আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে #পর্ব_৫৫ #লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0
114

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৫৫
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

বোনাস পর্ব ২

সাইফ আর সায়েমের সাথে অভিক তৃতীয় তলায় উঠে এল। সাজিয়া বেগম সুজানার ঘরে এসে বললেন

জামাই চলে এসেছে। কি কি দেব একটু এগিয়ে দে। আগে দেখা করে নে।

সুজানা মাথা নাড়ালো। রোজা বলল

আপা ভাইয়া যদি এখানে চলে আসে? আমার খুব লজ্জা করে। আমি চলে যাই।

সুজানা ওর হাত ধরে বলল

পাগল! কিছু হবে না। বোস।

রোজা বসলো না। বেরোতে যাবে তার আগেই দেখলো অভিক সাইফ আর সায়েমের সাথে ডাইনিং রুমে প্রবেশ করেছে। সুজানার ঘর থেকে সে বের হতে গেলেই দেখতে পাবে।

রোজা বলে উঠলো

দেখেছ বললাম না। সুজানা বলল

আরেহ কিছু হবে না।

অভিক সাইফকে বলল

সুজানার সাথে দেখা করে আসি। আপনি কোথাও যাবেন না কিন্তু।

সাইফ বলল

আমি আছি বারান্দায়।

অভিক সুজানার ঘরে পা রাখার আগেই রোজা ফাঁকফোকর দিয়ে একছুটে বেরিয়ে গেল। অভিক ঠোঁট উল্টে সাইফের দিকে তাকাতেই সে বলল

রোজা। লজ্জা পেয়েছে।

ধরব আমি সুযোগ পেলে। সাইফ হাসলো। বলল

আমরা বারান্দায় আছি।

অভিক মাথা দুলিয়ে ঘরের দরজার কাছে গিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি দিল। সুজানা আলমিরা থেকে নতুন গামছা বের করছিল। অভিক গুটিগুটি পায়ে হেঁটে গেল। সুজানা অভিকের আগমন বুঝতে পারলো, নিকটে এসে দাঁড়ানোটা অনুভব করতে পারলো। পেছন ফিরে তাকানোর পূর্বেই অভিক তার হাতদুটো দিয়ে আগলে ধরে থুঁতনি ঠেকালো কাঁধে। সুজানার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। অভিক গালের সাথে গালটা চেপে ধরতেই সুজানা একপাশে হেলে পড়তেই অভিক বলল

মিসের ফারদিন, আই মিস ইউ এ লট।

সুজানা অনেক্ক্ষণ কিছু বলল না। চুপচাপ ওভাবে থাকলো। আলমিরায় আয়নায় অভিককে দেখলো। অভিক সেখানে তাকিয়ে ভুরু নাচালো। বলল

এই দেখুন আপনি আমার অভাবে কতটা শুকিয়ে গেছেন। মুখ শুকিয়েছে, চোখ শুকিয়েছে, ঠোঁট শুকিয়েছে।

সুজানা হাসতে চাইলো না। তারপরও চাপা হাসলো। যদিও এভাবে তার শান্তি লাগছিল, এই কাঁপিয়ে দেয়া স্পর্শ আর ঘ্রাণটার মাঝে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করছিল তারপরও বলল

এখন যদি কেউ চলে আসে, আর এ অবস্থায় দেখে নেয় তার দায়টা কে নেবে?

নিঃসন্দেহে আমি।

আচ্ছা।

অভিক হাসলো। সুজানাকে সামনে ফিরিয়ে আবারও দু’হাতের বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিয়ে কপালের একপাশে ঠোঁট ছুঁয়ে মুখটা মাথায় ঠেকিয়ে রাখলো। বলল

আপনি আমাকে মিসটিস করেননি নাকি?

সুজানা মাথাটা বুকে মিশিয়ে নিতে নিতে বলল

করেছি।

অভিক হাসলো তা শুনে। বলল

রাগও করেছেন।

সুজানা চট করে মাথাটা তুললো।

করব না?

অবশ্যই করবেন। কিন্তু সারপ্রাইজটা দিতে পারলে আপনার রাগ করা নিয়ে এত আফসোস হতো না। সারপ্রাইজটাও ঠিকঠাক দিতে পারলাম না, এদিকে আপনি রাগ করে আছেন। মা সবটা ভাসিয়ে দিয়েছে।

জেনেছেন কিভাবে?

অভিক সুজানার চুল কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল

শালাবাবু বলেছে। যাইহোক, আপনি নাকি ছাড়া নবকুঠির জমছেনা ঠিক।

আপনিও ছাড়াও তো জমে না।

অভিক কথাটার মর্মার্থ বুঝতে পেরে হেসে সুজানার মাথাটা আলতো করে বুকে চেপে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল

কিছু করার নেই। একটা বছর থাকতে হবে। তারপর দেখা যাবে। এটা অবশ্য আপনার জন্য ভালো হয়েছে। আপনাকে আমি ডিস্টার্ব কম করব, আপনি পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারবেন।

সুজানা মুখ তুলে আবারও তার মুখের দিকে তাকালো। বলল,

আপনি না থাকলে আমার পড়াশোনায় একদমই মন বসেনা। ওখানে কি করছেন, কি খাচ্ছেন। ভালো লাগেনা আমার।

আমি সপ্তাহান্তে চলে আসব।

সুজানা খুশি হয়ে বলল

সত্যি?

অভিক চোখ নিভিয়ে সম্মতি জানালো। সুজানা হাসলো।

অভিক বলল

এটাই এতক্ষণ মিস করছিলাম।

সুজানা হাসি নিভিয়ে বলল

না, আমি রেগে আছি।

অভিক আলতো করে নাকে নাক ঘষে বলল

আর আমি রাগ ভাঙাতে আছি।

সুজানা হেসে উঠে মিশে থাকলো তার প্রিয় ঘ্রানটির সাথে।

____________

খাওয়ার টেবিলে সবাই বসে নাশতা খাওয়া হলো। অভিক সবকিছু থেকে হালকাপাতলা কিছু খেল। সাজিয়া বেগম বিবরণ দিচ্ছিলেন কখন কোনটা করেছেন। অভিকের মনে হয়েছিল সবকিছু থেকে খাওয়া উচিত। তাহলে কষ্টটা স্বার্থক হবে। সে যা ভেবেছিল তাই সাজিয়া বেগম মহাখুশি জামাই সবকিছু থেকে খেয়েছে বলে।

তারপর, সে রোজাকে ধরে আনলো সুজানার পেছন থেকে। সে সালাম দিল।

অভিক সালামের উত্তর দিয়ে বলল

গোলাপি শালিকা!

রোজা লজ্জা পেয়ে এক হাত চোখের উপর রাখলো। সুজানা বলল

ও লজ্জা পাচ্ছে। ছেড়ে দিন।

না ছাড়া যাবে না। আমার একটা মাত্র শালিকা। গোলাপি নামটা ভালো হয়েছে না সুজানা?

সুজানা হাসলো।

সাইফ বলল

দুলাভাই আসছে বলে তো ভীষণ খুশি ছিল। এখন এত লজ্জা কেন?

রোজা সাইফের দিকে চোখ গরম করে তাকালো। অভিক বলল

তাই? দুলাভাইকে তাহলে পছন্দ!

সুজানা বাটিতে দই তুলে দিতে দিতে বলল

ওকেও বিয়ে দেব।

সিরিয়াসলি?

হুম।

তাহলে তো বর খুঁজতে হবে। শালাবাবু আমাকে মনে করিয়ে দিয়েন তো।

সায়েম কান চুলকে হাসলো।

সুজানা বলল

গুড নিউজটা শুনেছেন আপনি?

সাইফ ওয়াহিদের চাকরি নিয়ে?

জানেন দেখছি।

আপনার কি আমাকে বোকা মনে হয়?

সুজানা কাজ থামিয়ে তাকালো। জীবনে একবার সে বোকা ভেবেছিল তাকে এরপর ভুলেও না। মাথা নেড়ে বলল

কিভাবে জানতে পারলেন?

সাইফ সাহেবের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। তাই না?

সাইফ মাথা দুলালো।

তাহলে তো ভালোই। এবার জিজ্ঞেস করুন তো বিয়েটা কবে করছে।

অভিক সাইফের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালো। সাইফ হেসে বলল

কোরবানের আগে হতে পারে।

সুজানা অভিমানী গলায় বলল

দেরী করবেনা কিন্তু। কত করে চেয়েছি আমি থাকা অবস্থায় যাতে মেহুলকে ভাবি করে আনতে পারি। ওর সাথে কত সময় কাটানো যেত।

অভিক বলল

আচ্ছা! খুব তাড়া হয়ে গেল বলতে চাচ্ছেন?

সুজানা ভাব নিয়ে বলল

হ্যা।

সাইফ বলল

এটাই ভালো হয়েছে।

অভিক বলল

সাইফ সাহেব আপনিই বলুন, এটা আপনার উডবি’র জন্য ভালো হয়নি? আশেপাশে এরকম অবিবাহিত ননদ রাখতে নেই বুঝলেন।

বলেই তারা উচ্চরবে হাসলো। সুজানা গাল ফুলিয়ে অভিকের দিকে তাকালো। বলল

আমি মেহুলের সাথে ঝগড়া করতাম?

ঝগড়া করতেন না। তবে তাদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হতেন। অসুবিধেটা বেশি সাইফ সাহেবের হতো। আপনি যদি সারাক্ষণই আপনার বান্ধবীর সাথে সময় কাটাতে থাকেন তাহলে তো ব্যাপারটা নিদারুণ যন্ত্রণার।

সুজানা বলল

কচু।

ওর কচু বলা শুনে রোজাও হেসে উঠলো। অভিক বলল

এত বছর এই শহরে আছে তারপরেও পটিয়ার ভাইরাস এখনো যায়নি।

সবাই আবারও হেসে উঠলো।

তাদের আড্ডার সমাপ্তি নেই।

অভিক একফাঁকে রান্নাঘরেও চলে গেল। সুজানা যখন থেকে নবকুঠিরের একজন, তখন থেকে সেও এখানকার একজন।

রান্নাঘরে তাকে দেখে রাশেদা বেগম বললেন

ওহ সুজুর মা,জামাই এসেছে।

সাজিয়া বেগম গরুর কলিজা ভাজি শেষে ভাত বসিয়েছেন, মাছ মাংস রান্না শেষ। অভিককে দেখে হেসে বললেন

আমার ভাঙা রান্নাঘর দেখতে এসেছে?

দেখতে এসেছি কোনো সিক্রেট কিছু আছে কিনা রাঁধুনীর রান্নাঘরে।

সাজিয়া বেগম একগাল হাসলেন। বললেন

একটা মোড়া এনে দেব?

না, তার দরকার নেই। রান্নাঘরে বসার জন্য আসে মানুষ? কি আন্টি?

রাশেদা বেগম মুচকি হেসে বললেন

একদম না।

আপনাকে টেবিলে নাশতা খেতে ডাকছিলাম না। আসেননি কেন? রাতের খাবার টেবিলে দুজনকেই চায়।

সাজিয়া বেগম,

অদ্ভুত আবদার করে ছেলে।

কারণ ছেলেটাই অদ্ভুত।

সাজিয়া বেগম বললেন

আমার তো আজকে ঈদ ঈদ লাগছে। যদি এখানে রেখে দিতে পারতাম!

অভিক বলল

ঈদের খুশিতে কফি খাওয়া যাক!

সাজিয়া বেগম বললেন

হ্যা তাইতো। সব নিয়ে বসে আছি। সুজানাটা এদিকে আসতে পারছেনা? কোথায় সে। আমি তো পারিনা কখন কি দেব?

উনি ট্রে দেখালেন। চার পাঁচটা কফির মগে কফি পাউডার দেয়া আছে।

সাজিয়া বেগম বললেন

সবাই নাকি এসব খাবে।

আড্ডা কফি ছাড়া জমে না।

বলেই সে গ্যাসের দিকে এগিয়ে গেল। বলল

কফি বানানোর প্রসেসটা খুব ইজি। শেখা যাক। সেরা রাঁধুনিদের জন্য এটা ছেলের হাতের মোয়া।

সাজিয়া বেগম উৎসুক হয়ে তাকালেন। বললেন

আমি শিখব?

শেখা উচিত না?

জামাইরাজার জন্য তো শেখা উচিত।

একদম।

সাজিয়া বেগম কফির জন্য দুধের পাতিল এগিয়ে দিয়ে বলল

এটা দুধ।

অভিক গ্যাসে বসিয়ে দিল দুধটা।
তারপর টেবিল চামচ মেপে কফি পাউডার, চিনি, আর গরম জল মিশিয়ে থি’ক ফোম তৈরি করলো।

সাজিয়া বেগম বলল

এভাবে?

হুম।

অভিক ফোমটা দেখিয়ে বলল

চামচে লেগে থাকবে ফোমটা। তারপর এখন দুধ ঢেলে দেব। দেন লিকুইড চকলেট। ব্যস।

এমা খুব সহজ দেখছি।

একদম।

সুজানা টেবিল থেকে প্লেট বাটিগুলো নিয়ে বেসিনে রাখতে রাখতে বলল

কি হচ্ছে? আমি তো আসছিলাম।

আমরা করে নিয়েছি।

অভিক দুধটা তারপর মগে মগে ঢেলে দিল।

সাজিয়া বেগম লিকুইড চকলেট এনে রাখলো। বলল

এটা উপরে দেব? কি সুন্দর ফুলে উঠেছে দুধটা।

অভিক লিকুইড চকলেট উপরে দিয়ে বলল

একটু হলেও খাওয়া উচিত। সাতটা মগে কফি ঢেলে নিল সে। বলল

ভীষণ টেস্ট। আর টেস্ট বুঝার জন্য খাওয়া উচিত। এম আই রাইট সুজানা? আপনি শুরুর দিকে খেতে চাইতেন না। পরে নিজেই কফির প্রেমে পড়ে গিয়েছেন।

সুজানা প্লেটগুলো ধুঁতে ধুঁতে মৃদু হাসলো। সে কফিপ্রেমিকের প্রেমে আটকা পড়েছিল, তাই এই কফির প্রেমে পড়াটাও আবশ্যক ছিল।

কফি টেবিলের আড্ডায় মুখোরিত ছিল পুরো সময়টা জুড়ে। সাজিয়া বেগম বহুদিন পর আজ মনখুলে হেসেছেন ছেলেটার প্রত্যেকটা কথায়, আবদারে। উপরওয়ালার কাছে অনেক অনেক চাওয়ার পর উনি মেয়ের জন্য এমন একটা মানিক পেয়েছেন। এবার যেন মরেও শান্তি। সুজানার সুখের অভাব কভু হবে না।

রাতের খাবার টেবিল আরও জমে উঠলো। সাজিয়া বেগম আর রাশেদা বেগমকেও বসিয়ে দিল অভিক তাদের সাথে । সাজিয়া বেগম তাকে সবগুলো রান্নার বিবরণ দিলেন। বাগদা চিংড়ি দিয়ে কচুর লতি রেঁধেছেন উনি। শুঁটকি ভর্তাও করেছেন। গরুর কলিজা ভাজি, গরুর কালা ভুনা, গরুর নলা ঝোল, চিকেন মাসালা, পুরো আস্ত মুরগীর রোস্ট, যেটা চট্রগ্রামের নতুন অতিথিদের ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার হয়, রুইমাছের দোপিয়াজা, ডিম কাসুন্দি, ইলিশ মাছের ডিম, সালাদ।

সবাই সব আইটেম থেকে কিছু কিছু তুলে দিল। অভিক বলল

মাশাল্লাহ রান্নাগুলো চমৎকার। দেখেই পেট ভরে গিয়েছে। কিন্তু খেতে না পারলে নষ্ট হবে না?

সাজিয়া বেগম বললেন

একদম কম কম করে রেঁধেছি। নষ্ট হবে না।

অভিক সবকিছু থেকে খেল। সাইফকে বলল

মিস্টার ওয়াহিদ আপনার পালা আসছে। এখন থেকে বেশি খাওয়া শিখে নিন।

সাইফ হাসলো। বলল

এখন থেকেই তো ভয় করছে।

আরেহ ভয়ের কিছু নেই। এই যে আমাকে দেখছেন। এভাবে খাবেন। ব্যস হয়ে গেল।

সবাই একসাথে হাসলো। অভিক সবাইকে নিজ হাতে এটা ওটা তুলে দিল। সাজিয়া বেগম আর রাশেদা বেগমকেও তুলে দিল। সাজিয়া বেগম বললেন

এতগুলো তারকারি খায় না তো আমি।

রান্না করলে তো খেতেই হবে। এতগুলো রান্না কে খাবে?

রোজাকে বলল

গোলাপি ম্যাডাম আপনাকে মাংস দেব?

রোজা আঙুল দিয়ে পাতে সব দেখিয়ে দিল। অভিক তার পাতের ডিম রোজার পাতে তুলে দিয়ে বলল

তাহলে মুরগীর আন্ডা খান শালিকা।

রোজা মাথা নীচে নামিয়ে হাসলো। সুজানা হেসে বলল

ওকে খেতে দিন তো। লজ্জায় খেতেও পারছেনা ঠিক করে।

অভিক হেসে রোস্টের পেছনের অংশ কেটে সায়েমকে দিল। বলল

লাস্টপিস খান আর কথা বলুন শালাবাবু। এত চুপচাপ লাজুক হলে চলবে না।

সায়েমও খেতে-খেতে হাসলো।

অভিক সাইফের দিকে তাকিয়ে বলল,

সাইফ সাহেব আপনিও দেখছি ওদের কাতারে পড়ে আছেন। আরেহ নিন।

সাইফ হাত দিয়ে ঢেকে বলল

যথেষ্ট খাচ্ছি। নষ্ট হবে। দেবেন না আর। আপনি কিন্তু খাচ্ছেন না।

আহ এটা বলবেন না। আমার শ্বাশুড়ি মা বেজায় রেগে যাবেন।

সাজিয়া বেগম ওর পাতের দিকে তাকিয়ে বললেন

ঝাল একদম কমিয়ে দিয়েছি।

এজন্যই তো বেশি খাচ্ছি।

অভিক সুজানার পাতের দিকে তাকালো। বলল

সুজানা মায়ের মতো। ঝাল বেশি খায়।

হ্যা, ও ঝাল না হলে খেতেই চায় না। এখন তো ঝাল কম খাওয়া শিখতে হবে।
দু’জনের জন্য কি আলাদা করা যায় নাকি? যদি ওকে যেতে হয় সিলেটে তখন? ঝাল বেশি খাওয়া মানুষ ঝাল কম খেতে পারে, কিন্তু ঝাল কম খাওয়া মানুষ ঝাল বেশি খেতে পারেনা।

এটা কোনো ব্যাপার না। ঝাল কম খাওয়া আমার অভ্যাস না, রোগ। ঔষধ পড়লেই ঠিক হয়ে যাবে। আমার রোগের কারণে সুজানার অভ্যাস পাল্টানো অনুচিত ।

সুজানা তার চোখে চোখে তাকানো শেষে, চোখ নামিয়ে হাসলো।

কাকে, কখন, কোন জায়গায়, কিভাবে বুঝ দিতে হবে তা অভিক ফারদিনের কাছে শেখা উচিত। এজন্যই উনি ” মাস্টারমশাই “। সুজানার।

_______

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে সাইফ মেহুলের বিয়ে নিয়ে তাদের সবার গল্প গুঁজবে ঘড়ির কাঁটা তখন বারোটা পেরিয়ে গিয়েছে। শ্বাশুড়ি জামাইয়ের গল্প তো শেষ হওয়ার নয়। সুজানার লেখালেখির কাজ ছিল। সে ভেবেছে মশাইয়ের গল্পগুজবের ব্যস্ততার ফাঁকে সে তার কাজটা সেড়ে নেবে। কাল ওবাড়িতে যাওয়ার পর সম্ভব নাও হতে পারে।

তাই সে লিখতে বসেছিল যদিও খুব ক্লান্ত লাগছিল সারাদিনের রান্নাবান্নার দৌড়াদৌড়িতে। মাছ কাটতে গিয়ে হাতে কাঁটাও বিঁধেছিল। সেটার আরেক যন্ত্রণা।

সে লিখতে লিখতে টেবিলে কখন মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে তার খেয়ালই নেই।

ঘড়ির কাঁটা দেখে সাইফ বলল

আপনি জার্নি করেছেন। ঘুমিয়ে পড়া উচিত।

সাজিয়া বেগমও সেটা বলতে পারছিলেন না এতক্ষণ। ছেলেটার কত খাটুনি হলো আজ চেহারায় তা লক্ষ করা যাচ্ছে।

উনি তাড়া দিলেন। শেষমেশ গল্পের আসর ভাঙলো। রাশেদা বেগম পইপই করে বলে গেলেন জামাইকে কাল সকালবেলা তাদের এখানে নাশতা করতে হবে আর দুপুরে ওখানেই আয়োজন হবে। বিকেলে যেতে পারবে তারা।

অভিকের না করার কোনো সুযোগ ছিল না।

—-

ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে অভিক সুজানাকে ডাকলো

সু-জা-না কোনো সাড়াশব্দ নেই কেন?

কিন্তু যা দেখলো তাতেই তার হাসি পেল ভীষণ। কি পড়াকু ছাত্রী তার। কলমটা এখনো হাতেই রয়ে গেছে। দুটো লাইনও কমপ্লিট করতে পারেনি সে। অভিক ওভাবে কয়েকটা ছবি তুললো সুজানার। সামনে থেকে, পাশ থেকে। তারপর আনিকার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিল। আনিকা ভয়স পাঠালো,,

এতরাতে ফাজলামি করছিস মেয়েটার সাথে?

এগুলোই ভীষণ জরুরি।

সুজানার শাড়ির আঁচল মেঝে ছুঁই ছুঁই করছে। খোঁপা আধখোলা অবস্থায়। অভিক পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করতেই সুজানা চট করে চোখ মেলে তাকালো। এদিকওদিক তাকিয়ে বলল

সকাল হয়ে গেছে?

অভিক হেসে উঠে বলল

হ্যা, দুপুর হবে হবে এমন।

সুজানা ঘড়িতে চোখ দিল হাই তুলে। বলল

কচু। ধুরর ঘুম চলে আসছে।

সে টেবিল গোছাতে ব্যস্ত। টেবিল গুছিয়ে রাখতে রাখতে মা বাইরে থেকে বললেন

সুজানা বালিশটা?

অভিক দরজা খুললো। সাজিয়া বেগম বালিশ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। অভিককে দেখে হেসে বললেন

জামাইয়ের জন্য কেনা।

অভিক বলল

পাটি?

সাজিয়া বেগম হেসে ফেললেন। বললেন

ছেলেটার সব মনে থাকে। ওটা বোধহয় লাগবে না। তবে সুজানার কাছে আছে।

ওকে, গুডনাইট শ্বাশুড়ি মা।

আচ্ছা।

সুজানা বিছানার চাদর ঠিক করে বলল

উপরে নাকি নীচে ঘুমাবেন?

বউ যেখানে, আমিও সেখানে।

সুজানা হেসে বলল

আমার বিছানা একজনের।

নীচে ঘুমাবো। নতুন পাটির বিছানায়। দারুণ হবে।

সত্যি?

তিনটা।

সুজানা রঙিন পাটি বের করলো। বিছানা ঠিক করলো। তারপর মশারি টাঙিয়ে দিল। বলল

এখানে মশা আছে।

অভিক মশারীর ভেতর ঢুকে বলল

এখানে নেট পাওয়া যাবে?

আমার ঘরে নেট পাওয়া যায় না। বারান্দায় যেতে হয়।

ধ্যাত।

এখানে ওয়াইফাই নেই, নেটও নেই। কিচ্ছু নেই।

সুজানা লাইট বন্ধ করে ফোনের লাইট জ্বালিয়ে মশারির ভেতর ঢুকে মশারি ঠিক করলো। বালিশ দুটো ঠিকঠাক বিছিয়ে দিতে দিতে অভিক একটানে কোলের কাছে এনে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজলো ঘাড়ে। বলল

বউ তো আছে।

সুজানার সুড়সুড়ি লাগায় সে হেসে উঠলো।

উষ্ণ উদরে হাতের ঠান্ডা ছোঁয়া লাগতেই বুকের সাথে পিঠে ঠেকিয়ে হাসতে হাসতে বলল

আমার সুড়সুড়ি লাগছে। ফ্ল্যাশলাইটটা বন্ধ করি। ছাড়ুন।

হালকা আলোয় আপনাকে দেখার মজাটাই আলাদা।

সুজানা হালকা ছাড়া পেয়ে সামনের দিকে ঘুরে বসলো। তখন কয়েকটা ইঞ্চির দূরত্ব বোধহয়। চোখের সাথে চোখ আর নিঃশ্বাসের সাথে নিঃশ্বাস মিশে যাবে এমন। খুব যত্নে সুজানার একটা একটা চুল পেছনে গুঁজে দিল অভিক। সুজানা চোখ নিভিয়ে আলতো স্পর্শগুলো তখন অনুভব করছিল।

হাতদুটো যখন তার মুখটা যত্ন করে আগলে নিল তখন সে চট করে চোখ মেললো। একটা আঙুল মাঝখানে রেখে বলল

আমি রেগে আছি।

তো আমি কেন আছি?

অভিকের উষ্ণ প্রলম্বিত চুম্বন ললাট স্পর্শ করাতেই আঙুলটা নেমে যেতে আর দ্বিধা করেনি। দ্বিধা করেনি পোক্ত ঠোঁটের দংশনে আর পেশনে।

সুজানা বুকে মুখ গুঁজে তাতে ঠোঁট ছুঁয়ালো।

তারপর মুখ তুলে গাল আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিতে দিতে হেসে বলল

এগুলোতে মাছ পরিষ্কার করা যাবে। এত ধারালো!

তার আঙুলে যেন বিঁধে যাচ্ছে।

অভিক নিজের গাল নিজে ছুঁয়ে সুজানা হাতটা এনে গালে ছোঁয়ালো আবার। বলল

এই নরম তালুতে এগুলো বিঁধে দেয়ার মজাটাই আলাদা।

সুজানা বলল

কচু।

অভিক তার গাল পেশল ঠোঁটের চুম্বনে রাঙিয়ে দিয়ে মজা করে বলল

মন ভালো রাখার জন্য প্রচুর প্রেম করতে হবে।

কচু কচু।

অভিক হেসে উঠলো। তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে বলল

কচু কচু রাখুন। দেখি বরের সেবা করুন।

সুজানা তার চুলে বিলি কাটলো। তার সর্বাঙ্গে তখনও শিহরণ। সে মিনমিন করে বলল,

সবাই থাকা স্বত্বেও আপনি না থাকলে আমার বাড়িতে খুব একা লাগে। আপনি থাকলে সব ভালো লাগে।

ভার্সিটির ক্লাস না থাকলে বইপত্রসহ আপনাকে নিয়ে যাব। টুনাটুনি রেঁধেবেড়ে খাব, সিলেট শহরটা ঘুরব। মজা হবে না? তারপর আপনার পড়াশোনা শেষ হবে আমারও এদিকে বছরটা ঘুরে যাবে। ততদিনে আপনার পাসপোর্টও হয়ে যাবে আর তারপর হানিমুনে যাব।

হানিমুন? অতদিন পর মানুষ হানিমুনে যায়?

অভিক তার উদরে মুখ গুঁজে বলল

আমরা যাব।

সুজানা কিছুক্ষণ কোনোরূপ শব্দ ছাড়াই বসে থাকলো। তার এরূপ অবস্থা দেখে অভিক হো হো করে হেসে উঠে সরে পড়লো বালিশে। সুজানা তার দিকে ঝুঁকে বলল

মজা করছেন আবার হাসছেন?

অভিক হাসি থামানোর চেষ্টা করলো। সুজানাকে টেনে বুকের উপর এনে দু’হাতে আগলে রাখলো। বলল

একটাই মানুষ আমার। হাসিমজা তার সাথেই তো করব।

সুজানা তার কপালে চুলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। বলল

শুনুন না, একটা কথা বলতাম।

শুনছি।

আমরা সেগুনবাগিচায় আর কবে যাব?

যাব, বছর দু-তিনেক পর। আরও একজন আসুক।

সুজানা চট করে সরে পড়লো তখনি। পিছু করে শুয়ে পড়লো। নাম না জানা অনুভূতিতে তার কেমন যেন লাগলো হঠাৎ। কেমন অসুখ অসুখ ভাব! সুখেরও অসুখ থাকে?

অভিক হেসে উঠলো তার লজ্জা পাওয়া দেখে।

শাড়ির নীচে হাত গলিয়ে উদর আঁকড়ে ধরতেই সুজানা কেঁপে কেঁপে প্রশ্ন করলো

তিন বছরে সেগুনবাগিচা আগের মতো থাকবে?

বলিষ্ঠ হাতটা তাকে একদম বক্ষদেশে মিশিয়ে নিতে নিতে বলল

হয়ত লালদিঘির নৌকার মাঝিগুলো অপরিচিত হবে, সেগুন কাঠের বসার টুলটা ভাঙা থাকবে। সমস্যা নেই। সেই ছোট্ট পুতুলটা বসতে পারলেই হলো। আমরা দুজন টুলের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবো। আর তাকে সবটা দেখিয়ে দেখিয়ে বলব

আমাদের প্রেমের স্বাক্ষী এই সেগুন বাগিচা, এই লাল দিঘীর পাড়, আর এই সেগুন কাঠের টুল।
আপনি কিন্তু সেদিনও নীল শাড়ি পড়বেন, মাথায় সাদা ফুল আর সাদা কানের দুল।

সুজানা ছোট্ট করে জবাব দিল

আচ্ছা।

সমাপ্ত……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here