আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে #পর্ব_৩৬ #লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0
75

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৩৬
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
সকাল সকাল বাড়িতে খুশির খবর এল। মমতাজ বেগমের একমাত্র কন্যা ইন্ডিয়া থেকে ফিরছেন। বাড়িতে তুমুল উত্তেজনা সবার মধ্যে। রান্নাবান্নার বেশ আয়োজন চলছে সকাল থেকে।

এদিকে বাচ্চাদের খাওয়াতে গিয়ে আনিকার নাজেহাল অবস্থা। দুজনেই খাবে না বলে ছুটছে এদিক-ওদিক। শুক্রবার হওয়ায় আজ বাড়িতে সবাই উপস্থিত।

আনিকা বাচ্চাদের পেছন ছুটতে ছুটতে খাওয়াচ্ছে। দুজনেই মহাবিরক্ত মায়ের উপর।

অনা বলল,

আন খাবু না আম্মু। আন না। আন না।

আর দুটো মা। আবিসোনা আর দুটো।

আবিদ একদম লুকিয়ে গেল। আনিকা বিরক্ত হয়ে
সোফায় বসে রইলো।

হাতের কব্জিতে পড়া ঘড়ির বেল্ট ঠিক করতে করতে অভিক নিচে এসে আনিকাকে হতাশাগ্রস্ত দেখে বলল

কি হয়েছে?

দেখ না। দু’টো বাচ্চা যদি এ কয়টা ভাত খেতে না পারে। আমাকে ক্লান্ত বানিয়ে ফেললো দৌড়াতে দৌড়াতে।

ওদের চিপস চকলেট কম দেবে। সারাক্ষণ ওসব খেতে থাকলে ভাত খাবে কি করে?

তুই ওসব আমাকে বলছিস কেন? তোর ভাইকে বল। সেই তো আদর করে বাচ্চাদের জন্য এসব নিয়ে আসে। সে কি দেখছে যে ওরা খাওয়ানোর সময় আমাকে কত জ্বালায়।

অভিকের পেছন পেছন আহনাফ নেমে এল। বলল

কি হলো?

এইতো এসেছেন মহাপুরুষ। আপনার বাচ্চাদের খাওয়ান। আমি আর পারছিনা।

অভিক বলল

প্লেটটা ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দাও।

আহনাফ হেসে বলল

কোনো সমস্যা না। আমি খাইয়ে দিতে পারি। প্লেট নিয়ে সে দু’জনকে ডাক দিতেই বাবার ডাক শুনে দুজনেই হাজির। একেবারে কোলে উঠে গলা জড়িয়ে বসলো।

আহনাফ বলল

এবার খাইয়ে দাও। আনিকা বাড়িয়ে দিতেই ওরা মুখ ফিরিয়ে নিল। আহনাফ বলল

কাল সবাই মেলায় যাব। না খেলে নিয়ে যাব না।

অভি যাবে?

হুম।

আম্মু যাবে?

সবাই যাবে।

ওহ ওহ পাপা গুড বয়।

আহনাফ গালে ঠেসে চুমু দিয়ে বলল,

এবার খান।

ওরা এবার খেতে খেতে হাজারও প্রশ্নের ঝুলি মেলে ধরলো বাবার সামনে।

আহনাফ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ফাঁকে অভিককে ডেকে বলল

তুই কোথাও বেরোচ্ছিস?

আনিকা বলল

হ্যা, ও শপে যাবে। নাহিদ আর তার বউকে আজ দাওয়াত দিল না। বউকে তো নতুন জামাকাপড় দিতে হবে। ওটা কিনবে। হ্যা রে অভি তুই শাড়ি চিনবি তো?

হুমম।

তাহলে তো ভালো। শোন আমার ফেইস ওয়াশটা শেষের দিকে। নিয়ে আসবি।

ওকে।

আবিদ বলল,

অভি চকলেট আনিবে। এত্ত বড় বড়। কেমন?

অভিক আনিকার দিকে তাকিয়ে হাসলো। আনিকা বলল

ওদের সাথে বেঁধে তোকেও পিঠাবো।

অভি তুমাকে ডিসুম ডিসুম মাববে।

সবাই হেসে উঠলো।

সালমা বেগম শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এলেন। বললেন

বেরোচ্ছিস অভি?

হ্যা। তোমার জন্য কিছু লাগবে?

না। তোর জেম্মা বলছে যে শাড়ির রঙ যাতে উজ্জ্বল রঙের হয়। নতুন বউ তো তাই।

হুম।

অনেকগুলো দেখবি। তারপর কিনবি। ঠিক আছে?

হুমম।

আনিকা বলল

উফ ছোটমা ওর উপর ছেড়ে দাও। এটা ভালো একটা প্র্যাক্টিস ওর জন্য। কিছুদিন পর বউয়ের জন্য তো কেনাকাটা করতেই হবে।

সালমা বেগম হাসলেন। অভিক বলল

আচ্ছা আসি মা।

সাবধানে যাস। ফি আমানিল্লাহ।

________________

নিউমার্কেটে এসে অভিকের সাথে কয়েকজন স্টুডেন্টদের দেখা হলো। তাদের সবাইকে চিনতে অভিকের বিন্দুমাত্র ভুল হলো না। তারা সবাই সুজানার বন্ধু। দেখামাত্র স্যার স্যার বলে ছুটে এল। অভিক বলল

পরীক্ষা তো শেষ!

হ্যা স্যার। আপনাকে এখানে দেখতে পাব ভাবিনি।

কি হচ্ছে এইখানে?

এমনি ঘুরছিলাম সবাই মিলে। আপনি কেন এসেছেন?

কিছু কেনাকাটা করব।

স্যার আমরা একটা কিছু অফার করতে পারি?

এখন না। সন্ধ্যা বেলায় স্কুল মাঠে যাওয়া হয়?

নিখিল বলল,

ক্যান্টেন্টমেন্ট?

হ্যা।

অফকোর্স। আপনি ওখানে আসবেন?

আজ যেতে পারি।

তাহলে জমবে ভালো। দুটো ছক্কা-ফোর হবে স্যার? আহিরের বল দারুণ ।

অভিক ভুরু উঁচালো আহিরের দিকে তাকিয়ে।

তাই?

ইয়েস স্যার।

দেখা যাক।

ওকে স্যার আমরা রেডি থাকব। আপনার সাথে যাই?

চলো। শাড়ি কিনবো।

কার জন্য?

বন্ধুর বউ।

নিখিল মাথার পেছনে হাত বুলিয়ে বলল

ভাবির জন্য হলুদই বেস্ট।

অভিক সরু চোখে তাকিয়ে বলল

এরেহ দেবরের সামনে ভাবির জন্য শাড়ির কথা বলছি। তাহলে তো ভালোই। চলো তোমরা চুজ করে দেবে।

জায়িন বলল

আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সুজানার কালার চয়জটা খুব ভালো।

বাকিরা মৃদু হাসলো। অভিক হেসে যেতে যেতে বলল

তাই? তাহলে তো সুজানার থাকাটা দরকার ছিল।

তারা মজা করে জানতে চাইলো।

আপনি সুজানাকে চেনেন স্যার?

চিনি। একটুখানি।

______

ইতোমধ্যে অনেকগুলো শাড়ি দেখা হয়ে গিয়েছে। অভিক মেরুন রঙের একটা শাড়ি বাছাই করেছে। সাথে গোল্ডেন রঙের পাড়। শাড়িটা বাকিরাও পছন্দ করেছে। পাশেই একটা শাড়ি পড়েছিল। কালো পাড়ের লাল শাড়ি। শাড়ির গায়ে কাজ ভারী সুন্দর।

অভিক সেটা নেড়েচেড়ে দেখে বলল

এটাও প্যাক করা যাবে?

দোকানদার ফোকলা হেসে বলল

কেন নয়?

আহির জানতে চাইলো।

স্যার দুটো নিচ্ছেন?

অভিক উত্তর দিল।

একটা বন্ধুর বউয়ের জন্য। অন্যটা তার বন্ধুর বউয়ের জন্য।

বেচারা ছাত্রগুলো এর মাথামুন্ডু না বুঝে ভ্যাবলার মতো মাথা নাড়ালো।

তারা সবাই শপ থেকে বেরোতেই একজন বোরকা পড়া মহিলা তাদের দিকে এগিয়ে গেল। মহিলার পেছনে সায়েমকে দেখা গেল। তারা সবাই সালাম দিতেই সাজিয়া বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বলল

ভালো আছ সবাই?

হ্যা আন্টি। আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

একটু ডাক্তারের কাছে এলাম। কোমর ব্যাথাটা বেড়েছে তো।

ওহ আচ্ছা। অভিকও চোখ সরু করে চেয়ে আছে। ওরা পরিচয় করিয়ে দিল।

আন্টি উনি আমাদের স্যার।

অভিক সালাম দিতেই সাজিয়া বেগম সালাম নিয়ে বললেন

ওয়ালাইকুমুস সালাম। ভালো আছেন?

অভিক নির্মল হেসে বলল

জ্বি।

সাজিয়া বেগম আরও কাউকে খুঁজে বলল

করিম নামের ছেলেটা নেই?

সবাই কপাল ভাঁজ করে একে অপরের দিকে তাকালো। বলল

কোন করিমের কথা বলছেন আন্টি?

ওই যে তোমাদের বন্ধু। ও তোমাদের সাথে থাকে না?

আমাদের ওই নামে কোনো বন্ধুই নেই আন্টি।

সায়েম বলল

আম্মা তোমার ভুল হচ্ছে। আপার ওরকম কোনো বন্ধু নেই।

সাজিয়া বেগম বলল

ওহ আমার ভুল? কিন্তু তোর আপাই তো বললো করিম নামে ওর বন্ধু আছে। আচ্ছা বাসায় গিয়ে জিজ্ঞেস করব।

আহির বলল

সায়েম আজ মাঠে আসবি। দারুণ খেলা হবে কিন্তু।

সায়েম মাথা নেড়ে হাসলো। অভিকের দিকে তাকাতেই অভিক চোখ পিটপিট করতেই সে লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে হাসলো।

ভাইবোনের এই এক অবস্থা!

সাজিয়া বেগম বলে উঠলেন।

আচ্ছা আসি। কেমন? ভালো থেকো সবাই।

নিখিল গাড়িতে তুলে দিতে গেল সাজিয়া বেগমের পিছু পিছু। উনি যেতে যেতে ফিরে তাকিয়ে দেখলেন সবার পেছনের মাস্টারমশাইয়ের ঠোঁটের হাসি। কি নির্মল! অথচ কত রহস্য লুকোনো তার হাসিতে!

________

কম সময় নয়। সুজানার পরীক্ষা শেষ হয়ে ইতোমধ্যে তিনদিন গড়িয়ে গিয়েছে।

গত তিন মাসে তার আর মাস্টারমশাইয়ের পরীক্ষার হলে দেখা হয়েছিল। কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি অবশ্য। কারণ এক দেখায় তো কতশত কথা হয়ে যায় তাদের।

অভিক ফোন করে বিরক্ত করতে চাইনি আর অন্যদিকে বাড়াবাড়িটা কম হওয়ায় সুজানার ব্যাকুল মন খানিকটা অভিমানী হয়ে উঠেছিল এই তিনমাসে।

কিন্তু হঠাৎ করে সন্ধ্যায় বেশ ভালো একটা খবর বয়ে নিয়ে এল সায়েম। এসেই বললো

আপা তোদের স্যার আছে না? আজকে মাঠে আমরা একসাথে খেলেছি। নিখিল ভাই, আহির ভাই, আর জায়িন ভাইও ছিল। আমিও খেললাম।
একসাথে আইসক্রিমও খেয়েছি। তোদের স্যার দারুণ ব্যাট চালাতে পারে।

অভিক স্যার?

হ্যা।

ওহহহ।

খানিকটা জিরোলো সুজানা। ওই নামটা শুনলেই ঝিমঝিম করে উঠে সারা শরীর। উত্তেজিত হয়ে পড়ে সে। কিছু নিজ থেকে জানতে চেয়েও চাইলো না।

সায়েম নিজেই বলল,

তুই নাকি উনার একটা ট্র্যাকস্যুট নিয়ে এসেছিস কয়েকমাস হয়েছে। ফেরত দিসনি।

ও আল্লাহ খেয়ালই ছিল না। সেলাই করাও হয়নি।

সায়েম পকেট থেকে টিস্যু প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল

এটা দিয়েছে।

এটা কি?

টিস্যু প্যাকেট।

টিস্যু? কেন দিয়েছে?

আমি কি জানি? আমাকে বললো খোলা চলবে না। সোজা আপুর হাতে।

সুজানা সেটা নিয়ে চলে গেল। পিছু ফিরে ভাইয়ের সন্দিগ্ধ চাহনি দেখে বলল

আম্মাকে কিছু বলিস না।

সায়েমের কপালের ভাঁজ আরও গভীর হলো। কিছুটা সে ধারণা করতে পারে।

সুজানা ঘরে গিয়ে ট্র্যাকস্যুটটা খুঁজে নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে টিস্যু প্যাকেটটা খুললো। এক এক করে টিস্যুর ভাঁজ মেলতেই মধ্যিখান থেকে একটা কাগজ বের হয়ে এল যাতে এবড়োখেবড়ো ভাবে লেখা।

সু —- জা —- না!
লালদীঘির পাড়ে সেগুন কাঠের ঝড়া পাতা বিছানো টুলটাতে অনেকদিন কেউ বসে না। আপনি আমি বসতে পারি।

যদি নীল শাড়ি পড়ে আসেন লাল শাড়ি ফ্রি!

সাদা ফুল গুঁজে এলে একটা ফুলের বাগানের মালিকানা ফ্রি!

বুদ্ধিমতীরা এমন অফার সহজেই অগ্রাহ্য করেনা। আপনি আসবেন আমার জানা আছে।

সুজানা কাগজটা মুঠো করে মুখ লুকোলো ট্র্যাকস্যুটের মাঝে। খানিকটা পরেই মায়ের প্রশ্ন ভেসে এল।

করিমের নাম্বার ‘এ’ দিয়ে সেভ করেছিস কেন?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here