অসম্ভবেও আমার তুমি নুসরাত সুলতানা সেজুথি পর্ব–০১

0
970

অসম্ভবেও আমার তুমি
নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–০১

এক হ্যাচকা টানে স্নিগ্ধাকে বিছানার ওপর ছুড়ে ফেললো আবরার। পড়নে লাল টুকটুকে বেনারসি মোড়ানো স্নিগ্ধার,,,আপাদমস্তক হলুদের গন্ধে মোঁ মোঁ করছে একেবারে। কয়েক ঘন্টা আগেই আবরারের সহিত বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে স্নিগ্ধা। নিজের নামের সাথে আবরারের নাম সারাজীবনের জন্যে জুড়ে গিয়েছে তার।

তবে এরুপ আকস্মিক ছুড়ে ফেলার দরুন খাটের সহিত পায়ে বেঁধে ভীষণ রকম ব্যাথা লেগেছে স্নিগ্ধার। তবুও আবরারের ভয়ে মুখ থেকে কোনও রুপ আওয়াজ বের করলোনা সে।
কান্নাভেজা মুখ নিয়ে ফিরে তাকালো রক্ত চক্ষু নিক্ষেপ করে থাকা আবরারের দিকে।
স্নিগ্ধা তাকানো মাত্রই ঝুঁকে গিয়ে ওর চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করালো আবরার।এবার আর নির্বিকার থাকতে পারলোনা স্নিগ্ধা। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো সে। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,

— ব্যাথা লাগছে,ছাড়ুন।

— ব্যাথা লাগার জন্যেই ধরেছি।( দাঁতে দাঁত চেপে)

— কেন এমন করছেন আমার সাথে, কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার?

— আমি করছি নাকি তুমি করছো? যা হয়েছে চুপচাপ মেনে নাও।

— মরে গেলেও না। আপনার মতো লোক কে নিজের স্বামী বলে কখনওই মেনে নেবোনা আমি।

এবার রাগে আগের থেকেও জোরে স্নিগ্ধার চুল চেপে ধরলো আবরার। পুনরায় ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো স্নিগ্ধা।

— এত্তো জেদ??
তুই এখনও আমাকে চিনে উঠতে পারিস নি। এই আবরার ফাহাদ চৌধুরী ভালোর ভালো খারাপের খুব খারাপ।

— আপনিও আমাকে চেনেন না। গরিব ঘরের মেয়ে হয়েছি বলে নূন্যতম আত্মসন্মান নেই এটা ভাবতে যাবেন না।

— তোর সব আত্মসন্মান আমার পায়ের কাছে এসে ঠেকবে বুঝেছিস?
একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ,,,একটু আগে যে কাজ টা করলি বাইরে,,,, সেটা দ্বিতীয় বার করার আর দুঃসাহস দেখাস নাহ।তবে আমার ভয়ানক রুপ টাই দেখবি তুই।
আজ থেকে আমি আর এই ঘর টাই তোর পৃথিবী। ভুলেও এর বাইরে পা রাখার চেষ্টা করতে যাস না। একেবারে কেটে টুকরো টুকরো করে রেখে দেবো।

কথাটা বলে আবারো স্নিগ্ধাকে বিছানার ওপর ফেলে দিলো আবরার। গায়ের পাঞ্জাবির বুকের ওপরে দিকের দুটো বোতাম খুলে নিলো তারপর। পুনরায় তাকালো স্নিগ্ধার দিকে।উপুড় হয়েই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে স্নিগ্ধা। এ পর্যায়ে খানিকটা দয়া অনুভুত হলো আবরারের
বেশ শান্ত স্বরে বলে উঠলো।

— চুপচাপ ফ্রেশ হয়ে এসো,,,রাতের খাবার আমার সাথে খাবে,,,

কথাটা বলা শেষে আর দাড়ালোনা আবরার,,রুম থেকে বেরিয়ে পরলো,,,ওদিকে দরজার দিক থেকে চোখ সরিয়ে অনবরত কান্নায় ভেঙে পরলো স্নিগ্ধা।

.
.
.

দরজার বাইরে আসতেই সামনে তনয়া কে দেখে দাঁড়িয়ে পরলো আবরার। পরক্ষনেই ভ্রু কোচকালো নিজের।

— আপনি এতক্ষন এখানে দাড়িয়ে ছিলেন?

জবাবে মাথা নিচু করে নিলো তনয়া।

— কি হলো? আড়ি পাতছিলেন?? উত্তর দিন…

আবরারের বাজখাই ধমকে একেবারে কেপে উঠলো তনয়া।
ভয়ার্ত গলায় কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলো,

— আপনি কি সত্যিই মেয়েটাকে বিয়ে করেছেন?

তনয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে হেসে উঠলো আবরার। রাগ মিশ্রিত হাসি।

— আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন?? আমার কথার জবাব না দিয়ে উল্টে আমাকেই প্রশ্ন করছেন? দারুন তো!

— দে…দে..খু..ন আমি আপনার স্ত্রী,,, এটা আমার সংসার। সেখানে আপনি একটা মেয়ে নিয়ে এসেছেন, মেয়েটাকে কে বা কি জন্যে এসেছে সেসব আমি জানতে চাইতেই পারি।

— ওহ তাই নাকি??
বেশ ঠিক আছে,,,ওর নাম স্নিগ্ধা, , আমার বিবাহিত স্ত্রী। এবং বিয়েটা আজই হয়েছে আমাদের। এখন থেকে এটা ওর ও বাড়ি। আশা করছি আর কিছু জানার নেই আপনার।

—- আপনি এরকম কি করে করতে পারেন? এক স্ত্রী থাকা কালীন…

— এই যাস্ট চুপ হ্যা? এটা আমার বাড়ি,,আমি যাকে খুশি তাকে আনতে পারি। যদি ইচ্ছে হয় তবে সতীন নিয়ে সংসার করুন নাহলে রাস্তা মাপুন আই ডোন্ট কেয়ার।
সামনে থেকে সরুন এবার,,

কথাগুলো এক দমে শেষ করে তনয়ার দিকে তাকালো আবরার। দু গাল বেয়ে সরল রেখার মত পানি গড়াচ্ছে তার। এবার প্রচন্ড বিরক্তি এসে চেপে ধরলো আবরারকে।

— এই,এইসব ন্যাকা কান্না নিজের রুমে গিয়ে করুন,,আমি সরতে বলেছি আপাতত। আই সেইড গো।

নির্বিকার ভাবে কাঁদতে কাঁদতে আবরারের সামনে থেকে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে দৌড়ে চলে গেলো তনয়া। বিষয় টা একটুও প্রভাব ফেললোনা আবরারের ওপর।
.
.
.

এগিয়ে গিয়ে ডায়নিং টেবিল এর ওপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নিলো সে। হাতে উঠিয়ে পুরো এক চুমুকে শেষ করে নিলো সেটি।
ইতোমধ্যেই পকেটের মধ্যে ফোনের রিংটোন বেজে উঠেছে আবরারের।গ্লাস টা রেখে ফোন বের করে সামনে উচিয়ে ধরলো । স্ক্রিনের নাম্বার টাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে স্নিগ্ধার রুমের দরজা অতি সন্তর্পনে বাইরে থেকে আটকে দিলো সে।
এবার রিসিভ করে ফোন কানে ঠেকালো আবরার। মুহুর্তেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো একজন মধ্যবয়সী পুরুষের ভাঙা গলার আওয়াজ।

— হ্যালো ছোট সাহেব..

— জ্বি বলুন।

— আপনারা কি পৌঁছেছেন সাহেব। না মানে স্নিগ্ধার মা চিন্তা করছিলো খুব।

— হ্যা কিছুক্ষন আগেই পৌছেছি।আর আপনাদের এত চিন্তা করার কি আছে বলুন তো। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন জলে তো ফেলে দেন নি। আপনাদের মেয়ে আমার কাছে নিরাপদেই থাকবে এবং সব থেকে ভালো থাকবে।

— সে আমরা জানি সাহেব। তবুও বাবা মায়ের মন তো।

— হুম। আর কিছু বলবেন?

— জ্বি মানে,একবার যদি মেয়েটার সাথে কথা বলতে পারতাম..

— আসলে ও প্রথম বার এতোটা জার্নি করেছে তো,এসেই ঘুমিয়ে পরেছে। উঠলে আমি বলবো।

— ঘুমিয়ে পরেছে?
ওকি খুব কান্নাকাটি করেছিলো সাহেব?

— জ্বি -না,কাঁদতে যাবে কেন? ওসব ছাড়ুন। আপনার আর কিছু বলার আছে মজিদ??

— না সাহেব নেই।

— ঠিক আছে রাখুন তাহলে।

.
.
.

লাইন কাটতেই কান থেকে ফোন নামালো মজিদ। মুখের মলিনতা এখনও কাটেনি তার। কলিজা সমতূল্য সন্তান কে শ্বশুর বাড়ি পাঠালে বাবা মায়ের ছটফটানি পৃথিবীর কারোরই বোধগম্য হয়না।

মজিদের বিষন্ন ভাব দেখে ওনার দিকে এগিয়ে এলেন মিনা।

— মেয়েটার সাথে কথা হলো?

জবাবে পেছন ফিরে তাকালেন মজিদ । পূর্বের থেকেও মলিন হয়ে এসছে তার মুখমণ্ডল।

— না,

— কি বললো?

— ঘুমিয়ে পরেছে…

— ওহ। হতে পারে,এত টা পথ কখনও যায়নি তো। ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে হয়তো।

— হুম।

— মন খারাপ করোনা। পরে না হয় কথা বলে নিও।

উত্তর দিলেন না মজিদ,আগের মতোই মাথাটাকে নিচু করে রাখলেন।

— কি ভাবছো??

— মেয়েটা সুখি হবে তো মিনা?

— নিশ্চয়ই হবে,,রাজপূত্রের মত মেয়ে জামাই,তার ওপরে কত টাকা পয়সার মালিক বলোতো।

— টাকা দিয়েই কি আর সুখ কেনা যায় বলো??

— তা হয়তো যায়না। তবে তিন বেলা পেট পুড়ে খেতে তো পারবে। আমাদের মত অভাবে তো আর থাকতে হবেনা বলো।

এবারো চুপ করে রইলেন মজিদ।মেয়েটার মুখ টা ভীষণ মনে পরছে। যাওয়ার সময় কি কান্না টাই না করছিলো তাকে জড়িয়ে। ভবিষ্যতে আল্লাহ যা করবেন তা ভালোই হবে এটাই ভরসা এখন ।

.
.
.
.

অন্যদিকে কাঁদতে কাঁদতে গলা শুকিয়ে এসেছে স্নিগ্ধার। সকাল থেকে পেটে একটি দাঁনা অব্দি পরেনি তার। পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে বালিশ থেকে মাথা ওঠালো স্নিগ্ধা।

তবে কক্ষের কোথাও পানি না দেখে আশাহত হলো সে।তবে সব কিছুর মাঝেও বিছানার পাশে রাখা টেবিলের ওপর একটা ল্যান্ড ফোন দেখতেই এক ক্ষীন আলোতে চকচক করে উঠলো স্নিগ্ধার মুখমণ্ডল। ধড়ফড় করে উঠে পরলো সে। চোখ মুছে ফোন উঠিয়ে কয়েকটা বোতাম চেপে ডায়াল করতে শুরু করলো নিজের বাবার নম্বরে। তবে সে আশাতেও ভাঁটা পরলো তার।

ফোনের নিচে লাগানো তার টা কাটা খেয়াল করতেই হতাশ হলো স্নিগ্ধা। তার মানে পুরো আটঘাট বেধেই এখানে আনা হয়েছে তাকে?
ধুপ করে হাত থেকে ফোন পরে গেলো স্নিগ্ধার। চোখের পানি গুলো আবারো সাড়িবদ্ধ হয়ে পরতে শুরু করলো।
পুনরায় গলা ফাটিয়ে কান্নায় ভেঙে পরলো স্নিগ্ধা।
তার মুখ থেকে ক্রমাগত অস্ফুটস্বরে বের হতে শুরু করলো,

— এ তুমি আমায় কোথায় পাঠালে বাবা?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here