প্রণয়ের_বন্ধন #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_৩

0
387

#প্রণয়ের_বন্ধন
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

তাহসিন হা করতেই মেঘা হাতে থাকা ফুচকাটা পুরে দিল তাহসিনের মুখে। হতবম্ব তাহসিন, ঝালে ফর্সা মুখশ্রী লাল বর্ন ধারন করেছে। চোখ দুটোও রক্তিম বর্ন ধারন করেছে, কান দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। মেঘাও হতবম্ব, কি করলো সে। লোকটা বোধহয় ঝাল খেতে পারে না, আর ফুচকায় ঝাল বেশি দেওয়া ছিল। ঝাল ছাড়া ফুচকা ভালো লাগে নাকি? তাই সে বেশ কড়া করে ঝাল দিতে বলেছিল ফুচকাওয়ালাকে। তাহসিনের মুখশ্রী দেখে মেঘার মায়া লাগলো। কাঁধ ব্যাগটা থেকে দ্রুত পানির বোতলটা বের করে তাহসিনের হাতে দিল। তাহসিন দ্রুত বোতলের মুখ খুলে ঢকঢক করে পানি গিলে ফেললো। তবুও তার ঝাল কমেনি । মেঘা দৌড়ে ফুচকাওয়ালার কাছ থেকে দুই টুকরো শসা এনে দিলো, বলল – এটা খান, ঝাল কমে যাবে।

তাহসিন ঝালে হিসাতে হিসাতেই ধমক দিলো মেঘাকে, বলল – আমি এইসব অস্বাস্থ্যকর জায়গা থেকে কিছু মুখে দেব না।

চোখ বড় বড় করে তাকালো মেঘা। ঝালে মরছে তবুও এর অস্বাস্থ্যকর আর স্বাস্থ্যকর গেল না। তাহসিনের এতক্ষনে ঝালে চারদিকে খেয়াল ছিল না, ঝাল যদিও এখনও সম্পূর্ণ কমেনি একটু কমেছে। হঠাৎ নজরে পড়লো হাতে থাকা পানির বোতলটা দিকে, মনে পড়লো তার সামনে দাঁড়ানো অভদ্র মেয়েটা তাকে এই পানি দিয়েছে। পানির বোতলটা ছুঁড়ে ফেলল তাহসিন, বলল – এটাও মনে হয় আপনার মতো অস্বাস্থ্যকর। আপনি তো আবার আস্বাস্থ্যকর ছাড়া চলতে পারেন না।

মেজাজ বিগড়ে গেলো মেঘার। যেচে উপকার করতে গেলে এই অবস্থাই হয় , এই দুনিয়ায় ভালোর আর কদর রইলো না। মেঘা হাত উঁচু করে তাহসিনকে কিছু বলবে তখনই তার মনে পড়লো সময়ের কথা। বাড়ি ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। নয়তো মা হাতের কাছে হাতা খুন্তি যা পাবে তা নিয়েই তেড়ে আসবে। বাবাও বাসায় নেই যে তাকে বাঁচাবে। তাই আর কথা বাড়ালো না মেঘা, শুধু বলল – আপনার এই কা কা ধ্বনি শোনার কোনো ইচ্ছে নেই আমার, অভদ্র পাজী ডাক্তার একটা। থাকুন আপনি আপনার ঝাল নিয়ে।

তাহসিনের উত্তরের আর অপেক্ষা করলো না মেঘা। মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল। হতবম্ব তাহসিন। মেয়েটা কি বলে গেল ওকে ও অভদ্র, পাজী? রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিচ্ছে শুধু। কারন পাবলিক প্লেসে ঝামেলা করে নিজের মান ইজ্জত নষ্ট করার কোনো ইচ্ছে নেই তার। নয়তো এখনই এই মেয়েকে তার উচিত শিক্ষা দিয়ে দিতো সে।

মেঘা ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়িতে ঢুকলো। বাসার ভিতরে ঢুকেই ধারাম করে দরজাটা আটকে দিল। সুফিয়া বেগম চেঁচিয়ে উঠলো, বলল – তোকে কতদিন বলেছি এভাবে দরজা আটকাবি না।

মেঘা পাত্তা দিলো না কোনো। রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে ঢুকলো। হঠাৎ তার চোখে পড়লো ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা মাস্কটা। মনে পড়লো সেদিনের বাসের ঘটনা। সেদিন সে এক যুবকের বুকে চু’মু খেয়েছিল, খামচে ধরেছিল তার বুকের অংশ। এই ডাক্তারই তো সেই যুবক ছিল। হ্যা তাই তো, বিব্রত বোধ করলো মেঘা। লজ্জায় তার গাল দুটো লাল হয়ে গেল। না না এই লোকের সামনে আর কখনও তার পড়া চলবে না। অবশ্য এই লোকের সাথে তার আর কখনও দেখাও হবে না। ঐ হাসপাতালেই আর কখনও মেঘা যাবে না তাহলেই তো হলো।

________________________________________

সময় বহমান, সে নদীর স্রোতের মতো বয়ে চলছে আপন গতিতে। প্রায় ছয়টা মাস কেটে গেছে। মেঘার এইচএসসি শেষ, গোল্ডেন এ+ পেয়েছে‌। ভর্তি পরীক্ষায় মেডিকেলে চান্স হয়েছে। বরাবরই ভালো ছাত্রী ছিল মেঘা। মেধাবী ছাত্রী হলেই যে তাকে গম্ভীর, চুপচাপ হতে হবে এই ধারনা বদলৈ দিয়েছে মেঘা। সে চঞ্চল, হাস্যজ্জ্বল, দুষ্ট তবে যাই করুক না কেন পড়ালেখা ঠিক রেখে তারপরে। মেঘার ইচ্ছে ছিল সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তার ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স না হয়ে হয়েছে মেডিকেলে। বাবা মাও উঠে পড়ে তাকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছে। তাদের মতে এত বড় সুযোগ নাকি কেউ হাত ছাড়া করে না। কিন্তু মেঘা যে কাঁটা ছেড়া রক্ত দেখতে পারে না একদম সেটা তার বাবা মাকে কে বোঝাবে? অনেক করে বলেও কাজ হলো না তার বাবা মায়ের ভাষ্যমতে কাঁটা ছেড়া নাকি প্রথম প্রথম কেউই দেখতে পারে না পরে সবটা অভ্যাস হয়ে যায়। শেষে বাবা মায়ের জোড়াজোড়িতে তাকে মেডিকেল কলেজেই ভর্তি হতে হলো। আজ কলেজের প্রথম দিন মেঘার কিন্তু তার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। সুফিয়া বেগম জোর করে পাঠিয়েছে ক্লাসে। মেঘার বাবা রাশেদ সিকদার নিজে কলেজে পৌছে দিয়ে গেছে মেয়েকে।

মেঘা সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে গেট থেকে প্রবেশ করলো। গায়ে তার হলুদ রঙের একটা থ্রি পিস জড়ানো। মাথায় ওড়না চাপিয়েছে, চুলগুলো কাঠি দিয়ে উপরে তুলে বাঁধা। মুখে নেই কোনো কৃত্রিম প্রসাধনী। মেঘা চোখ ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালো। চারদিকে সব নতুন মুখ। স্কুল কলেজে যাদের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল তারা কেউই নেই এখানে। কিছুটা নার্ভাস লাগছে মেঘার। যতই চঞ্চল হোক না কেন নতুন জায়গা নতুন পরিবেশ কেমন একটা ভীত লাগছে নিজেকে। গুটি গুটি পায়ে ক্লাস রুমের দিকে এগিয়ে গেল মেঘা। বিশাল ক্লাসরুম তবুও সে বসবে কোথায় বসার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ একটা মেয়ে মেঘার সামনে এসে দাঁড়ালো, হাত নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো এটা মেডিকেল কলেজ? ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেঘা। এটা আবার কেমন কথা? মেডিকেল কলেজের ভিতরে এসে জিজ্ঞেস করছে এটা মেডিকেল কলেজ কিনা? মেঘা মেয়েটার পা থেকে মাথা অবধি চোখ বুলানো, দেখে তো এই কলেজের স্টুডেন্টই মনে হচ্ছে। মেঘাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথা চুলকালো মেয়েটা, মেকি হেসে বলল – আসলে আমি যে মেডিকেলে চান্স পেয়েছি বিশ্বাসই হচ্ছিলো না তাই জিজ্ঞেস করলাম তোমাকে।

হেসে ফেললো মেঘা। কি বাচ্চা বাচ্চা কথা। মেয়েটাও হাসলো মেঘার সাথে। ক্ষানিক পর হাসি থামিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল – হাই আমি তনু‌।

মেঘাও হাত বাড়ালো, ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে বলল – আমি মেঘা।

– চলো বসবে না?

মুখ ভার করলো মেগা, বলল – কোথায় বসবো।

তনু পা উঁচু করে দেখলো অতঃপর বলল – ঐ তো জায়গা আছে ওখানে চলো।

মেঘা আর তনু এগিয়ে গেল বসে পড়লো মাঝ বরাবর একটা সিটে। প্রথম দিন ক্লাস মেঘার সাথে আর তেমন কারোই কথা হলো না। দেখতে দেখতে দুটো ক্লাস হয়েও গেল। দুটো স্যারই বুড়ো টাকওয়ালা। এবার তৃতীয় ক্লাস, মেঘা বিরস মূখে বসে আছে ক্লাসে। পাশেই তনু নামের মেয়েটা। সে বকবক করেই যাচ্ছে। কেন করবে না সে আজ ভীষণ খুশি। তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ছোট বেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল সে মেডিকেলে পড়বে।

মেঘার বিরক্তির মধ্যেই ক্লাসে প্রবেশ করলো নতুন স্যার। স্যারকে দেখেই সবাই উঠে দাঁড়ালো, মেঘাও দাঁড়ালো। তবে সামনে তাকিয়ে দেখলো না লোকটা কে? মাথা নিচু করেই দাঁড়ালো। তনু কনুই দিয়ে খোঁচা মারলো মেঘাকে, বলল – আমি বোধহয় হার্ট অ্যাটাক করবো মেঘা। একটা মানুষ এত হ্যান্ডসাম কিভাবে হয়?

তনুর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেঘা। তনু হাত ইশারা দিয়ে সামনে তাকাতে বলল। সামনে তাকিয়েই মেঘার কুঁচকানো ভ্রু জোড়া যেন আরও কুঁচকে গেল। কোথায় যেন যেন আগে দেখেছে এই লোককে। কোথায় দেখেছে? কোথায় দেখেছে? মস্তিষ্কর উপরে একটু চাপ পড়তেই মেঘার চোখের সামনে ভেসে উঠল ছয় মাস আগের ঘটনা। মেঘার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর হওয়ায় বেশি ভাবতে হয়নি তাকে। তাছাড়া ঐ লোক ওকে যে পরিমাণ অপমান করেছিল তাতে তাকে ভুলে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। তার উপর সেই বাসের ঘটনা, প্রথম চু’মু। মেঘা দ্রুত ব্যাগ থেকে মাস্ক বের করলো। পড়ে নিল মুখে। তাহসিন সামনের দিকে তাকিয়ে বলল – বসুন।

সবাই বসলো। সে চোখ ঘুরিয়ে একবার তাকালো পুরো ক্লাসে। মেয়েগুলো কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এ নতুন নয়, প্রতি ক্লাসেই এমন হয়। এগুলোর অভ্যাস আছে তার। সবার দিকে চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল এক হলুদে আবৃত মেয়ের দিকে। মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে। একবারও তাকাচ্ছে না তার দিকে। তাহসিনের কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটা তার থেকে নিজেকে লুকাতে চাইছে। ভ্রু কুঁচকালো তাহসিন তারপরে ক্লাসে মনোযোগী হলো। তবে ক্লাসের মধ্যে কৌতুহলবশত একটু পর পরই তাহসিনের নজর চলে যাচ্ছে মেয়েটার দিকে। সে যতবারই মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে মেয়েটা আরও গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। তাহসিনের সন্দেহ আরও গাঢ় হলো। এবার সে অনেক্ষন তাকালো না মেয়েটার দিকে। এরপর একসময় হঠাৎ করেই তাকালো। মেয়েটা তার দিকেই তাকানো ছিল, চোখাচোখি হয়ে গেল তাদের। বুকটা ধক করে উঠলো তাহসিনের। এই সেই চোখ। যা তাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিচ্ছে না গত ছয়টা মাস ধরে। না এই চোখ চিনতে সে ভুল করবে না কখনও না। গত ছয় মাস ধরে ঘুমের মধ্যেও চলে আসে এই চোখধারী নারী‌। সেই বাসের ঘটনার মতো প্রতি রাতেই তার বুকে স্বপ্নে স্পর্শ একে দিয়ে যায়। এই মেয়ে এখানে? এই মেয়েও কি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে? ঢোক গিললো তাহসিন। কেমন অস্থির লাগছে তার। এমন আর কখনও তো লাগেনি। এই পেশায় সে আজ প্রায় এক বছর ধরে নিয়োজিত কখনও কাউকে দেখে তো এমন লাগেনি। তাহলে আজ এমন লাগছে কেন? এই মেয়ের জন্য? তাহসিন আর তাকালো না মেঘার দিকে। মাথা থেকে তার সকল চিন্তা ভাবনাকে ঝেড়ে ফেলে দিল। কিন্তু ঝেড়ে ফেলে দিলেই কি ফেলে দেওয়া যায়? মোটেই না, না চাইতেও বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ঐ মেয়ের দিকে। তাহসিন নিজেকে ধাতস্থ করলো। মনে মনে বলল – তুই এত বেহায়া হলি কবে তাহসিন? যে একটা মেয়ের দিক থেকে তুই চোখ সরাতে পারছিস না। তাও মেয়েটা তোর ছাত্রী, শুধুই ছাত্রী।

তাহসিন দ্রুত ক্লাস শেষ করে চলে গেল। তাহসিনকে বের হতে দেখেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো মেঘা। নয়তো আজ যদি তাহসিন তাকে দেখে ফেলতো কি লঙ্কা কান্ডটাই না লাগাতো। শেষ তাদের দেখা হওয়ার কথা মনে পড়তেই আঁতকে ওঠে মেঘা। শেষ দিন তাহসিনকে সে অভদ্র, পাজী ডাক্তার তারপর কাক বলেছিল। আচ্ছা সেসব কি মনে রেখেছে এই লোক? ছয় মাস আগের ঘটনা। মনে তো রাখার কথা নয়। তবুও এই লোক যে পরিমাণ খবিশ, মনে রাখতেও পারে। একবার এই লোকের সামনে ধরা পড়লে তার আর জীবিত থাকতে হবে না। তাই যতটা সম্ভব এই বদ লোকের থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে তাকে। জান বাঁচানো ফরজ।

চলবে….
পরের পর্বটি পেতে পেইজে ফলো দিয়ে রাখুন। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
ধন্যবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here