#অসম্ভবেও আমার তুমি
নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–১৪
খুব সকালে ঘুম ভাঙলো স্নিগ্ধার।ঘুমুঘুমু আলসেমি কেটে উঠলে চোখ মেলে তাকালো,,,,,,দু হাত বিস্তৃত করে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো তারপর।
রুমের মধ্যে থাই গ্লাশ ভেদ করে দু একটা পাখি ডাকার শব্দ আসছে,,,, সেদিকে তাকিয়ে পিঠ অব্দি ছড়ানো চুল গুলোকে হাত খোপা করে নিলো স্নিগ্ধা,,,,ঘাড় বাকিয়ে তাকালো পাশে উপুড় হয়ে ঘুমে তলিয়ে থাকা আবরারের দিকে,,
সকালের কুসুম রঙের রোদ পর্দার ফাকা দিয়ে উকি দিচ্ছে,,,,,একটু বাদে বাদে ছুয়ে যাচ্ছে আবরারের মুখ টাকে,,,চুল গুলো মৃদূমন্দ বাতাসে ঈষৎ উড়ছে,,,,
ঠোঁট উল্টে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আবরার,,,একেবারে বছর তিন চারেকের বাচ্চাদের মত। স্নিগ্ধা মনোযোগ দিয়ে দেখলো আবরার কে,,, ছেলে হলেও ভ্রু,,, চোখ থেকে শুরু করে নাক ঠোঁট সব গুলোই একেবারে নিখুঁত ভাবে হাতে আকার মত,,
কানের পাশে ছোট্ট একটা গাঢ় কালো কুচকুচে তিল আবরারের,,,, স্নিগ্ধা আর দৃষ্টি ফেরায়না,,,একভাবে দেখতে শুরু করে,,
বিয়ের এখন দিন পনেরো পার হতে চললো,,,, এত দিনে এত নিপুন ভাবে আবরার কে এই প্রথম পর্যবেক্ষন করছে স্নিগ্ধা ,,,
স্নিগ্ধার মনে পড়ে বিয়ের দুদিন আগের কথা,,,, আবরারের জোরপূর্বক তাকে সাথে নিয়ে মেলায় ঘোরার মুহুর্ত টা,,,কতটা অস্বস্তি হচ্ছিলো সেদিন,,,,নাগর দোলায় উঠে ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘেঁষে বসেছিলো আবরারের পাশে,,,চড়কি ঘুরতে শুরু করলেই ঘাবড়ে গিয়ে আবরারের এক বাহু জাপটে ধরেছিলো।
সেদিন গ্রাম্য পরিবেশে একটা ছেলের সাথে এভাবে মেলায় ঘুরে বেড়ানোয় সবাই কতটা বাকা চোখে তাকাচ্ছিলো তাদের দিকে,,,কেউ বা অবাক চোখে দেখছিলো জমিদারের ছেলের সাথে তাকে এভাবে মিশতে দেখায়,,
অবশ্য ওদের মত সেদিন সে নিজেও তো জানতোনা,,,যে এই ছেলেটাই তার বর হবে…!! এই ছেলের অর্ধাঙ্গিনী হতেই তার পৃথিবীতে আসা।
স্নিগ্ধা ,বাবার মুখে সব সময় শুনতো,,,আবরার দের পরপোকারি উদাহরণ,,,,অবশ্য সে নিজেও মুগ্ধ হয়েছিলো আবরারের ব্যাবহার,, আচার,সৌজন্যে। কত বড় ঘরের ছেলে হলেও অহংবোধের লেশ মাত্র ছিলোনা,,
,কিন্তু এই বাড়িতে পা রেখে যেদিন তনয়ার মুখোমুখি হয়,,,সেদিন জমে আসা সব ধারনা ভুল মনে হয়,,,, মনে হয়েছিলো এ কদিনে পাওয়া আবরারের পরিচিতি শুধুমাত্র একটা মুখোশের মত ,,
কিন্তু নাহ! আদৌ সেরকম নয়,,,তার সব ভুল ভেঙেছে। বলা বাহুল্য খুব তাড়াতাড়িই ভেঙেছে।
আবরারের ব্যাপারে শোনা প্রত্যেকটা কথাই,,,সত্যি। সম্পূর্ন রুপে সত্যি,,
আবরার কে এখন ভালো লাগে,,,ভালো লাগে আবরারের হাসিখুশি তে পূর্ণ মুখটাকে,,,সেই সাথে ভালো লাগতে শুরু হয়,,,আবরারের দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসা গুলোকে,,
স্নিগ্ধা নিচের দিকে তাকিয়ে আনমনে মুচকি হেসে ওঠে,,, মৃদূ পলক ফেলে আবরারের দিকে তাকালেই চমকে উঠলো একেবারে,, আবরার ভ্রু কুচকে কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে,,,
আচমকা ভড়কে ওঠে স্নিগ্ধা,,,চোখ গুলো গোলগোল হয়ে আসে,,,উদ্বেগ নিয়ে বলে,
— আপনি না ঘুমিয়ে ছিলেন..??
আবরার উপুড় থেকে এবার স্নিগ্ধার দিকে পাশ ফিরে শোয়,,,ভ্রু নাঁচিয়ে বলে,
— একা একা হাসছিলে কেন..??
স্নিগ্ধা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে,,মনে মনে ভাবে
— উনি আবার বুঝে যায়নিতো? আমি ওনাকে দেখছিলাম..??
আবরার একিভাবে দুই ভ্রু নাচায়,,,বলে,
— আবার কি ভাবছো?? এই তোমাকে ভূতে টুতে ধরেনিতো আবার.?
স্নিগ্ধা কপালে ভাজ ফেলে বললো,,
— ভূতে ধরতে যাবে কেন..??
— একা একা হাসলে তো ভূতে ধরে শুনেছি,,
আবরারের কথায় স্নিগ্ধা ছোট্ট করে দম ফেলে পুনরায় মনে মনে বললো,,
— আর প্রেমে পড়লে যে মানুষ একা একা হাসে,ভাগ্যিস সেটা শোনেন নি.!!
আবরার এবার স্নিগ্ধার মুখের সামনে হাত নাড়লো,,গলা বাড়িয়ে বললো,,
— এই মেয়ে,,জেগে আছো তুমি..??
স্নিগ্ধা নড়ে ওঠে,,,আবরারের দিকে তাকিয়ে ব্যাগ্র গলায় বলে,,
— জেগে আছি মানে টা কি??চোখ মেলে কি কেউ ঘুমোয় নাকি..??
আবরার উঠে বসতে বসতে বললো,,
— কি জানি,,যা সব লক্ষন দেখছি,,,কিছুইতো বুঝতে পারছিনা…!!
স্নিগ্ধা কপাল কুঁচকে বললো,,
— কি এমন দেখলেন রে বাবা…??
আবরার মাথা নাড়লো এক দিকে,,,বললো,
— অনেক কিছুই,,তবে সেসব তো এখন বলবোনা,,,এখন তৈরি হতে হবে,,,কিন্তু কটা বাজে..??
কথাটা বলে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা ঘড়ির দিকে তাকায় আবরার,,,ঘড়ির কাটা,,আট টা ছুইছুই দেখে আলোড়িত গলায় বলে ওঠে,
— বাহ,,একদম পার্ফেক্ট টাইমে ঘুম টা ভাঙলো,,,
এটুকু বলে স্নিগ্ধার দিকে চোখ ফিরিয়ে হাসিমুখ করে বললো,,
— এত সকালে এই প্রথম উঠলাম,,,ছোট বেলায় আরলি রাইজিং পড়লেও আরলি রাইজার হওয়া আর হয়ে ওঠেনি,,
কথাটায় স্নিগ্ধা ঠোঁট প্রসারিত করলো,,,তবে শব্দহীন হাসিতে,,আবরার কয়েক মুহুর্তে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, পরক্ষণে ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলে উঠলো,,
— এখন এত তাড়াতাড়ি ওঠার জন্যেতো তোমাকে একটা উপহার দেয়া উচিত পরি…তাইনা..??
স্নিগ্ধা বুঝতে না পেরে বলল
— এটার জন্যে আবার উপহার?? এতে আমি কি করলাম?? আমিতো আপনাকে ডাকিওনি,,,আপনি নিজে থেকেই তো উঠলেন,,
উত্তর না দিয়ে আবরার জানলার দিকে তাকায়,,চোখ ইশারা করে উদ্বেজিত ধ্বনি নিয়ে বললো,,
—- আরে ওই দেখো ওটা কি..??
স্নিগ্ধা কৌতুহল নিয়ে ঘাড়া বাকা করে তাকালো,,,চট করে স্নিগ্ধার গালে চুমু খেলো আবরার।ভড়কে উঠলো স্নিগ্ধা,,,অবাক চোখে তাকালো আবরারের দিকে,,,
আবরার বাকা ঠোঁটে হাসছে,,,স্নিগ্ধা মুখ হা করে কিছু বলতে ধরলে আবরার তাড়াহুড়ো করে উঠে পরে বিছানা ছেড়ে,,,স্নিগ্ধার থেকে কয়েক কদম দূরে সরে উদ্বেগ হীন গলায় বললো,
— মাই ফেইরি,,,দিস ইজ ইওর গিফট,,,( এটাই তোমার উপহার পরি)
আবরার আর অপেক্ষা করলোনা,,,হাসিহাসি মুখ করে বেরিয়ে পরলো রুম ছেড়ে,,, অন্যদিকে কয়েক মুহুর্ত বোকার মত সেদিকে তাকিয়ে থেকে গালে হাত বোলালো স্নিগ্ধা,,,সাথে সাথে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁট জুড়ে,,
,,,
,,,
,,,
ভর্তির কাজ বেশ আরামসে পূরন হলো স্নিগ্ধার,,,যদিও সামান্য হলেও কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আবরারের,,,তাও এর আঁচ লাগেনি স্নিগ্ধার গায়ে,,,নতুন করে পড়া শুরুর আনন্দে মনটা উৎফুল্লতায় ছেয়ে আছে তার। আবরার কে মনে মনে শতশত বার ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করছে,,
ভার্সিটির গেটে প্রথম পা রেখে যেভাবে হৃদস্পন্দন বাড়ছিলো ক্রমশ,,এখনও তার রেশ কাটেনি। সব কাজ শেষে অধ্যক্ষের অফিস থেকে মাত্রই স্নিগ্ধার হাত আকড়ে বের হলো আবরার,,,
আবরারের মুখের ভঙিমা স্বাভাবিক থাকলেও স্নিগ্ধা অবাক চোখে এদিক সেদিক দেখছে,,কত কত মানুষ,, কত ছেলে মেয়ে,,, সবাই কত্ত টিপটপ,,সাথে কি সুন্দর বিস্তৃত দালানের কাঠামো গুলো,,,
স্নিগ্ধার ভারি অদ্ভূত লাগে একটা কথা ভাবতেই,,কোনও ভাবে যদি এর একটাও ভেঙে মাথার ওপর পরে?? তবে কি হবে..?? কেন এত উচু করে বানাতে হলো দালান গুলো,,আরেকটু নিচু বানালেও পারতো,সময় ও বাঁচতো সাথে পরিশ্রম ও,,
ভাবনার এক ফাকে স্নিগ্ধার চোখ পৌছালো একটু দূরে সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকা বাদাম গাছের দিকে,,,একত্র হয়ে এক সাথে কত গুলো মেয়ে আড্ডা দিচ্ছে তার নিচে,,বিষয় টা এখানেই শেষ নয়,মূল ব্যাপার হলো সবাই কেমন অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে তাদের দিকে,
এমন চাহনী দেখে মৃদু কপাল কোচকালো স্নিগ্ধা,,,এভাবে তাদের দেখার কি আছে?? মেয়েগুলো কি আদৌ তাদের দেখছে নাকি অন্য কোনও ব্যাপার,,
কয়েক মুহুর্ত এই নিয়েই মাথা ঘামালো স্নিগ্ধা,,ঘাটতে ঘাটতে আচমকা মূল বিষয় মাথায় এলো,,,বুঝতে পারলো মেয়েগুলোর দৃষ্টির মানে,,,চট করে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো স্নিগ্ধার,,,তাড়াহুড়ো করে তাকালো আবরারের দিকে,,,
আবরার সামনের দিকে তাকিয়ে একভাবে হাটছে তো হাটছেই,,স্নিগ্ধা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবারো মেয়েগুলোর দিকে তাকায়,,,
এবার ভারি বিরক্ত লাগতে শুরু করে তার,,,এভাবে অন্যের বর কে দেখার কি আছে?? কিরকম নির্লজ্জের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে,,,,যেন জীবনে কোনদিন ছেলে দেখেনি।
স্নিগ্ধা দাঁতে দাঁত চেপে নিলো,,,আবরারের ধরে রাখা হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরলো,,চোখ গুলো এখনও মেয়েগুলোর দিকেই,,স্পর্শ পেয়ে আবরার কৌতুহল নিয়ে তাকালো স্নিগ্ধার দিকে,,,
ধীর আওয়াজে বললো,
— যেভাবে ধরলে, মনে হচ্ছে আমি পালাচ্ছি…
স্নিগ্ধা আবরারের দিকে না তাকিয়েই বলল,
— পালানো এত সহজ নাকি,আমি ধরে আছিনা।
কথাটার মাথামুণ্ডু কিছুই ঢুকলোনা আবরারের মাথায়,,এ নিয়ে ঘাটলোওনা খুব বেশি,,,আবারো সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে এগোতে লাগলো,,
,,
,,
একটা সময় গেটের কাছে আসতেই গাড়ির দরজা খুলে দিলো আবরার,,স্নিগ্ধা পেছন ঘুরে ক্ষনে ক্ষনে মেয়ে গুলোকে দেখছে,,,
মেয়েগুলো এখনও তাকিয়ে আছে আবরারের দিকে,,,অনেকটা মুখ হা করে থাকার মত,,,এসব দেখে গায়ে ভীষণ জ্বালা করছে স্নিগ্ধার,,,
,না পারছে গিয়ে কিছু বলতে আর না পারছে চুপচাপ হজম করে নিতে,,,,
আবরার স্নিগ্ধার দিক থেকে সাড়া না পেয়ে গলা বাড়িয়ে বলল,
— কি হলো পরি,,ওঠো গাড়িতে,,
কথাটা কানে পৌঁছাতেই আবরারের দিকে তাকালো স্নিগ্ধা,,পুনরায় একবার রাগী চোখে মেয়ে গুলোকে দেখে নিয়ে উঠে পরলো গাড়িতে,,
স্নিগ্ধার এমন ব্যাবহারে সামান্য হলেও কৌতুহল হল আবরারের। প্রশ্ন না তুলে নিজেও ঘুরে গিয়ে বসে পরলো ড্রাইভিং সিটে,,,,!!
গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখে গাড়ি স্টার্ট করতে উদ্যত হলো আবরার,, এর মধ্যেই পাশ থেকে স্নিগ্ধা গোমড়া মুখে বলল,,
— আপনি আজ এত সেজেগুজে এসছেন কেন..?
সরু চোখে তাকালো আবরার।বললো,,
— মানে..??
স্নিগ্ধা গাল ফুলিয়ে বললো,
— ওই মেয়ে গুলো আপনার দিকে কিভাবে হা করে তাকাচ্ছে দেখেছেন,,, আপনি এভাবে এসছেন বলেই তো..সব দোষ আপনার।
বোকা বোকা চাহনীতে নিজেকে একবার আপাদমস্তক ভ্রু কুঁচকে কুঁচকে দেখলো আবরার,,,এরপরে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বলল,,
— আমিতো কিছুই বুঝলাম নাহ,,আমি কি করেছি??
স্নিগ্ধা উত্তর দিলোনা,,ঠোঁট উল্টে বসে রইলো,,,,,,
আবরার ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝে নিতে অপর পাশের জানলা দিয়ে তাকালো একবার,,,একই সময় আবরারের দিকে তাকালো স্নিগ্ধা,,,কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েদের দিকে আবরারের দৃষ্টি দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,,
— আপনি ওদিকে কেন তাকাচ্ছেন..??
আবরার তাড়াহুড়ো করে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো, বললো,,
— আরে বাবা,,আমিতো দেখছিলাম,,যে,,
স্নিগ্ধা মাঝপথে কথা কেড়ে নিয়ে বললো,,
— কি দেখছিলেন হ্যা?? মেয়ে দেখলেই তাকাতে হবে..??
আপনি ও একইরকম।খুব বাজে,, খুব খারাপ।
আবরার খানিক ক্ষন দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা নিয়ে স্নিগ্ধার মুখটা কে পর্যবেক্ষন করলো,,পরক্ষনে মুচকি হেসে ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,,
— বাই এনি চান্স,,, তুমি কি জেলাস ফিল করছো পরি..??
স্নিগ্ধা নাক মুখ কুঁচকে তাকায়,,,বলে ওঠে,,
— না।
আবরার ফিচেল গলায় বলল,
— আমার কিন্তু মনে হচ্ছে,,,
স্নিগ্ধা ক্ষেপে উঠে বললো,
—মনে হলে তাই,,দয়া করে আমার দিকে আর ওই মেয়ে দের দিকে না তাকিয়ে গাড়ি চালাতে মন দিন,,,
আবরার ঠোঁট টিপে হেসে চোখ ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকালো,,,
বলল,, — জেলাস নেস খুবই ভালো জিনিস,,,অন্তত ভালোবাসার ক্ষেত্রে,,
স্নিগ্ধা চট করে তাকায়,,মুখে কিছু বলেনা,,আবরার গাড়ি স্টার্ট করতেই নিমিষেই ভার্সিটির গেট থেকে হাওয়া হয়ে পরে সেটি।স্নিগ্ধা মনে মনে ভাবে,,
“” যাক বাবা! অন্তত মেয়েগুলোর কুনজর থেকে রক্ষা পাওয়া গেলো,,,
,,
,,
,,
গাড়ি এসে থামে একটি বড় জায়গা জুড়ে বিস্তৃত পার্কের সামনে,,স্নিগ্ধা জানলা থেকে মাথা বের করে,, দেখে অবাক হয়ে বলে,
— আমরা এখানে কেন এসছি..?
উত্তর পেতে স্নিগ্ধা আবরারের দিকে ফেরে,,আবরার যথাযথ উত্তর না দিয়ে নিজের সাথে সাথে স্নিগ্ধার সিট বেল্ট খুলে দিতে ব্যাস্ত হয়ে পরলো,,এরপর নেমে পরে দরজা খুলে,,,ঘুরে এসে স্নিগ্ধার পাশের দরজাও খুলে দেয়,,,ধীর পায়ে নেমে পরে স্নিগ্ধা।
আশেপাশে তাকায়,,,লোকালয় হলেও লোক সামান্য হাতে গোনা হবে কেবল,,, তবে জায়গাটা মন কাড়ার মত সুন্দর,,, আর যথেষ্ট কোলাহল হীন।
সামনে গোলাপি পদ্ম ফুটে আছে দীঘির শ্যাওড়া যুক্ত পানিতে,,,পায়ের নিচে সবুজ ঘাস গুলো মাথা তুলে আছে,যদিও দুপুর বেলায় সামান্য ঘাড় নুইয়ে পরেছে তাদের,,,তবে শীতের শিশির বিন্দুতে রোদের আলো ঠেকতেই চিকচিক করছে মুক্তোর মত।
আবরার শিথিল গলায় বলল,
— চলো সামনে এগোই,,
এক পার্শ্বিক মাথা কাত করে চুপচাপ আবরারের পিছু ধরলো স্নিগ্ধা,,,ঘরের বাইরে এমন সবুজ প্রান্তরে এসে খুব একটা মন্দ লাগছে নাহ।
আবরারের পেছন পেছন এগিয়ে এসে দাড়িয়ে পরলো ওর সাথে সাথে,,
আবরার বেঞ্চি দেখিয়ে বললো,,
— তুমি বোসো আমি একটু আসছি।
স্নিগ্ধা চোখ বড় করে বলল,
— কোথায় যাবেন আমাকে রেখে????
আবরার ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই স্নিগ্ধা ইতস্তত করে বলল
— না মানে,,আমি একা বসে থাকবো তাই,,,
আবরার মুচকি হেসে বলল,
— ভয় নেই,আমি যাবো আর আসবো।
আবরারের যাওয়ার দিকে কিছু সময় একভাবে তাকিয়ে রইলো স্নিগ্ধা,,,
চোখ ফিরিয়ে আবারো আশেপাশে দেখতে শুরু করলো,,,একটু দুরুত্বের বেঞ্চিতে বসে থাকা এক জোড়া কপোত-কপোতী কে গা ঘেঁষে বসে থাকতে দেখে ভেতর ভেতর অদ্ভুত শিহরণ শুরু হলো আবরার কে নিয়ে ।
দশ মিনিটের মাথায় ফিরে এলো আবরার,,,পেছনে দুহাত লুকিয়ে স্নিগ্ধার সম্মুখে দাঁড়ালো। মুখে মিটিমিটি হাসি। ,ব্যাপারটায় স্নিগ্ধা ভ্রু ক্রুটি করে বলল,,
— কি হয়েছে??
আবরার কিছু বললোনা,,,তবে বসে পরলো হাটু গেড়ে,,চমকালো স্নিগ্ধা।এক ঝাক কৌতুহল চোখে মুখে মেখে তাকিয়ে রইলো,,,আবরার মুচকি হেসে বলল,,
— কখনও কাউকে এভাবে বলিনি,,,তবে সিনেমাতে দেখে দেখে শিখে নিয়েছি এ কদিনে,,
স্নিগ্ধার বোধগম্য হয়না,একিভাবে চেয়ে থাকে,,আবরার এবার পেছন থেকে দুহাত এনে স্নিগ্ধার সামনে ধরলো,,,দুহাত ভর্তি,,, সদ্য ফোটা,,, তাজা জলে ভেজা,, পদ্মফুলে,,
মুখ হা হয়ে এলো স্নিগ্ধার,,, আনন্দে ঠোঁট বিস্তৃত হলো মুহূর্তে।
আবরার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে শীতল গলায় বললো,,
🍁
তুমি চাইলে এনে দিতে পারি আকাশের ওই মেঘমালা,,রোদ্দুর।
পাড়ি দিতে পারি প্রেমের সমুদ্দুর।
তুমি চাইলেই নদী হয়ে বয়ে যাব,,পাড়ি দেব দূর্গম সব পর্বত মালা।
তুমি কি আমার হবে সারাবেলা??🍁🍁🍁
এটুকু বলে থামলো আবরার,স্নিগ্ধার বিস্ময়কর চাহনী এখনও কাটেনি,,চমকানোর দরুন চোখের পাতা ফেলে পলক অব্দি পরছেনা।আবরার মৃদু হেসে উদ্বেগ হীন গলায় বললো,,
— সবাই তো গোলাপ দিয়ে ভালোবাসা জানায়,,আমি তো ইউনিক তাই,,, আমার ভালোবাসা প্রকাশের ধরন টাও ইউনিক।
কাছাকাছি থাকা প্রত্যেকেই নিজেদের ব্যাস্ততা রেখে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে,,,চোখের সামনে লাইভ টেলিকাস্ট দেখলে সবার উত্তেজনাই অতিমাত্রায় স্বাভাবিক।
আবরারের কথায় স্নিগ্ধা নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওঠে,, ডুবু ডুবু সূর্যের মত লাল আভা গালে স্পষ্ট দাগ তুলে থাকে।
আবরার ঠোঁট উল্টে ছেলেমানুষী গলায় বলল,
— পরি,, নেবেনা আমার ভালোবাসা ?? পা ব্যাথা করছে তো..?
স্নিগ্ধা তাড়াহুড়ো করে ফুল গুলো নিয়ে নেয়,,,মৃদূ আওয়াজে বলে,
— আপনি উঠে দাড়ান,,,সবাই দেখছে,,
আবরার দৃঢ় ভাবে উত্তর দিলো
— সো হোয়াট,,,আমিতো আমার বউকে প্রোপোজ করছি,, অন্যের বউকে নয়,,ওরা দেখলেই বা কি?
স্নিগ্ধা নিচের দিকে চোখ রেখে লাজুক ভঙিতে বলল,
— তবুও উঠুন,আমার লজ্জ্বা লাগছে।
আবরার মাথা দুলিয়ে উঠে দাড়ায়,,,স্নিগ্ধার এক হাত ধরে দাড় করায় ওকে,,,কিঞ্চিৎ জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকে স্নিগ্ধা,,,,আবরার আবার কি করতে চাইছে সেই প্রশ্নই তার মনে।
আবরার স্নিগ্ধার দিকে গভীর মায়াময় দৃষ্টি তে তাকিয়ে থেকে অন্য হাত পকেটে গোজে,,,কয়েক সেকেন্ড পর একটি লাল রঙয়ের ছোটখাটো বক্স বের করে আনে,,,স্নিগ্ধা মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে,,,সেটাকে।
স্নিগ্ধার কৌতুহল এর উত্তর দিতে বক্স খুললো আবরার,,,মুহুর্তেই বিস্মিত হয়ে এলো স্নিগ্ধার মুখস্রী,,,ভেতরে সাদা পাথরে মোড়ানো একটি আংটি জ্বলজ্বল করছে,,,
স্নিগ্ধা অবাক হয়ে তাকালো,,আবরার সামান্য হেসে আংটি তুলে স্নিগ্ধার আঙুলে পরাতে উদ্যত হলো,,,
বাধ সাধলো স্নিগ্ধা,,,চট করে হাত নামিয়ে নিলো আবরারের হাত থেকে,,
আবরার ভ্রু কুঁচকে তাকালো,, বলল,,
— কি হলো??
স্নিগ্ধা নিচের ঠোঁট জ্বিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
— এটা নিশ্চয়ই হিরের..??আর অনেক দামি..??
— হ্যা তো..??
স্নিগ্ধা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
— আমি এটা নেবোনা…
ভ্রু কুঞ্চন গাঢ় হয়ে এলো আবরারের,,,বেশ অনেকটা রাগ লাগলেও শান্তভাবে প্রশ্ন করলো,
— কেন..?? পছন্দ হয়নি..??
স্নিগ্ধা আবরারের দিকে তাকালো,,,শীতল চাহনীতে। নিজের হাত ভর্তি পদ্ম ফুল গুলো উচিয়ে ধরে বলল,
— আপনার এই উপহার টাই আমার কাছে ভীষণ দামি ,,আমার আর অন্য কোনও উপহার চাইনা আবরার।
আংটিটা আপনি আপনার কাছেই রেখে দিন,,ভালোবাসার গভীরতা বোঝাতে আমার কাছে এই ফুল গুলোই যথেস্ট।
স্নিগ্ধার এমন কথায় মন প্রান জুড়িয়ে এলো আবরারের,,বিরক্তিতে মাখা মুখ চোখ মুগ্ধতায় ভরে আসে,,,
এক ভাবে চেয়ে থাকে স্নিগ্ধার স্নিগ্ধ মুখের দিকে,,,
“” নাহ এই মেয়েটাকে ভালোবেসে কোনও ভুল করেনি সে,,,
পরক্ষনেই চোখ নামিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নেয়,,,আবরার।ধীর আওয়াজে বলে,
— চলো যাওয়া যাক।
এক পাশে
মাথা নেড়ে সায় দিলো স্নিগ্ধা,,,হাতের মধ্যে ফুলগুলোকে শক্ত ভাবে ধরে নিয়ে আবরারের সাথে পা মিলিয়ে হাটতে শুরু করলো,,
আবরার স্বাভাবিক হাটলেও স্নিগ্ধা উশখুশ করছে বড্ড। কিছু একটা ভাবছে,,,অধৈর্য হয়ে হাটছে,,
হঠাৎই চোখ বন্ধ করে একটা দম নিলো স্নিগ্ধা।
ভীষণ সাহস আর জড়োতা কাটিয়ে অন্য হাত দিয়ে হালকাভাবে ধরলো আবরারের হাত টা।আবরার বিস্ময় নিয়ে তাকালো,,,
আবরার তাকাতেই স্নিগ্ধা লজ্জ্বায় হাত ছেড়ে দিলো। আবরার মুচকি হেসে বাম হাত দিয়ে চুল গুলো ওপরের দিকে একবার ঠেলে দিয়ে অন্য হাতে স্নিগ্ধার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো,,,
বলল,,
— এত লজ্জ্বা পাওয়ার কিছু নেই,,তোমার বরের হাত-ই তো…
স্নিগ্ধা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে,,,মাথা নুইয়ে রাখে পুরোপুরি লজ্জ্বা না কাটায়,,,
অতি সন্তর্পনে মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকায় আবরারের দিকে,,কখনও আবরার তাকিয়ে ফেললেও তড়িৎ গতিতে চোখ নামিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকায়,,
বিষয় টা অনেকটা হাইড এন্ড সিক খেলার মত মনে হয় আবরারের,,,স্নিগ্ধার লজ্জ্বা বাড়াতে তাও কোনও অনুভূতি প্রকাশ করেনা,,আদৌ বুঝতে দেয়না স্নিগ্ধার মধ্যে তার জন্যে তৈরি হওয়া অনুভূতির হদিস পেয়েছে সে সেই কথা।
কিছু সুন্দর মুহুর্তে চুপ থাকলে ক্ষতি নেইতো.. কেউ ভালোবাসা মুখ ফুটে বলে বোঝায়,,কেউ বা বোঝায় তার নিশ্চুপতার পরেও চোখের গহীন দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ।হোক না,, এর মাধ্যম টা ভিন্ন। ভালোবাসা তো পাল্টাচ্ছেনা।পাল্টাচ্ছেনা এর সঙ্গা।
,,
,,
দূর থেকে গাড়ির জানলা ভেদ করে স্নিগ্ধা আর আবরারের এমন মাখোমাখো প্রেম ক্ষিপ্ত নজরে দেখতে থাকে তনয়া,,,রাগে ক্রোধে কয়েক টুকরো তে পরিনত করতে ইচ্ছে হয় স্নিগ্ধাকে,,,
ইচ্ছে হয় দেয়াল হয়ে ওদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পরতে,,,যাতে অন্তত আমৃত্যু কেউ কারো দিকে চোখ দিয়ে হলেও ভালোবাসার বিনিময় করতে না পারে,
তনয়ার চোখের কোটর ভরে আসে জেদে,,,দাঁত চিবিয়ে বলে,
— অনেক উড়ছো তোমরা আবরার,,,অনেক। বেশ উড়ে নাও,,,কি ভাবছো আমি এত সহজে তোমাকে রেহাই দেবো আবরার?? নাহ! কখনোই নাহ। এরকম ভাবলেও ভুল ভাবছো তুমি,,আমার থেকে তোমার নিস্তার নেই,,,ভালোবেসেছি আমি,,,আমার ভালোবাসার দাম অবশ্যই আছে,,তুমি যদি তোমার ভালোবাসা পেতে জোর জবরদস্তি করতে পারো তবে আমিও পারি,,খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি আমি তোমার লাইফে,,, ভেবোনা।স্নিগ্ধার নতুন গজিয়ে ওঠা পাখা কাটতে আর তোমার দুদিনের ভালোবাসার দাফন করতে। এবার আমাকে সফল হতেই হবে,,
চলবে,,