আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে #পর্ব_২৭ Writer #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0
454

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_২৭
Writer #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

কেকের উপর নাম লেখা শেষ হতেই সুজানা হাঁফ ছাড়লো। কেকটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকবার দেখে ফোনে কয়েকটা ছবি নিল। মাকে ডাকতেই মা এসে হাজির। বললেন

শেষ হয়েছে?

হ্যা আম্মা। সুন্দর হয়েছে?

হুম।

সুজানা মায়ের মুখের দিকে তাকালো। কালকের জন্য আমার উপর রেগে আছ আম্মা? আমার মাঝেমাঝে কি যে হয়। মাথাটা একদম ঠিক থাকেনা আম্মা।

সন্তানের উপর মা কখনো রাগ করে থাকতে পারেনা। তবে সাবধান, বাইরের কারো সাথে যেন এমন না হয়। মুখের কথা কখনো ফিরিয়ে নেয়া যায় না।

মনে থাকবে আম্মা। আর কখনো এমন হবেনা।

বক্স করে নে। আর কাপড়গুলোও নিয়ে যাস মনে করে। আইরন করে ব্যাগ ভরে দিয়েছি।

আচ্ছা।

উনি যেতে গিয়ে আবারও ফিরে তাকালেন কেকের দিকে। নামটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাতেই সুজানা হেসে বলল

এটা স্যার লিখে দিতে বলেছেন।

নাম অভি?

উনাকে বাড়িতে সবাই এই নামেই ডাকে।

ক্লাবে দেখেছি। তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল সায়েমকে।

সুজানা মাথা দুলিয়ে মিনমিন করে বলল,

হুমম। এমনি ডেকেছিল।

_______________

সুজানাকে দেখে বাচ্চাদের হৈহৈ রব পড়ে গেল পুরো বাড়িতে। বাচ্চাদুটোর আনন্দের শেষ নেই তাকে দেখে। সুজানা এক কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো। একহাতে কেকের বাক্স,অপর হাতে কাপড়ের ব্যাগ। সুজানাকে দেখে আনিকা ছুটে এল।

এমা সুজানা যে! হঠাৎ কি মনে করে? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।

ওর হাত থেকে ব্যাগ টা নিতেই সুজানা কেকের বাক্সটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল

এখানে ভ্যানিলা কেক আছে। স্যার অর্ডার দিয়েছেন।

অনা আবিদ বলল

সুজান কেক?

সুজানা তাদের সাথে মিষ্টি হাসলো। তারা দুজনেই সুজানার হাঁটু জড়িয়ে ধরে আছে। সুজানা ঝুঁকে নীচু হয়ে তাদের আদর করলো। অনাকে কোলে নিয়ে গালে আদর দিয়ে বললেন

সুজানের জন্য মন পুড়েছে?

অনা ঘনঘন মাথা দুলিয়ে বলল

সুজান আবার এ বি চি পড়াবে?

সুজানা হেসে আবারও আদর দিয়ে বলল

অবশ্যই পড়াবে।

আবিদ বলল

সুজান আবিকে কুলে নাওনা কেন?

সুজানা অনাকে নামিয়ে দিয়ে তাকে কোলে নিয়ে আদর করে বলল

খুব অন্যায় হয়ে গেছে। আবিসোনা ভালো আছে?

আবি সুজানির সাথে লাগ কচচে।

কেন রাগ কচচে?

সুজানা আসেনা কেন?

এইযে এসেছি।

আজীম সাহেব এসে সুজানাকে দেখে বলল

আরেহ সুজানা আসামাত্র বাড়িটা তো মেতে উঠেছে। কি ব্যাপার সুজানা! এই তাহলে আমাদের ডিজাইনার!

সুজানা মৃদু হাসলো।

তাহলে ঠিক ধরেছি। অল দ্য বেস্ট।

থ্যাংকস আঙ্কেল। সুজানার মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন উনি।

আনজুমা বেগম আর মমতাজ বেগমও সুজানাকে দেখে ভারী খুশি হলেন। সালমা বেগম দূরে দাঁড়িয়ে দেখছেন সুজানাকে। আচ্ছা অভি এই মেয়ের কথা বলেছিল তাহলে।

আনজুমা বেগম বললেন

বৌমা অভি তাহলে দুপুরে এটাই সারপ্রাইজ বলেছিল?

হ্যা, আমারও সেটা মনে হচ্ছে। দেখুন সুজানাকে সেই আপনাকে এই বাড়িতে আসতেই হলো।

সুজানা হাসলো।

আমাদের কাছ থেকে যত পালাতে চাইবেন তত এখানে আসতে হবে কিন্তু হুমম।

সুজানা হেসে দোতলায় রেলিঙের দিকে তাকাতেই রেলিঙ ধরে ঝুঁকে মানুষটাকে দেখে ঠোঁটের হাসি মিইয়ে এল। তার সাথে চোখাচোখি হতেই অভিক ভুরু নাচালো।

এটা আবার কেমন ভাষা?
সুজানা লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিল।

মর্জিনা কেকটা নিয়ে চলে যাবে তখনি সুজানা কেকটা নিয়ে নিল। মর্জিনা কপাল কুঁচকে তাকাতেই সুজানা আরও একবার উপরে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে বলল

এটা স্যারকে দেখাতে হবে। উনি অর্ডার করেছেন তো তাই।

মর্জিনা মুখ মোচড়ে বলল

মাগোমা স্যারের জন্য যা দরদ!

সুজানা কেকটা নিয়ে পা বাড়াবে তখনি সালমা বেগম বলে উঠলেন

শোনো মেয়ে!

সুজানা ফিরে চাইলো।

জ্বি।

অভির গলায় টনসিল, গায়ে জ্বর। ওকে কম কথা বলাবে। প্রশ্ন করবেনা বেশি। বুঝেছ?

জ্বি।

সুজানা পা বাড়ালো। অভিককে আর দেখা গেল না। ওখানেই তো ছিল! গেল কই?

অনা আবিদ সুজানার পেছন পেছন ছুটলো। তারা আজ মহাখুশি।

সুজানা অভিকের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজা বন্ধ ভেতর থেকে। অনা আবিদ দরজা ধাক্কা দিয়ে বলল

অভি অভি দজজা খুলো। সুজান আসিছে। অভি দজজা খুলো।

খট করে দরজা খুলে গেল। সৌম্যদর্শন মুখটি দরজার ফাঁকে বেরিয়ে এসে জানতে চাইলো

আমার প্রথম প্রশ্ন, কেকের উপর নাম লিখেছেন?

হুমম।

আমার নাম?

হুম।

গুড।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, আজকে আপনি সময় নিয়ে এসেছেন?

হুম।

গুড।

আজকে আপনি ডিনার করেই যাবেন। ঠিক আছে?

আমি?

হুম, রাজী না হলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকুন বিশ মিনিট। এটা শাস্তি।

কিন্তু আম্মা খুব বকাঝকা করবে দেরীতে ফিরলে।

ফোন করে বলে দেবেন। ঠিক আছে? বলুন বলুন রাজী।

সুজানা মাথা নেড়ে বলল,

হুমম।

হুম বললে হবে না। বলুন, রাজী।

সুজানা মিনমিন করে বলল

হুম রাজী।

ওকে, এখন ভেতরে আসতে পারেন।

সুজানা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই অভিক বেরিয়ে গেল। বলল

আপনি চেয়ারে গিয়ে বসুন। আমি এক্ষুণি আসছি।

সুজানা কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখলো। অনা আবিদকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল

কেক খাবেন? খুব মজা।

সুজান কেক খুব মোজা।

সুজানা হাসলো।

হুম খুব মোজা।

অভিক তিনটে প্লেট আর দুটো কফির মগ নিয়ে ট্রে হাতে প্রবেশ করলো । ট্রে টেবিলে রেখে একটা মগ সুজানার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল

এটা আপনার।

সুজানা কিছু বলতে চাইলো,অভিকের চোখের ইশারায় আর কিছু বলে উঠতে পারলো না। অভিক মগে চুমুক দিতে দিতে বলল

বাক্সটা খুলুন। কেক খাবো।

এখন?

না। আগে কফির শেষ করুন।

সুজানা কফির মগে শেষ চুমুক দিল। পাশে রেখে বাক্সটা খুলতে খুলতে বলল

তিন প্লেটে নেব?

হুমম।

কেকটা বের করতেই নামটা দেখলো অভিক। ভুরু উঁচিয়ে বলল

আমার নাম তাই বাঁকা করে লিখেছেন।

সুজানা বিস্মিত চোখে তাকালো।

এমন বাঁকা হয় সবসময়ই। আপনার সাথে আমার কিসের শত্রুতা যে বাঁকা করে লিখবো।

আপনি তো আমার বন্ধুও নন। শত্রুতা নেই কি করে বুঝলাম?

অনা ডেকে বলল

অভি অভি তুমি সুজানের বুন্ধু হবে?

সুজানের এত্তগুলা বন্ধু আছে। সে কেন আমার বন্ধু হবে?

সুজানা কপাল কুঁচকে কেক কেটে দুই প্লেটে নিল। বলল

এখন?

অভিক একটা প্লেট অনাকে আরেকটা আবিদকে দিল। বলল

খান দু’জন। ওইদিনের মতো যদি নষ্ট করেন খুব মার দেব।

অভিকে মার দেব।

অভিক হেসে উঠলো।

ওকে। মারপিঠ পড়ে। এখন খান চুপচাপ। ঠিক আছে?

ঠিকাচে।

সুজানা অন্য প্লেটটা দেখিয়ে বলল

এসব কে খাবে?

আপনি খাবেন। আমি খাব।

সুজানা গোলগোল চোখে চাইলো।

অভিক শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে বলল

আমার ছোঁয়াছে রোগ নেই। কিন্তু গলা ব্যাথা আছে সেটা নিয়ে অন্য কারো মাথা ব্যাথা হলে মন্দ হয়না।

সুজানা অভিককে আড়াল করে হাসলো। এত প্যাঁচিয়ে কথা বলতে কি করে পারে!

অনা আর আবিদ সুজানার দিকে কেক বাড়িয়ে দিল। বলল,

সুজান কেক খুউউভ মোজা। খাও।

সুজানা ওদের দুজনের হাতে খেল।

অভিক বলল,

কপাল করে এমন স্টুডেন্ট পেতে হয়। আফসোস।

সুজানা ভুরু কুঁচকে তাকালো। প্লেট থেকে এক পিস কেক তুলে নিয়ে বলল

আমার হাতে খাবেন?

অভিক চোখ বড়বড় করে চাইলো।

সিরিয়াসলি!

এত আফসোস রাখতে নেই।

তাহলে খেতেই হচ্ছে।

কেকের কাছে মুখ নিয়ে থেমে গেল সে। কপাল কুঁচকে বলল

আপনার আবার ছোঁয়াচে রোগ নেই তো?

সুজানা হেসে বলল,

আমার আছে।

কি আছে?

মাথাব্যাথা।

মাথা ব্যাথার ভয় আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। আপনি অলরেডি আমার মাথা ব্যাথার কারণ।

সুজানা ভুরু কুঁচকে তাকাতেই অভিক কেক খেয়ে নিয়ে বলল

হুমম।

আঙুলে ভেজা চঞ্চুর স্পর্শ টের পেতেই চট করে হাতটা ছাড়িয়ে নিল সুজানা । ভেতরটা ধুকপুক করে কেঁপে উঠেছে। জানতে চাইলো,

খেতে ভালো হয়েছে?

অভিক কপালে ভাঁজ ফেলে গাল নাড়তে নাড়তে বলল,

হুমম, খানিকটা সুজানার মতো।

আমি কেমন?

ভয়ংকর।

সুজানা হেসে উঠে বাকি কেকটা নিয়ে বলল

আচ্ছা, আমি এটা দিয়ে আসি। আন্টিরা সবাই খাবেন।

সুজানা বেরিয়ে পড়তেই অভিক বাচ্চাদের কাছে ঝুঁকে বলল

সুজানকে খাইয়ে দিয়েছেন কিন্তু আমারটা কই।

অভিকে সুজান খায়ি দিচে। তাই আন নাই।

অভিক হেসে উঠলো তাদের কথায়।

_____________

সুজানা কেক কেটে মমতাজ বেগমকে দিল প্লেটে করে। বৃদ্ধা বললেন

রান্নাঘরে গিয়ে বাকিটা রেখে আসো বোন। বাকিটা ওরা খাবে।

সুজানা মাথা নেড়ে বলল

আচ্ছা দাদু।

বৃদ্ধা হেসে বললেন

মিষ্টি মেয়ে।

সুজানা মিষ্টি করে হাসলো। বাকি কেকটা রান্নাঘরে রেখে আসতে যেতেই দেখলো সালমা বেগম রান্নাঘরে একা। সুজানা কেকটা রেখে চলে আসবে তখনি সালমা বেগম ডাকলেন

দাঁড়াও মেয়ে।

সুজানা দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘাড় ফিরিয়ে বলল,

জ্বি।

সালমা বেগম উনার ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললেন

নীলা নামে মেয়েটার নান্বার তোমার কাছে থাকলে দাও তো। ও তো তোমার বান্ধবী হয়, নাম্বার তো থাকার কথা।

না উনি আমার ম্যাডাম।

সে যেই হোক নাম্বার আছে?

জ্বি।

আমাকে দাও। তোমার স্যার আমাকে অনেকদিন নাচিয়েছে। মেয়েটার কোনো খোঁজখবর আমাকে দিচ্ছেনা। তাকে এসব আবার বলোনা যেন। নইলে আমার পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেবে। বুঝতে পেরেছ?

সুজানা মাথা নাড়লো।

তুমি তো দেখেছ নীলাকে। দেখতে শুনতে ভালো তো?

জ্বি।

জ্বি জ্বি করা ছাড়া আর কিছু শেখোনি? নাকি আমার সামনে এলেই সাধু হয়ে যাও। তোমার হবু জামাইয়ের সাথে কথা বলোনা কেন? তুমি শর্ত দিয়েছ তাও তারা মেনেছে। তারপরও তোমার এত জেদ কিসের? হ্যা?

সুজানা মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

শোনো যতটুকু পেয়েছ ততটুকু নিয়ে খুশি থাকো। তোমার কপাল ভালো এত ভালো পরিবার তোমার জন্য সম্বন্ধ নিয়ে গিয়েছে। এখন যাও। আর শোনো ব্লাউজ সেলাইয়ের টাকা অভিকে বলব দিয়ে দেয়ার জন্য। ও তোমার বিকাশে পাঠিয়ে দেবে। ঠিক আছে?

সুজানা মাথা নাড়ালো।

আর শোনো আমাকে নাম্বার দিয়েছ একথা অভি নয় কেউ যেন জানতে না পারে।

সুজানা সাহস করে জিজ্ঞেস করলো

ফোন নাম্বার কেন নিয়েছেন?

ওর বাবার সাথে কথা বলবো তাই। তুমি ওকে অভির সাথে কখনো কথা বলতে দেখেছ?

সুজানা দুপাশে মাথা নাড়ালো।

মিথ্যে বলছ কেন? আমি তো কাল দেখেছি অভিকে কথা বলতে।

আমি বোধহয় জানিনা।

হ্যা জানোনা। এখন যাও।

অভিক রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলল

এতক্ষণ লাগে আসতে? কাজের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসুন।

সুজানা মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল অভিকের পিছু পিছু। সালমা বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে চেয়ে রইলেন তাদের যাওয়ার দিকে। ছেলেটার কোনো হাবভাব আজকাল তিনি ধরতে পারছেন না।

ফোনে সেভ করা নাম্বারটার দিকে তাকালেন। কল দিতেই দু’বার রিং হওয়ার পর মেয়েলী কন্ঠস্বর ভেসে এল।

আসসালামু আলাইকুম। নীলা বলছি। কে বলছেন?

ওয়ালাইকুমুস সালাম। তোমার বাবার নাম্বারটা পাওয়া যাবে?

জ্বি। কিন্তু আপনি কে?

তুমি আমাকে চিনবেনা। তোমার বাবার ফোন নাম্বারটা দরকার ছিল।

আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছেন?

আজব ব্যাপার তো। তুমি এত প্রশ্ন করছ কেন? তোমার বাবার ফোন নাম্বারটা দাও।

নীলার ভুরু কুঁচকে এল ।

আপনি পরিচয় না দিলে বাবার ফোন নাম্বার দেয়া যাবেনা। আপনার গলার স্বর পরিচিত মনে হচ্ছে।

তোমার বাবার নাম্বারটা দাও মেয়ে। আরেকবার যদি বলতে হয় খুব খারাপ হবে কিন্তু।

খারাপ হলে হবে। পরিচয় দিন। তাহলে নাম্বার দেব। নইলে ফোন রাখুন। এটা অফিসিয়াল নাম্বার। অযথা কল দেবেন না।

তারমানে তোমার বাবার নাম্বারটা দেবেনা?

আপনি কি পাগল? নাকি কানে কম শোনেন? কি বলেছি শুনতে পাননি? আজাইরা মানুষের আর কাজকাম নেই মনে হয়।

সালমা বেগম রাগে অপমানে ফোনটা জোরে টিপে ধরলেন। একেবারে সুইচঅফ হয়ে গেল সেটি। রাগে কিড়মিড়িয়ে উঠতেই আনিকা এসে বলল

ছোটমা কি হলো? কি হলো ছোটমা?

উনি ঘেমে উঠলেন তরতরিয়ে । কান্না আটকে বললেন

অভির পছন্দ এত খারাপ কি করে হলো বৌমা? মেয়েটা একটুও ভালো না। একটুও ভালো না। মুখে মুখে তর্ক করে। আমাকে অপমান করেছে। আমাকে।

আনিকা উনাকে ধরে বললেন

ছোটমা শরীর খারাপ লাগছে? কিসব বলছ? অভি এই অভি? মা তাড়াতাড়ি এসো।

সালমা বেগমের দাঁতে দাঁত লেগে গেল। কিছু সময়ের ব্যবধানে হুলস্থুল পড়ে গেল পুরো বাড়িতে।

অভিক ছুটে এসে দেখলো মা জ্ঞান হারিয়ে আনিকার কোলে পড়ে আছে। সে স্তব্ধ হয়ে গেল। সুজানও বিস্ময়ের চরম পর্যায় । আন্টি এখন তার সাথে কথা বললো না। হঠাৎ কি হলো?

অভিক মায়ের মাথা কোলে তুলে নিয়ে বলল

মায়ের এ অবস্থা কি করে হলো?

আনিকা কান্না আটকে রেখে বলল

আমি জানিনা অভি। এসে দেখলাম ছোটমা হাঁপাচ্ছে, ঘাম দিয়েছে। পরে দেখি দাঁতে দাঁত লেগে গিয়েছে। আমার ভয় হচ্ছে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যা।

অভিক মায়ের নিথর শরীর কোলে নিয়ে ছুটে গেল। আহনাফ এসে বলল

অভি ডাক্তার রওনা দিয়েছে। হসপিটালে নিয়ে যেতে হবেনা। ছোটমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দে। আনু হাত পা মালিশ করতে থাকো।

অভিক বলল

মায়ের কিছু হবে না তো।

আহনাফ বলল,

কিছু হবেনা ভাই।
আচ্ছা বাড়ি ভর্তি মানুষ আর কেউ দেখলো না একটা মানুষের এই অবস্থা কেন হলো?

আজীম সাহেব আর আজাদ সাহেব ডাক্তার নিয়ে এল। সুজানা আর আনিকা সালমা বেগমের হাতের তালু মালিশ করছে। ডাক্তার বলল

উনি কি অসুস্থ ছিলেন?

না। পুরো সুস্থ সবল মানুষ।

সুজানা বলল

আন্টি কয়েক মিনিট আগেই আমার সাথে কথা বলেছে। তখনও ঠিক ছিল।

ডাক্তার পরীক্ষা নিরিক্ষা করে বলল

উনি রাগে নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছেন। তাছাড়া ফ্রেশার লো ছিল। তেমন চিন্তার কিছু নেই তবে এভাবে হাইপার হওয়াটা উনার শরীরের পক্ষে খুব ক্ষতিকর।

অভিক হাঁটুভেঙে মায়ের মাথার কাছে বসে কপালে চুমু খেয়ে বলল

মা, মা উঠে যাও।

মমতাজ বেগম কপাল চাপড়ে বললেন

এই মেয়ের রাগ কমার নয়। কভু নয়। বউ করে এনেছি পর্যন্ত কোনো উলটপালট কিছু শুনলেই তার এই অবস্থা। ছোট খোকা তোর বউকে মাথাটা ঠান্ডা করতে বলবি এবার। ঘরে ছেলের বউ আসলে অনেক কিছু তার অপছন্দের হবে তখন কি হবে?

আজাদ সাহেব বললেন

মা এখন এসব বলো না তো। সালমার জ্ঞান ফিরুক। জানা যাবে কি হয়েছে।

সুজানা হাত মালিশ করার এক পর্যায়ে সাজিয়া বেগমের ফোন এল। সুজানা ফোন তুলে ঘরের বাইরে গিয়ে বলল

আম্মা ছোট আন্টি অজ্ঞান হয়ে গেছে। খুব খারাপ অবস্থা এই বাড়িতে। আমি এখন এইভাবে চলে যেতে পারিনা। আমি আসব। চিন্তা করো না।

কি হলো উনার?

জানিনা। তোমাকে পরে ফোন দিচ্ছি।

আচ্ছা জানাস।

ডাক্তার ইনজেকশন পুশ করে দু চোখের মাঝখানে সন্তর্পণে চেপে ধরার কিছুপরেই সালমা বেগমের জ্ঞান ফিরে এল। চোখের কিনারায় জল গড়িয়ে পড়লো কান বেয়ে। অভিক দ্রুত মুছে দিয়ে বলল

মা মা আমি তোমার অভি। দেখো।

সালমা বেগম ধীরেধীরে চোখ মেলে তাকালেন। শিয়রে ছেলের মুখখানা দেখলেন। অপর পাশে উনার হাতের তালু মালিশে মত্ত মেয়েটাকে দেখলেন। কিছু পূর্বের ঘটনা মনে পড়তেই বুকে ফেটে কান্না পেল। এভাবে অপমান করে কেউ কখনো কথা বলেনি উনার সাথে।

জ্ঞান ফেরায় সবাই শান্ত হলো। আনিকা অভিকের হাত ধরে বাইরে টেনে আনলো। বলল

ছোটমা ওইসময় বলছিল তোর পছন্দ নাকি খারাপ। মেয়েটা মুখে মুখে তর্ক করে। ছোটমাকে অপমান করেছে। কেন বলেছে এসব? মেয়েটা কে? আমরা কিছু জানিনা কেন অভি?

অভিক চিন্তিত বদনে তাকালো। আনিকা বলল

দেখ অভি কিছু লুকোবিনা। এসব নিয়ে পরে কথা হবে ছোটমা সুস্থ হয়ে উঠুক। তোকে দেখছি।

অভিক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের কথা অনুযায়ী ভেজা রুমাল ভিজিয়ে সালমা বেগমের কপালের ঘাম মুছে দেয়া সুজানার দিকে অপলক তাকালো। ডেকে বলল

জরুরি কথা আছে। বাইরে আসুন সুজানা।

সবাই তাকালো অভিকের দিকে।

সুজানাও ভড়কে গেল। তাকে এভাবে ডাকলো কেন?

সালমা বেগমকে উঠিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসানোর পর সুজানা অভিকের খোঁজে গেল। সে ভেবেছে অভিক তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য ডেকেছে তাই ব্যাগ নিয়ে আসলো অভিকের ঘর থেকে। নীচে চলে আসতেই মর্জিনা বলল

বাবু বাইরে আছে।

সুজানা সদর দরজা পার হতেই দেখলো অভিক উত্তরমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গম্ভীর হয়ে। সুজানা ধীরপায়ে হেঁটে পেছনে গিয়ে বলল

কেন ডেকেছিলেন?

অভিক ফিরলো। মায়ের আকস্মিক অসুস্থতা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। সুজানা কখনোই এমন না
কিন্তু এত এত প্রশ্ন তাকে স্বস্তি দিচ্ছেনা। তাই প্রশ্নটা করলো

আপু বলেছে মা জ্ঞান হারানোর আগে কিছু বলছিল।

কি বলছিল?

বলছিল যে আপনি মায়ের মুখে মুখে তর্ক করেছেন। অপমান করেছেন। আমাকে এসব বিশ্বাস করতে বলবেন না। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি কিন্তু,

সুজানার দুচোখ জলে টলমল হয়ে এল। আবছা আঁধারে গড়িয়ে পড়লো বৈকি।

এই মানুষটাই তাকে চিরকুটে লিখেছিল আমি আপনাকে বিশ্বাস করি সুজানা?

সুজানা দুপা পিছু হেঁটে নিজেকে সামলালো। অভিক দু পা এগিয়ে গিয়ে বলল

সুজানা আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমি,

সুজানা শুনতে চাইলো না আর কিছু। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। যে চোখে সে তার জন্য মায়া দেখেছে সেই চোখে সে অবিশ্বাস কি করে সহ্য করবে? বিশ্বাস শব্দটা এতটা ঠুনকো?

চলবে….

পাঠক রিচেক করে নেব পরে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here