অসম্ভবেও আমার তুমি নুসরাত সুলতানা সেজুথি পর্ব–০২

0
104

#অসম্ভবেও আমার তুমি
নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–০২

সারা দিনের ব্যাস্ততা শেষে বাড়ি ফিরলো আবরার। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই ড্র‍য়িং রুমের সোফার সাথে মাথা এলিয়ে বসে থাকা তনয়া কে দৃষ্টি গোচর হলো তার।প্রতিদিন কার মতো আজকেও আবরারের জন্যে তনয়ার অপেক্ষা করার এই ব্যাপারটা কোনও নতুনত্ব আনেনি।

বরাবরের মতোই এতে বিরক্তবোধ করলো আবরার। তার দৃষ্টিতে এটা শুধুমাত্রই আদিক্ষেতা।
আবরারের উপস্থিতি টের পেতেই ধড়ফড় করে উঠে দাড়ালো তনয়া।
শাড়ির আঁচলটাকে পিঠের সাথে ভালো করে টেনে নিয়ে ধীর গলায় বলে উঠলো,

— আপনি এসেছেন,,,যান ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি খাবার বাড়ছি টেবিলে।

কথাটা বলেই সামনের দিকে এগোতে ধরলো তনয়া। তবে দু পা এগোতেই পেছন থেকে ডেকে উঠলো আবরার।

— শুনুন….?

আবরারের গলার আওয়াজে বেশ ভালো লাগা কাজ করলো তনয়ার। উৎফুল্ল মন নিয়ে পিছু ফিরলো সে।

— জ্বি…?

— স্নিগ্ধা খেয়েছে কিছু??

আবরারের এমন কথায় মলিন হয়ে এলো তনয়ার মুখমণ্ডল। মুখের স্মিত হাসি উবে গেলো নিমিষেই। চোখের কোটর ভরে আসা পানিগুলো গড়িয়ে পরা আটকাতে মাথা নিচু করে নিলো সে।

“” কই বিয়ের এক বছরে কখনোই তো আবরার জিজ্ঞেস করেনি সে খেয়েছে কিনা?? সে তো ভেবেছিলো মানুষ টাই এমন,,,মেয়েদের ভালো লাগা খারাপ লাগার মূল্য দিতে জানেনা। কিংবা জানেনা খেয়াল রাখতে। কিন্তু নাহ,,
আজ নতুন বউ পেয়েই সব নিয়ম পাল্টে এসেছে।তবে কি সব অনিয়ম তার বেলাতেই ছিলো?
অন্যদিকে নিজের কথার উত্তর
না পেয়ে কপাল কুচকে নিলো আবরার।

— কি হলো কিছু জিজ্ঞেস করেছি আপনাকে?

— জ্বি শুনেছি…

—- শুনেছেন?? উত্তর কে দেবে?

—- আমি জানিনা ও খেয়েছে কিনা,তাছাড়া এ নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ ও নেই…

কথাটা বলে দিয়ে আর দাড়ালোনা তনয়া। উল্টো ঘুরে হাটা ধরলো সামনের দিকে। মুখের ওপর এমন কাঠকাঠ জবাব পাওয়ায় চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আবরারের। এই মেয়ের এত সাহস তার সামনে এমন কথা বলে? তবে এই মুহুর্তে তনয়াকে শিক্ষা দেয়ার থেকেও স্নিগ্ধার কাছে যাওয়া বেশি জরুরি বলে মনে হলো আবরারের,,সেই দুপুর থেকে একবারো তার পরি টাকে দেখা হয়নি যে…!!

.
.
.
.

দরজা খোলার শব্দ পেয়ে খানিকটা ঘাবড়ে গেলো স্নিগ্ধা। চোখ মুছে হকচকানো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সেদিকে। কে এসেছে বোঝার আগেই ঘরের আলো জ্বলে উঠলো তার। মুহুর্তেই আবরারের মুখ টা স্পষ্ট হয়ে এলো তার সামনে।

খাবার ভর্তি প্লেট আর পানি নিয়ে তার পাশে দাড়িয়ে রয়েছেন একজন পুরুষ সার্ভেন্ট। লোকটিকে ইশারা করতেই খাবারের ট্রেটা এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর রেখে দিলেন তিনি। এরপর নতজানু ভাবে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।
লোকটি প্রস্থান নিতেই দরজার লক টেনে দিলো আবরার। হাসি মুখে এগিয়ে এসে বসলো স্নিগ্ধার মুখোমুখি। মুহুর্তেই মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো স্নিগ্ধা। ব্যাপারটা আবরারের ইগোতে কিঞ্চিৎ প্রভাব ফেললেও পরক্ষনেই রাগ কে দমিয়ে হেসে উঠলো সে।

— রাগ করেছো পরি?? সারাদিনে তোমার খোঁজ নেইনি বলে? আসলে হুট করে একটা আর্জেন্ট কাজ পরায় এতোটা ব্যাস্ত ছিলাম আজ। তবে এরপর আর এমন হবেনা।

আবরারের কথায় আগ্রহ দেখালোনা স্নিগ্ধা। পূর্বের মতোই মুখ শক্ত করে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইলো সে।

এবার ওর দিকে আরেকটু এগিয়ে এলো আবরার। ট্রে থেকে খাবারের প্লেট হাতে নিতে নিতে বলতে লাগলো…

— তোমার নিশ্চয়ই ভীষণ খিদে পেয়েছে?? অবশ্য পাওয়ার- ই কথা,সারাদিনে দাঁতে একটা দানাও কাটোনি তুমি,,,যদিও এজন্যেও আমি দ্বায়ী,,আমার তোমার খেয়াল রাখা উচিত ছিল,,,প্রথম দিন তো,তাই একটু ভুল হয়ে গেলো,,পরেরবার আর এমন হবেনা বললাম নাহ।

মাংস তরকারীর সাথে ভাত মেখে এবার স্নিগ্ধার সামনে উঁচিয়ে ধরলো আবরার।

— নাও খেয়ে নাও।

দ্বিরুক্তি দেখালোনা স্নিগ্ধা। যেখানে আবরার কে দেখা মাত্রই রাগে শরীর জ্বলছে তার,, সেখানে সেই লোকের হাতে খাবার খেতেও ঘৃনা অনুভূত হচ্ছে,,,

— কি হলো পরি? খাবার ধরে আছিতো… খাও। দেখো আমিও এখন অব্দি খাইনি,,ভেবেছি এক প্লেটে খাবো দুজন। ভালোবাসা বাড়বে এতে বুঝলে,,

এবার যেন মুহুর্তেই তেঁতে উঠলো স্নিগ্ধা। এক ধাক্কায় আবরারের হাতের ভাত ফেলে দিলো মেঝেতে।

— ভালোবাসা? কিসের ভালোবাসা? আপনার আর আমার মধ্যে কখনো ভালোবাসা হতেই পারেনা। আপনি একটা মিথ্যেবাদি… আর…

পুরোটা শেষ করার আগেই রাগে বাম হাত দিয়ে স্নিগ্ধার চোয়াল চেপে ধরলো আবরার।

— তোর এত বড় স্পর্ধা তুই আবরার ফাহাদ চৌধুরী হাতের খাবার ফেলে দিস?? (দাঁতে দাঁত চেপে)

আবরারের হাত ছাড়াতে নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে যাচ্ছে স্নিগ্ধা,,ব্যাথায় গাল যেন ছিড়ে যাচ্ছে তার।
তবুও কোনও রকম মুখ থেকে মৃদু আওয়াজ বের করে বলে উঠলো,,,

— লাগছে,ছাড়ুন আমায়…

স্নিগ্ধার মুখের ভঙ্গিমা দেখে হাত সরিয়ে নিলো আবরার।
চোখ বন্ধ করে লম্বা এক নিঃশ্বাস নিয়ে রাগ কে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো খানিকক্ষণ। এরপর শান্ত স্বরে বলে উঠলো,

— দেখো আমাকে রাগিও না।চুপচাপ খেয়ে নাও,,,

— আমি আপনার হাতে খাবোনা।

— আরেকবার বলবো পরি,,,
হা করো,,

এবারো আগের মত একিভাবে বসে রইলো স্নিগ্ধা।
উঠে এসে আবারো স্নিগ্ধার গাল জোরে চেপে ধরলো আবরার,, এবার জোর – পূর্বক স্নিগ্ধার মুখকে হা করিয়ে অন্য হাত দিয়ে এক লোকমা খাবার পুড়ে দিলো সেখানে,

খাবার মুখে পুড়ে দিয়ে,, এসে আবার নিজের জায়গায় বসে পরলো আবরার। ফোস করে এক নিঃশ্বাস নিয়ে পুনরায় খাবার মাখায় মনোযোগ দিলো সে।

খাবার চিবোতে থাকা অবস্থাতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো স্নিগ্ধা। কাঁদতে কাঁদতে একদিনেই চোখের নিচে চামড়া ছিলে গিয়েছে তার। যার দরুন এক ফোটা নোনা অশ্রু গড়াতেই জ্বলে উঠলো জায়গাটিতে।
তবুও এমন ব্যাথা বড়ই ক্ষীন মনে হলো স্নিগ্ধার। অন্তত যেই রক্তক্ষরণ তার ভেতরে হচ্ছে তার তুলনায় এ -যে কিছুই নয়।

,
,
,

তবে এবার নির্বিকার থেকেই বেশ শান্ত ভাবে খেয়ে নিতে শুরু করলো স্নিগ্ধা। এদিকে এক লোকমা তাকে খাওয়াচ্ছে আবরার,, তো অন্য লোকমা নিজে খেয়ে নিচ্ছে।খাওয়া শেষে অনেক যত্ন নিয়ে নিজের হাত দিয়ে স্নিগ্ধার মুখ টা কেও মুছিয়ে দিলো আবরার।

— কি লক্ষী মেয়ের মত খাবার খেলে,,এরকম টা শুরুতে করলেই পারতে,কেন বারবার ইচ্ছে করে আমায় রাগাও বলোতো??

জবাব দিলোনা স্নিগ্ধা,,,শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আবরারের দিকে,,,,,পুনরায় আবরার নিজে থেকেই বলে উঠলো,,

— খাওয়া শেষ, ঘুমিয়ে পরো এবার।

ঝুঁকে এসে স্নিগ্ধার কপালে চুঁমু একে দিলো আবরার। এতে যেন ঘৃনায় তেঁতো হয়ে এলো স্নিগ্ধার পুরো শরীর,তবুও বিন্দুমাত্র প্রকাশ করলোনা সে। প্রকাশ করলেই কোন ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে কে জানে?

স্নিগ্ধাকে শুইয়ে দিয়ে বুক সমান কাথা টেনে দিলো আবরার।
মুচকি হেসে রুমের আলো নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পরলো সে,,,তবে এবারো দরজাটা বাইরে থেকেই টেনে দিয়েছে আবরার।
আবরার বেরিয়ে যেতেই স্বস্তির এক নিঃশ্বাস নিলো স্নিগ্ধা।
“” যাক! লোকটা এই রুমে শোবেনা আজ এটাই নিশ্চিন্তের। একটা দিন অন্তত বেঁচে গেলো পশুর আক্রমণ থেকে।

.
.
.
.

নিজের রুমে এসে তাড়াহুড়ো করে বিছানায় শুয়ে পরলো তনয়া। চোখের পানি বাঁধ মানছেনা তার। এতক্ষন আবরার আর স্নিগ্ধার ঘটে যাওয়া সব কর্মকাণ্ডই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলো সে।স্নিগ্ধার রুমের জানলা দিয়ে।

“” আবরার কত যত্ন নিয়ে খাইয়ে দিচ্ছিলো মেয়েটাকে,, আজ অব্দি এর তিল পরিমান যত্ন তাকে করেনি…! আর মেয়েটা? কত বড় বোকা! যে ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে সে নিজে ছটফট করছে সেই ভালোবাসা পেয়েও পায়ে ঠেলছে ওই মেয়ে? এটাই বুঝি ভাগ্য,কেউ চেয়েও পায়না,,আর কেউ পেয়েও সেটা চায়না।
ভাবতেই হেসে উঠলো তনয়া। ততক্ষনে রুমে প্রবেশ করেছে আবরার। উপস্থিতি টের পেতেই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান ধরে রইলো তনয়া।

এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে চুপচাপ তনয়ার পাশে এসে শুয়ে পরলো আবরার। প্রচন্ড শীতেও এসির হীম বাতাস উপভোগ করা তার অন্যতম অভ্যাস বলা যায়।

টানটান হয়ে ওপরের দিকে মুখ করে শুয়ে রইলো আবরার। পাশে ঘুমিয়ে থাকা তনয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো একবার। তনয়ার চোখের পাতা কাপতে দেখে বুঝতে পারলো ঘুমোয়নি তনয়া।ঘুমের ভান করছে মাত্র। বিষয় টাতে বেশ মজা উপভোগ করলো আবরার। বলে উঠলো,,

— আমি জানি আপনি ঘুমোন নি,,

এ পর্যায়ে চট করে চোখ খুললো তনয়া। হয়তোবা ধরে পরেছে সে… আবরারের কথার জবাবে তার ভীষণ বলতে ইচ্ছে করলো….
“” যার কপালে সতীন এসেছে তার কি আর ঘুম আসে? তবুও মনের ইচ্ছেকে দমিয়ে নিলো তনয়া,,বললো,,,

— না ঘুমোয়নি,,,কিছু বলবেন?

— হ্যা। অকারণে তো আর আপনাকে ডাকিনি এভাবে,,

— তাও ঠিক ( মলিন হেসে) বলুন,কি বলবেন?

— এবার থেকে একা ঘুমোনোর অভ্যেস করে নিন,,

— কেনো??

— কাল থেকে ও ঘরে থাকবো আমি,,আমার স্ত্রীর সাথে।

এরুপ কথায় বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো তনয়ার। গলার মধ্যে দলা পাকানো কান্না গুলো উপচে আসতে শুরু করলো,
“” শেষ মেষ এ-ও তার কপালে ছিলো,??

যদিও আবরারের রাগ কে ভীষণ ভয় লাগে তনয়ার,,
তবুও সাহস করে বলেই উঠলো…

— ওই মেয়েটা আপনার স্ত্রী হলে আমি কে??

— আপনিও আমার স্ত্রী।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here