুমারকেই নাহয় নামটা দেই৷ নাথিং সিরিয়াস। কিন্তু গল্প বানাতে গিয়ে তো অকাজ করে ফেললাম। ভাইয়া শুনে ফেলল। আমিই কেন ফেঁসে যাই প্রতিবার! মানুষ এত এত অন্যায় করে পার পেয়ে যায় আমি সামান্য মিথ্যাটা বলতে গিয়েও ফেঁসে যাই।” যাবীনের চোখের কোণে অবরুদ্ধ অশ্রু উঁকি দিতে থাকে।

সব শুনে অনন্ত হো হো করে হেসে ফেলল। শক্ত হাতে বিকট তালির ধ্বনি তুলে বলল, “বেশ হয়েছে। এবার দেখব আসল মজা।”

বিপদে কাউকে পাশে না পেয়ে যাবীন আহত হলো। ছড়ে যাওয়া আইলাইনারের কালিটা শুকিয়ে গেছে। টিস্যু দিয়ে সেটুকু ঘষে তুলে পাফ বুলিয়ে নেয় সারা মুখে। ভেজা চুল পিঠময় ছড়িয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরোয়। প্রস্থানের আগে কী ভেবে যেন একবার পিছু ফিরে ক্যানভাসের দিকে চায়। এরপর কড়া চাহনি নিক্ষেপ করে চলে যায়।

তপ্ত আকাশের গা বেয়ে মসৃণ ধারায় নামছে সোনালি কিরণ। প্রকৃতির বুকে খা খা তোলা দুপুর ক্ষয়ে যাচ্ছে মৃদু গতিতে। সূর্য এখন ধাবমান পশ্চিমের রাজপথে। যাবীন নিচে এসে বসার ঘরের সুবিশাল জানালার সামনে শিউলি ফুলের মতো আলতো স্পর্শে ছড়িয়ে থাকা রোদে ভেজা চুলগুলো মেলে ধরল। রেশমের মতো মসৃণ, জটহীন সোজা চুলগুলো রোদমেখে চিকচিক করে। সুমা বেগম বললেন,
“মাথা গরম হবে, ফ্যানের নিচে বস।”

যাবীন গেল না। ভাইয়া বসে আছে ফ্যানের নিচে। কাছে গেলে যদি জিজ্ঞাসাবাদের কবলে পড়তে হয়! যাবীন ঠিক করে ভাইয়াকে একা পেলে নিজে থেকেই জানাবে ব্যাপারটা বানোয়াট। যাবীনের প্রেমনগর সম্পূর্ণ ফাঁকা। একদম চৈত্রতপ্ত মাঠের মতো নিরাক। প্রণয়কুমারের ছায়াটাও নেই তাতে। খাওয়ার সময় যাবীনকে ভাইয়ার পাশেই বসতে হলো। ভাগ্য অনুকূলে জাওয়াদ ওকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। একবার শুধু বলল,
“চুল বেঁধে খেতে বসতি।”

একদম স্বাভাবিক স্বর। তাতে রুষ্টতার সামান্যতম আঁচড় নেই। যাবীন ওড়না দিয়ে ভালোমতো চুলগুলো আড়াল করে নেয়। খাবার টেবিলেই আলোচনা বসল রিসেপশনের দিন ঠিক করার। শাওনের মামারা দেশে ফিরবে দুই সপ্তাহের মধ্যে। তখনই জমকালো আয়োজন হবে। দুই বাড়িতেই প্রথম বিয়ে এটা। সুতরাং অনুষ্ঠান থেকে কোনো আত্মীয়কে বাদ রাখতে চান না। আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখা যাবে না। আজ শাওনকে বাপের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। একেবারে অনুষ্ঠানের পরই পুনরায় কন্যা শ্বশুরবাড়ি আসবে। তবে জাওয়াদের শ্বশুরবাড়ি যাওয়া নিয়ে কোনো বাধা নেই।

চাঁদনী বেগম বললেন,
“যাবীনও চল শাওনের সাথে। দুটো দিন বেড়িয়ে আসবি।”

যাবীন মানা করতে উদ্যত হতেই সুমা বেগম বললেন, “লেখাপড়া তো লাটে উঠেছে বিয়ের চক্করে। ভার্সিটির মুখও দেখছে না একজনও। তারচেয়ে কদিন বাদেই তো আবার যাওয়া-আসা লেগে যাবে। এখন থাক।”

জাওয়াদ বলল, “শাওনেরও তো ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছে না। দুজনে ও বাড়ি থেকে একসঙ্গে যাবে নাহয়। যাবীন পরশু আমার সঙ্গে আবার ফিরে আসবে। তুমি চিন্তা কোরো না।”

অতঃপর ঠিক হলো যাবীনও যাচ্ছে ভাইয়া-ভাবির সঙ্গে। রওনা হওয়ার সময় শোভা নিশান্তের কাছে এসে দাঁড়াল। ভাইয়া বলেছে স্কুটির চাবি দেবে। মানে দেবেই। আদুরে বিড়ালের মতো নিশান্তের বাহুতে গাল ঠেকিয়ে দাঁড়ায় ও। দুচোখে উপচে পড়া আবদার। নিশান্ত এক মুহূর্তেই মেয়েটির মনোভাব বুঝে যায়। কঠোর চোয়ালে নমনীয়তা আসে। কণ্ঠে নামে স্নেহের সুক্ষ্ম স্পর্শ। পকেটে হাত গুজে বলে,
“এখন কোথায় যাবি শুনি?”

“ভেটেনারি হাসপাতালে যাব একটু। ওখান থেকে সোজা দ্বীপশিখায় যাব।”

“সন্ধ্যার পর ফেরা যাবে না। নয়তো চাবিটা নিয়ে দাদির সিন্দুকে তুলে রাখব।”

নিশান্ত তর্জনীর ডগায় চাবির রিং ঝুলিয়ে পকেট থেকে হাতটা বের করল। শোভা ছো মেরে সেটা নিয়ে হেসে বলল,
“সন্ধ্যার আগেই ফিরব। এখন আসি।”

নিশান্ত পিছু ডাকল, “কই যাস? স্কুটার আনতে হলে বাড়ি ফিরতে হবে না?”

শোভা না থেমেই জবাব দেয়, “তোমরা ধীরেসুস্থে ফেরো৷ আমার তাড়া আছে।”
______________

দুটো গাড়িতে সবাই রওনা হবে বাড়ির পথে। বড়োরা সব এক গাড়িতে উঠল। অন্য গাড়িটা চালাবে নিশান্ত। জাওয়াদ ও শাওনরা সে গাড়িতেই যাওয়ার কথা। কিন্তু বড়োদের গাড়িটা বের হবার পর জাওয়াদ মত পাল্টালো। নিশান্তের কানে কানে কিছু বলতেই সে মুচকি হেসে মাথা নাড়ল। অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“চল, আমরা এগোই।”

শাওন ভাইয়ের গাড়িতে উঠতে নিলে জাওয়াদ খপ করে হাত ধরে ফেলল। চোখের ইশারায় মানা করল এগোতে। শাওন লাজুক চোখে চেয়ে মানা করতে চায়। জাওয়াদ সেই আশকারাপূর্ণ প্রত্যাখ্যানকে গায়ে না মেখে গ্যারেজে যায় নিজেদের গাড়িটা বের করতে।

যাবীন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়া-ভাবির অভিপ্রায় ও ধরতে পারবে না এতটা বোকা না। নবদম্পতিকে বিরক্ত করার মানেই হয় না। এদিকে যাওয়ার আর একটাই পথ। নিশান্তের গাড়ি। যাবীনের সর্বাঙ্গে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দেয়। এতই দৈন্যদশা এলো যে ওই মুডি মিলিটারির গাড়িতে উঠতে হবে! ড্রাইভিং সিটে নিশান্ত। অনন্ত তার পাশের সিটে বসে ডাকল,
“যাবীন, চলে আয়।”

যাবীন স্থানে অনড়। নিস্তরঙ্গ স্বরে অনাগ্রহ মিশিয়ে বলল, “আমি বরং না যাই। তোরা চলে যা।”

শাওন ওর কথায় দাঁড়িয়ে পড়ল। ও জানে যাবীন নিশান্তকে অপছন্দ করে। তাই যেতে চাইছে না। এদিকে জাওয়াদ তাকে নিয়ে একান্তে কিছু মুহূর্ত ব্যয় করতে চাইছে। ফলে জাওয়াদের গাড়িতে যাবীনকে নেওয়ার কথাটা জোর দিয়ে বলতেও পারছে না। একদিকে স্বামীর মন রাখতে হবে। অন্যদিকে ননদরূপী বন্ধুর মনটাকে অগ্রাহ্য করতে পারছে না। ক্ষীণ প্রতিবাদ করে বলল,
“এক কাজ করি। তোর ভাইকে বলি তোকে দ্বীপশিখায় নামিয়ে দিতে।”

যাবীন তড়িঘড়ি করে বলল, “আরে না না, আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। তোদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় এখন। স্মরণীয় করে রাখ।”

যাবীনের কথায় নিশান্ত মাথা এগিয়ে একবার ওর দিকে চাইল। গমগমে স্বরে বলল, “সবই তো বুঝতে পারছো। তাহলে শুধু শুধু নিজের সঙ্গে ওদেরও সময় নষ্ট করছো কেন? তুমি যেতে চাইছ না শুনে যে ওরা দ্বিধায় ভুগছে এটুকু তো আলাদা করে বলে দিতে হবে না। আমার গাড়িতে উঠতে সাহস হচ্ছে না নাকি ভাবছো তোমায় পাচার করে দেব?”

কথার তীর সরাসরি গায়ে বিঁধল যাবীনের। জাওয়াদের গাড়িটা পথে নেমেছে। সে হাতের ইশারায় শাওনকে আসতে বলল। যাবীনের ক্ষীপ্ত চোখদুটির দিকে চেয়ে শাওন আস্তে করে বলল, “মানছি নিশান্ত ভাইয়ার প্রতি তোর মনে ক্ষোভ আছে। কিন্তু এভাবে নিজেকে গুটিয়ে রেখে আরো প্রমাণ করছিস তুই কতটা ভীতু। নিজের দুর্বলতা কিন্তু অন্যের সামনে দেখাতে নেই৷ তাতে অন্যরা পেয়ে বসে। আমার পরামর্শ তুই নিজের এই দুর্বলতাকে এবার কাটিয়ে ওঠ।”

শাওন চোরা হেসে চলে গেল। নিশান্ত পুনরায় আওয়াজ দিল, “মেহযাবীন, না গেলে বলে দাও আমরা চলে যাই।”

যাবীন তপ্ত শ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে বসল। দরজা লাগাল সশব্দে। তাতে সম্পূর্ণ গাড়িটা দুলে ওঠে। অনন্ত চমকে বলে, “কীরে মেয়ে, গায়ের জোর দেখাচ্ছিস নাকি?”

যাবীন তেরছা স্বরে বলল, “তোদের মতো বডিওয়ালার সঙ্গে অধম আমি গায়ের জোর দেখাব! আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা?”

“গায়ের জোর না থাকলেও চাপার জোর ষোলোআনা।” কটাক্ষের শব্দগুলো নিক্ষেপ করেই নিশান্ত চোখদুটো সানগ্লাসে ঢেকে নিল। গাড়ি চলল ঊর্ধ্বশ্বাসে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here